Revival of Religious Sciences -Al-Ghazali
১.
যেসব আলেম ও দার্শনিকদের প্রভাবে উসমানি-চিন্তার বলয় গড়ে উঠেছে, গাযালি তাদের অন্যতম। পঞ্চদশ শতক থেকেই উসমানি আমলের জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবেশে গাযালি-পাঠ ও প্রসারের উপস্থিতি দেখা যায়। পান্ডুলিপি সংরক্ষণ, অনুবাদ এবং টীকা সংযোজন সহ ব্যাখ্যা ও ক্রিটিকের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ হয়েছে গাযালিকে নিয়ে। আবু হামিদ গাযালির ‘আসাসুল কিয়াসে’র অপ্রকাশিত কপি (মাখতুত) ‘সুলাইমানিয়া’ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ছিল কিছুদিন আগেও। পরবর্তীতে ফাহাদ বিন মুহাম্মাদ সাদহান এটি তাহকিক করে ছেপেছেন। প্রথম সংস্করণ ১৯৯৩ সালে রিয়াদের ‘মাকতাবাতুল আবিকান’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। উসমানি আমলে জ্ঞানচর্চার সিলসিলা নিয়ে শতপ্রশ্ন হারিয়ে যায় শুধু ‘সুলাইমানিয়া গ্রন্থাগারের’ দিকে তাকালে। ইসলামি ঐতিহ্যের বহু দুর্লভ পান্ডুলিপি সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এই গ্রন্থাগারে। সেদিন ‘ফিহরিসু মাখতুতাতিল আরাবিইয়্যা ওয়াল ফারিসিইয়্যা ওয়াত তুর্কিইয়্যাহ ফিল মাকতাবাতিস সুলাইমানিয়া’ নামে একটা কিতাব নজরে পড়ল , তিন খন্ডের কিতাবটি মাহমুদ সাইয়েদ আদদাগিমের লেখা ; এখানে আরবি ফার্সি এবং তুর্কি ভাষার সহস্রাধিক গ্রন্থের তালিকা রয়েছে, যেগুলো সুলাইমানিয়া গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
উনিশ শতকের শেষে , সংষ্কার আন্দোলন শুরু হবার কালেও অনেক উসমানি চিন্তক গাযালির চিন্তায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। যেমন, ঈসমাইল হাক্কি ইজমিরী , মুহাম্মদ আলি আঈনি , মুহাম্মদ হামদি প্রমুখ সবাই চল্লিশের দশকে ইন্তেকাল করেন। তাঁরা সবাই গাযালির চিন্তা ও দর্শনকে ইসলামি চিন্তার পুনর্গঠনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন। বিশেষত, “ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনকে” মুসলিম দর্শন ও বিশ্বাসের সংষ্কারে জরুরি মনে করতেন। উসমানি-চিন্তায় নীতি নৈতিকতা, সুফিতত্ত্ব , দর্শন ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে গাযালির “ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন” ছিল সুত্রমুখ। ফলে ‘জিলবি’র লেখক সহ উসমানি আমলের অনেক চিন্তকের মনোভাব ছিল এমন যে, পৃথিবীর সকল কিতাব-পত্র গোপন করলে, শুধু ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনের দ্বারাই প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে যাবে। ইহইয়া’র প্রচুর তর্জমা হয়েছে উসমানি আমলে, সবচে প্রসিদ্ধ অনুবাদ ছিল শাইখুল ইসলাম বুসতান যাদাহ আফেন্দির ; “ইয়ানাবিউল ইয়াকিন ফি ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন” নামে। ভুমিকা সহ নানাস্থানে শাইখুল ইসলাম ইহইয়ার গুরুত্ব, প্রাসঙ্গিকতা ও সামগ্রিকতা তুলে ধরছেন।উনবিংশ শতকে ইউসুফ আহমদ সিদকী ইহইয়ার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ শেষ করেছেন, বড় বড় ৬ ভলিউমে উসমানি তার্কিশ ভাষায়। ১৮৬৯ সালে অনূদিত কপি দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের হাতে, তবে শেষে তা আর অনূদিত হয়ে আসে নি। তুর্কি সমাজে বহুল আলোচিত মুহাম্মদ আফেন্দি বারকাভির গ্রন্থ ‘আত তরিকাতুল মুহাম্মদিয়া ফিস সিরাতিল আহমদিয়া’ পাঠ করলে গাযালির প্রভাব দেখা যায়, বিশেষত ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনের নীতি নৈতিকতা নিয়ে আলাপের বড় একটা অংশে গাযালি হাজির আছেন। তবে দু’জনের মধ্যে মোটাদাগের তফাত আছে তাসাউফ, বিদয়াত ও সুফিধারা সংশ্লিষ্ট বোঝাপড়ায়।
এছাড়া কিমিয়ায়ে সাআদাত গ্রন্থটিও তুর্কি সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। সুলাইমান কানুনির সময়ে, ষষ্ঠদশ শতকে হিসামুদ্দীন বিন হুসাইন কিমিয়ার একটি অনুবাদ সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে নার্জবিসি যাদাহ মুহাম্মদ আল বুসনাভী চতুর্থ মুরাদের আমলে, সপ্তম শতকে আরেকটা অনুবাদের কাজ করেছিলেন। গাযালির দার্শনিক গ্রন্থাদির মধ্যে ‘তাহাফুতুল ফালাসিফা’র কিছু টিকা সংযোজনের কাজ হয়েছে, ষষ্ঠ শতকে করেছেন কামাল পাশা যাদাহ। আর আলাউদ্দিন তুশি নামের একজন চতুর্থ শতকে বেশ কিছু সংযোজনের কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। গাযালির ‘আইয়ুহাল ওলাদ’ (হে পুত্র) গ্রন্থের তর্জমা করেন মোস্তফা আলি, ষোল শতকে।
২ .
পৃথিবীর অন্যান্য ট্রাডিশনের মতো তুর্কি উসমানি সিলসিলায়ও গাযালির তানকিদ হয়েছে, সমালোচনা করেছেন অনেকে। এই ঘটনা ঘটেছে বিশেষত খেলাফত পতনের প্রাক্কালে, গণতান্ত্রিক উত্থানের সূচনাকালে। সেসময়ের পত্র-পত্রিকা এবং নানান তৎপরতা খেয়াল করলে গাযালি পাঠের দু’মুখী সুরত পরিলক্ষিত হয় – প্রথমত, অনেকে মনে করতেন, গাযালি ইসলামি চিন্তা, দর্শন ও সভ্যতার হন্তারক। গাযালি আদতে সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে হঠাৎই স্তিমিত করে দিয়েছেন। এই প্রথম ব্লকে ছিলেন বিভিন্ন সাংবাদিক ও সংষ্কারবাদি ব্যক্তিরা। যেমন, জালাল নূরী, শামসুদ্দীন কুনালতাঈ। দ্বিতীয়জন ছিলেন উসমানি আমলে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উস্তাদ, গবেষক এবং ঝানু রাজনীতিবিদ। তিনি তাঁর ‘আল ফালসাফাতুল উলা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ইসলামি দর্শনের স্রোত কিন্দি থেকে প্রবাহিত হয়ে ইবনে সিনার এসে যে পাহাড়সম প্রাচীর গড়েছিল, তাহাফুতুল ফালাসিফায় গাযালির নির্দয় আক্রমণে তা ভেঙে পড়ে। দর্শনের স্থানে তাসাউফ রাজত্ব কায়েম করে নিয়েছে। কুনালতাঈ দেখিয়েছেন, গাযালি আদতে ইবনে সিনা ও ফারাবির কাউন্টারের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয়চিন্তা, জ্ঞান ও যুক্তির খেলাফে চলে গেছেন। দ্বিতীয়ত,গাযালি যেমন সমালোচিত হয়েছেন তুর্কি সমাজে, তেমনি তাঁর পক্ষে প্রতি-সমালোচনা গড়ে উঠেছে শক্তিশালীভাবে। সুফিতত্ত্বের পাটাতন থেকে বিশেষভাবে গাযালির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আহমদ হামদি। তিনি মাহফিল পত্রিকায় বেশকিছু প্রবন্ধে সুফিতত্ত্ব , রুহ ও কালামবিদগনের প্রসঙ্গ নিয়ে জরুরি আলাপ করেছেন।এছাড়াও সরাসরি গাযালির পক্ষে লড়েছেন, গাযালির গ্রন্থাদি থেকে নিজস্ব চিন্তার পাটাতন গড়ে তুলেছেন অনেকেই। যেমন, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও চিন্তক, তুর্কি তরুণ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আলি সাওয়াফি ‘উলুম’ পত্রিকায় গাযালিবিরোধী অভিযোগের খোলাসা করে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ; যেগুলো ছেপেছে ‘আর রাদ্দু আলা মান রদ্দা আলাল গাযালি’ (গাযালি-সমালোচকদের সমালোচনা) নামে। তিনি পষ্ট ইশারা করেছেন, গাযালির সমালোচকরা প্রাচ্যবাদীয় প্রভাব থেকে মুক্ত না।
আলি সাওয়াফ খোলাসা করেছেন , অধিবিদ্যা সংশ্লিষ্ট আলাপে গাযালি নিছক মুসলিম দার্শনিকদের বয়ানকে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার নীতিমালা নাকচ করেন নাই। ক্ষেত্রবিশেষে বরং দেখাইছেন যে, মুসলিম দার্শনিকরাই (ইবনে সিনা, ফারাবি) নীতিমালা অগ্রাহ্য করেছে। সুতরাং, এই বয়ান মানা যায় না যে, গাযালির কারণে দর্শন ও মুসলিম সভ্যতার জার্নি থমকে দাঁড়িয়েছে। ফলত গাযালির খেলাফে যেয়েও ইবনে রুশদ যেমন মুসলিম তুরাসের অতি ঘনিষ্ঠ, তেমনি গাযালি ইবনে সিনা ও ফারাবিদের
খেলাফে যেয়ে দর্শনের মুলেই থাকবেন। আরও যারা গাযালির হয়ে লড়েছেন মুহাম্মদ আলি আইনি তাদের একজন, তিনি গত শতকের পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি গাযালি নিয়ে ফরাসি প্রাচ্যবিদ কারা দে ভক্সের কাজগুলো তার্কিশ ভাষায় তর্জমা করেন। তিনিও সচেষ্ট ছিলেন গাযালিকে দর্শন সংশ্লিষ্ট হিসেবে হাজির করায়। এছাড়াও উসমানি আমলের শাইখুল ইসলাম মুসা কাযেম ( মৃত্যু:১৯২০) গাযালির পক্ষে কলম ধরেছেন, তিনি তাহাফুতুল ফালাসিফার বেশকিছু দিক নিয়ে আলাপ তুলেছেন। বিশেষত স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে। এবং এই প্রবন্ধগুলো গ্রন্থাকারে ছেপেছেন।
খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ
লেখক
অনুবাদ
গবেষক