Al Muqaddimah-ibn khaldun

আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান , ইতিহাস , দর্শন ও অর্থনীতির জনক হিসেবে ওলী উদ্দিন আবু যায়েদ আবদুর রহমান ইবনে খালদুন আল হাযরামী পরিচিত । ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিউনিসে জন্ম গ্রহণ করেন । সমগ্র তিউনিস জুড়ে যখন প্লেগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন প্রথম বারের মতো ইবনে খালদুন রাজ প্রাসাদে পা রাখেন । এর পর কখনো আফ্রিকা , কখনো স্পেন এবং জীবনের শেষ দিকে তিনি মিশরে অতিবাহিত করেন । ইবনে খালদুন ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে “আল- মুকাদ্দিমা” লেখা শেষ করেন ।

মুকাদ্দিমায় উপস্থাপিত বিষয় গুলো মোট ছয়টি অধ্যায়ে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে । প্রথম অধ্যায়ে মানব সভ্যতা ,বায়ু, চরিত্র এবং জীবাত্মার শ্রেণী বিভাগ সম্পর্কে । দ্বিতীয় অধ্যায়ে যাযাবর জীবন, বর্বর জাতি ও তাদের জীবন যাপন সম্পর্কে । তৃতীয় অধ্যায়ে সাম্রাজ্য, রাষ্ট্র শক্তি ও তাদের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে । চতুর্থ অধ্যায়ে বিভিন্ন দেশ ,নগর ও প্রদেশ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । পঞ্চম অধ্যায়ে শিল্প দক্ষতা, নগর ও প্রদেশের আলোচনা এবং  ষষ্ঠ অধ্যায়ে শিক্ষা জ্ঞান- বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন তিনি । আল মুকাদ্দিমায় মূলত অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব,  ইতিহাস ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রজ্ঞাদীপ্ত পর্যবেক্ষণ দেখা যায় । কথিত আছে এই আরব পণ্ডিত ইউরোপীয়দের কাছে উনিশ শতকে পৌঁছায় কিন্তু তাদের সকল উদ্ভাবনে এই আরব পণ্ডিতের সমাজ ,ইতিহাস ও দর্শন তত্ত্ব ঘুরে ফিরে উঠে এসেছে ।

“আল -মুকাদ্দিমা ” নব দিগন্তে সূর্যের আলোক রশ্মির মতো চির অক্ষয় হয়ে আছে । যদিও ইবনে খালদুনের ইতিহাস উদ্ভাবন পরবর্তীতে সমাজ বিজ্ঞানের তত্ত্ব হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে । চিন্তাধারায় যদিও তিনি ইবনে রুশদের বিরোধিতা করেছেন কিন্তু ইমাম গাযালীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন । ইবনে খালদুনই একমাত্র মুসলিম দার্শনিক যার চিন্তাধারা একাত্ববাদের ধারণাকে অত্যন্ত বলিষ্ঠ আকারে উপস্থাপন করেছে । ইবনে খালদুন মানুষের চিন্তা শক্তি সম্পর্কে বলেছেন, ” মানুষ সম্পূর্ণ ভাবে স্বাধীন নয় ,যদিও মানুষ বিশেষ গুণের দ্বারা সমগ্র প্রাণী জগতে বিশিষ্ট হয়ে আছে । এর মধ্যে জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলা তাদের চিন্তার ফসল ।” তিনি মধুমক্ষিকা ও পঙ্গপালের গুণের উল্লেখ করেন । কিন্তু এসব তাদের সহজাত প্রবৃত্তির তাড়না । চিন্তা,প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির ফসল নয়।

ইমাম গাযালী “আল হিকমাতু ফি মাখলুকাতিল্লাহ ” গ্রন্থে সৃষ্টির রহস্য দর্শন আলোচনা করেছেন । এখানে ইমাম গাযালী চতুষ্পদ প্রাণী ,পাখি , মাকড়সা, মাছি ,কাক ,চিল প্রভৃতির সৃষ্টি রহস্য বর্ণনা করেছেন । মানুষের সম্মান মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের মূলে রয়েছে তার প্রজ্ঞা শক্তি । সূরা বনি ইসরাইলের সত্তর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন , ” নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি । আমি তাদেরকে জলেস্থলের বাহন দিয়েছি, দিয়েছি উত্তম জীবনোপকরণ। আমার অনেক সৃষ্টির  ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি ।”

ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন গাধা, গরু, হাতি ও ঘোড়ার শক্তি যদিও মানুষ থেকে অনেক বেশি কিন্তু মানুষের এমন একটি শক্তি রয়েছে যা অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে নেই । যে চিন্তা শক্তি দিয়ে বিচিত্র ধরণের হাতিয়ার মানুষ তৈরি করে বড় বড় শক্তিকে পরাজিত করতে পারে । তিনি আরো বলেছেন মানব চরিত্র, গাত্র বর্ণ, মানসিক অবস্থা বায়ুর প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে । তিনি ইবনে সীনার চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কীয় “রেজায” গ্রন্থের উদাহরণ টেনেছেন ,
” জজ্ঞদের দেহে উষ্ণতা পরিবর্তন এনেছে,তাদের বর্ণ কালো হয়েছে ।
স্লাভরা পেয়েছে শুভ্রতা , তাই তাদের ত্বক কোমল হয়েছে ।”
তিনি দেখিয়েছেন খাদ্যের প্রাচুর্যতায় ও ক্ষুধায় মানবদেহ ও মানব চরিত্র কিভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ও সুগঠিত হয়ে ওঠে । তিনি বলেছেন,
” অতিরিক্ত আহার্য ও অতিরিক্ত পচনশীল মিশ্রিত রস দেহের মধ্যে অতিরিক্ত মেদের সৃষ্টি করে । এর ফলে অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ অসামঞ্জস্য রূপে বেড়ে ওঠে । অনাহার যেমন দূষিত রক্ত ও দেহ মনের ক্ষতিকর জৈবিক রস থেকে দেহকে পরিষ্কার রাখে ,তেমনি আহার্যও দেহের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে । “

ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন আসাবিয়াহ তথা গোত্রের স্থায়িত্বকাল পারিবারিক উপায়ে গড়ে ওঠে । সমাজকে তিনি দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন । এক দিকে শহুরে সমাজ অন্যদিকে যাযাবর সমাজ । তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন পদমর্যাদার স্থায়িত্ব, শক্তির বিস্তার ও প্রতিষ্ঠালাভ গোত্রপ্রীতি ছাড়া ফলপ্রসূ হয় না । যাযাবররা তাদের জীবিকার জন্য স্বাভাবিক ভাবে কৃষি ও পশুপালনের উপর নির্ভরশীল । অন্যদিকে নগরবাসীরা চাকরি ,স্থাপত্য শিল্প ,পুস্তক শিল্প, সঙ্গীত বিদ্যা ,চিকিৎসা শাস্ত্রের ন্যায় পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে থাকে । নগরবাসীদের তুলনায় যাযাবর গোষ্ঠীরা সৎ,শৌর্যবীর্যের অধিকারী ও সাহসী হয়ে থাকে । তিনি পবিত্র কুরআন থেকে সূরা ইউসুফের ১৪ আয়াত দেখিয়ে গোত্রপ্রীতির ইতিবাচকতা তুলে ধরেছেন ।
“যদি তাকে বাঘে খেয়ে ফেলে ,অথচ আমরা একটি গোত্র , তা হলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হব ।”
গোত্রপ্রীতি ও বংশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের মধ্যে গভীর আকর্ষণ, প্রীতি ও মায়া প্রদান করেছেন । এই সম্পর্কের অন্যতম ফলশ্রুতি রক্তসম্পর্কীয় স্বজন ও ঘনিষ্ঠজন । এখানে হজরত মুহাম্মদ (দঃ) এর বাণীর তাৎপর্য বোঝা যায়, ” তোমাদের বংশধারা সম্পর্কে ঐ জ্ঞান লাভ করো ,যা তোমাদের রক্ত সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে পারে ।” এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই ইবনে রুশদ তার “এরিস্টটল ” গ্রন্থে বলেছেন , “বংশ মর্যাদা হলো কোন জাতির কোন নগরীতে বসবাস করার প্রাচীনত্ববোধক একটি বিষয় ।”এ ক্ষেত্রে দেখা যায় রুশদ বংশ মর্যাদাকে কেবল পিতৃপুরুষের সংখ্যা গণনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন । তিনি গোত্রপ্রীতির কোন গুরুত্বই দেননি ।

ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন একই বংশধারায় বংশমর্যাদার স্থায়িত্ব মাত্র চার পুরুষ পর্যন্ত স্থায়ী হয় । বংশমর্যাদার যিনি প্রতিষ্ঠাতা তিনি জানেন কিভাবে কি উপায়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন । তাই তিনি যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু পুত্র এসে কেবল অংশীদার হয় এবং শ্রুতির সাহায্যে সব কিছু গ্রহণ করেন । এরপর পৌত্র এসে কেবল অনুসরণ ও অনুকরণের দায়িত্ব পালন করেন । এরপর প্রপৌত্র সম্পূর্ণ ভাবে ত্রুটির মধ্যে নিমজ্জিত হয় এবং বংশমর্যাদা ও তাদের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে । তিনি বুঝতেই পারেননি বংশমর্যাদা ধরে রাখতে গোত্রপ্রীতি, চরিত্রগুণ ও আনুগত্যের আবশ্যকতা রয়েছে । তিনি হজরত মুহাম্মদ (দঃ) এর বাণী দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়েছেন ,” অবশ্যই সম্ভ্রান্তের পুত্র সম্ভ্রান্ত, ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাকের পুত্র ইয়াকুবের পুত্র ইউসুফ (আঃ) ।”

ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন গোত্রপ্রীতির ফলে যখন একটি গোষ্ঠী সম্মিলিত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে তখন অন্য একটির জন্য ইচ্ছুক হন । নেতৃত্ব লাভের পর তার মধ্যে ক্ষমতার প্রাধান্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে । দেখা যায় গোত্রপ্রীতির শেষ লক্ষ্য হল রাজ্য ক্ষমতা লাভ । তিনি সূরা বাকারার ২৫১ আয়াত তুলে ধরে দেখিয়েছেন ,”যদি মানব সমাজের কতকাংশকে দিয়ে অপর কতকাংশকে দমন না করতেন ,তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো । ” তবে এই রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে বাধাসমূহের অন্যতম হলো কোন গোত্রের বিলাসব্যসন ও প্রাচুর্যের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া । তবে তিনি হীনমন্যতা ও অপরের প্রতি আনুগত্যকেও রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হিসেবে দেখিয়েছেন । উদাহরণ হিসেবে আমরা বনী ইসরাইলদের দেখতে পেলাম যারা হীনমন্যতা ও অবাধ্যতার কারণে দীর্ঘ চল্লিশ বছর শাস্তি স্বরূপ তীহ প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন । ইবনে খালদুন রাজ্য  প্রতিষ্ঠায় চরিত্রকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন । তিনি বলেছেন, “মানব সমাজে আল্লাহর সমুদয় বিধি-নিষেধ হল কল্যাণধর্মী ও যোগ্যতার অনুসারী, অন্যদিকে মানুষের বিধি-বিধান একান্তই মূর্খতা ও শয়তানের কাজ । কারণ তাতে আল্লাহর মহিমা ও তার সত্যাসত্য নির্ধারণের বিরোধিতাই প্রকট । ” তিনি দেখিয়েছেন যখন ক্ষমতাশীল গোত্র কম ক্ষমতাধর গোত্রের কাছে জয়ী হয় তখন বিজিতরা সাধারণত বিজয়ীদের অনুকরণ করে থাকে । এই অনুকরণ হতে পারে পোশাক- পরিচ্ছদ,যানবাহন, অস্ত্র- শস্ত্র এমনকি সামগ্রিক অবস্থার মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় ।

ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন সাধারণত সাম্রাজ্য ও রাষ্ট্র শক্তি একমাত্র গোত্রপ্রীতির সাহায্যেই লাভ হয় । তবে রাষ্ট্র যে আসাবিয়া শক্তির উপর টিকে থাকে সে কেবল ধর্মের জন্য । তিনি বলেছেন ” সকল অন্তরকে একত্র করে এক সূত্রে গাঁথা একমাত্র ধর্মমত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত সম্ভব নয় ।” যেহেতু মুসলিমের উদ্দেশ্য এক এবং প্রাপ্য একই সুতরাং তাদের কর্তব্য সাধনে মৃত্যুবরণ করতেও দ্বিধান্বিত হয় না । ইবনে খালদুন কাদেসিয়া ও ইয়ারমুক যুদ্ধের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেছেন “একদল সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিতে উৎসাহী আর অন্যদল মিথ্যার মোহে মৃত্যু ভয়ে হীনমন্য”। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও পরমজ্ঞানী তিনি সূরা নিসার ১৩৫ আয়াতে বলেছেন “জীবন বিধানের দিক দিয়ে কে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ যিনি তার সকল উদ্দেশ্যেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে দেন ,মানবের কল্যাণ বিধান করেন এবং ন্যায় নিষ্ঠ ইব্রাহিমের মিল্লাতকে অনুসরণ করেন” । অতএব ধর্মমত প্রচার ও গোত্রপ্রীতির সাহায্য ব্যতীত রাজ্য গড়ে ওঠে না । রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ধর্ম কতটুকু জরুরী এবং কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করে ? আল ফারাবীর চিন্তাধারায় দেখা যায় যে তিনি রাজনৈতিক উৎকর্ষতার জন্যই ধর্মীয় জ্ঞান অপরিহার্য বলে দাবি করেন । কিন্তু ইবনে তাইমিয়া দেখান যে ধর্মীয় উৎকর্ষতার জন্যই রাজনৈতিক ক্ষমতা অপরিহার্য ।” আল্লামা ইকবাল তার “ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” প্রবন্ধে বলেন “ধর্ম জাতীয় ও গোষ্ঠী ভিত্তিক নয়,ব্যক্তিগত ও ঘরোয়াও নয় বরং তা হচ্ছে বিশুদ্ধ মানবীয় এবং তার লক্ষ্য হচ্ছে মানব জাতির যাবতীয় স্বাভাবিক বৈষম্য সত্ত্বেও তাকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করে তোলা ।” তিনি জালালুদ্দিন রুমীর চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে আসরারে খুদীতে বলেছেন
” অন্তরের ঐক্য শ্রেষ্ঠতর,
জবানের ঐক্য থেকে “।
অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক বিকাশের প্রকাশ যেখানে মুসলিম আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে সমর্পণ করবেন ।

ধর্মযুদ্ধের পর মধ্য এশিয়ায় মঙ্গলদের উৎপাত এবং খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের ফলে মুসলিম সালতানাতের নাকাল অবস্থা হয়ে পড়ে । এই শোচনীয় অবস্থার জন্য ইবনে খালদুন ধর্মহীনতাকেই দায়ি করেছেন । মুসলিম মিল্লাত যখন ভোগবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে তখন তারা ধর্ম থেকে দূরে সরে আসে । তাই তিনি ধর্মহীনতাকে মুসলিম জাতির পতনের জন্য দায়ী মনে করেছেন । ইউরোপীয় চিন্তা ধারায় যিনি প্রভাব বিস্তার করেছেন সেই ম্যকিয়াভেলির “The prince” গ্রন্থ ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে । তিনি ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছেন । কিন্তু পরবর্তীতে তার গ্রন্থ “Discourses on Livy ” তাঁর চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন দেখা যায় । তিনি ধর্মহীন রাষ্ট্রকে দন্তহীন মুখের সাথে তুলনা করেছেন । সাধারণ জনসাধারণকে রাজ্যের অনুগত রাখতে গেলে ধর্মের আবশ্যকতা রয়েছে । তিনি একটু ঘুরিয়ে বলেছেন যে ধর্মকে আইনের আওতায় এনে ব্যবহার করা যেতে পারে ।
আমরা দেখতে পাই ভিকোর “The new science ” বা অগাস্ট কোঁতের “Sociology ” তত্ত্ব গুলো বহু আগেই ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমায় স্থান পেয়েছে ।

রাষ্ট্রের জন্ম থেকে ধ্বংস পর্যন্ত সময়কে খালদুন পাঁচ স্তরে বর্ণনা করেছেন ভূখণ্ড বিজয়, রাজ্য গঠন , ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত, ক্ষমতার হ্রাস এবং অবশেষে রাষ্ট্রের পতন । একটা জীবনের ক্ষেত্রে শৈশব, কৈশর, যৌবন, বার্ধক্য,মৃত্যু যেভাবে আঘাত হানে ঠিক তেমনি একটা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এই পর্যায় গুলো লক্ষ্য করা যায় । আবার যখন কোন রাজ্য গঠিত হয় তখন সেই রাজ্যের জীবনকাল তিন পুরুষের অধিক স্থায়ী হয় না । অর্থাৎ বংশমর্যাদা চতুর্থ পর্যায়ে এসে শেষ হয় ।

ইবনে খালদুন রাজকীয় ক্ষমতার ইতিবাচকতা তুলে ধরেছেন । তিনি বলেন “সম্রাট হবেন প্রজাদের একজন । রাজকীয় শক্তির সৌন্দর্য হল সহানুভূতি । সম্রাট যদি কঠোরতা ও প্রতাপের অধিকারী হন ,মানুষকে শাস্তি দিতে,তাদের গোপনীয়তা নষ্ট করতে এবং তাদের পাপাচারকে খুঁজে দেখতে তৎপর হন , তাহলে তারা ভীত ও অপমানিত হতে থাকে । এর ফলে সম্রাটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মিথ্যা কৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে । অনেক সময় তারা একত্রিত হয়ে সম্রাটকে হত্যার পরিকল্পনা করে । এর ফলে রাজ্য ধ্বংস হয় ।” তাই সম্রাটকে সত্য ন্যায় ও ইনসাফের পথে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণপণে লড়তে হয় । এর ফলে রাজকীয় ক্ষমতা ও সাম্রাজ্য দৃঢ় হয় । অতএব প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণের মধ্য দিয়েই রাজকীয় শক্তি যথার্থ ও পূর্ণতা লাভ করে ।

ইবনে খালদুন বলেছেন ” ন্যায় বিচার এমন একটি তুলাদণ্ড যা স্বয়ং প্রভু মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তার জন্য একজন পরিদর্শক নিযুক্ত করে দিয়েছেন তিনি হলেন সম্রাট । ” তিনি সাসানী সম্রাট প্রথম খসরুর ন্যায়বিচার সংক্রান্ত বাণী তুলে ধরেছেন এভাবে “সৈন্যদল ছাড়া রাজ্য হয় না । সম্পদ ছাড়া সৈন্যদল গড়ে ওঠে না । সম্পদের জন্য রাজস্বের প্রয়োজন আর রাজস্বের জন্য সমৃদ্ধি । সমৃদ্ধি আসে ন্যায় বিচারের মাধ্যমে আর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পায় কর্মচারীদের উন্নতি বিধানে ।” অর্থাৎ শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে কোন ভাবেই যেন তাদের বঞ্চিত করা না হয় । শ্রমের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা পরিদর্শকের অবশ্য কর্তব্য । ইবনে খালদুন বলেন ” শাসন ব্যবস্থার বিশেষ পরিধিতে সমশ্রেণীর গোত্র ও তুল্য ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একান্ত প্রয়োজন । এভাবে তিনি প্রতিটি লোককে তার যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবার নামই সদ্ব্যবহার যার অন্য নাম ন্যায় পরায়নতা । “

ইবনে খালদুন ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন । খেলাফত, রাজতন্ত্র ও সালতানাত । ইবনে তাইমিয়াও এরকম বিভক্তি করেছেন । তবে ইবনে খালদুন খেলাফতকেই সর্বোৎকৃষ্ট এবং শরীয়ত সম্মত ব্যবস্থা মনে করেছেন । তিনি রাজশক্তির উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছেন ” সকল মানুষকে স্বার্থ ও প্রবৃত্তির বিশেষ তাড়নায় পরিচালিত করা , শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত বিধিনিষেধের লক্ষ্য হলো সকলকে বিবেক সম্মত পথে পরিচালিত করে পার্থিব জীবনের কল্যাণ সাধন ও অকল্যাণ দূর করা । ” আবার খেলাফতের উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছেন ” মানুষকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সমুদয় পারলৌকিক মঙ্গল ও ইহলৌকিক কল্যাণের দিক দর্শন করা । কারণ তাদের পার্থিব জীবনের সকল কাজই পরলোকে তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে । এজন্য ধর্ম প্রবর্তক সেই পারলৌকিক মঙ্গলের দিকে লক্ষ্য রেখেই সমুদয় পার্থিব কর্ম নিয়ন্ত্রণ করবে । অর্থাৎ ধর্ম প্রবর্তকের প্রতিনিধি হয়ে ধর্মীয় বিধানকে সংরক্ষণ ও ন্যায় ভিত্তিক শাসন পরিচালনা করবে । একেই খেলাফত বা ইমামত বলা হয় যিনি এই কার্য সম্পাদন করেন তাকে খলিফা বা ইমাম বলা হয় । ইবনে খালদুন খলিফা পদমর্যাদা লাভের চারটি শর্তের কথা বলেছেন । জ্ঞান, ন্যায়পরায়ণতা, যোগ্যতা এবং সুস্থ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়াদির সম্পূর্ণতা । খেলাফত অর্থ হল ধর্মের সংরক্ষণ ও পার্থিব শৃঙ্খলা বিধান । তিনি ধর্ম প্রবর্তকের দুটি বিষয়ের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করেছেন ।
এক: ধর্মীয় বিধি-নিষেধের যথাবিহিত প্রচারণা এবং মানুষকে তৎসম্পর্কে কর্তব্য পালনের জন্য উৎসাহিত করা ।
দুই: মানব জীবনের কল্যাণকে সম্মুখে রেখে পার্থিব শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ।

মহান রাব্বুল আ’লামীন মানুষের মধ্যে অনেককে তার বাণী বহনের মর্যাদা দিয়ে নির্বাচিত করেছেন । কখনো স্বপ্ন যোগে কখনো ঘন্টাধ্বনিতে আবার কখনো ওহীর মাধ্যমে তার বাণী পাঠিয়েছেন । হজরত মুহাম্মদ (দঃ) কে প্রত্যাদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন ” কখনো এটা আমার নিকট আসে ঘন্টা ধ্বনির মতো এবং এটাই অতিশয় কষ্টদায়ক । ” হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মানবীয় শক্তি, প্রজ্ঞা ,দূরদর্শীতা ও প্রেমের দৃষ্টান্ত মেলে যখন আবু সুফিয়ান রাসূলের পত্র নিয়ে হিরাক্লিয়াসের নিকট গেলেন । হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানের কাছে জানতে চাইলেন তিনি তোমাদের কি কি করতে বলেন ? আবু সুফিয়ান বললেন , ” নামাজ, যাকাত, আত্মীয়তা ও পবিত্রতা পালন করতে আদেশ দেন । ” হিরাক্লিয়াস সুফিয়ানের জবাব শুনে বললেন ” তুমি যা বলেছ তা যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি আমার এ পদদ্বয়ের নিচের ভূমি পর্যন্ত অধিকার করে নেবেন । “

আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে মানবীয় গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবার ক্ষমতা দিয়ে থাকেন । ইবনে খালদুন মানবীয় জীবাত্মার তিনটি স্তরের কথা বলেছেন । এক প্রকার যারা কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধি ও ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে । দ্বিতীয় প্রকার যারা দৈহিক মননজনিত গতিকেই আত্মিক উপলব্ধির অধিকারী হন যাতে দৈহিক মাধ্যম গুলোর সাহায্যের প্রয়োজন হয় না । তৃতীয় প্রকার যারা দৈহিক ও আত্মিক উভয় দিক থেকেই সম্পূর্ণ ভাবে উচ্চস্তরের ফেরেশতীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্মগত যোগ্যতা রাখে । তবে মানবীয় গণ্ডি পেরিয়ে আত্মিক সর্বোচ্চস্তর অর্থাৎ ফেরেশতীয় গণ্ডিতে কেবল নবীদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব । ধর্ম প্রবর্তক স্বপ্ন দর্শনকে নবুয়তের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলে বর্ণনা করেছেন । অন্য এক হাদিসে তেতাল্লিশ ভাগের এক ভাগ আবার অন্য একটিতে সত্তর ভাগের একভাগ ।

ইবনে খালদুন সম্পদের পরিমাণের একক হিসেবে শ্রমের মূল্যতত্ত্বের উদ্ভাবন করেছেন । এবং সম্পদের মূল্য হিসেবে শ্রমকে নির্ধারণ করেছেন । তিনি বলেন রাষ্ট্রের সূচনায় করের পরিমাণ কম থাকে কিন্তু আয় হয় অধিক । কিন্তু রাষ্ট্রের শাসকেরা যখন বিলাসী হয়ে ওঠে তখন নতুন নতুন কর সৃষ্টি করে এবং করের হার বৃদ্ধি করে । এর ফলে উৎপাদকেরা উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে । ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন উৎপীড়নের ফলে কিভাবে সভ্যতার ধ্বংস হয় । তিনি বলেছেন যদি কেউ ভাল কাজে হস্তক্ষেপ করে এবং অন্যায় ভাবে কিছু দাবি করে অথবা ধর্মীয় বিধানের বাইরে গিয়ে কোন দাবি প্রতিষ্ঠিত করে সে উৎপীড়ক । সুতরাং কোন ন্যায় ভিত্তি ছাড়া কর আদায়কারীরা উৎপীড়ক এবং জবরদস্তিকারীরাও উৎপীড়ক । তিনি দেখিয়েছেন একনিষ্ঠ ভাবে ধর্ম পালনকারীরাই কেবল উৎপীড়ন করেন না ।

এরপর ইবনে খালদুন শিল্প কলা ও নানা প্রকার জ্ঞান- বিজ্ঞান যা মানুষের মনন শক্তির ফসল ,যা দ্বারা সমস্ত প্রাণীর মধ্যে মানুষ বিশিষ্ট হয়ে আছে তার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন । তিনি ধাত্রী শিল্প, কৃষি শিল্প ,লিপি ও গ্রন্থ শিল্পের গুরুত্বের কথা বর্ণনা করেছেন । তিনি ইলমে কালামের দ্বারা অসম্ভবকে অধিকারের লোভ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন । তিনি বলেন বুদ্ধিমত্তা একটি বিশুদ্ধ তুলাদণ্ড এবং তার নিয়মাবলীও বিশ্বস্ত, তাতে মিথ্যার কোন অবকাশ নেই । কিন্তু তাই বলে তা দিয়ে আপনি আল্লাহর একত্ব,পরকাল,নবুয়াতের তাৎপর্য এবং আল্লাহর গুণাবলীর যথার্থতা আয়ত্তের চেষ্টা করবেন না । ” উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন যে , এক ব্যক্তি যে তুলাদণ্ডে স্বর্ণ ওজন করতে দেখে তা দিয়ে পর্বত মেপে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলো ।

সমাজতত্ত্ব , ইতিহাস ,প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও দর্শন চিন্তায় ইবনে খালদুনের অবদান অনস্বীকার্য । তিনি ইউরোপীয় চিন্তা ধারায় প্রভাব বিস্তার করেন । দেখা যায় অগাস্ট কোঁৎ,মন্টেস্কু, ম্যাকিয়াভেলি ও ভিকোর চিন্তা ভাবনায় এই আরব পণ্ডিতের ভাবনা গুলো ফুটে উঠেছে । সমাজ তত্ত্বের যে ভাবনা গুলো সেই তেরো শতকে ইবনে খালদুন তার আল- মুকাদ্দিমায় তুলে ধরেছেন তা এখন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে । লোক মুখে যদিও এই আরব পণ্ডিত ইউরোপীয় মন্টেস্কু নামে পরিচিত কিন্তু তার সমাজ তত্ত্বের ধারে কাছেও কেউ যেতে পারেনি ।।

শুকরিয়া:
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি । কেবল তিনিই সত্য উপলব্ধি করার সৌভাগ্য দেন ।।
ধন্যবাদ ।।

আবদুল কাদের জিলানী

সম্পাদক  

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *