Shah Waliullah Dehlawi

শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির চিন্তাধারা কেউ যদি গভীর মনোযোগ সহকারে পড়েন, তাহলে মোটাদাগে কয়েকটি জিনিস চোখে পড়বে :

(ক)
পবিত্র কোরআন একটি বৈপ্লবিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দেয়। এই বৈপ্লবিক ব্যবস্থায় সারা দুনিয়ার ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ শামিল। কেয়ামতের আগ মুহূর্তেও মুসলমানদের কোনো দল যদি সেই ব্যবস্থা কায়েম করে, তখনও তারা মুসলমানদের প্রথম প্রজন্মের মতো সফলতার মুখ দেখবে। এটা কোরআনের প্রভাব, কোরআনের মোজেজা, এই প্রভাব কোনো ব্যক্তিবর্গ ও নির্দিষ্ট যুগের জন্য নয়, বরং কেয়ামত অবধি প্রত্যেক যুগের জন্য সমান কার্যকর।

খ্রিষ্টীয় দুনিয়া কোরআনের এই প্রভাবকে সাদামাটাভাবে দেখার জন্য এবং বিপথগামী করার জন্য সদা তৎপর। প্রসিদ্ধ খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক ও গবেষক জরজি জায়দান তো একদম পরিষ্কারভাবে লিখেছেন— ‘হজরত আবু বকর ও হজরত ওমরের (রা) খেলাফত তো ঘটনাক্রমে কিসমতে লেগে গেছিল।’ মানে তিনি বলতে চান, মুসলমানদের প্রথম প্রজন্মের বিশ্বব্যাপী জয়জয়কার কোরআনি শিক্ষার প্রভাবে নয়, বরং এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যার ফলে এই ঘটনা ঘটেছিল, দ্বিতীয়বার আর এমন ঘটার সম্ভাবনা নাই। এসব কথা ছাড়াও কোরআনের প্রভাবকে ছোট করে দেখানোর জন্য তারা নানা কিসিমের তত্ত্ব-অস্ত্র ব্যবহার করে।

মুসলমানদের অনেক গবেষক ও তাত্ত্বিকও একই সুরে কথা বলে। তারা বোঝে বলুক কিংবা না বোঝে, খ্রিষ্টীয় প্রোপাগান্ডা ঠিকই মুসলমানদের মস্তিষ্কে এই ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, কোরআন অনুযায়ী বৈপ্লবিক ব্যবস্থা কেবল আল্লাহর রসুল এবং কেবলই আল্লাহর রসুলের মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যদি ভবিষ্যতে কখনো এমন ব্যক্তিত্ব জন্ম নেন, তখনই কেবল সম্ভব হবে বিপ্লব করা। আর একারণেই মুসলমানদের একটি বড় দল ইমাম মাহদির অপেক্ষায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে।

(খ)
কোরআনি শিক্ষার প্রভাবে মুসলমানদের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের জন্ম, আল্লাহর রসুলের (স) আগমন থেকে শুরু করে হজরত ওসমানের (রা) শাসনকালের প্রকৃত ইতিহাস, কোরআনের কার্যত বাস্তবায়নের নিয়মাবলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া জরুরি।

আল্লাহর রসুল (স) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তারপর মদিনাতেই ইসলামের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা হয়। আল্লাহর রসুলের (স) ইন্তেকালের পর হজরত আবু বকর, ওমর ও ওসমান (রা) মদিনাকেই বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে রাখেন। তারপর মুসলমানদের মধ্যে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, হজরত আলী (রা) রাজধানী মদিনা থেকে সরিয়ে কুফায় স্থানান্তর করেন। উমাইয়ারা ক্ষমতালাভের পর রাজধানী সরিয়ে নেন দামেশকে। কিন্তু ধর্ম ও চৈতন্যলাভের কেন্দ্রভূমি তখনও মদিনাই ছিল। এই জন্যেই কোরআনের প্রভাবে যেসব ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠাকরণ হয়েছে, তার ভিত্তি ও সূতিকাগার মদিনাই ছিল, এবং মদিনাবাসীরাই এইসব শিক্ষা সংরক্ষিত রেখেছেন। পরবর্তীতে ইমাম মালেক (র) তার মুয়াত্তায় এসব লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

(গ)
هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰى وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَى الدِّیْنِ كُلِّهٖ١ۙ وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ

‘আল্লাহই তার রসুলকে সুস্পষ্ট পথনির্দেশ ও সঠিক জীবনবিধান সহকারে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি এই বিধানকে (দুনিয়ার) সবকয়টি বিধানের ওপর বিজয়ী করেন, মুশরিকরা একে যতই অপছন্দ করুক না কেন।’ (সুরা তওবা : আয়াত ৩৩) এই আয়াতে সমস্ত ধর্ম ও বিধিবিধানের ওপর বিজয়ের যে দাবি করা হয়েছে তা খেলাফতে রাশেদা ও মুসলমানদের প্রথম প্রজন্মেই পূরণ হয়ে গেছে এমন ধারণা সম্পূর্ণই ভুল। কোরআনের এই দাবি প্রত্যেক যুগেই বাস্তবায়ন হতে পারে, যদি মানুষ কোরআনওয়ালা হয়, আর এর জন্য কোনো নবী বা বুজুর্গের জন্য অপেক্ষারও প্রয়োজন নাই।

(ঘ)
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য লাভের জন্য চারটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের শর্ত দিয়েছেন :
(১) তহারাত বা পবিত্রতা।
(২) ইখবাত বা পরমসত্তার সাথে মিলনের নিবিষ্টতা।
(৩) সামাহাত বা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত রাখবার শক্তিমত্তা।
(৪) আদালাত বা ইনসাফ কায়েম করা।

এই চার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য বা কেন্দ্র হলো ‘ইনসাফ কায়েম করা।’ আর কোনো সমাজে ততক্ষণ পর্যন্ত ইনসাফ কায়েম করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না শ্রমিকের ওপর শ্রমমূল্যের চেয়ে বেশি শ্রম চাপিয়ে দেওয়ার নিয়ম ভেঙে চুরমার করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া না হয়। একারণেই কোরআনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল রোমসম্রাট ও পারস্যরাজের তখত মিসমার করে কোরআনি ব্যবস্থা কায়েম করা, যাতে সারাবিশ্বের সব জাতি এই অসাম্যের মুসিবত থেকে মুক্তি পায়।

ঙ)
কোরআনের বৈপ্লবিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ আল্লাহর রসুল (স) এবং তাঁর সঙ্গে হিজরতকারী সাথীবর্গ ও তাঁকে সহায়তাকারী মদিনাবাসীর জীবন-সংগ্রামকে নিজের জীবনগঠনের পথপ্রদর্শক বানানো।

মুসলমানদের মনে বিপ্লবের হাওয়া যোগাতে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি আরবি ভাষা শিক্ষা ও আরবদের ইতিহাস জানাকে ভিত্তিমূল বানিয়েছিলেন, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আহাম্মক আরবরা আরবে জাহেলি যুগ ফিরিয়ে আনার নর্তনকুর্দন করলেও আমরা তাদের অনুসরণ করব।

শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির চতুর্থ মূলনীতি— ‘কোনো সমাজে আদল ও ইনসাফ কায়েম করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না শ্রমিকের ওপর শ্রমমূল্যের চেয়ে বেশি শ্রম চাপিয়ে দেওয়ার নিয়ম ভেঙে চুরমার করা না হয়।’[১]— আমি এই কথার উদ্দেশ্য ইউরোপে গিয়ে সমাজতন্ত্র নিয়ে পড়বার আগে বুঝিনি। যাদের সাহায্যে আমি সমাজতন্ত্র নিয়ে পড়েছি, তাদের প্রায় সবাই কার্ল মার্কসের অনুরাগী। তারা যেভাবে শ্রদ্ধাভরে মার্কসের নাম ও মার্কসীয় অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন, আমার খুব কষ্ট হতো, কারণ এই অর্থব্যবস্থার কথা বহু আগেই শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি তার কিতাবে লিখে গেছেন। মার্কস তো সেদিনের, শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি মার্কসের জন্মেরও ৫৫ বছর আগে ইন্তেকাল করেন।

টীকা :
[১] হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, অধ্যায় : সিয়াসতুল মদিনা

মূল: মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি
তর্জমা : মওলবি আশরাফ
লেখক
অনুবাদক
গবেষক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *