Kashmir: the case for freedom
যে কাশ্মীর উপত্যকা একসময় এর অসাধারণ অলৌকিক সৌন্দর্যের জন্য সুপরিচিত ছিলো তা আজ দুনিয়ার সব থেকে ঘোর রক্তাক্ত জমিন ও সামরিক দখলদারির কবলে আচ্ছন্ন। পাকিস্থানের সহায়তায় ভারত বিরোধী বিদ্রোহে আশি হাজারেরও অধিক মানুষের লাশ হয়ে যাওয়া এবং খুনের দরিয়ায় পরিণত হওয়া কাশ্মীর আজ ফিলিস্তিন ও তিব্বতকেও অতিক্রম করে গেছে। প্রত্যেক সরকারের আমলে প্রায় সাত লক্ষ ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন করা কাশ্মীরে চলছে অবাধে গ্রেফতার, কারফিউ জারি, রেইড কিম্বা আক্রমণ করা ও চেকপয়েন্ট বসিয়ে জোরপূর্বক হেনস্থা করার মতো ঘটনা । এছাড়াও কাশ্মীর উপত্যকাতে বসবাস করা চল্লিশ লক্ষ মোসলমানকে নিয়মিত বিচার বহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণ ও খুন জখমের মুখোমুখি হতে হয়,এবং এসব করা হয় গোপানাঙ্গে সরাসরি বৈদ্যুতিক শক দেয়ার মত আরো বহু বর্বর ও জাহেলী কায়দায়।
কাশ্মীরে এই অপরিমেয় মানবিক বিপর্যয় দেখেও কেন আমাদের নৈতিক কল্পজগতে কোনো নাড়া না দিয়ে তা অগোচরে পড়ে আছে? সর্বোপরি ভারতের রাষ্ট্রীয় ও সামরিক জুলুমের অবসান ঘটিয়ে কাশ্মীরিদের মুক্তির দাবি জোরালো এবং স্পষ্ট হতে পারে নাই। নির্বাচনে কারচুপি ও বিক্ষোভকারীদের উপর চালানো হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ১৯৮৯ সালের বিদ্রোহকে ভারত সরকার শক্তহাতে দমন করেছিলো। আর আজ সময়ের আবর্তনে কাশ্মীরের শহরের রাস্তাঘাট হাজার হাজার সক্রিয় কাশ্মীরিদের দ্বারা পরিপূর্ণ যাদের সিংহভাগ হচ্ছে যুবক। এর মধ্যে অনেকেই কিশোর এবং সশস্ত্র, যাদের কাছে পাথরের টুকরা ছাড়া অন্যকোনো মরণঘাতী সরঞ্জাম নেই। অথচ ভারত সরকারের হাবভাব দেখে মনে হয় তারা নতুন প্রজন্মের কাশ্মীরিদের কন্ঠস্বর চেপে ধরতে বদ্ধ পরিকর। ঠিক যেভাবে বর্তমান প্রজন্মের পুর্ব পুরুষ ও তাদের বাপ দাদাদের সাথে করেছিল। ২০১০ সালের গ্রীষ্মের মৌসুমে, ভারতীয় সৈন্যরা একশো’য়েরও বেশি বিক্ষোভকারীকে সরাসরি গুলি করে মেরেছে ;যাদের বেশিরভাগ ছিলো কিশোর তরুণ ।
নিউ ইয়র্ক টাইমস কাশ্মিরে চলমান লড়াই ও প্রতিবাদকে পুরোপুরি ইন্তিফাদার মতো জনপ্রিয় বিপ্লব ও গণবিদ্রোহ হিসেবে বর্ণনা করেছে। আরব বিশ্বে ঘটে যাওয়া আরব বসন্তের থেকেও কিংবা ইরানে সংঘটিত হওয়া গ্রীণ মুভমেন্টের চেয়েও কাশ্মীরিদের বিদ্রোহের গণভিত্তি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এর শিকড় অনেক গভীরে। অথচ কোনো পশ্চিমা ভাষ্যকারকে দেখা যায় নাই কাশ্মীরের বিপ্লবকে কোনো রঙচঙ লাগিয়ে ঘোষণা করতে। ইন্ডিয়ান সৈন্যদের হাতে ছোট এক কাশ্মিরী শিশুর মাথায় গুলি করার দৃশ্যটাও বিবিসি কিংবা সিএনএন লুফে নেয় নাই। মৃত লাশ ও ক্ষতবিক্ষত কাশ্মীরিদের পাশে থেকে পশ্চিমা ব্লগার ও টুইটার ব্যবহারকারীরাও ভার্চুয়াল জাগরণ কিংবা আওয়াজ তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি, একশো’য়েরও বেশি নিরীহ কাশ্মীরিদের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘ কোনো জরুরী সভা ডাকে নাই।
এটা খুবই স্পষ্ট যে কাশ্মীরি মুসলমানরা নির্যাতন নিষ্পেষণের শিকার হয়ে খুবই ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত। সাংবাদিক পারভেজ বুখারি বলছেন, বিক্ষোভকারীরা যখন এলোপাথাড়ি পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে, আসলে তা হচ্ছে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ফুঁসে ওঠা ক্ষোভের এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ এবং তারা বুঝতে পারে দুনিয়ার মোড়লেরা তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে। অভিজ্ঞ কাশ্মীরি সাংবাদিক মাসুদ হোসাইন জানিয়েছেন, দুই দশক ধরে নৃশংসতা ও বর্বরতা নিয়ে তিনি যেসব কাজ করেছেন তার সেসব নিরন্তর শ্রমের ফসল সম্পূর্ন নিষ্ফলতায় পর্যবসিত হয়েছে। কারণ, তা দুনিয়ার মোড়লদের বিবেককে একটুখানিও নাড়া দিতে পারেনি। এভাবে কাশ্মীর আজ দুনিয়ার ব্যাপক দমন পীড়নের কাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
কাশ্মীর নিয়ে পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের অতি সাবধানতা অবলম্বন ও ভয়ের কারণ সহজে বুঝা যায়। ইন্ডিয়া হল চায়নাবিরোধী শক্তি । সুতারং ইন্ডিয়ার সাথে কোনোরূপ ঝামেলায় না গিয়ে পশ্চিমা অর্থনীতির জীবনঘাটে যেকোনো ঝুঁকিকে এড়িয়ে চলাই হলো পশ্চিমা কৌশলীদের একধরনের ফ্যান্টাসি। নির্বাচনের এক মাস আগে, বারাক ওবামা ঘোষণা দিয়েছিল কাশ্মীর সংকটের সমাধান করাটা ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে একটি কাজ। কিন্তু নির্বাচনের পর থেকে তাকে আর দক্ষিণ এশিয়ার সকল ঝামেলার মূল কারণ কাশ্মীর সংকট নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে দেখা যায়নি। গত বছর ইন্ডিয়াতে ভ্রমণ করার সময় ডেভিড ক্যামেরুনকেও জনসম্মুখে কাশ্মীর নিয়ে কোনো কথা না বলার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।
যেসব পশ্চিমা পণ্ডিতদেরকে সব সময় গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নিপীড়ক ও জুলুমি শাসন ব্যবস্থাকে তিরস্কার করতে দেখি ,ঠিক তাদের কাশ্মীর বিষয়ে উচিত কথা বলতে যেন জিহ্বায় টান পড়ে। ঐতিহ্যগত ও প্রকৃতিগতভাবে পশ্চিমে রয়েছে উচ্চশিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠী, প্রগতিশীল এবং বহুত্ত্ববাদী যারা জেনুইনলি গণতন্ত্রের জন্য মনেপ্রাণে মরিয়া । সভ্যতা ও বর্বরতার মধ্যকার লড়াই নিয়ে বুদ্ধিজীবি মহল যে ঐশ্বরিক ও কিছুটা রহস্যময় ঘোরে আচ্ছন্ন তা তাদেরকে এই অনুমানের দিকে ধাবিত করেছে যে গণতান্ত্রিক ইন্ডিয়া স্বভাবগতভাবেই উদারবাদী পশ্চিমাদের দোস্ত । সুতরাং পশ্চিমাদের ভাবনাটাই হলো ইন্ডিয়া কাশ্মিরে অবশ্যই সঠিক কাজটা করতে থাকবে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে ইসলামো ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই। ঠিক এভাবেই ক্রিস্টোফার হিচেন্সরা মুসলিম ফ্যাসিজমের কবল থেকে রেহাই পেতে যেকোনো বহুজাতিক গণতান্ত্রিক দেশের সাথে সামরিক জোট গঠন করার জন্য বুশ প্রশাসনকে আহ্বান করতো। এমনকি ইন্ডিয়ার গুজরাটে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটিয়ে দুই হাজারেরও অধিক মুসলমানকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত লোকটার পক্ষে তখনকার নির্বাচিত হিন্দু জাতিয়তাবাদী সরকার সমর্থন যুগিয়েছিল। বহুজাতি ও বহুধর্মের ইন্ডিয়াতে নির্বাচন মার্কা গণতন্ত্র হচ্ছে আধুনিক কালের সব থেকে আজগুবি মার্কা রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ । ত্রুটি ও ব্যর্থতার ফলে যেটার ভঙ্গুর অবস্থা দিনকে দিন আরো বেড়েই যাচ্ছে। এর পরিণতিতে বিবাদমান অসন্তুষ্টি এবং তা দমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। আর ঠিক তখন মানবতাবাদের নামে যুদ্ধ চালানো পশ্চিমের নতুন মোড়লেরা মানুষের প্রতি অবিচার ও তাদের দুঃখ যাতনাকে ভুলে গিয়ে আদর্শিক লড়াইয়ের ক্যানভাস ও ক্ষেত্র তৈরির ছক আঁকতে থাকে।
হিন্দু আধিপত্যবাদীদের দ্বারা কিভাবে ইন্ডিয়ার সেক্যুলার গণতন্ত্র লোপাট হয়ে গেল, ইন্ডিয়ার লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এমনকি জনগণের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে আসল সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার মত এমন নোংরা বাস্তবতা সম্পর্কে এই লেখক বুদ্ধিজিবীরা আরো বেশি অবগত। কিন্তু কাশ্মীর বিষয়ে এই লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা এতোটাই ছললচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে থাকে ঠিক যেভাবে তাদের চাইনিজ বন্ধুরা তিব্বত নিয়ে করে থাকে।
গণতন্ত্রের আবছা ছায়ায় থাকা মানুষেরা তাদের দেশের প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত অঘোষিত যুদ্ধকে স্বীকৃতি দিতে কিংবা বুঝতে গিয়ে কিছুটা সময় নিয়ে থাকে । কিন্তু ১৯৬০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের খুব কম পাবলিক ফিগারই ছিল, জে কে গাল্ব্রেইথ থেকে ফিলিপ রোথ, যারা কোনোরকম চাপাচাপিকে তোয়াক্কা না করে ইন্দোচীন যুদ্ধে আমেরিকার অযৌক্তিকভাবে জড়ানোর জন্য কঠোরভাবে নিন্দা জানিয়েছে । অথচ লাশের তুলনা করলে দুই দশকের থেকেও কম সময়ে কাশ্মীরে প্রায় আশি হাজার মানুষকে খুন করা হয়েছে ;কিন্তু ইন্ডিয়ান লিবারেল বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কলামিস্টদের বিবেকে সেটা তেমন দাগ কাটে নাই।
ইন্ডিয়ানরা হয়তো কাশ্মীর উপত্যকাকে মৌলবাদী মুসলিমদের উপস্থিতি এবং তাদের বিদ্রোহের পাশবিক দিক বিবেচনা করে নিজদেরকে কাশ্মীর বিষয়ে কথা বলা থেকে গুটিয়ে রাখছে। অথচ ২০০৮ সাল থেকে কাশ্মীরিরা ব্যাপক গনজমায়েত করে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ কায়দায় যে প্রতিবাদ করে আসছে এর জন্য তো ইন্ডিয়ানদেরকে তেমন একটা সহানুভুতির বন্যায় ভাসতে দেখা যায় নাই।
নির্বাচনে রেকর্ড করা কারচুপি ও কাশ্মীর উপত্যকাকে ইন্ডিয়ার চালানো নৃশংসতাকে ফোকাস করে ইন্ডিয়ার খুব কম ভাষ্যকারদেরই পাওয়া যাবে যারা একনাগাড়ে কিম্বা জোরালো গলায় এসবের নিন্দা জানিয়েছে। কাশ্মীরিদের আশা আকাঙ্খার কথা না হয় বাদই দিলাম এমনকি যদি এসব সাংবাদিক ও ভাষ্যকাররা কাশ্মীরের সঙ্কট নিরসনের জন্য কিছুটা হলেও আওয়াজ তুলতো কিম্বা কথা বলতো তাহলেও তাদের বিবেকবোধের কিছুটা তারিফ করা যেত । কিন্তু কাশ্মীর উপত্যকার অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভকে আলোকপাত করতে গিয়ে তাদের অনেককেই দেখা যায় খুব নার্ভাস হতে। আমি এখানে কাউকে খোঁচা মারার জন্য কোনো প্রশ্ন তুলছিনা । অমর্ত্য সেন উনার ‘’আর্গুমেন্টিটিভ ইন্ডিয়া’’ বইয়ে কাশ্মির নিয়ে একটা ফুটনোট লিখেছেন। উনি যে কাশ্মীরিদের প্রতি কতটা ভক্তি ও দরদ রাখেন তার প্রমাণ হচ্ছে এতবড় একটা বইয়ে দায়সারা একটা ফুটনোট। হাহা…..। কাশ্মীরিদের প্রেক্ষাপটের সাথে প্রাসঙ্গিক তার আরেকটি বই ‘’আইডেন্টি এন্ড ভায়োলেন্স।‘’ এমনকি এই বইটাতেও কাশ্মির বিষয়কে তিনি জাস্ট একটা ফুটনোটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এই হচ্ছে ইন্ডিয়ার সেকুলার লিবারেল বুদ্ধিজীবিদের আসল সুরুত। ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থা।
দমন পীড়নের পক্ষে ভারতের সেক্যুলার জাতীয়তাবাদীদের সাধারণ যুক্তি হলো, যদি কাশ্মীরি মুসলমানদের প্রতি কঠোরতা না দেখিয়ে ভারত সরকার স্বল্পমাত্রায় হলেও তাদের বাক স্বাধীনতার সুযোগ করে দিতো তাহলে এই সুযোগে কাশ্মীরিরা কট্টর ইসলামিস্ট হয়ে যেতো কিম্বা পাকিস্থানের সাথে আলিঙ্গন করতো। যা কিনা ভারতের উত্তরপূর্ব প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্য উস্কানি কিম্বা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু সেক্যুলার জাতীয়তাবাদীরা কখনো কাশ্মীরে যে ইসলামের বিপ্লবী চিন্তাধারার দীর্ঘমেয়াদী গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তার সুলুক সন্ধান করে নাই । ফলে পাকিস্থানের প্রতি কাশ্মীরিদের ভাবাবেগ হয়তো খামখেয়ালি কিন্তু পাকিস্থানের প্রতি তাদের এই টান একান্তই ভারতীয় সামরিক দখলদারিত্ত্বের কারনে উৎপাদিত ঘৃণার ফসল।
গণবিদ্রোহের উস্কানির দায়ে অরুন্ধতী রায়ের উপর নেমে আসা নির্জন কারাবাসের খড়গ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে, কাশ্মীর নিয়ে ভারতে যে কেউ কোনো খোলাখুলি আলোচনা শুরু করলে তা কেবল হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের রক্তচক্ষুর রোষাণলেই পড়ে না বরং বিল ও’রেইলি এবং শন হ্যানিটির মত আমেরিকান টিভি উপস্থাপকদের অনুকরণ করা ভারতীয় টিভি ও টকশো উপস্থাপকদের কাছ থেকেও প্রচন্ড গালাগালির শিকার হতে হয়। ইন্ডিয়ার কর্পোরেট মিডিয়ার মদদে দাজ্জালীয় মার্কা টিভি উপস্থাপক, পক্ষপাতদুষ্ট সাংবাদিক এবং মতামত বেচে খাওয়া কারবারীরা কাশ্মীরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার আজগুবি, মিথ্যা ও শঠতায় ভরপুর তথ্যকে পুঁজি করে এর সাথে আরো চটকদার কিচ্ছা কাহিনীর গল্প জুড়ে দিয়ে তা নিয়মিত প্রচার করে থাকে। ২০১০ সালে কাশ্মীরে স্বতস্ফুর্তভাবে শান্তিপুর্ণ গনজমায়েতের পর দ্যা ইকোনমিস্ট পত্রিকা দেখিয়েছে কাশ্মীরি জনগন যে ইন্ডিয়া থেকে সত্যিকারার্থে মুক্তি চায় তা এতোদিন আড়ালে চেপে যাওয়া কিম্বা অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়েছে । আর যত দোষ তা কেবল পাকিস্থান ও ইসলামী মৌলবাদীদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। ফলে মূল সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে আড়ালে আবডালে রাখায় পরিস্থিতি ইন্ডিয়া সরকারের জন্য আরো অধিক কঠিন হয়ে উঠছে। এত ঝুট ঝামেলার মধ্যেও রাজনৈতিক দার্শনিক প্রতাপ বানু মেহতা, যিনি কাশ্মীর বিষয় স্বচ্ছ ধারনা রাখা স্বল্প কিছু মানুষদের মধ্যে একজন,তিনি বলেছেন “ইন্ডিয়ান মিডিয়া আসলে কাশ্মীরে যেকোন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের বৈধতাকে অস্বীকার করার পাশাপাশি সরকারের সুরে তাল মিলিয়ে একযোগে কাজ করছে “।
কাশ্মীরিদের উপর এই ধরনের কার্যকরী নিয়ন্ত্রন আরোপ মুলত উদ্বিগ্ন ইন্ডিয়ানদেরকে এই নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে ইকোনমিক পাওয়ার হাউজ ও ভাইব্রেন্ট ডেমোক্রেসীর দেশ হিসেবে সাম্প্রতিক ইন্ডিয়া রাষ্ট্রের যে চটকদার সুনাম এবং যে সুনামের কার্ড ইউজ করে ইন্ডিয়ান এলিটরা পশ্চিমা দেশে স্বতন্ত্র ক্লাবের সদস্য হওয়ার আবেদন করে থাকে তা বিদ্রোহী কাশ্মীরীদের দ্বারা নষ্ট হতে দিবে না। যাইহোক কাশ্মীরের মুল বাস্তবতা হলো প্রচন্ড ক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতার। পারভেজ বুখারী তুলে ধরেছেন কাশ্মীরিরা আসলে ইন্ডিয়ান সাংবাদিক এবং ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক নেতাদেরকে কাশ্মীরিদের কন্ঠস্বর চেপে ধরা ও তাদেরকে নিয়ে ভুল ব্যাখা করার জন্য দায়ী করে থাকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেহতা লিখছেন, লিবারেল ইন্ডিয়ার যে প্রতিশ্রুতি ছিলো তা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরিদের কাছে লিবারেল ইন্ডিয়ার প্রতিশ্রুতি এতটাই ফাঁপা মনে হয়েছে যা কিনা পাকিস্থানের রপ্তানি করা মৌলবাদী ইসলামের থেকেও ভয়ঙ্কর। রাজনৈতিক প্রতারণার শিকার না হয়ে, কাশ্মীরের রাস্তায় তরুণ যুবকদের দেখে মনে হয় তারা রাষ্ট্রীয় নির্মমতার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে চায় এবং রাষ্ট্রীয় জুলুমের কারনে যেসব তরতাজা প্রাণ ঝরে গেছে তাদের স্মৃতি স্মরণ করতে চায় । যেমন কাশ্মীরি লেখক বাশারাত পীর তার ‘লেটার টু এন আননৌন ইন্ডিয়া’ তে লিখেছেন, ইন্ডিয়ান সাংবাদিকরা শহীদ হওয়া বালকের মুখের গড়ন এলোমেলো করে দিয়ে কিম্বা তাদের বাবার বিষাদে ভরা যন্ত্রণার গল্পগুলোকে কাটছাট করে প্রচার করে অথচ অনন্তনাগের যে মহিলার ঘরের সামনে তার সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে আর সে মহিলা নিজ সন্তানদের জমাট রক্ত নিজে ধুয়ে দিচ্ছেন সেই ভিডিও প্রচার করে দেখাতে পারে না। এই হল সাংবাদিকতা । কিন্তু কাশ্মীরিদের কাছে এসব ঘটনার কোনো কিছু অজানা নয়। কারণ চকচকা রঙ্গিন মিডিয়ার ইডিট করা কাশ্মিরকে নয় বরং তারা তাদের রক্তস্রোতের আসল কাশ্মীরকেই প্রতিনিয়ত নিজ চোখের জলে ভাসতে দেখে।
আরেকটু স্মরণ করা যাক। বাশারাত পীর লিখছেন, “অন্য অনেক কাশ্মীরিদের মতো আমিও নিরব থেকেছি। দিনের পর দিন ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনার সাক্ষী থেকে স্মৃতির স্তুপ বানিয়েছি ।” রাস্তার প্রতিবাদী যুবকদের সাথে যোগ না দিয়ে এরকম অনেক আছে যারা বইয়ের পাতায় নাক ঘষে কিম্বা বাধার দেয়াল টপকিয়ে নিপীড়ন নির্যাতন কে বরণ করে। খুব শীঘ্রই এই প্রজন্ম তাদের এসব ট্রমা বহন করার মধ্যে দিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেদের মঞ্জিল ও আবাস বানিয়ে নিবে। রাজনৈতিক জুলুমের অধীনে থেকেও জীবন ও বাস্তবতার পরিবর্তন শুরু হয়েছে। যদিও তা প্রচন্ড তিক্ততা নিয়ে ধীরে ধীরে হচ্ছে। কিছু চিন্তাসম্পন্ন ও শৈল্পিক কাজের ফসল স্বরূপ ২০১১ সালে প্রকাশিত বাশারাত পীরের স্মৃতিকথা নিয়ে লেখা ‘কারফিউ নাইট’ যেটা মুলত মীর্যা ওয়াহিদের অত্যন্ত চমৎকার উপন্যাস ‘দ্যা কোলাবোরেটরের’ আদলে লেখা হয়েছে। এরকম আরো অনেক কাজ আছে যা একের পর এক আসতে থাকবে; কাশ্মীরিরা নিজেরাই নিজেদের জন্য কথা বলবে। যেকেউ শুধু এতটুক আশা করতে পারে যে কাশ্মিরীদের এই আওয়াজ একদিন আমাদের উদাসীনতা ও বেখেয়ালী মনোভাবের মর্মে আঘাত করবে এমনকি মাঝে মাঝে আমাদের বিবেকে গেঁড়ে বসা শ্যাওলার ছাপকেও ফুঁটো করে দিবে ।
লেখক পরিচিতি:
মূল: পঙ্কজ মিশরা
তর্জমা: মামুন আব্দুল্লাহিল
লেখক
চিন্তাবিদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়