করোনা ভাইরাস আল্লাহর গজব না চৈনিক জীবাণু অস্ত্র এই প্রশ্নের চেয়ে মসজিদে গিয়ে জামাতে সালাত আদায় করা উচিত, নাকি উচিত নয়, এমন প্রশ্ন বর্তমানে মুসলিমদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
করোনা ভাইরাস আক্রমণের ফলে যারা নয়া-উদ্যমে মসজিদে জামাতে অংশগ্রহণ করে নামাজ আদায় করাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন, তাদের যুক্তি হলো, করোনা ভাইরাস আল্লাহর গজব, আর এই গজব এসেছে, জমিনে পাপের বিস্তারের জন্য। ‘আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না।’ এখন এই গজব হতে মুক্তি পেতে হলে, আমাদের ধর্মের পথে ফিরে আসতে হবে, এবং আরো অধিক উদ্যমে, মসজিদে নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করতে হবে। ফলে, আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন এবং এই গজব তুলে নিবেন।
আল্লাহর হস্তক্ষেপেই এই গজবের হাত হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এবং যারা করোনা ভাইরাস বিস্তারের দোহাই দিয়ে মসজিদে জামাতে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করছেন, তারা মূলত জেনে অথবা না বুঝে মসজিদ ও নামাজ বন্ধ করার শয়তানি ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়েছেন। ‘হায়াত মউত রিযিক আল্লাহর হাতে। তাই যখন যেখানে যেভাবে যার মৃত্যু লেখা আছে, তা-ই হবে। আল্লাহই একমাত্র ভরসা।’
খুবই জোড়ালো এবং শক্তিশালী যুক্তি।
এই যুক্তি যারা দিচ্ছেন, সাধারণত তারা আমাদের পিতৃস্থানীয়।
এই অবস্থানের বিপক্ষে যাদের অবস্থান, তারা মূলত নতুন প্রজন্ম, যারা ধর্মীয় আবেগ থেকে নয়, বরং পুরো বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে আগ্রহী। এই পক্ষ মহামারীকালে রসূলের নির্দেশ, সাহাবাদের জীবন থেকে বাস্তব উদাহরণ টেনে, এবং মসজিদ হতে কীভাবে এই মহামারী বিস্তার লাভ করে সেসব দেখিয়ে, মসজিদে এই মুহূর্তে জামাতে নামাজ না পড়ার পক্ষে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করছেন।
এখন তৃতীয়পক্ষ হিসাবে কিছু আলোচনা করা যাক।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণের ফলে এর মরণ ছোবল থেকে বাঁচার আকুতিতে সারাবিশ্বের মানুষের মধ্যে এই মুহূর্তে যে আচরণ ছড়িয়ে পড়ছে, তা হলো, “লা মিসাস” (সূরা ত্বহা-৯৭) মানে, “আমাকে স্পর্শ করো না!”, Toutch me not.
আল-কোর’আনের সূরা ত্বহায় আমরা দেখতে পাই,
হযরত মুসা আ. যখন সিনাই পর্বতে আল্লাহর সাথে একান্ত সান্নিধ্যে ৪০ রাত-দিনের দীর্ঘ সাধনায় লিপ্ত ছিলেন, তখন সামিরি ইয়াহুদীদের মধ্যে মূর্তিপূজার প্রচলন করে। মূসা আ. ফিরে এসে সামিরিকে মূর্তিপূজা প্রবর্তণের ইহকালীন শাস্তি দেন এই বলে যে, সে বাকী জীবন “লা মিসাস”, মানে “আমাকে স্পর্শ করো না!” বলে কাটাবে। অর্থাৎ স্পর্শ এক মহাভীতির কারণ হয়ে উঠেছিলো সামিরির কাছে, যেমন হয়ে উঠেছে বর্তমান বিশ্বের সকলের কাছে।
সামিরির অভিশাপের ধরণের সাথে বর্তমান বিশ্বের মানবজাতির বিপর্যয়ের সাদৃশ্য থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি, বর্তমানে করোনা ভাইরাস আক্রমণ মূলত আল্লাহর গজব এবং তা আল্লাহর সাথে শিরকের শাস্তিরূপে মানবজাতির উপর নেমে এসেছে। কারণ, আল্লাহ অন্যসকল অপরাধ ক্ষমা করলেও তাঁর সাথে শিরকের অপরাধ ক্ষমা করেন না। (সূরা নিসা-৪৮)
আমরা যদি এটি সত্য হিসাবে ধরেও নেই, করোনা ভাইরাস প্রকৃতি থেকে আগত নয় বরং চৈনিকদের ল্যাবে প্রস্তুতকৃত জীবাণু অস্ত্র, তাহলেও এটা আল্লাহর গজব না, এমনটিও বলতে পারি না, কারণ আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান” (সূরা বাকারা-২০)। এবং আল্লাহ মানুষের একদলকে দ্বারা অন্যদলকে প্রতিহত করেন। (সূরা-বাকারা-২৫১)
যদি করোনা মহামারী মানবজাতির উপর শিরকের অপরাধ হিসাবে সামিরির ইহকালীন শাস্তি, “আমাকে স্পর্শ করো না” রূপে নেমে এসে থাকে, তবে মুসলিমরা কেন এর হাত হতে রক্ষা পাচ্ছে না? এমন প্রশ্নের উত্তর কী হবে।
এই প্রশ্নের পূর্বানুমান হলো, মুসলিমরা শিরকে লিপ্ত নয়, তাই শিরক করার অপরাধে তাদের শাস্তি দেয়া যায় না।
এই পূর্বানুমানটি সঠিক নয়। কারণ আল-কোর’আন বলছে, নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখে। (সূরা-আনকাবুত-৪৫), এবং বর্তমানে মুসলিমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করার পরিবর্তে নামাজ পড়ছে, তারমানে হলো, তারা সালাতকে একটি ধর্মীয় আচার হিসাবে অভ্যাসবশত পালন করছে, কিন্তু নিজ ও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন থেকে অশ্লীলতা ও অন্যায়কে প্রতিহত করা বা উচ্ছেদ করার কোন প্রচেষ্টাই পরিচালনা করছে না। কারণ তারা জমিনে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে নিজেদের আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে জুলুমের রাজত্বকে উচ্ছেদের পরিবর্তে, খোদার পাশাপাশি জালিমের পদদলে মাথা ঝুঁকিয়েছে, এবং নিজেদের প্রবৃত্তি ও পার্থিব জীবনের আরাম-আয়েশকে আল্লাহর হুকুম মানার চেয়ে অধিক প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই, সালাত তাদের পরিত্রাণের কারণ না হয়ে অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে (সূরা-মাউন)।
অন্যদিকে, এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে জমিনে নিজেদের আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে এমন কোন মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না, যার ভিত্তি তাকওয়া, যেমনটি হযরত মুহাম্মদ স. মক্কার জুলুমের রাজত্ব হতে ইয়াসরিবে হিজরত করে প্রথমে সার্বভৌম মদিনা রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা করেন, এবং সেখান থেকে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রধানকর্তা হিসাবে নিয়মিত সালাতের জামাতের নেতৃত্ব দিতেন।
কিন্তু যে মসজিদের ভিত্তি এইরূপ তাকওয়া না, তা না কোন মসজিদ, না সেখানে জুম্মা বা কোন সালাতের জামাত বৈধ। (সূরা-হাজ্জ-৪১, সূরা-তাওবা-১০৭-৯)
সুতরাং করোনা ভাইরাসের আক্রমণকালে, মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করা না করার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যে মসজিদে সালাত আদায় করছি, সে মসজিদ কি তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত? আমরা কি জুলুমের রাজত্ব হতে হিজরত করতে পেরেছি, নাকি আল্লাহর সাথে জালিমের জুলুমের রাজত্বকে আমাদের উপর সার্বভৌম ক্ষমতা অর্পণপূর্বক, আল্লাহর প্রতিনিধির গুরুভার প্রত্যাখ্যান করে, শিরকের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছি? ফলে সালাত আমাদের পরিত্রাণের উপায় না হয়ে, অভিশাপের কারণ হয়ে উঠেছে?
লেখক পরিচিতি:
হাবিব রহমান
ইসলামী চিন্তাবিদ
সিনিয়র আইনজীবী – বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট