নজরুল ইসলাম কবি, নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কিন্তু সর্বোপরি নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’। বর্ধমান জিলার চুরুলিয়া গ্রামের এক খান্দানী কাজী বংশে নজরুল ইসলামের জন্ম। পিতা কাজী ফকীর আহমদ ও মাতা জাহেদা খাতুনের দুরত্ত পুত্র দুখু মিঞা (নজরুল ইসলাম) কিশোর বয়স থেকে গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। এই সময়ে তিনি কবিতাও লিখতেন। কিরূপ কবিতা লিখতেন? নমুনা-

চাষ কর দেহ জমিতে
হবে নানা ফসল এতে
নামাজে জমি উগালে
রোজাতে জমি সামালে
কলেমাতে জমিতে মই দিলে
চিন্তা কি হে এই ভবেতে ৷৷

লাইলাহা ইল্লাল্লাতে
বীজ ফেল তুই বিধি মতে
পাবি ঈমান ফসল তাতে
আর রইবি সুখেতে ৷।

এই কবি আরও একটু বড় হয়ে লিখলেনঃ

চল চল চল
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণীতল
অরুণ প্রাতের তরুণ দল চলরে চলরে চল ॥
তাজা-ব-তাজার গাহিয়া গান।
সজীব করিব গোরস্তান
আমরা আনিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল ।।
চলরে নওযোয়ান
শোনরে পাতিয়া কান
নয়া জামানার মিনারে মিনারে
নও ঊষার আজান ।।

আরও লিখলেন :

বাজলো কিরে ভোরের শানাই
নিদ মহলার আঁধার পুরে।
শুনছি আজান গগন তলে
অতীত রাতের মিনার চুড়ে ॥

সরাইখানার যাত্রীরা কি
“বন্ধু জাগো” উঠল হাঁকি
নীড় ছেড়ে ওই প্রভাত পাখী গুলিস্তানে চলল উড়ে।

আজ কি আবার কাবার পথে
ভীড় জমেছে প্রভাত হ’তে
নামল কি ফের হাজার স্রোতে
‘হেরা’র জ্যোতি জগৎ জুড়ে ।।

প্রথম যৌবনে ‘বিদ্রোহী’ নামে একটি কবিতা লিখে তিনি সুধী সমাজে পরিচিত হয়েছিলেন। ফলে তাঁর খেতাবও হয়ে গেল বিদ্রোহী । বিদ্রোহী? কিসের বিরুদ্ধে ? কবি বললেনঃ

আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে একে দেব পদচিহ্ন;
আমি শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণভূমে রণিবে না।

আর যান কোথা? ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেবে, খেয়ালী বিধির বক্ষ ভিন্ন করে দেবে, এ লোক বিদ্রোহী তো বটেই, বরং সে ‘কাফের’। কাফের মনে, আল্লাহ্দ্রোহী।

ফতওয়া দিলেন একদল আলেমে-সমাজ মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে দু’ একজন কুফরী কালামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। কবি গোলাম মোস্তফা, কবি মোহাম্মদ গোলাম হোসেন এ কবিতার বাঙ্গ অনুকৃতি (প্যারোডি) লিখে এর জবাবও দিলেন। কিন্তু কৌতূহলের বিষয়, কবি নজরুল ইসলাম কবি নজরুল ইসলামই রয়ে গেলেন।

বিদ্রোহী কবিতাতে কবি ভৃগুর কাহিনীটি স্মরণ করেছেন বিশেষ একটি তত্ত্ব-ব্যাখ্যার্থে, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই কবিতা প্রকাশের পর নানা বাদ-প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। নজরুলকে তার জন্য বহু জ্বালাতন সইতেও হয়েছিল। আর ভৃগুমূণির এই পদাঘাতের মূলে হিন্দুয়ানী তত্ত্বে যাই থাক না কেন মুসলিম কবিতাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। যিনি এই বিশ্ব জগতের স্রষ্টা তিনি তো অন্তর্যামী : এবং তিনি কি কোনো জাতি-বিশেষের হতে পারেন ?

স্রষ্টা তো হলেন, নিখিল বিশ্বের, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলেরই ‘রববুল আলামীন’ তিনি কি ঘুমাতে পারেন , সাধারণের মত চলাফেরা করতে পারেন ? এখানে বিদ্রোহী ভক্ত ঘুমন্ত ভগবানকে জাগাতে চেয়েছেন ৷ ভগবান না জাগলে যে সমগ্র সৃষ্টিই ধ্বংস হয়ে যাবে।

তোমার ধরার দুঃখ কেন
আমায় নিত্য কাঁদায় হেন
উচ্ছৃঙ্খল সৃষ্টি তোমার
তাই তো কাঁদে আমার প্রাণ ।
বিদ্রোহী করেছে মোরে
আমার গভীর অভিমান।

এ বিদ্রোহী নিতান্তই ভক্ত, বিদ্রোহ হ’ল তাঁর অভিমান মাত্র। তাই এ অভিমানকে কোন মতেই উপেক্ষা করা যায় না। ভক্তের অভিমান আর বিদ্রোহ কি এক কথা ?

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, নজরুল ইসলাম ধর্মপ্রচারক বা ধর্মসাধক নন, তিনি কবি। কবি-প্রাণের তাগিদে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র, ধর্ম গ্রন্থ কুরআনে পুরাণের দ্বারস্থ হয়েছেন, কিন্তু তাঁর প্রাণের ধর্ম ইসলামকে তিনি কখনও বিসর্জন দেন নি। বরং বলা যেতে পারে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামকে প্রকৃত মর্মবাণী রূপায়ণে তাঁর মত সার্থক কবিও বড় একটা মেলে না।

তিনি নাস্তিক, তিনি অধর্মচারী, তিনি বিদ্রোহী ইত্যাদি যত রূপেই তাঁকে দেখা যাক না কেন, তাঁর ইসলাম-প্রীতির কথা খাটো করে দেখা যায় না। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর লেখা চিঠির জবাবে নজরুল তাই আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন :

“যাঁরা মনে করেন আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তার সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি, তারা অনর্থক এ ভুল করেন। তাঁরা যেন আমার লেখাগুলো মন দিয়ে পড়েন দয়া করে- এ ছাড়া আমার আর কি বলবার থাকতে পারে।”

নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বাঁধন হারা’ পত্রোপন্যাসে নূরুল হুদা চরিত্র সম্পর্কে নায়িকা রেবেকা যে কথা বলেছেন, তার ব্যক্তিগত চরিত্র ও বিদ্রোহ বাণী সম্পর্কেও তা আশ্চর্য রকমে খাটে-

“( নায়ক নুরুল হোদা) নুরুকে স্রষ্টার বিদ্রোহী বলে তোর ভয় হয়েছে, বা দুঃখ হয়েছে দেখে তো আর হেসে বাঁচিনে লো। নুরুটাও স্রষ্টার বিদ্রোহী হল আর অমনি স্রষ্টার সৃষ্টিটাও তার হাতে এসে পড়ল আর কি। এখন ওর কাঁচা বয়েস গায়ের আর মনের দুই -এরই শক্তিও যথেষ্ট, তার শরীরে উদাম উন্মাদ যৌবনের রক্ত হিপ্পোল বা খুনজোশী তীব্র উষ্ণ গতিতে ছুটাছুটি করছে, তার ওপর আবার এই স্বেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল বাঁধনহারা সে, অতএব এখন রক্তের তেজে আর গরমে সে আরও কত অসম্ভব সৃষ্টি- ছাড়া কথা বলবে। এখন সে হয়ত অনেক কথা বুঝেই বলে, তার অনেক কথা না বুঝেই শুধু ভাবের উচ্ছাসে বলে ফেলে। একটা বলবান জোয়ান ষাঁড় যখন রাস্তা দিয়ে চলে, তখন থামখাই সে কত দেওয়ালকে কত গাছকে হুঁশ দিয়ে বেড়ায় দেখেছিস তো। এটা ভুলিসনে রেবা যে, এ ছেলে বাঙলাতে জন্ম নিলেও বেদুঈনের দুরন্ত মুক্তি পাগলামী ও আরবদের গোর্দা, আর তুর্কীদের রক্ততৃষ্ণা ভীম স্রোতোবেগের মত ছুটছে এর ধমনীতে ধমনীতে। অতএব এ-সব ছেলেকে বুঝতে হলে এদের আদত সত্য কোনখানে সেইটেই সকলের আগে খুঁজে বের করতে হবে।”

বুঝতে কষ্ট হয় না এখানে শ্রীমান নূরু প্রথম যৌবনদীপ্ত নজরুল ইসলামেরই প্রতিরূপ। নূরুর দুরন্তপনা ও নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী মনোভাবের স্বরূপ বুঝতে গেলে ‘বাঁধনহারার’ নূরুল হুদা চরিত্রটি ভাল করে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।

তার যথার্থ পরিচয় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেও আছে। বিদ্রোহীতে শুধুমাত্র ভৃগুর বিদ্রোহই নেই, তার পাশেই আছে –

“আমি সহসা আমারে চিনেছি,
আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।”

কিসের বাঁধ ? অজ্ঞতার বাঁধ

একদিকে বিদ্রোহের অগ্নিবাণী আর একদিকে চরম আত্মোপলব্ধি পরম বাণী ।

অনেক সমালোচক একে কবি-মনের স্ববিরোধিতা বলে ভুল করেছেন। কিন্তু এটি স্ববিরোধিতা তো নয়ই বরং একটি অপরটির পরিপূরক।

দুরন্ত যৌবনের উন্মাদনায় যার আদৌ তোয়াক্কা করা যায় না যৌবন জল-তরঙ্গ কানায় কানায় ভরে যাওয়ার পর তারই উপলব্ধি জ্ঞানে তখন অতীতের হাস্যকর দুরন্তপনার কথা মনে করে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে হয়।

নজরুলের বিদ্রোহ তো সত্য সুন্দরের বিরুদ্ধে নয়, বরং সত্য-সুন্দরের প্রতিষ্ঠায়। তাঁর বিখ্যাত ‘জবানবন্দী’ নিবন্ধে তিনি স্পষ্টই বলেছেন, আমি কবি, আমি সত্য ও সুন্দরের হাতের বীণা’। বীণা ভাঙলেও ভাঙা যেতে পারে, কিন্তু কবির কণ্ঠে যে বীণা বাজে সে তো কবির নিজের নয়- সে বীণা-বাদক স্বয়ং সত্য ও সুন্দর আল্লাহ্ তা’আলা। তাই বীণাকে ভাঙা সহজ কিন্তু আল্লাহ তা’আলাকে ভাঙবে কে ?

তাই এক দিকে কবিকে বিদ্রোহীর ভূমিকায় দেখা যায়, আবার পরক্ষণেই মনে হয়, এ বিদ্রোহী ভক্ত ব্যতীত নয় এবং তাঁর বাণীও অভিমানী ভক্তেরই বাণী। কবি বলেছেন, “বেদনা সুন্দরের গান গেয়েছি বলেই কি আমি সত্য সুন্দরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি ?”

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এই দ্বৈত ভাবেরই চরম প্রকাশ ঘটেছে।

কবি প্রথমেই বলেছেন মানুষের অনন্ত শক্তির কথা ,বলেছেন যৌবনেই যার প্রকৃত অভিব্যক্তি ঘটে এবং যে যৌবন কোন বাঁধা-বন্ধন মানে না, তারই অভিব্যক্তি বিদ্রোহীর প্রথম স্তবকে-

“বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারই নত শির
ওই শিখর হিমাদ্রির।”

এ তো প্রকৃতপক্ষে আমিত্বেরই জাগরণী কথা। মুসলিম পরিভাষায় এ কে বলে খুদী । এর মধ্যে বিদ্রোহ কোথায় ?

নজরুল কি আল্লাহকে অস্বীকার করেছেন ?

না। তিনি মানুষের অসীম শক্তির কথা বলেছেন । স্বয়ং আল্লাহ্ও তো মানুষকে তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি করেছেন। তুলনীয় হযরত বায়ে জীদ বোস্তামীর বাণীঃ
“সুবহানী যা আজমে শানী “

মানে কত বড় আমি কি আমার মহিমা !কত বড় ? বায়েজীদ কি নজরুলের মত ‘ভূলোক- দ্যুলোক গোলক ভেদি’ খোদার আসন আরশ ছেদি’ কোন অলৌকিক জগতে পৌঁছানোর কথা বলেছেন ?

না। তবে তিনি যে কথা বলেছেন, ‘বাঁধন হারা’ নূরুর জীবনের উপলব্ধির সঙ্গে তার মিল হবে। নজরুল ইসলাম যে সত্য পথের তথা ইসলামের একজন শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন তাঁর কাব্য-কবিতা ভালোভাবে গড়লে আর সন্দেহ থাকে না। সুধী সমাজের অবগতির জন্য এখানে তাঁর কিছু বাণীর উদ্ধৃতি দিলামঃ

(ক)
“আজি ইসলামী ডঙ্কা গরজে ভরি জাহান।
নাই ছোট বড় সকল মানুষ এক সমান, রাজা-প্রজা নয় কারো কেহ ।”

(খ)
“কে আমীর তুমি নওয়াব বাদশা বালা থানায় ?
সকল কালের কলঙ্ক তুমি; জাগালে হায় ইসলামে তুমি সন্দেহ।”

(গ)
“আমানুল্লাহর করি বন্দনা কাবুল রাজার গাহিনা গান,
শেরা জানি ওই রাজার আসন মানব জাতির অসম্মান
ওই বাদশাহী তখতের নীচে দীন-ই-ইসলাম শরমে হায়;
এজিদ হইতে শুরু করে আজো কাঁদে আর শুধু মুখ লুকায় ।”

(ঘ)
“ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি
আমরা সেই সে জাতি ।

কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনিক ইসলাম
সত্যে যে চায় আল্লায় মানে মুসলিম তারি নাম।
আমীর ফকীর ভেদ নাই সবে ভাই সব এক সাথী
আমরা সেই সে জাতি ।।”

(ঘ)
“গোলামীর চেয়ে শহিদী দর্জা অনেক উর্ধ্বে জানো
চাপড়াশীর ঐ তকমার চেয়ে তলোয়ার বড় মানো।
আল্লাহর কাছে চেয়োনা কখনও ক্ষুদ্র জিনিস কিছু
আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কাছে শির করিওনা নীচু। “

(ঙ)
“আল্লাহ্ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়। আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।।
আমার কিসের শঙ্কা,
কোরআান আমার ডঙ্কা,
ইসলাম আমার ধর্ম,
মুসলিম আমার পরিচয় ।”

আর উদ্ধতির প্রয়োজন নেই। উদ্ধতিগুলি নিতান্তই ইসলামী ভাবনায় উদ্দীপ্ত এবং নির্ভেজাল ইসলামী সাহিত্যের নিদর্শন। নজরুল ইসলাম ‘ইসলাম’ বলতে এক আল্লায় বিশ্বাস এবং সর্ব মানবে সাম্য ও মৈত্রীর কথা এবং মুসলিম বলতে প্রকৃত সত্য সন্ধানীদের কথা বুঝেছিলেন। সর্বোপরি একমাত্র ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাই যে মানব জাতিকে মুক্তি দিতে পারে, এ বিশ্বাস ও তাঁর ছিল। তিনি স্পষ্টই বলেছেন-“ইসলামের সত্যকার প্রাণশক্তি গণতন্ত্রবাদ সার্বজনীয় ভ্রাতৃত্ব ও সমানাধিকারবাদ ” এ বিশ্বাস না থাকলে তিনি কিছুতেই এমন পূর্ণাঙ্গ মনমাতানো ইসলামী সঙ্গীত এবং ইসলামী জাগরণ মূলক কাব্য-কবিতা লিখতে পারতেন না। তবে মনে রাখতে হবে, একজন কবিকে শুধু সত্য বা ধর্ম কথা বললে চলে না, তার সঙ্গে ছন্দ, অলঙ্কার, উপমা, উৎপেক্ষা ইত্যাদি মিশিয়ে তাকে পরিপূর্ণ ব্যঞ্জনাময় করে তুলতে হয়। সাধারণ পাঠকের পক্ষে সব সময় তার সব কথা বুঝা সম্ভবও হয় না।

তাই তিনি দুঃখ করে বলেছেন, “আমার বিদ্রোহী পড়ে যাঁরা আমার উপর বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তাঁরা যে হাফিজ রুমীকে শ্রদ্ধা করেন এও আমার মনে হয় না।
আমি তো আমার চেয়েও বিদ্রোহী মনে করি তাদের। এঁরা কি মনে করেন হিন্দু দেবদেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে ?

বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দুদের দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুদেরও তেমনি মুসলমানের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের মধ্যে নিত্য প্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাঁদের সাহিত্যে দেখে ভ্রু কোঁচকানো অন্যায়। লাখ-কথার এক কথা।

এতদ্সত্ত্বেও তথাকথিত কাব্য শক্তিকে খর্ব করেও নজরুল মুসলমান সমাজের মুখের দিকে তাকিয়ে অসংখ্য ইসলামী গান রেকর্ড করে প্রচার করেছেন, যা তাঁর ভাষায় ‘আল্লাহর হুকুম’ বলে তিনি মনে করেছেন।

তিনি এ সম্পর্কে অকপটে ঘোষণাও করেছেনঃ

“আমি মুসলিমকে সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য, তাদের জড়ত্ব, আলস্য, কর্ম বিমুখতা ক্লৈব্য, অবিশ্বাস দূর করার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছি। বাঙলার মুসলমানকে শির উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য যে শির এক আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে নত হয়নি-আল্লাহ্, যতটুকু শক্তি দিয়েছেন তাই দিয়ে বলেছি, লিখেছি ও নিজের জীবন দিয়েও তার সাধনা করেছি।”

শুধু কি তাই? তিনি বলছেনঃ

“আমার কাব্যশক্তিকে তথাকথিত খর্ব করেও গ্রামোফোন রেকর্ডে শত শত ইসলামী গান রেকর্ড করে নিরক্ষর তিন কোটি মুসলমানের ঈমান অটুক রাখতে চেষ্টা করেছি।এ আমার আল্লাহর হুকুম ….. আমি তাঁর হুকুম পালন করেছি।

বলা বাহুল্য, তিনি শুধু ইসলামী গানই লেখেন নি, তিনি কুরআনের শেষ খণ্ড আমপারার পদ্যানুবাদও করেছেন। এই পদ্যানুবাদে নাম লিখেছেন ‘খাদেমুল ইসলাম’ বা ইসলামের খাদেম বলে।

তাঁর এই ইসলামের খিদমত কতটা সার্থক হয়েছে আমাদের জানা নেই। তবে সবদিক বিবেচনা করে মনে হয়, তাঁর খিদমত বড় কমও নয়।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *