Political Philosophy of Allama Iqbal
আল্লামা মুহম্মদ ইকবালের কোন পরিচয়টি বড়, জানি না। ইকবাল অবশ্যই বড় কবি ছিলেন। তিনি দুই ভাষার কবি ছিলেন- উর্দু ও ফারসি। তিনি একই সাথে দার্শনিক ছিলেন। মুসলিম দর্শনে তিনি নতুন প্রাণসঞ্চার করেছিলেন। তিনি নতুন দর্শন দান করে গেছেন। মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করার জন্য তিনি ‘আসরারে খুদি’ বা খুদির দর্শন উপহার দিয়েছেন। আর সেটিকে আরো ব্যাখ্যা করেন রমুজে বেখুদিতে যে, খুদির প্রকাশটা কী আর খুদির বিলীন হওয়াই বা কী?
সত্যিকার অর্থেই ইকবাল একজন বড় দার্শনিক ছিলেন। তিনি খ্যাতিমান দার্শনিক শুধু নয়, তিনি ইসলামেরও দার্শনিক ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তিনি দর্শনে এমএ এবং পিএইচডি করেছেন। শিক্ষার দিক থেকেও তিনি এ উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আরবিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। আবার বার অ্যাট ল-ও করেছেন। সর্বোপরি, তিনি একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। আর কবি হওয়া এমন এক অনন্য প্রতিভা, যার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাগে না। ডিগ্রি ছাড়াই বড় কবি হওয়া যায়। এ সবকিছু মিলেই ইকবাল।
ইকবালের রাজনৈতিক দিকটি মানুষ তেমন খেয়াল করে না। কিন্তু উপমহাদেশের সমকালীন রাজনীতিতে তার অবদান খুব বেশি। তাকে খুব বড় একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমরা দেখি। তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে লাহোর থেকে পাঞ্জাব সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তিনি গণতন্ত্রের, মূলত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন। পার্লামেন্টের ভেতরেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। তবে তিনি সেকুলার গণতন্ত্রকে পছন্দ করতেন না। গণতন্ত্র যদি ইসলামভিত্তিক হয়, সেটিকেই তিনি প্রকৃত গণতন্ত্র বলে মনে করতেন; যেখানে আইন হবে আল্লাহ তায়ালার আর শাসন হবে মানুষের।
রাজনীতির ক্ষেত্রে ইকবালের দু’টি অবদানকে সবচেয়ে বড় মনে করা যায়। একটি হলো, তদানীন্তন মুসলিম লীগে তার সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা পালন। তখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মূল প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠানের তিনি এক সময়ে প্রেসিডেন্টও ছিলেন। তিনি তার সাধ্যমতো মুসলিম লীগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করেছেন। সে মুসলিম লীগ ভারতীয় রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল।
তার দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি ১৯৩০ সালে এ দলের এলাহাবাদ কনফারেন্সে তৎকালীন ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব দিকে দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। এ দুটি এলাকাতেই মুসলিমরা মেজরিটি। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, সমগ্র ভারতে হিন্দুরা মেজরিটি এবং সেখানে মুসলিমরা সত্যিকার স্বাধীনতা পাবে না। মুসলমানরা সংখ্যায় অল্প নয়, বরং তারা বড় একটি জাতি। তারা ভারতের পূর্ব দিকের দুটি প্রদেশে মেজরিটি অর্থাৎ বেঙ্গল ও আসামে, যা বর্তমানে ৯টি প্রদেশে বিভক্ত। এ অঞ্চল আর পশ্চিম দিকের মুসলিম মেজরিটি প্রদেশগুলো নিয়ে দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের কথা ইকবাল বলেছিলেন।
তিনি মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। তিনি জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামের সমন্বয় ঘটালেন। জাতীয়তাবাদের ধারণা হলো- প্রতিটি জাতির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আছে। ভাষাভিত্তিক হোক আর অঞ্চলভিত্তিক হোক, প্রতিটি জাতির স্বায়ত্তশাসন চাওয়ার অধিকার আছে। ইকবাল এটিকে ইসলামের সাথে সমন্বয় ঘটান। তিনি বললেন, ইসলামের ভিত্তিতেও জাতীয়তা হতে পারে। আর এ জাতির সাথে পাশ্চাত্যের তত্ত্বের মিলন ঘটালেন এ কথা বলে- আদর্শিক মুসলিম জাতি, তারা যে ভূখণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে এলাকায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
ওয়েস্টার্ন থিওরি ছিল, জাতি সাধারণত অঞ্চলভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক বা বর্ণভিত্তিক হবে এবং তার আলোকে সেখানে যারা মেজরিটি, তাদের রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। তবে তাদের মধ্যে আদর্শিক জাতির ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু ইকবাল সেখানে ইসলামভিত্তিক জাতির কথা বললেন। মুসলমানদের বললেন ‘আদর্শিক জাতি’। যেখানে মুসলমানরা মেজরিটি, সেখানে স্বাধীন হওয়ার কথা তিনি বললেন। এর মাধ্যমে তিনি ইসলামের সাথে আধুনিক জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এ সমন্বয়ের মাধ্যমেই তিনি ‘পাকিস্তান’ দাবি করলেন। একপর্যায়ে উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশ মিলে একটি জোরদার আন্দোলন হলো। সে আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলো। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশ হলো।
ভারতের এ রাজনৈতিক বিবর্তনে ইকবালের ভূমিকা অনেক বড়। ইসলামের ভাবধারা ও চেতনার সাথে তিনি আধুনিক জাতীয়তার সমন্বয় ঘটিয়ে তাকে ইসলামীকরণ করেছেন, অথবা আমরা বলতে পারি তাকে ইসলামাইজ করে ফেললেন। এটি তার একটি বিরাট অবদান। কাজটি তার আগে কেউ করেননি। এ দিক থেকে ইকবাল অনেক বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার কথা আমরা ইতিহাস থেকে বাদ দিতে পারি না।
প্রথমত, যে তাত্ত্বিক ও জ্ঞানগত শূন্যতার কারণে বর্তমান যুগের মানুষের চোখে ইসলামি জীবনব্যবস্থা অসম্পূর্ণ ও অকার্যোপযোগী বলে মনে হয়, সেই শূন্যতা পূরণ করা। দ্বিতীয়ত, এমন কিছু লোক তৈরি করা, যারা মুসলমানদের তাত্ত্বিক ও বাস্তব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারেন। একটা নির্ভেজাল ও সর্বাত্মক ইসলামি আন্দোলনের ধারণা তখন আমাদের সামনে ছিল না।
সেই সময় আসলে এমন একজন মানুষের প্রয়োজন ছিল, যিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় সাধারণ লোকদের চেয়েও বেশি শিক্ষিত এবং পাশ্চাত্য বিদ্যায় তাদের চেয়েও দক্ষ ও পারদর্শী হবেন, তারপরও এত জোরদার ভাষায় ইসলামি জীবনপদ্ধতিকে সমর্থন করবেন যে, পাশ্চাত্যপূজারীরা তার সামনে কথা বলারই সাহস পাবে না। সেই দুর্লভ ব্যক্তিত্বই ছিল ইকবালের। সেকালে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ ছিল এবং সাধারণ ধারণা প্রচলিত ছিল যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে আপস (Compromise) এবং পাশ্চাত্য মতবাদগুলোর সাথে ইসলামি দর্শনের সমন্বয় সাধন অপরিহার্য। আল্লামা ইকবাল এ ধারণা খণ্ডন করেছিলেন। এটিই ইকবালের আসল অবদান।
লেখক :শাহ্ আব্দুল হান্নান
সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার