কেন কবিতা লিখি
কাব্য রচনা করছি নিজেকে জানার জন্য, ভাষার মারপ্যাঁচ দেখাবার জন্য নয় বা কোন মতবাদ প্রচার করার জন্য নয় । “মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু “। ‘যে নিজেকে চিনেছে সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে । ‘ -তাই আত্মানং বিদ্ধিঃ অর্থাৎ ‘নিজেকে জানা ‘এই-ই হচ্ছে আমার কাব্য রচনার মূল উদ্দেশ্য ।
কে সেই নিজে ? সে নিজেকে চিনবে কিভাবে? মানবিক প্রেম আর বিরোধের রাজ্যে নিজেকে পেয়েছি । সমাজের বিচিত্র মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সংগত-অসংগত বিবিধ অবস্থার মধ্যে নিজেকে দেখেছি । কামনা ,বাসনা , লোভ ,হিংসার বিচিত্র দোলায় নিজেকে দোলায়িত অবস্থায় অনুভব করেছি । মানুষকে বিশ্বাস করে অকৃপণ বর্বরতার আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছি ।
তবে মানুষের পরম সত্যের উপর বিশ্বাস হারাইনি বরঞ্চ এমন সমস্ত মহৎ আত্মার স্পর্শে আমার সত্তা জাগ্রত, উদীপ্ত এবং আলোকিত হয়েছে যে মানবতার মহত্ত্বের উপর বিশ্বাস গাঢ়তর হয়েছে, সমাজের অসংগতির অন্তরালে সংগতির উৎসের সন্ধান পেয়েছি এবং মানবাত্মার কল্যাণ কামনায় অসুন্দরের বিরুদ্ধে জেহাদে লিপ্ত হয়েছি ।
এই জেহাদের মাধ্যমে নিজের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার সন্ধান পেয়েছি, তাই কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে নিত্য নতুনভাবে নিজস্ব সত্তার বিশ্লেষণ ঘটেছে । নাট্যকারের দৃষ্টিভংগীর সাহায্য নিয়ে পরম সত্যের সন্ধানীর বিচিত্র রূপ অবলোকন করেছি । কখনো দেখেছি তাকে সংসার সাধনায় পরাজিত প্রণয়ীর অন্তর্নিহিত বিদ্রোহী আত্মার সাময়িক তীব্র সচেতনতায় এবং চিরন্তন প্রেমের আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতাকেই স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করায়,কখনো দেখেছি এই ব্যর্থতার বন্ধন থেকে সাময়িক মুক্তির প্রসন্নতায়, কখনো বা সমাজের কৌশলপ্রবণ কুচক্রের মধ্যেও প্রকৃতির চিরন্তন রূপের মধ্যে চিরসত্যের অপূর্ব বিকাশে । আর সর্বত্রই পেয়েছি তাকে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে, আসফালা সাফেলীনের রাজ্য পার হয়ে স্বপ্নসিদ্ধ মদিনায় হিজরত করার তীব্র আকুতিতে ।
এই আকুতি আর তার সফলতার মধ্যেও অপরিপূর্ণতার আক্ষেপ ভাষা ছন্দ এবং রূপকল্পের সাহায্যে কল্পলোক রচনার ভিতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি এবং বাস্তবজগৎ থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যের রূপচিত্তের মাধ্যমে তার সন্ধান পেয়েছি । বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন কৃষ্টির সংগে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ভাষায় বিচিত্র রূপকল্প, প্রতীক এবং ছন্দদ্যোতনায় একই মানব সত্যের বিবিধ প্রকাশ দেখে আমার অন্তরাত্মা কখন যে কি আহরণ করেছে তা আমিই জানি না । কাব্য রচনার সময় সংগুপ্ত চেতনার সেই আহরিত সম্ভার থেকে কে বা কারা আমাকে প্রতীক, চিত্র রূপকল্প বা বাক্যভংগীর জোগান দিয়েছে তা বলতে পারি না । কিন্তু সবকিছুই আমার ইসলামী সত্তার ভিয়ানে সমন্বিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ,অতীত এবং বর্তমান, শাহনামা এবং ইলিয়াড, শেক্সপীয়ার এবং রবীন্দ্র- নজরুল, গংগা- যমুনা এবং নীল ইউফ্রেতিস এবং পদ্মা মেঘনা বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষি এক সাধনপথের পথিক-হৃদয়ে তাজমহলের সৌন্দর্য এবং সৌকর্য দিয়েছে । বাংলাদেশ যেহেতু আর সংকীর্ণ পরিমণ্ডলের মধ্যে বন্দী নয় ,বাংলাভাষার আত্মাকেও বিশ্বের বিবিধ কৃষ্টি সম্পর্কিত ভাষার মুক্তাংগনে বিচরণের স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজনীয়।তবু আমার নিজস্ব সত্তার ঐতিহ্য যেহেতু মূলত বাংলাভাষার প্রাচীনতম ঐতিহ্যের সংগে সংশ্লিষ্ট অথচ মুসলিম তহজিব তমুদ্দীনগত ঐতিহ্যের মূল চরিত্র দ্বারা বর্ধিত ,গঠিত এবং পরিপুষ্ট, তাই আমার লেখনী স্বাভাবিকভাবেই ভাষার মাধ্যমে সবকিছুর সমন্বয় সাধন করেছে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ।
এই সমন্বয়সাধন করার জন্য ইচ্ছাপূর্বক কোন চেষ্টাই আমি করিনি । যতই আমি চেষ্টা করেছি আল্লাহর পথে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করার জন্য ততই আমি বাধ্য হয়েছি ধৈর্যধারণ শিক্ষা করতে ,ততই মিথ্যা থেকে, অন্যায় থেকে,ঈর্ষাদ্বেষ থেকে পরহেজ করার জন্য অর্থাৎ সত্যিকার মানুষ হওয়ার মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার জন্য এবং নিজের কর্মপথে সেই মূল্যকে রূপায়িত করার জন্য ।যেহেতু এই ধর্ম -নির্ধারিত মূল্যবোধ চিরন্তন, সার্বজনীন এবং সমস্ত কৃষ্টির মূলে,হয়ত সেইজন্যই আমার অন্তরাত্মায় এক স্বাভাবিক সমন্বয় সাধিত হয়েছে এবং আমার ভাষায় এবং ছন্দে তারই প্রতিফলন পেয়েছি ।
তবে এ সমন্বয় কোন নতুন সমন্বিত কৃষ্টির সৃষ্টি করেনি । এই সমন্বয় আরো দ্রুতবেগে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে ইসলামের নির্দিষ্ট পথে । কারণ সে পথেই নিজের মুক্তির সন্ধান পেয়েছি , মানবিকতার চরম উৎকর্ষ উপলব্ধি করেছি,এবং হৃদয় সন্দেহচিহ্নিত সম্ভাবনার জগৎ পার হয়ে স্থির দৃঢ় কীটের জগতে উত্তীর্ণ হয়েছে । সেই জগৎকেই, সেই অনুভূতিকেই সেই নতুন উপলব্ধিকেই প্রকাশ করার নতুন ভাষা ,উপমা, প্রেক্ষা, প্রতীক,ছন্দের সন্ধান করেছি । বাধ্য হয়েই সম্পূর্ণ নতুন প্রতীক সৃষ্টি করেছি । উদ্দেশ্য পাঠকের মনেও যেন এই অভিজ্ঞতা সত্তা দোলা জাগায় এবং সে বুঝতে সক্ষম হয় কিভাবে এক এক অবস্থা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে একটি মানুষ এই অবস্থায় উপনীত হয় । ভাষা ও ছন্দের মাধ্যমে মানবাত্মায় সেই অনুভূতিজাত সচেতনতা জাগিয়ে তোলার জন্যই আমার কাব্য প্রয়াস ।
সৈয়দ আলী আশরাফ
সূত্র:
সকাল পত্রিকা
সৈয়দ আলী আশরাফ বিশেষ সংখ্যা “৯৭
সম্পাদক – ইশারফ হোসেন