ইংরেজি শিক্ষা হারাম’ ফতওয়া:

ইসলামের জন্মভূমি আরব। ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা আরবি। কিন্তু ইসলাম যখন আরবের বাইরে বহির্বিশ্বে তার বিস্তারযাত্রা আরম্ভ করে, সেখানকার স্থানীয় ভাষাসমূহের সাথে তার পরিচয় ঘটে। মুসলিমরা সে-সকল ভাষা আয়ত্ত ও আত্মস্থ করে নেয়। পারস্যদেশ বিজয়ের পর মুসলমানদের ভেতর ফার্সি ভাষা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এতটাই জনপ্রিয় যে, তা মুসলমানদের ঐতিহ্যের ভাষায় পরিণত হয়। ভারতবর্ষে আগমনের সময় মুসলিমরা একই সাথে নিয়ে আসে আরবি ধর্মীয় ভাষারূপে এবং ফারসি ঐতিহ্যের ভাষারূপে। এ ভাষায় মুসলিম কবিসাহিত্যিকগণ রচনা করেন একের পর এক মূল্যবান বই-পুস্তক এবং কাব্য-মহাকাব্য। তাদের রচিত গ্রন্থসমূহ হয়ে ওঠে জ্ঞানানুরাগী মুসলমানদের নিত্যপাঠ্য । এবং করা হয় সিলেবাসভুক্ত।

যদি দেখা হয় ফারসি ভাষার প্রকৃতি কী ও কেমন ছিল, তবে জানা যাবে তৎকালে এরচেয়ে নিকৃষ্ট ভাষা আরেকটি হয় না; যে ভাষার ভাণ্ডারে মুশরিক ও অগ্নিপুজকদের শিরকি ও আল্লাহ বিস্মৃতির অজস্র উপাদান মজুদ রয়েছে, রয়েছে ভোগবাদী জীবনচর্চা ও বিলাসিতার রমরমা উপকরণ। কিন্তু তবুও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুসলমানগণ সেই ভাষাটিকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিল । এর মাধ্যমে তারা উলুম ও মা’আরিফ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল !

কোনো বিজাতীয় এবং ইসলামি চেতনাবিরুদ্ধ বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের আচরণের এ এক ঐতিহাসিক উদাহরণ। এজাতীয় ব্যবহারিক উদাহরণ এবং ইসলামি বিশ্বাসবোধের আলোকে অতএব এ কথা বলা যায় যে, কোনো ভাষা-বিশেষের ব্যাপারে মুসলমানদের বৈরী মনোভাব মূলত নেই। ভাষা সম্পর্কে এহেন বৈরী মনোভাব পোষণ করার বা কোনো ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার অভিযোগ নিতান্তই অমূলক এবং আরোপিত, যা সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায়।

ইসলামের বিরুদ্ধে ইংরেজ তথা খ্রিস্টান পাশ্চাত্যের সংঘাতের রয়েছে এক সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক সিলসিলা। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের ক্রুসেডীয় উগ্রতা ও উন্মাদনা কখনও থেমে থাকে নি । ভারতবর্ষে আগমনের পরেও তারা তাদের সেই পুরনো খাসলত সমেত আত্মপ্রকাশ করেছে। মিশনারি তৎপরতার মধ্য দিয়ে ইসলাম ও পয়গম্বরে ইসলাম সম্পর্কে বিষেদগার ও অপপ্রচার শুরু করে। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মুসলমানদের থেকে শাসনকর্তৃত্ব কেড়ে নিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং জাগতিক ও বৈষয়িক দিক থেকে মুসলমানদের পুরোপুরি পঙ্গু করে দেওয়ার সর্ববিধ কুশেশ করে তারা। শিক্ষা, চাকরি, বৈষয়িক সম্পত্তি সবকিছু থেকে করে, বঞ্চিত ও বিতাড়িত । এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের ইংরেজ বিরোধিতা বা ইংরেজদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা কত প্রবল হবে এবং হওয়াটা যে নিতান্তই স্বাভাবিক, তা বলাই বাহুল্য !

স্যার সৈয়দ আহমদ লিখেছেন, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের অন্যতম একটি কারণ হলো, তারা আমাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ শুরু করেছিল এবং আমাদের তাহজিব-তমদ্দুন, সভ্যতা-শিক্ষা-সংস্কৃতি ধ্বংস করার পায়তারা করেছিল। ব্রিটিশ সরকার তার কর্মী ও প্রচারকদের মাধ্যমে খুব ধীরে ধীরে, সন্তর্পণে এবং অত্যন্ত চতুরতার সাথে সবকিছু চালিয়ে নিচ্ছিল। কারও ধর্ম পরিবর্তন করার বিষয়ে সরকার জবরদস্তি না করার আহ্বান জানিয়েছিল, তবে গোপনে গোপনে আরবি ও সংস্কৃত ভাষাকে নির্মূল করার পরিকল্পনা জারি রেখেছিল, যাতে ভারতীয়রা তাদের ধর্মীয় ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে পড়ে। বহুরকম লোভ ও প্রলোভন দেখিয়ে ইংরেজ সরকার লোকদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে রাজি করাতো।[১]

মুসলমানী শাসন আমলে হিন্দুজাতি অশেষ আগ্রহ নিয়ে সেকালীন রাজভাষা ফারসীর চর্চা করেছে এবং অম্লানবদনে মুসলমানের অধীনে চাকুরী করে অন্ন সংস্থান করেছে । এইরূপ আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে হিন্দুরা নয়া মনিব ইংরেজদের ভাষা শিখেছে ও তার অধীনে চাকুরী গ্রহণ করেছে। মুসলিম শাসনের পতন হিন্দুর পক্ষে ছিল প্রভু বদলমাত্র, মুসলমানের বদলে ইংরেজ। বরং জীবনােপায়ের নতুন নতুন ক্ষেত্র খুলে যাওয়ায় এবং সেসবের একচ্ছত্র ভােগাধিকার পাওয়ায় হিন্দুর ইংরেজ-প্রীতি শতগুণে বেড়ে গেছে। আর ইংরেজও হিন্দুকে নিকটে টেনেছে সাম্রাজ্যিক কাঠামাের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বশংবদ শ্রেণী সৃষ্টির গরজে।[২]

মুসলিম শাসনের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি মুসলমানদের পক্ষে কেবলই বিপর্যয় ডেকে আনে। পক্ষান্তরে হিন্দুদের জন্য তা হয়ে ওঠে অনুকূল। একদিকে হিন্দুরা ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, চাকরি-বাকরি সবকিছু লাভ করতে লাগল। অন্যদিকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের উদ্ধারকল্পে ইংরেজরাও হিন্দুদের জন্য খুলে দিলো সুযোগ-সুবিধার সকল দ্বার। কিন্তু, মুসলমানদের জন্য রুদ্ধ করে দেওয়া হয় সব । রাজনৈতিক শক্তি হারানোর মধ্য দিয়ে সরকারি চাকরি, সম্পত্তি সব হাতছাড়া হয়ে মুসলমানদের দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। উপরন্তু খ্রিস্টান মিশনারীকর্তৃক স্থাপিত স্কুল-কলেজে পরিকল্পিতভাবে এমন শিক্ষা-পদ্ধতি ও সিলেবাস চালু করা হল, যেগুলি মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষা ও জাতীয় চেতনার সরাসরি বিরুদ্ধে যায়। ফলতঃ মুসলিম শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রেও তৈরি হয় প্রতিবন্ধকতা ।

ইংরেজ প্রবর্তিত এই মিশনারি স্কুলগুলি সম্পর্কে স্যার সৈয়দ আহমদ লিখেছেন: “মুসলমানদের এসব কলেজে পড়াশোনা করে উন্নতি করা, জাতীয় পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া এমনকি অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা আদৌ সম্ভব নয়। অতএব, এই সকল বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কেউ আশা করতে পারে না যে, আমাদের জাতি এর মধ্য দিয়ে একটি সত্যিকার জাতি হয়ে উঠবে।” [৩]

বস্তুত, মুসলিম জাতিকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখতে খৃষ্টান মিশনারী, ইংরেজ শাসক এবং এদেশীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের যুথবদ্ধ পরিকল্পনা জারি ছিল৷ তারা এমনসব শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করল, যার ব্যয়ভার বহন করা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মুসলমানদের সাধ্যের বাইরে ছিল। তাছাড়া এমন স্কুল ও কলেজও ইংরেজ সরকার বা ইংরেজ অর্থায়নে হিন্দুরা প্রতিষ্ঠিত করেছিল, যা কেবল হিন্দুদের জন্য বরাদ্দ ছিল ।

খৃস্টান মিশনারী সােসাইটির (C.M.S.) কোলকাতা শাখার উদ্যোগে বর্ধমানে ১৮১৯ সালে হিন্দুদের জন্যে একটি ইংরেজী স্কুল স্থাপিত হয়। কোলকাতা শাখার প্রতিনিধি Mr. Shrew এবং Mr. Thompson নিয়মিত স্কুলটি পরিদর্শন করতে থাকেন। অবশেষে যখন ১৮২২ সালে স্কুলটিকে একটি গীর্জা প্রাঙ্গণে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন ছাত্রদেরকে খৃষ্টীয় ধর্মে দীক্ষিত করা হবে এ আশঙ্কায় স্কুলটি নষ্ট হয়ে যায়। অনুরূপভাবে ১৮৩২ সালে বিশপ কোরী (Corrie) কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কলংগিতে একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু যখন তার পাশে একটি গির্জা নির্মাণ করা হলো, তখন অধিক সংখ্যক মুসলিম ছাত্র স্কুল পরিত্যাগ করে। মিঃ টমসন তার রিপোর্টে মুসলিম ছাত্রসংখ্যা হ্রাসের কারণ বর্ণনা করে বলেন যে, “হিন্দুরা পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যেমন অনুরাগী, মুসলমানরা তেমন নয়।[৪]

মিঃ টমসন প্রকৃত কারণটি গােপন রেখে কৌশলে মুসলমানদের উপরেই দোষ চাপিয়েছেন। প্রকৃত কারণ এই যে, পাশ্চাত্যের ভাষা ও সাহিত্যের সাথে খ্রিস্টান ধর্মের প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ ওতপ্রােতভাবে জড়িত। এসব মিশনারী স্কুলে যেতে নিজেকে মানসিক দিক দিয়ে প্রস্তুত করা মুসলমানদের জন্যে যতােটা কষ্টকর ছিল, হিন্দুদের ততােটা ছিল না। খৃষ্টধর্মের প্রতি মুসলমানরা যেমন বীতশ্রদ্ধ ছিল তেমনি মিশনারির কার্যক্রমের প্রতি ছিল একধরনের ঘৃণা। কারণ মুসলমানগণ খৃষ্টধর্মকে নাকচ করে তাদের ধর্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছে। পক্ষান্তরে এ বাস্তবতা হিন্দুদের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। ধর্মের দায় থেকে তাদের এমন কোন সংকট ছিল না, সে জন্যে তারা সহজেই খৃষ্টধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হতো।

ভারতে ইংরেজি শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় মূলত মিশনারিদের মাধ্যমে, ইউরোপীয় বণিকদের আর্থিক সহযোগিতায়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন মিস্টার ডেভিড হেয়ার এবং স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট। তাদের সহায়তায় হিন্দু যুবকদের শিক্ষার জন্য ১৮১৭ সালে কোলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮১৬ সালের ২৭ আগষ্ট স্যার এডওয়ার্ডের বাসভবনে হিন্দুদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক সাধারণ সভায় এ প্রস্তাবিত কলেজের গঠনতন্ত্র ও নিয়মনীতি প্রণীত হয়। এতে বলা হয়, ‘হিন্দু সন্তানদেরকে ইংরেজী ও ভারতীয় ভাষা এবং ইউরোপ-এশিয়ার সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়াই প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।’ [৫]

এই হিন্দু কলেজটি ১৮২৩ সালে একটি সরকারি কলেজে পরিণত হয়। এভাবে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে। হিন্দুদের উচ্চশিক্ষার জন্য হিন্দু কলেজ ছাড়াও বহু ইংরেজি স্কুল, হিন্দু, ইংরেজ, মিশনারী এবং কোলকাতা স্কুল সোসাইটির দ্বারা স্থাপিত হয় কিন্তু কোথাও মুসলমানদের প্রবেশ করার কোন উপায় ছিল না। অ্যাডাম সাহেবের বর্ণনামতে, কোলকাতা আপার সার্কুলার রোড এবং বড় বাজারে জনৈক খ্রিস্টান এবং জনৈক হিন্দু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দুটি স্কুল ছিল। তারা স্কুলে শিক্ষকতাও করতেন। আরেকটি শোভাবাজারে। এখানে তিনশত ছাত্র অধ্যায়নরত ছিল। এই স্কুলটিও একজন খ্রিস্টান ও একজন হিন্দু পরিচালনা করতেন। এসব স্কুল যেহেতু বেসরকারি ছিল, সেজন্য ছাত্রদের নিকট থেকে মোটা বেতন আদায় করা হতো। সেখানেও মুসলমানদের প্রবেশাধিকার ছিল কিনা জানা যায় না, তবে থাকলেও তারা অর্থাভাবে তাদের সন্তানকে সেখানে পাঠাতে পারতেন বলে মনে হয় না, সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।

মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কারই তাকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারা গ্রহণ থেকে দূরে রেখেছিল এবং এজন্যই তার আর্থিক অন্য সকলপ্রকার দুর্গতি ও তার ফলে সে জীবনের সব ক্ষেত্রে হিন্দুর বহু পিছনে পড়ে গিয়েছিল– মূলত এমন ধারণা ও বক্তব্য ঐতিহাসিক সত্যরূপে বিবেচনা করা যায় না। এধরণের প্রচলিত দাবি ও অভিমতকে ‘অভ্রান্ত ও যুক্তিনির্ভর নয়’ বলে বাতিল করে দিয়েছেন আব্দুল মওদুদ। তিনি তাঁর “মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, সংস্কৃতির রূপান্তর” গ্রন্থে লিখেছেন : এমন ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই মুসলমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিভাগ পূর্বযুগের ভূমিকাকে বিকৃত রূপ দেওয়া হয়েছে। আমাদের সুচিন্তিত অভিমত, মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ সংগঠন বিলম্বিত হওয়ার কারণ প্রধানত দুটি– রাজনৈতিক ও আর্থিক। নেহাৎ সুবিধার জন্য এ কারণ দু’টিকে আচ্ছন্ন রেখে প্রচার করা হয়েছিল–ইংরেজির প্রতি ঘৃণা এবং ইংরেজী ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি অনীহা এ মুসলমানদের পশ্চাত্পদ হওয়ার কারণ হয়েছিল !’

প্রসঙ্গত আব্দুল মওদুদ আরেকটি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি হিন্দু ও মুসলিমদের ইতিহাস, ধর্মাচার ও সংস্কার-বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করে দেখান যে, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্য জাতি থেকে ‘আত্মরক্ষা’র মতো জাতীয় খাসলত মুসলমান নয়, হিন্দুদের মধ্যেই অধিক প্রকট এবং অতিমাত্রায় প্রচলিত। তিনি লিখেছেন: হিন্দুর ধর্মীয় গোঁড়ামি মুসলমানের চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশী। হিন্দুর ‘ছুঁৎমার্গ’ বিশ্ববিদিত। ইংরেজের সঙ্গে মেলামেশার দরুন রামমােহন ও ঠাকুর পরিবারকে সমাজচ্যুত হয়ে ভিন্ন সমাজ স্থাপন করতে হয়েছে। হিন্দুর সাগরপার নিষিদ্ধ এবং তার জন্যেও জাতিপাত হয়। এরূপ শত সহস্র কুসংস্কারের বেড়ায় ও প্রথাদাসত্বের নিগড়ে হিন্দুর জীবন আবদ্ধ। ‘সনাতন নিষ্ঠাবান হিন্দুদের মধ্যে জাত খােয়ানাের ভয়ে অনেককে এক অদ্ভুত রীতি অনুসরণ ও সামঞ্জস্য বিধান করতে দেখা যায় । তারা ম্লেচ্ছ ইংরেজদের অধীন বিষয়কৰ্ম করে অপরাহ্নে অফিস হতে বাড়ী ফিরে স্বদেশীয়দের মধ্যে ব্রাহ্মণের গৌরব ও আধিপত্য সংরক্ষণের জন্যে স্নানাহ্নিক করতেন এবং এভাবে গ্লানি ও পাপমুক্ত হয়ে “দিবসের অষ্টম ভাগে” আহার করতেন। (হিস্টোরি অব দ্য কংগ্রেস, pattabhi sitarmayya. পৃষ্ঠা ১৬)। রামমােহন রায়ের মধ্যেও এই অন্তর্দ্বন্দ্ব ও তার সমাধান প্রচেষ্টার করুণ অভিব্যক্তি দেখা যায়। তার এই নিয়ম ছিল যে, তিনি প্রাতে দেশীয় প্রথা অনুসারে আসন বা পিড়িতে বসে মাছ ভাত খেতেন ; রাত্রে বন্ধুগণ সমভিব্যাহারে টেবিলে বসে ইংরেজী রীতিতে খানা খেতেন।

মুসলমানের নিশ্চয়ই এই ছুঁৎমার্গ ছিল না, এবং এ অন্তর্দ্বন্দ্বে সে কখনও পীড়িত হয়নি। তার অতীত ইতিহাস তাকে শিক্ষা দেয়, মুসলমানরা ইউরােপীয় বিভিন্ন জাতির সংস্পর্শে বহুবার এসেছে, বহুধর্মের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়েছে; গ্রীক ল্যাটিন ভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করে সেসবের শিক্ষাকে আত্মস্থ করেছে, এমন কি সংস্কৃত ভাষাও; কিন্তু কখনও জাতিনাশ বা ধর্মনাশের ভয় তাদের পীড়িত করেনি, কিংবা এরূপ কোনও অন্তর্দ্বন্দ্বও তাদের আহত করেনি। মুসলমান রাজ্য মিসর কম গোঁড়া নয় এবং তাদের ইসলাম-প্রীতিও প্রগাঢ়; তবু সেখানে আর্থিক ও রাজনীতিক পরিবেশ অনুকূল থাকার দরুন বহুপূর্বে বলিষ্ঠ মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছিল। ধর্ম তাদের পথের বাধা হয়নি। তবুও কি এমন কারণ ঘটেছিল, যার দরুন ভারতীয় মুসলমান পশ্চাতে থাকতে বাধ্য হয়েছিল?

এর জবাবে আব্দুল মওদুদ বলেন, এর প্রথম কারণ রাজনৈতিক । অতঃপর তিনি লিখেন: মুসলমানদের হাত থেকে বাংলার মসনদ ও পরে দিল্লীর রাজসিংহাসন বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে ইংরেজরা মুসলমানদের দারুণ সন্দেহ করেছে। এবং কঠোরভাবে উৎপীড়ন করেছে। আর কোন নীতিতে চালিত হয়ে মুসলমানদের সর্বপ্রকার শাসনকার্য থেকে বহুদূরে রেখেছে, তা পূর্বেই বিশদ হয়েছে। হান্টার সাহেব নিজেই বলেছেন, ‘আমরা মুসলমান সাম্রাজ্যের অনুগ্রহপ্রার্থী গােলামের মতাে বাংলাদেশে পদার্পণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের বিজয়কালে আমরা তাদের প্রতি কোন করুণাও দেখাইনি, এবং ভুইফোড়ের ঔদ্ধত্য নিয়ে আমাদের পূর্বতন মনিবদের পঙ্কে নিমজ্জিত কর দিয়েছি। এক কথায়, ভারতীয় মুসলমানরা অনুযােগ করে ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতির অভাবের জন্যে, মহত্ত্বের অভাববােধের জন্যে।’

মুসলমানের প্রতি ইংরেজের এই সহানুভূতি ও মহানুভবতার অভাব জন্মগত, মজ্জাগত ও ঐতিহাসিক। ইসলাম ও মুসলমানের সংগে ইউরােপের পরিচয় ও সংগ্রাম-সংঘাত আট শতকেরও পূর্ব থেকে, যার দরুন ক্রুসেডের সময় মধ্যযুগের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট অধ্যায় অধিকার করে আছে। এজন্যে এ বিদ্বেষ ছিল ট্রাডিশনগত। মনে রাখা ভালাে, ইউরােপ হিন্দুত্ব ও হিন্দুর সমাজের সংস্পর্শে প্রথম আসে ১৪৯৮ সালে ভাস্কো-ডা-গামা কালিকটে অবতরণ করার পর থেকে এবং তার দরুন হিন্দুর বিরুদ্ধে কোনও পূর্ব বিদ্বেষের কারণও ছিল না। বস্তুত নতুন প্রভুরা নিজেদের নিরাপত্তার রক্ষাহেতু রাষ্ট্রীয় নীতির দরুন যখন মুসলমানদের প্রাণ নিয়েই টানাটানি করছে, তখন জীবন বিকাশের সুযোগ-সুবিধা সন্ধানের অবকাশ কোথায়? রাজনীতিক কারণে ইংরেজরাই মুসলমানদের শাসন ব্যবস্থা থেকে, কুঠি-হৌস থেকে বিতাড়িত করেছে, এতােটুকু আশ্রয় দেয়নি। অতএব ইংরেজদের সঙ্গে সহযােগিতা করার প্রশ্নই ওঠেনি, প্রথম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত।[৬]

দ্বিতীয় অর্থনৈতিক কারণ বিশ্লেষণ করে আব্দুল মওদুদ লিখেছেন: ইংরেজদের আর্থিক ব্যবস্থা মুসলমানের প্রতিকূলে ছিল এবং তা ছিল প্রধানত রাজনীতিক কারণে। আত্মরক্ষার যে নীতির গরজে ইংরেজ মুসলমানকে রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা থেকে দূরে রেখেছে, সে-গরজেই তাকে আর্থিক আয়ের সব উৎস থেকেই বঞ্চিত করে রেখেছে গােটা প্রথম শতাব্দী ধরে। ইংরেজের সরকারী অফিসে, ইংরেজের কুঠিতে, হৌসে, ফার্মে মুসলমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ, অতএব জীবনােপায়ের এ বৃহত্তম দ্বার মুসলমানের পক্ষে একেবারে রুদ্ধ। শিক্ষার পথ সংকোচ করার দরুন স্বাধীন বৃত্তি অবলম্বনও অসম্ভব। ব্যবসা-বাণিজ্যে মুসলমানকে কোনও সুযােগ দেওয়া হয়নি। মুসলমানের শিল্প ধ্বংস করেই ইংরেজের বিলেতী শিল্পের প্রসার বৃদ্ধি হয়েছে, মুসলমান কারিগর ও শিল্পকর্মীরা অনন্যোপায় হয়ে কৃষিকাজে নেমেছে; যে হাতে বিশ্ববিখ্যাত মসলিন তৈরী হতাে, সে হাতে লাঙলের মুঠো ধরেছে। অতএব শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রেও মুসলমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।[৭]

ইতিহাসের এ সকল তথ্য এবং সাক্ষ্য-প্রমাণকে বিবেচনায় নিলে, মুসলমানরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিছক ধর্মীয় সংস্কারের জায়গা থেকে ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্যের আধুনিক জ্ঞানচর্চা করা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছিল মর্মে একতরফাভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বহুল প্রচলিত যে অভিযোগ, তা খোদ নিজেই অভিযুক্ত হওয়ার অবকাশ তৈরি হয়। এর বিপরীতে বরং ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে সুকৌশলে মুসলমানদেরকে সর্বপ্রকার সুবিধা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে–সেটাই হয়ে ওঠে প্রচলিত ইতিহাসের প্রতি-বাস্তব !

ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন মুলধারার শীর্ষস্থানীয় আলিমদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে কী ধরনের অবস্থান ছিল এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁরা কেমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন, তারও একটু খতিয়ান দেখা দরকার। তারা আসলেই কি এমন কিছু বলেছিলেন, কিংবা কোনপ্রকার বাচবিচারহীন ছাড়াই কি ইংরেজি শিখার বিরুদ্ধে হারাম ফতওয়া দিয়েছিলেন? একচেটিয়াভাবে বলে দিয়েছিলেন কি, এটা কাফিরদের ভাষা, মুসলমানদের পক্ষে এটা শিখা, পড়া জায়েজ হবে না?

দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. (১২৯৭ হি. ১৮৭৯ ঈ.) শেষ জীবনে ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, আমি যদি ইংরেজি জানতাম, তাহলে ইউরােপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘােষণা দিতাম যে, তােমরা যাকে জ্ঞান মনে কর, তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং প্রকৃত জ্ঞান হল যা নবীদের (আ.) বক্ষ থেকে বেরিয়ে আলােকিত অন্তরে এসে অবস্থান নিয়েছে। –আর-রশীদ, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪। বলাবাহুল্য, বিরোধিতা নয় বরং নানুতবির অন্তিম সময়ের এই অভিব্যক্তিতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার গুরুত্বই উচ্চকিত হয়েছে।

রশীদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. তদীয় ফাতওয়াগ্রন্থে জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, ইংরেজী ভাষা শেখা জায়েয। –ফাতাওয়া রশীদিয়াহ, পৃ. ৫৭৪। একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন মাওলানা কাসিম নানুতবী রহ.-এর সমসাময়িক বিখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুল হাই লখনভী রহ.। তিনি তাঁর ফাতওয়ায় লিখেন, ‘ইংরেজি পড়া ও ইংরেজি শেখা জায়েয, যদি এতে দ্বীনদারির ক্ষতি না হয়।’ –ফতওয়ায়ে মাওলানা আল হাই লখনভী, ২/২৩৩।

১৯২০ সালে মাল্টার বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ. আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাওয়াতে আলীগড় আমন্ত্রিত হন। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘উলামায়ে কেরাম কখনো ইংরেজী ভাষায় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে নিষেধ করেননি।’ –আর রশীদ, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ৬৬০ ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/ ১৫৬-১৫৭।

মাওলানা আশরাফ আলি থানভি রহ. ইংরেজি পড়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “তাহকীকে তা’লীমে আংরেজী পুস্তিকা”য় বিস্তারিতভাবে লিখেছি। সারকথা এই যে, অন্যান্য ভাষার মতাে ইংরেজিও একটি মােবাহ (বৈধ) ভাষা, কিন্তু আনুসঙ্গিক বিভিন্ন কারণে তা দোষযুক্ত হয়। যদি কেউ সেইসব অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত থাকে অর্থাৎ তার আকীদা-বিশ্বাস বিনষ্ট হয়, যার সহজ বরং একমাত্র পথ হচ্ছে, ইলমে দ্বীন হাসিল করে চিন্তা- চেতনায় তা বদ্ধমূল রাখা এবং আমল-আখলাকও নষ্ট না হয় এবং সংকল্পও এই থাকে যে, এর দ্বারা জীবিকা উপার্জনের শুধু এমন পথ অবলম্বন করব, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয। অতঃপর কার্যক্ষেত্রেও এ নীতির উপর অটল থাকে, তাে এমন ব্যক্তির পক্ষে ইংরেজি শেখা জায়েয ও মােবাহ। আর যদি নিয়ত এই থাকে যে, একে দীনের খেদমতের জন্য ব্যবহার করবে, তবে তা ‘ইবাদত বলে গণ্য হবে।[৮]

শীর্ষস্থানীয় এবং মুলধারার আলেমগণ কর্তৃক প্রদত্ত এসমস্ত ফতওয়ার উদ্ধৃতি আমাদের সামনে যে সাধারণ সত্য হাজির করছে, তা ইতিহাসের প্রচলিত প্রচারণার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে অবস্থান করে। সত্য হচ্ছে, প্রকৃত ইতিহাসও তাই। ইংরেজি শিক্ষা থেকে মুসলিম সন্তানদের দূরে রাখা বা বিরত থাকার মূল কারণ কোনভাবেই ধর্মীয় সংস্কার বা উলামায়ে কেরামের ফতওয়া ছিল না। সমসাময়িক মান্যগণ্য আলেমদের কেউই ইংরেজি ভাষাশিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞানার্জনের সরাসরি বিরোধিতা বা হারামের ফতওয়া দেননি, বরং পরিকল্পিতভাবে চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থা আর সংকটাপন্ন পরিস্থিতিই মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে মূল বাঁধা এবং বিপত্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল।

আমরা জানি, মুসলমানদের সাথে ইংরেজদের ঐতিহাসিকভাবে একটা শত্রুভাব সক্রিয় ছিল সবসময়৷ ১৮৫৭ -এর সিপাহি বিপ্লবের ব্যর্থতা মুসলমানদেরকে ব্রিটিশ কোপানলে নিক্ষেপ করে পুরোপুরি। কারণ, এ বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের উলামাগণ, বিধায় মুসলমানদেরকে প্রতিপন্ন করা হয় ইংরেজ শাসনের একক প্রতিপক্ষ শত্রুরূপে। এরই ফলশ্রুতিতে তাদেরকে সবদিক থেকে দমিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চলে। যতদিন এই মুসলমানদেরকে অবদমিত করা যাবে না, ততদিন ইংরেজ শাসন নিরাপদ নয়–এ বিশ্বাস ইংরেজ শাসকদের অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে বসে যায়। কাজেই মুসলমানদেরকে নানারকম কায়দা করে যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেয়। তাদের উপর শিক্ষাহীনতা ও মূর্খতার অভিশাপকে চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে করে দেয় বিকলাঙ্গ ও কর্ম-অক্ষম। কিন্তু, মুসলমানদেরকে যে পরিকল্পিতভাবে পঙ্গু করে দেয়া হল এবং ইংরেজদের স্বার্থ হাসিলের মতলবে তাদেরকে যে মূর্খ করে রাখা হল–এর দায়ভার যাতে ইংরেজদের উপর না আসে, কোনরকম অভিযোগ যাতে তাদের বিরুদ্ধে কেউ উত্থাপন করতে না পারে, সেজন্য তারা রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করে অপপ্রচারের হাতিয়ার। প্রচার করতে থাকল– আমরা নই, মুসলমানরা খোদ নিজেরাই নিজেদের ধর্মীয় গোঁড়ামিবশত, হারামের ফতওয়া দিয়ে ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞান থেকে দূরে ছিল। আর এভাবেই তারা নিজেদের কৃত অপরাধের পুরো দায়ভার চাপিয়ে দিলো মুসলমানদের কাঁধে ।

চতুর ইংরেজরা অপপ্রচারের অংশ হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ‘ফতওয়া কথা’টাকে ব্যবহার করল। বলল, মুসলিম উলামাদের ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষার বিরুদ্ধে হারামের ফতওয়ার কারণে সাধারণ মুসলমানরা শিক্ষা থেকে মাহরুম হলো! তারাই মুসলমানদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখলো! এর মধ্য দিয়ে তারা যে ফায়দাটা লুটতে পেরেছে তা বড়ই বেদনাদায়ক। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মুসলমান এবং ইসলামের ধারক-প্রচারক আলেমসমাজের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক দ্বিধা-বিভক্তি তৈরি করে দিতে সক্ষম হল তারা। সাধারণ মানুষ ইংরেজ-প্রচারিত তথাকথিত ‘হারাম ফতওয়া’র প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে ভেবেছে যে, আলেম-মোল্লাদের সাথে থাকলে, তাদের কথা শুনলে জগতে মূর্খ হয়ে থাকতে হবে। তাদের দ্বারা আর যাই হোক দুনিয়াদারি চলবে না। বলাবাহুল্য, এমন বিপজ্জনক মনোভাব আজও সক্রিয় রয়েছে অসংখ্য মুসলমানের মনে।

মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় আলিমদেরকে শুধু ভুল বুঝলো, ঘটনা এতদূর পর্যন্ত নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী ইসলামবিরোধী বৃটিশদেরকে তারা ভাবতে শুরু করল নিজেদের উন্নতি-অগ্রগতির অভিভাবক। এর পরিণতি মুসলিম জাতির পক্ষে হয়েছে আত্মঘাতী! কে না জানে, একটি জাতি যখন তার প্রকৃত কল্যাণকামী এবং অভিভাবক শ্রেণীকে নিজের ‘পর’ জ্ঞান করে, প্রতিপক্ষ মনে করে, আর স্বার্থপর, শত্রুজাতিকে ‘আপন’ এবং কল্যাণকামী বলে ধরে নেয়, তার ধ্বংস ও বিপর্যয় তখন হয়ে ওঠে অনিবার্য।

উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজকর্তৃক পরিকল্পিত প্রোপাগাণ্ডা ও মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধর্ম ও ধর্মীয় উলামাবিরোধী সেই মনোভাব ও আচরণ আমাদের সমাজে এখনও নানাভাবে প্রকাশ পায়। বিশেষত সেকুলার ও প্রগতিশীল মহলে এর আপত্তিকর উপস্থিতি প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায় । অথচ, এরকম দূর্ব্যবহার আর অবজ্ঞার হকদার উলামায়ে কেরাম আদৌ ছিলেন না । যেখানে এই আলেমসমাজ সবসময় ইসলামের সুরক্ষা আর মুসলমানদের বৃহত্তর স্বার্থচিন্তায় জীবন ও জগতের যাবতীয় আয়েশ-বিলাস বিসর্জন দিয়েছেন এবং দিয়ে চলছেন, সেখানে চেনাজানা শত্রুদের মিথ্যা প্রচারণার জের ধরে উলামাদের অবিশ্বাস করা, উপেক্ষা করা এবং তাঁদের অবদানকে অস্বীকার করা–মোটেও তাঁদের প্রতি সুবিচার নয়।

উলামারা কখনও মুসলিম জনসাধারণের কল্যাণ বৈ কিছু চিন্তা করেন নি। তারা নবির ওয়ারিস হয়ে উম্মতের সাথে কোনপ্রকার খেয়ানত করবেন–এটা আদৌ হতে পারে না। তাঁরা ইংরেজবিরোধী ছিলেন তা ঠিক, কিন্তু তাই বলে কখনও ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করা থেকে স্রেফ ইংরেজ বিরোধিতার কারণে মুসলমানদের দূরে থাকার কথা বলেন নি। স্থান কাল পাত্র বিচারে মত-অমত করেছেন হয়তো, কিন্তু নির্বিচারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত তাঁরা সমাজের কাঁধে চাপিয়ে দেন নি; যা মুসলিমজাতির জন্য সামষ্টিকভাবে অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এটাই স্বাভাবিক এবং ইতিহাসের প্রামাণিক সত্য, এ স্বভাব-সত্যকে আমরা যত দ্রুত নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারবো, আমাদের জন্য ততই মঙ্গল ।


তথ্যসূত্র :

১. স্যার সৈয়দ আহমদ, খুতবাতে স্যার সৈয়দ, প্রকাশকাল, ১৯৭৩ খৃষ্টাব্দ।
২. আব্দুল মওদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ: সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃষ্ঠা, ১৭৮, ইফাবা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১৫।
৩. খুতবাতে স্যার সৈয়দ, প্রাগুক্ত,
৪. আব্বাস আলী খান, বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস, পৃষ্ঠা, ১৫৭, পঞ্চম প্রকাশ ২০০৬, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা।
৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা, ১৬০।
৬. আব্দুল মওদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃষ্ঠা, ১৭৭।
৭. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা, ১৭৮,
৮. মাওলানা আব্দুল মাজিদ, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা : একটি প্রচারণা ও বাস্তবতা, মাসিক আল কাউসার, সংখ্যা ২, ফেব্রুয়ারি, ২০১০।

লেখক পরিচিতি:
কাজী একরাম
শিক্ষার্থী : মা’হাদুল ফিকরি ওয়াদদিরাসাতিল ইসলামিয়্যা, ঢাকা।
উচ্চতর ধর্মতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *