আমরা যে বিশ্বে বাস করি, তার চরিত্র ও স্বরূপ কী? এ বিশ্বচরাচরের আবয়বী সংগঠনে কি কোনো নিত্যস্থায়ী উপাদান আছে? আমাদের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? আর আমরা এ জগতের যে স্থানটি অধিকার করে আছি, আমাদের কোন ধরনের কাজ তার উপযুক্ত? ধর্ম,দর্শন এবং উচ্চাঙ্গের কাব্যের এটাই হলো সাধারণ জিজ্ঞাসা। কিন্তু কাব্যিক প্রেরণা যে জ্ঞানের আলো দান করে, তার প্রকৃতি একান্তই ব্যক্তিগত, আর এই জ্ঞান রূপক,অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। ধর্ম তার অধিকতর প্রাগ্রসরচিন্তার জন্য কাব্যকে অতিক্রম করে এবং ব্যক্তির গণ্ডি ছাড়িয়ে সমাজের গণ্ডিতে উপনীত হয়।পরম সত্যের প্রতি এর যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে ধর্ম মানুষের সসীমতাকে অস্বীকার করে এবং মানুষের সেই দাবিকে বাড়িয়ে দেয় এবং এ সম্ভাবনাকে মেনে নেয় যে মানুষ সেই সত্যের নিকটবর্তী হতে পারে। তাহলে জিজ্ঞাসা, দর্শনের নিছক যুক্তিবাদ ধর্মে প্রয়োগ করা চলে কি না?
দর্শনশাস্ত্রের মোদ্দা কথাই হচ্ছে মুক্ত জিজ্ঞাসা। যাবতীয় সনাতন বিধিনিষেধের কর্তৃত্বকে দর্শন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। মানুষের চিন্তাজগতে যেসব অন্ধ ধারণা থাকে, সেসব ধারণার গোপন উৎস ও আশ্রয়স্থানগুলো খুঁজে বের করাই দর্শনের কাজ। এভাবে খোঁজ করতে করতে দর্শন এ সিদ্ধান্তেও উপনীত হতে পারে যে পরম সত্য বলে আদৌ কিছু নেই; আর যদি বা থাকে, তবে নিছক যুক্তির মাধ্যমে তাকে বুদ্ধিগোচর করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে ধর্মের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে ইমান; বুদ্ধির মোহমুক্ত এই ইমান পাখির মতো তার সামনে চেয়ে দেখে বন্ধনহীন পথ । ইসলামের মহান মরমি কবির ভাষায়, বুদ্ধি মানুষের জীবন্ত চিত্তের পথ আগলে সে তার অন্তর্নিহিত অদৃশ্য সম্পদ কেড়ে নেয়। তথাপি এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইমান নিছক অনুভূতির চেয়ে বড়। ইমানে খানিকটা জ্ঞানাত্মক উপাদানও রয়েছে।ধর্মের ইতিহাসে বুদ্ধিবাদী ও মরমবাদী—এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অস্তিত্ব দ্বারা প্রতিপন্ন হয় যে ধর্মের যা মূল বস্তু, আইডিয়া হচ্ছে তার অন্যতম। এ ছাড়া অধ্যাপক হোয়াইটহেডের সংজ্ঞানুযায়ী ধর্ম তার মতবাদের দিক দিয়ে কতগুলো সাধারণ সত্যের বিন্যাস—যা অকপটভাবে পালন এবং তীব্রভাবে অনুধাবন করলে চরিত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এখন যেহেতু ধর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ভেতর ও বাইরের জীবনপ্রবাহের রূপায়ণ ও নিয়ন্ত্রন, সে জন্য ধর্মের মূল সাধারণ সত্যগুলো সম্বন্ধে কোনো কিছু অমীমাংসিত না থাকা একান্ত প্রয়োজনীয়। অন্যথায় সংশয়যুক্ত নীতির ওপর ভিত্তি করে কেউই জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হতে সাহস পেত না।
বস্তুত ধর্মের যা আসল কাজ, সে হিসেবে তার মূলনীতি বিজ্ঞানের নীতির চেয়েও দৃঢ়তর যুক্তির ওপর সংস্থাপিত হওয়া আবশ্যক। বিজ্ঞান যুক্তিবাদী তত্ত্বদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান এ-ই এত দিন করে আসছে। মানুষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় যেসব দ্বন্দ্ব দেখা যায়, তাদের সমন্বয় ও সামঞ্জস্য সাধনের চেষ্টাকে ধর্ম উপেক্ষা করতে পারে না। আর যে পরিবেশের মধ্যে মানুষকে জীবন যাপন করতে হয়, তারও সমর্থন না করে পারে না। সে জন্যই সূক্ষ্মদর্শী অধ্যাপক হোয়াইটহেড মন্তব্য করেন : ধর্মের যুগ যুক্তিবাদের যুগ।’ কিন্তু ধর্মকে যুক্তির গণ্ডিতে নিয়ে আসার অর্থ এই নয়, দর্শনের স্থান ধর্মের উর্ধ্বে বলে স্বীকার করা। ধর্মকে বিচার করার অধিকার দর্শনের আছে বটে; কিন্তু ধর্ম-ব্যাপারে দর্শনের যা বিচার্য তার প্রকৃতি এমন যে সে বিষয়কে কেবল ধর্মের নিজ শর্ত মোতাবেকই বিচার করা চলে, অন্য কোনো পথে তা দর্শনের আওতায় আসে না। ধর্মের বিচারকালে দর্শন তার তথ্যসমূহের মধ্যে ধর্মকে নিরন্তর স্থান দিতে পারে না।ধর্ম কোনো বিভাগ-বিশেষের ব্যাপার নয়, ধর্ম সমগ্র মানুষেরই একটি অভিব্যক্তি। কাজেই ধর্মের মূল্য নির্ধারণে দর্শনকে স্বীকার করতেই হবে যে ধর্মই সকলের কেন্দ্রস্থল এবং চিন্তাজগতে সমন্বয় সাধনের চেষ্টায় ধর্মকে কেন্দ্রবিন্দু গণ্য করা ছাড়া দর্শনের গত্যন্তর নেই। আবার চিন্তা ও সংজ্ঞাকে পরস্পরবিরোধী ভাববারও কোনো কারণ নেই। একই মূল থেকে উভয়ের উৎপত্তি এবং উভয়ে পরস্পরের পরিপূরক। এদের একটি সত্তাকে খণ্ড-খণ্ডভাবে উপলব্ধি করে আর অপরটি করে সমগ্রভাবে। ধর্ম তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সত্তার চিরন্তন রূপের ওপর, আর দর্শন তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সত্তার অনিত্য রূপের ওপর । ধর্ম চায় সমগ্র সত্তার আশু উপলব্ধি, আর দর্শন চায় সমগ্র সত্যকে উপলব্ধির জন্য তাকে ধীরে-সুস্থে খখণ্ডভাবে পর্যবেক্ষণ করতে। উভয়েই নৰ নৰ শক্তি সঞ্চয়ের জন্য পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। উভয়েই একই সত্তার দর্শন অভিলাষী, যা তাদের জীবনের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে তাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে। বার্গস যথার্থই বলেছেন যে স্বজ্ঞা অন্য কিছু নয়-তা হলো উন্নত ধরনের বুদ্ধি।
ইসলামের মতবাদসমূহ যুক্তির দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার যে সাধনা, তা শুরু হয় স্বয়ং রাসুলুল্লাহর সময় থেকে। তিনি অহরহ প্রার্থনা করতেন; আল্লাহ! সব জিনিসের চরম স্বরূপ সম্পর্কে আমায় জ্ঞান দাও।’ এরপর আসেন পরবর্তী যুগের মরমি ও অমরমি যুক্তিবাদীগণ। এঁদের সাধনার অবদানে ইসলামের তামদ্দুনিক ইতিহাসের এক পরম শিক্ষণীয় অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের ভাবধারাসমূহ সুসমঞ্জস্য ও সুসংবদ্ধ করতে এরা একাগ্রভাবে চেষ্টা করেছিলেন। এঁদের সাধনার কথা চিন্তা করলে বিস্মিত হতে হয়। এদের লেখার মধ্যে একটি অকুণ্ঠ নিষ্ঠা যেমন প্রকাশ পেয়েছিল, তেমনি সে যুগের দোষত্রুটিও প্রকাশ পেয়েছিল। এর ফলে সে যুগে যেসব ধর্মীয় আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল, তার কোনোটিই সম্যক ফলপ্রসূ হতে পারেনি।
আমরা সবাই জানি, মুসলিম তমদ্দুনের ওপর তখন গ্রিক-দর্শন একটা বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু আমরা যদি সতর্কতার সঙ্গে কোরআন এবং গ্রিকদর্শন প্রভাবিত বিভিন্ন ধর্মমতের আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে গ্রিকদর্শন একদিকে মুসলিম চিন্তানায়কদের দৃষ্টিভঙ্গিকে যেমন বহুল পরিমাণে প্রসারিত করেছিল, অন্যদিকে কোরআন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিকে রেখেছিল তেমনি আচ্ছন্ন করে। সক্রেটিসের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল শুধু মানবজগতের ওপর। তাঁর কাছে মানুষের বিচারই ছিল মানুষের স্বরূপ বোঝার প্রকৃষ্ট উপায়। মানুষের মহিমা বিচার করতে তিনি গাছপালা, কীটপতঙ্গ এবং গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করেননি। সত্যি, কোরআনের সঙ্গে এ দৃষ্টিভঙ্গির কী আকাশ-পাতাল পার্থক্য! একটি ক্ষুদ্র মধুমক্ষিকার মধ্যেও কোরআন দেখতে পায় এক ঐশী প্রেরণার আধার। পাঠকদের উদ্দেশে কোরআন প্রতিনিয়ত এই তাগিদ দিচ্ছে : ‘তোমরা বাতাসের নিরন্তর গতি পরিবর্তন ও দিন-রাত্রির নিয়মিত আবর্তন লক্ষ করো; বিচিত্র মেঘমালা, নক্ষত্রখচিত আকাশ ও অসীম শূন্যে সঞ্চরমাণ গ্রহসমূহ অবলোকন করো।’ যেমন ছিলেন সক্রেটিস, তেমনি ছিলেন তার শিষ্য প্লেটো । ইন্দ্রিয়-অনুভূতির ওপর ছিল তাঁর গভীর অবজ্ঞা। তাঁর মতে, ইন্দ্রিয়-অনুভূতির দ্বারা শুধু কতকগুলো ধারণারই সৃষ্টি হতে পারে, সত্যিকারের কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয় ।
কিন্তু কোরআন বলেছে কী? আল্লাহর দানসমূহের মধ্যে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তিই হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান। দুনিয়াতে এরা যা কিছু করবে, তার জন্য আল্লাহর কাছে এদের জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু গোড়ার দিকের মুসলমানরা কোরআন পাঠ করলেও কোরআনের এই ভাবাদর্শ তাদের মর্মগোচর হয়নি। আর হবেই বা কী করে? গ্রিক চিন্তাধারা তাদের ওপর এত দূর প্রভাব বিস্তার করেছিল যে গ্রিক চিন্তার আলোকে তারা কোরআন পাঠ করত। কোরআন যে মূলত প্রাচীন মতবাদসমূহের বিরোধী, মুসলমানদের এই সত্য সম্যক উপলব্ধি করতে ২০০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল। যদিও সে উপলব্ধি সম্যকরূপে স্পষ্ট ছিল না, তবু এতেই মুসলমানদের মনন-জগতে দেখা দিয়েছিল একটা বিদ্রোহ। অবশ্য আজ পর্যন্তও সে বিদ্রোহের মর্ম পূর্ণরূপে উপলব্ধ হয়নি। কতকটা এই বিদ্রোহের জন্য এবং কতকটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে গাজ্জালি ধর্মকে দার্শনিক সংশয়বাদের ওপর স্থাপন করলেন, যা ধর্মের জন্য নিরাপদ ভিত্তি নয় এবং কোরআনের মর্মাদর্শ যা অনুমোদন করে না। গাজ্জালির প্রধান বিরেধী ছিলেন ইবনে রুশদ। ইবনে রুশদ এই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গ্রিক-দর্শনকে সমর্থন করলেন। অ্যারিস্টটলের মতবাদের দ্বারা তিনি এতখানি প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন যে জগৎ আত্মার অবিনশ্বরতার মতবাদেও তিনি বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন।
এই মতবাদ একসময় ফ্রান্স ও ইতালির মনন-জগতের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, মানবাত্মার মূল্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে কোরআনের যে অভিমত, এটা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কাজেই ইসলামের একটা মহান ও ফলন ভাবাদর্শ ইবনে রুশদের কাছে অনধিগম্যই রয়ে গেল এবং ভুল করে তিনি এমন একটি নিস্তেজ জীবন-দর্শনের উদ্ভবে সাহায্য করলেন, যা মানুষকে তার নিজের, তার স্রষ্টার এবং বিশ্ব সৃষ্টি সম্বন্ধে অন্ধ করে রাখে। আশয়ারি চিন্তানায়কদের মধ্যে যারা ছিলেন অপেক্ষাকৃত সৃষ্টিধর্মী, তারা নিঃসন্দেহে সঠিক পথেই ছিলেন, এবং ভাববাদের কতগুলো অপেক্ষাকৃত আধুনিক রূপের আভাসও তাদের দর্শনে পাওয়া যায়। তবে মোটের ওপর আশয়ারিদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল গ্রিক যুক্তিতর্কের সাহায্যে শুধু গোড়া সনাতন মতবাদসমূহকে সমর্থন করা আর মুতাজিলাদের ধারণায় ধর্ম ছিল শুধু কতকগুলো নীতিবাদের সমষ্টি। ধর্মকে তাঁরা একটা প্রাণবন্ত বাস্তব হিসেবে কিছুতেই গ্রহণ করতে চাইলেন না। পরম সত্তায় পৌঁছাতে চিন্তার অতীত যেসব উপায় রয়েছে, সেসবের দিকে তারা খেয়ালই করলেন না। ফলে তাঁদের হাতে ধর্ম শুধু কতকগুলো যুক্তিসর্বস্ব ধারণায় পর্যবসিত হলো। এবং ধর্মের প্রতি তাঁদের যে মনোভাবের সৃষ্টি হলো, তা ধর্মের প্রতি নিছক আস্থাহীনতারই শামিল। জ্ঞানের রাজ্যে তা বিজ্ঞানেরই হোক বা ধর্মেরই হোক বাস্তব অভিজ্ঞতাকেই সম্পূর্ণ বর্জন করে চিন্তা যে সম্ভব নয়, তা তাঁরা বুঝতেই পারেননি। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে জার্মান দার্শনিক কান্টের মতো গাজ্জালির ব্রতও প্রায় বাণী-বাহকের ব্রতের সমতুল্য ছিল।
আমরা জানি, জার্মানিতে যুক্তিবাদের উদ্ভব হয়েছিল ধর্মের সহায়ক হিসেবে। কিন্তু যুক্তিবাদী দর্শন অচিরেই বুঝতে পারল যে ধর্মের যেটা বিধি-ব্যবস্থার দিক, সেটা কার্যত প্রমাণ করা যায় না। কাজেই সে দর্শনের পক্ষে ধর্মশাস্ত্রের ডগমাভিত্তক বিধিব্যবস্থাগুলোর একেবারে পরিহারের পথই শুধু খোলা ছিল। আর ডগমাকে বিদায় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক বিধান সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখা দিল। তাকে হিতবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলা চলে। এভাবে যুক্তিবাদ ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করা দূরের কথা, অবিশ্বাসের রাজত্বকেই তুলল কায়েম করে। জার্মানিতে ধর্মীয় চিন্তার এই অবস্থা, তখনই হলো দার্শনিক কান্টের আবির্ভাব। তিনি লিখলেন ক্রিটিক অব পিয়র রিজন নামক একটি অমর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি দেখালেন যে মানুষ যে যুক্তির এত বড়াই করে, তার ক্ষমতা একান্ত সীমাবদ্ধ। তার সমালোচনার ফলে যুক্তিবাদীদের সমস্ত যুক্তি ও সিদ্ধান্ত ধূলিসাৎ হয়ে গেল। কাজেই কান্টকে তার দেশের প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম দান বলে আখ্যায়িত করা খুবই ঠিক হয়েছে।
ইসলামি জগতে ইমাম গাজ্জালির দার্শনিক সংশয়বাদও অনুরূপ বিপ্লবাত্মক। জার্মানির কান্ট-পূর্ব যুগের ন্যায় ইসলাম জগতেও যুক্তিবাদ এমন একটা রূপ নিয়েছিল, যার মূলে ঔদ্ধত্য ছিল প্রচুর, কিন্তু গভীরতা ছিল না আদৌ। এহেন যক্তিবাদের মূলে ইমাম গাজ্জালি হানলেন দুর্বার আঘাত। তবু ইমাম গাজ্জালি ও কান্টের মধ্যে রয়েছে একটা মস্ত পার্থক্য। কান্ট আল্লাহ সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞানের সম্ভাবনাকে স্বীকার করতে পারেননি। এর জন্য দায়ী তার অনুসৃত চিন্তাপদ্ধতি। গাজ্জালি দেখলেন যে যুক্তিতর্ক বা বিশ্লেষণী চিন্তার দ্বারা আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভের আশা বৃথা । তাই তিনি শুষ্ক চিন্তার সাহারা থেকে মরমিসুলভ অভিজ্ঞতার বাগিচায় হিজরত করলেন। সেখানে তিনি ধর্মের স্বাধীন সত্তার সন্ধান পেলেন। এই রূপে তিনি বিজ্ঞান ও তত্ত্বশাস্ত্রের নির্ভরতা ছাড়াই ধর্মের বেঁচে থাকার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ইমাম গাজ্জালি তাঁর মরমি অভিজ্ঞতার আলোতে প্রত্যক্ষ করলেন গোটা অসীমের রূপ । এই থেকে এই ধারণা তাঁর মনে শিকড় গেড়ে বসল যে মানুষের চিন্তাশক্তি একান্ত সীমাবদ্ধ, তা কোনো চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে অসমর্থ। তাই তিনি চিন্তা এবং স্বজ্ঞার মধ্যে টানলেন একটা স্পষ্ট বিভেদরেখা। কিন্তু চিন্তা এবং স্বজ্ঞার যে একটা অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে, তা তিনি ধরতে পারলেন না। এটাও তিনি খেয়াল করতে পারলেন না যে যেহেতু পরপর চলমান সময়ের সঙ্গে চিন্তা অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, সে জন্যই মনে হয় চিন্তা অসীমও নয় আর তা কোনো সিদ্ধান্তেও আসতে পারে না।
কিন্তু চিন্তা যে একান্তই সসীম এবং সে জন্য তার পক্ষে অসীমের উপলব্ধি যে সম্ভব নয়, এরূপ মনে করার কারণ হচ্ছে জ্ঞানের জগতে চিন্তার গতি সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা। যথেষ্ট যুক্তির ভিত্তিতে বুদ্ধি প্রতিষ্ঠিত না হলে মনে হয় জগতে পরস্পরবিরোধী বস্তুর অভাব নেই এবং তাদের মধ্যে ঐক্য বিধানেরও সম্ভাবনা নেই। তখন স্বভাবত সন্দেহ হয় যে বুদ্ধি কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারে না। এমনকি যুক্তিগত বুদ্ধির দ্বারাও এই বৈচিত্র্যকে আমরা একটা সুসংবদ্ধ বিশ্বরূপে দেখতে পাই না। যুক্তি-আশ্রিত বুদ্ধির দ্বারা বস্তুনিচয়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা যে আমরা একেবারেই করতে পারি না, এমন নয়। পারি, তবে বিভিন্ন বস্তুর সাদৃশ্যকে অবলম্বন করে মাত্র । কিন্তু সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে যে ঐক্যের প্রতিষ্ঠা আমরা করতে চাই, তা একটা কাল্পনিক ঐক্য মাত্র। এর দ্বারা বিভিন্ন বাস্তব বস্তুর সত্তা প্রভাবিত হয় না। তবে চিন্তা যখন তার গভীর স্তরে প্রবাহিত হয়, তখন সে চিন্তা অন্তর্নিহিত অসীমে পৌছাতে সমর্থ—যে অসীমের আত্মবিকাশ-পথে অসীম। ধারণাসমূহ কতকগুলো মুহর্তমাত্র। কাজেই চিন্তায় আসল ধর্ম স্থিতিশীল নয়, বরং এটা একান্তরূপে গতিশীল। প্রথম থেকেই বীজের মধ্যে সমগ্র বৃক্ষের সম্ভাবনা বর্তমান থাকে, কালক্রমে বৃক্ষের বিভিন্ন অঙ্গ আত্মপ্রকাশ করে; তেমনি কালপ্রবাহে চিন্তা তার অন্তনিহিত অসীমতা ক্রমে ক্রমে প্রকাশ করে। সুতরাং আত্মপ্রকাশের দিক দিয়ে চিন্তা গতিশীল ও অখণ্ড; কালের বিভিন্ন অংশে খন্ড- খন্ডভাৰে এর বিকাশ; এই বিভিন্ন বিকাশের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ বিচার না করলে চিন্তার সামগ্রিক ধারণা করা কঠিন। এদের আলাদা আলাদা নিজস্ব সত্তা হিসেবে কোনো তাৎপর্য নেই; এদের আসল তাৎপর্য পাওয়া যাবে সমগ্রের ভেতর। কারণ, এরা এই সমগ্রেরই বিভিন্ন অভিব্যক্তি মাত্র । এই বৃহত্তর সত্তা হচ্ছে কোরআনে উল্লেখিত ‘লওহে মাহফুজ’ বা সংরক্ষিত ফলকের মতো।
এই ফলকে জ্ঞানের অনির্দিষ্ট সম্ভাবনার সমস্তই বর্তমান আছে; এই বর্তমান সম্ভাবনার বিকশিত স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য চিন্তা ক্রমিক কালের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আত্মপ্রকাশ করে। এই সসীম ধারণাসমূহের লক্ষ্য হচ্ছে সেই ঐক্যে পৌঁছানো, যে ঐক্যটি গোড়া থেকেই তাদের মধ্যে নিহিত আছে। বস্তুত জ্ঞানের অগ্রগতিতে সমগ্র অসীমতার অস্তিত্ব বর্তমান আছে বলেই মানুষের সসীম চিন্তা সম্ভব হয়ে ওঠে। কান্ট ও গাজ্জালি কেউ এটা লক্ষ করেননি যে চিন্তা জ্ঞানে রূপান্তরিত হওয়ার পরই তার সসীমতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। প্রকৃতিতে যেসব সসীম জিনিস আছে, তা পরস্পরের বাইরে, কিন্তু চিন্তার বিভিন্ন বিকাশ তেমন নয়। আসলে চিন্তা কোনো সীমারেখা মেনে চলতে পারে না। নিজের স্বাতন্ত্রের সংকীর্ণ আবর্তে আবদ্ধ থাকা চিন্তার ধর্ম নয়। এর বাইরে যে বিপুল জগৎ বিদ্যমান,তার কিছুই এর অনাত্মীয় নয়। যার সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই বলে মনে হয়, তারই জীবনে ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ দ্বারা চিন্তা তার সসীমতার সীমাকে ধ্বংস করে দেয় এবং তার অন্তর্নিহিত অসীমতাকে উপলব্ধি করে। চিন্তার গতি এই জন্যই সম্ভব যে এর অন্তরে অসীম লুকিয়ে থেকে এর অনন্ত অভিযানের অনুপ্রেরণা সরবরাহ করে। চিন্তাকে সসীম মনে করা ভুল; কারণ, চিন্তার অঙ্গনেই হয় অসীমে ও সসীমে অভিবাদন বিনিময় ।
গত পাচ শ বছর ধরে ইসলামে ধর্মীয় চিন্তা একরূপ গতিহীন হয়ে আছে। অথচ এমন এক দিন ছিল, যখন ইউরোপীয় চিন্তাধারা প্রেরণা পেয়েছিল মুসলিম জাহান থেকে। আধুনিক ইতিহাসের বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হচ্ছে এই যে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে মুসলিম জাহান পাশ্চাত্য জগতের দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এতে অবশ্য অন্যায় কিছু নেই, কারণ জ্ঞান সাধনার দিক দিয়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতি হচ্ছে ইসলামি তমদ্দুনের কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রূপেরই উন্নততর বিকাশমাত্র।
আমাদের একমাত্র ভয় হচ্ছে, পাছে বা শুধু ইউরোপীয় সংস্কৃতির বাইরের চাকচিক্য আমাদের গতি আটকে ফেলে, আর তার আসল মর্মস্থানে পৌঁছাতে আমরা হই অসমর্থ। কয়েক শতাব্দী ধরে যখন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ছিল আচ্ছন্ন ও নিষ্ক্রিয় হয়ে, তখন ইউরোপীয় চিন্তানায়কগণ চিন্তা করেছেন সেই সব বড় বড় সমস্যা নিয়ে, যার সমাধানে মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরাও ছিলেন গভীর আগ্রহশীল। মধ্যযুগে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন মজহাব চূড়ান্তরূপ লাভ করেছিল। তখন থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার জগতে সাধিত হয়েছে অশেষ অগ্রগতি। প্রকৃতির ওপর মানুষের শক্তি প্রসারিত হয়েছে, তাতে মানুষের মনে হয়েছে এক নতুন বিশ্বাসের সঞ্চার। যেসব শক্তির সমন্বয়ে তার পরিবেশ রচিত, তার ওপর প্রাধান্যের এক নব বোধের উন্মেষ ঘটেছে। নতুন নতুন মতবাদের হয়েছে উদ্ভব, পুরনো সমস্যাগুলো নবীন অভিজ্ঞতার আলোকে হয়েছে পুনর্বর্ণিত এবং বহু নতুন সমস্যা দাঁড়িয়েছে মাথা তুলে। মনে হয়, মানুষের বুদ্ধি যেন তার সবচেয়ে মৌলিক তত্ত্বগুলো, যথা : স্থান, কাল ও কার্যকারণকে যাচ্ছে অতিক্রম করে।
বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি-সম্বন্ধীয় ধারণারও ঘটেছে পরিবর্তন। আইনস্টাইনের মতবাদ বিশ্বের এক নতুন রূপ খুলে ধরেছে। আমাদের সামনে, আর ধর্ম ও দর্শনের সাধারণ সমস্যাগুলো বিচারের নতুন নতুন পথের দিয়েছে ইশারা। কাজেই এশিয়া এবং আফ্রিকায় ইসলামের তরুণসমাজ যে তাদের ধর্মের এক নবরূপ দাবি করছে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ইসলামের পুনর্জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে তাই প্রয়োজন, ইউরোপ কী চিন্তা করেছে এবং তার সিদ্ধান্তগুলো ইসলামের ধর্মীয় চিন্তার শোধনে এবং প্রয়োজন হলে তার পুনর্গঠনে কতটুকু আমাদের সাহায্য করতে পারে, স্বাধীন মনোভাব নিয়ে তা বিচার করে দেখা । তা ছাড়া সাধারণভাবে ধর্মবিরোধী এবং বিশেষ করে ইসলামবিরোধী যে প্রচারণা মধ্য-এশিয়ায় দেখা দিয়েছে এবং যা ভারতবর্ষের সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে, তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এই আন্দোলন প্রবর্তকদের মধ্যে এমন কয়েকজন রয়েছেন, যাঁদের জন্ম মুসলমান কুলেই। এঁদের একজন হচ্ছেন তুর্কি কবি তওফিক ফিতরাত, মাত্র কিছুদিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
আমাদের একজন বড় ভাবুক কবি আকবরাবাদের মীর্জা আবদুল কাদির বেদিলকে পর্যন্ত তিনি এই আন্দোলনের কাজে নামিয়েছেন। কাজেই, ইসলামের মূল সত্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা এখন জরুরি হয়ে পড়ছে। এই বক্তৃতাগুলোতে আমি ইসলামের কয়েকটি মূল তত্ত্ব সম্বন্ধে দর্শনসম্মত আলোচনা করার প্রস্তাব করছি। আমি আশা করছি, মানবসমাজের প্রতি ইসলাম যে এক সুসংবাদ এনেছে, এই আলোচনা অন্তত সেই হিসেবে ইসলামের অর্থ সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। বৃহত্তর আলোচনার একটি মূল কাঠামো দাঁড় করানোর উদ্দেশ্য আমি এই প্রাথমিক বক্তৃতায় জ্ঞান এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞতার স্বরূপ সম্বন্ধে আলোচনা করতে চাই।
আল্লাহ এবং বিশ্বের সঙ্গে রয়েছে মানুষের বহুবিধ সম্পর্ক। এই সম্পর্ক সম্বন্ধে মানুষের মনে গভীরতর চেতনার উন্মেষ করাই হচ্ছে কোরআনের প্রধান উদ্দেশ্য। কোরআনি শিক্ষার এই মূল দিকটা লক্ষ করে গ্যেটে ইসলামের শিক্ষা সম্বন্ধে সাধারণভাবে এক আলোচনা প্রসঙ্গে একারম্যানকে বলেছিলেন :
দেখুন, এই শিক্ষা কখনো ব্যর্থ হয় না। আমাদের সকল ব্যবস্থা বিধান দিয়েও আমরা এটাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারি না এবং সাধারণভাবে বলতে গেলে কোনো মানুষই তা পারে না।
ধর্ম এবং সভ্যতা এই দুই শক্তির মধ্যে একই সঙ্গে রয়েছে পারস্পরিক বিকর্ষণ ও আকর্ষণ। ধর্ম ও সভ্যতার এই যুগপৎ বিরোধ ও আকর্ষণই ইসলামের সামনে সত্যিকার সমস্যারূপে দেখা দিয়েছিল। গোড়ার দিকে খ্রিষ্টধর্মও এই একই রূপ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। খ্রিষ্টধর্মের বড় কথা হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবনের স্বাধীন সত্তার সন্ধান। এর প্রতিষ্ঠাতা তাঁর অন্তদৃষ্টি দিয়ে বুঝেছিলেন যে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নয়ন সম্ভব; তবে সে উন্নয়ন মানুষের আত্মা-বহির্ভূত জাগতিক শক্তিসমূহের দ্বারা নয়, বরং তার আত্মার অভ্যন্তরে এক নতুন জগতের আবিষ্কারের মাধ্যমে। ইসলাম এই অন্তদৃষ্টির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তবে ইসলাম এই অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে যোগ করেছে আর একটি অন্তদৃষ্টি। সে অন্তদৃষ্টি অনুসারে মানুষের অন্তরে বিকশিত এই নতুন জগতের আলোক বস্তুজগতের বিরোধী নয়, বরং বস্তুজগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর অনুপ্রবেশ।
তাই খ্রিষ্টধর্ম যে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নয়নের জন্য সন্ধান করে, সে উন্নয়ন বহির্জগতের শক্তি বর্জন করে সম্ভব হওয়ার নয়। কারণ এই শক্তিসমূহই আধ্যাত্মিক প্রভাব দ্বারা আগেই প্রভাবিত হয়ে আছে; সে উন্নয়ন সাধন করতে হবে বাইরের এসব শক্তির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের উপযুক্ত সমন্বয় সাধনের দ্বারা। আদর্শের রহস্যময় পরশই বাস্তবকে প্রাণদান করে এবং শুধু এর মাধ্যমেই আমরা পারি আদর্শকে আবিষ্কার ও উপলব্ধি করতে। ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ এবং বাস্তব এমন দুটি বিরোধী শক্তি নয় যে তাদের মিলন অসম্ভব। আদর্শকে বেঁচে থাকতে হলে বাস্তবের সঙ্গে তার পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটানোর প্রয়োজন নেই।
বাস্তবকে উপেক্ষা করতে গেলেই জীবনের সামগ্রিক রূপ হয় বিনষ্ট, জীবনের সামনে তখন দেখা দেয় নানাবিধ বেদনাময় বাধা-বিরোধ। পরিণামে বাস্তবকে নিজের রূপে রূপান্তরিত এবং তার গোটা সত্তাকে নিজের আলোকে রঞ্জিত করার উদ্দেশ্যে তাকে আয়ত্ত করার নিরন্তর প্রচেষ্টার মধ্যেই আদর্শের জীবন। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে, অর্থাৎ নিরেট গাণিতিক বহির্জগৎ এবং স্বাধীন অন্তর্জগতের মধ্যে এই বিরোধই খ্রিষ্টধর্মের কাছে বড় বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু ইসলাম এ বিরোধেরই মোকাবিলা করে তাকে জয় করার জন্য। বর্তমান পরিবেশে মানুষের জীবনের সমস্যা সম্বন্ধে এই দুটি মহান ধর্মের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা নির্ণীত হয় উভয় ধর্মের মধ্যে একটা মৌলিক ব্যাপারে এই গভীর পার্থক্য দ্বারা। মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক সত্তার প্রতিষ্ঠা উভয় ধর্মেরই কাম্য, তবে পার্থক্য শুধু এই যে আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের সংযোগকে স্বীকার করে ইসলাম বস্তুজগৎকে জানায় স্বাগতম; আর বাস্তবসম্মত উপায়ে জীবন পরিচালনার একটি ভিত্তি সন্ধানের উদ্দেশ্যে দেয় বস্তুজগৎকে আয়ত্ত করার পথের নির্দেশ।
তাহলে যে বিশ্বে আমরা বাস করছি, কোরআনের মতে তার স্বরূপ কী? প্রথমত এটা নিছক সৃজনলীলার ফল নয় তো?
আমরা আকাশ ও পৃথিবীর এবং তাদের মাঝখানে যা কিছু আছে, তা ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমরা তাদের সৃষ্টি করিনি একটা গভীর উদ্দেশ্য ছাড়া : কিন্তু তাদের (মানুষের) বৃহত্তর অংশ তা জানে না। (৪৪ : ৩৮-৩৯)
বিশ্ব হচ্ছে একটা প্রত্যক্ষ বাস্তব এবং সে বাস্তবকে আমাদের স্বীকার করতেই হবে: নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃজনে এবং পরপর দিনরাত্রির আগমনে সমঝদারদের জন্যে রয়েছে সংকেত; তারা (সমঝদারগণ) দণ্ডায়মান, উপবেশন ও হেলানো অবস্থায় আল্লাহর কথা স্মরণ রাখে, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা করে এবং বলে : হে আমাদের প্রভু, তুমি এসব বৃথা সৃষ্টি করোনি। (৩: ১৯০-১৯১)
আবার বিশ্ব এমনভাবে গঠিত যে তা সম্প্রসারণযোগ্য।
তিনি (আল্লাহ) যা ইচ্ছা তা তাঁর সৃষ্টিতে সংযোজন করেন। (৩৫ : ১)। এটা ছাদে-কাটা নিরেট বিশ্ব নয় । চূড়ান্ত করে তৈরি করা অচল অপরিবর্তনীয় বস্তুও এটা নয় । হয়তো এর সত্তার গভীরে রয়েছে নবজীবনের স্বপ্ন : বলো—পৃথিবী পরিভ্রমণ করো এবং দেখো আল্লাহ কীভাবে সৃষ্টিকে অস্তিত্ব করেছেন। এরপর তিনি একে (সৃষ্টিকে) আর এক জন্ম দান করবেন (২৯:১৯)
বস্তুত বিশ্বের এই রহস্যময় গতিস্পন্দন, কালের এই নিঃশব্দ সঞ্চরণ (যা আমাদের কাছে দিনরাত্রির গতি বলে প্রতীয়মান) হচ্ছে আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শনসমূহের অন্যতম :
আল্লাহর হুকুমেই পালাক্রমে দিনরাত্রি সংঘটিত হয়। বস্তুত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের কাছে এটা একটা শিক্ষণীয় বিষয়। (২৪ : ৪৪)
এ জন্যই রসুলুল্লাহ বলেছেন : “কালের নিন্দা কোরোনা, কারণ কালই হচ্ছে আল্লাহ।’ দেশ-কালের এই বিশালতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাদের ওপর মানুষের পূর্ণ আধিপত্যের সম্ভাবনা। মানুষের তাই উচিত আল্লাহর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করা এবং এভাবে তার প্রকৃতি বিজয়কে একটি বাস্তব সত্যে রূপায়িত করে তোলার উপায় আবিষ্কার করা।
আল্লাহ কীভাবে আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুই তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং দৃশ্য ও অদৃশ্যের ব্যাপারে তার অনুগ্রহরাশি তোমাদের ওপর বর্ষণ করেছেন তা কি তোমরা দেখতে পাও না? (৩১:১৯)
এবং আল্লাহ রাত্রি ও দিনকে সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। এবং তাঁর (আল্লাহর) নির্দেশে নক্ষত্রগুলোও তোমাদের অধীন: নিশ্চয়ই এতে সমঝদারদের জন্য নির্দেশ রয়েছে। (১৬ : ২০)
এই যদি হয় বিশ্বের প্রকৃতি ও প্রতিশ্রুতি, তাহলে যে মানুষকে সে চার দিক থেকে ঘিরে রয়েছে, তার স্বরূপ কী? অত্যন্ত উপযোগী এবং সুসমঞ্জস্য শক্তিসমূহে অধিকারী হয়েও মানুষ দেখতে পাচ্ছে যে জীবমণ্ডলীর এক নিম্নস্তরে তার স্থান। আর তার চারদিকে ঘিরে আছে নানা বিরুদ্ধ শক্তি : আমরা মানুষকে উদ্ধৃষ্টতম উপাদানে সৃষ্টি করেছি, তারপর তাকে স্থাপন করেছি সকলের নিচে। (৯৫ : ৪-৫)
এই পরিবেশের মধ্যে মানুষকে আমরা কী অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি? মানুষকে আমরা দেখছি একটা সদাচঞ্চল জীবরূপে। সে তার আদর্শ নিয়ে গভীরভাবে মশগুল। এ আদর্শের জন্য সে আর সবকিছু ভুলে যেতে চলেছে। আত্মপ্রকাশের নৰ নব সুযোগ সন্ধানে সে নিরন্তর সচেষ্ট। আর এ জন্য কোনো রকমের কষ্টকেই সে পরোয়া করে না। সকল ব্যর্থতা সত্ত্বেও সে প্রকৃতির চেয়ে বড়। কেননা মানুষ তার নিজের মধ্যে বহন করে চলেছে এক মহান আমানত, যে আমানত বহন করতে আকাশ পৃথিবী, পাহাড়-পর্বত সকলেই অস্বীকার করেছিল :
নিশ্চয়ই আমরা আকাশের কাছে পৃথিবীর কাছে এবং পর্বতসমূহের কাছে প্রস্তাব করেছিলাম (ব্যক্তিত্বের) আমানত গ্রহণ করার জন্য, কিন্তু তারা সে ভার (গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল এবং গ্রহণ করতে ভয় পেল। একমাত্র মানুষ সে ভার গ্রহণ করতে স্বীকৃত হলো, কিন্তু পরে সে নিজেকে অন্যায়কারী, নির্বোধ বলে প্রমাণ করেছে। (৩৩ : ৭২)
মানুষের জীবনের একটা আরম্ভ অবশ্যই রয়েছে, তবে সৃষ্টির কাঠামোতে একটা স্থায়ী উপাদানে পরিণত হওয়াই সম্ভবত তার বিধিলিপি : মানুষ কি মনে করে যে তাকে অকেজো জিনিস বলে ফেলে দেওয়া হবে? সেকি একটা ভ্রুণ মাত্র ছিল না? তারপর সে ঘন রক্তে পরিণত হলো এবং আল্লাহ সেই রক্ত থেকে তার আকৃতি ও রূপ দান করলেন এবং তাকে সৃষ্টি করলেন পুরুষ ও স্ত্রীরূপে । তিনি কি মৃতকে সঞ্জীবিত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নন? (৭৫ : ৩৬-৪০)
চারপাশের শক্তি যখন মানুষকে আকর্ষণ করে তখন সেই শক্তিকে নিজের ইচ্ছামতো গঠিত ও পরিচালিত করার ক্ষমতা তার রয়েছে। আবার সেই শক্তি যখন মানুষের চলার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায়, তখন নিজের সত্তার গভীরে বিশালতর জগৎ সষ্টি করার সামর্থ্যও সে রাখে। এই অন্তর্জগতে সে তখন আবিষ্কার কৰে অসীম আনন্দ ও প্রেরণার উৎস। কঠিন মানুষের ভাগ্য, আর গোলাব পাতার মতো ভঙ্গুর তার জীবন। তবু বাস্তব জগতের কোনো বস্তুই মানুষের শক্তির মতো তেজস্কর, উদ্দীপক ও সুন্দর নয়। এভাবে কোরআনে বর্ণিত মানুষ তার অন্তরতম সত্তার একদিক দিয়ে এক সৃজনশীল শক্তি। ক্রমোন্নতির পথে এগিয়ে চলাই তার ধর্ম। সত্তার অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় সে নিরন্তর উন্নীত হয়ে চলেছে :
তোমরা যে নিশ্চিতই সামনের পথে অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে নীত হবে, তার জন্য সূর্যাস্তের রক্তিমাভা, রাত্রি ও তার পরিমণ্ডল এবং পূর্ণচন্দ্রের নামে আমার শপথ করার প্রয়োজন করে না। (৮৪ : ১৭-২০)
চতুষ্পার্শ্বে বিরাজিত এই বিশ্বের সুগভীর স্বপ্নসাধের শরিক হওয়া এবং কখনো বিশ্বের শক্তিনিচয়ের সঙ্গে নিজের সংগতি রক্ষার দ্বারা, আবার কখনো নিজের সকল শক্তি প্রয়োগে করে বিশ্বের শক্তিসমূহকে নিজের উদ্দেশ্য ও অভীষ্টের অনুকূলে রূপায়ণের দ্বারা নিজের এবং বিশ্বের ভাগ্য গড়ে তোলাই মানুষের ব্রত। এই প্রগতিমূলক পরিবর্তন সাধনে আল্লাহ হন মানুষের সহকর্মী, অবশ্য মানুষ যদি নিজে হয় উদ্যোগী :
এ কথা নিশ্চিত, যে পর্যন্ত না মানুষ তাদের নিজেদের মধ্যে যা রয়েছে তার পরিবর্তন করবে, সে পর্যন্ত আল্লাহ তাদের অবস্থার পরিবর্তন করবেন না। (১৩ : ১১)
মানুষ যদি নিজে উদ্যোগী না হয়, সে যদি তার সত্তার অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্যের বিকাশ সাধন না করে এবং সে যদি চলমান জীবনের নিগঢ় আবেগ অনুভব করতে হয় অক্ষম, তাহলে তার ভেতরকার শক্তি হয় পাথরে পরিণত এবং সে নিজে হয় মৃত বস্তুর পর্যায়ে অবনমিত। কিন্তু মানুষ যে বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন হয়, তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ওপরই নির্ভর করে তার জীবন ও তার আত্মিক শক্তির অগ্রগতি। জ্ঞানের দ্বারাই এই সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বুদ্ধির দ্বারা পরিস্ফুট ইন্দ্রিয়ানুভূতিই হচ্ছে জ্ঞান :
তোমার প্রভু যখন ফেরেশতাদের বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার এক খলিফা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি; তখন তারা বলল, আমরা যখন আপনার গুণগান করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি তখন আপনি কি সেখানে এমন একজনকে নিযুক্ত করবেন, যে সেখানে খারাপ কাজ করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? আল্লাহ বললেন, তোমরা যা জান না, নিশ্চয়ই তা আমি জানি। এবং তিনি আদমকে সকল জিনিসের নাম শিক্ষা দিলেন ও সেগুলো ফেরেশতাদের সামনে উপস্থিত করলেন এবং বললেন, যদি তোমরা বিজ্ঞ হও তাহলে তোমরা আমাৱা কাছে এগুলোর নাম বলো। তারা বলল, আপনার প্রশংসা করছি, আপনি আমাদের যা জানাতে দিয়েছেন, তা ছাড়া আর কিছু নাই আমাদের নেই। আপনি সর্বোজ্ঞ ও জ্ঞানী। তিনি বললেন, হে আদম, তুমি নামগুলো তাদের জানিয়ে দাও। এবং সে (আদম) যখন তাদের নামগুলো বলে দিল, তখন আল্লাহ বললেন, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আকাশ ও পৃথিবীর গুপ্ত জিনিসগুলো আমি জানি এবং তোমরা যা প্রকাশ করো এবং যা গোপন করো তা আমি জ্ঞাত আছি। (২: ৩০-৩৩)
ওপরে উল্লেখিত আয়াত কয়টিতে এই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে বিভিন্ন বস্তুর নামকরণের, অর্থাৎ তাদের সম্বন্ধে মনে ধারণা সৃষ্টির ক্ষমতা মানুষের রয়েছে। আর বস্তুসমূহের ধারণা করার মানেই হচ্ছে সেগুলো আধিগত করা। মানুষের মনোগত ধারণার ওপর নির্ভর করেই হয় তার জ্ঞানের সষ্টি এবং ধারণালব্ধ জ্ঞানের হাতিয়ার নিয়ে মানুষ অগ্রসর হয় সত্তার পর্যবেক্ষণ-উপযোগী রূপের দিকে। কোরআনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে তাকে সত্যের পর্যবেক্ষণোপযোগী রূপের ওপরই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এখানে আমি কয়েকটি আয়াতের উল্লেখ করছি :
নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, পর্যায়ক্রমে দিনরাত্রির আগমনে, জাহাজে- যা মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সাগর-বক্ষে চলাচল করে, বৃষ্টিতে-যা আল্লাহ, আকাশ থেকে প্রেরণ করে পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর আবার জীবন দান করেন এবং তার বুকে গো-মহিষাদির পাল ছড়িয়ে রাখেন, বাতাসের পরিবর্তনে, এবং মেঘে- যাকে আকাশ এবং পৃথিবীর মাঝখানকার সেবা কার্যে নিয়োজিত করা হয়েছে তাতে সমঝাদারদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (২; ১৬৪)
এবং তিনি তোমাদের জন্যে এমন ব্যবস্থা করেছেন, যাতে তোমরা স্থল এবং সমুদ্রের অন্ধকারে চলতে পারো। আমরা জ্ঞানবানদের জন্য এবং আমাদের ইশারাগুলোকে স্পষ্ট করে দিয়েছি। এবং তিনিই তোমাদের একটি নিশ্বাস দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য (গর্ভাধানে) আবাস বিরাম-স্থানে ব্যবস্থা করেছেন। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের জন্য আমরা আমাদের দিকদর্শনকে উজ্জ্বল করেছি এবং তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি প্রেরণ করেন এবং এর দ্বারা আমরা সকল তরলতায় মুকুলরাশির উদগম করি এবং তাদের মধ্য থেকে আমরা ঘনসন্নিবিষ্ট গাছপালা, থোকা থোকা খেজুরের কাঁদি-বিশিষ্ট খেজুরগাছ, দ্রাক্ষাকুঞ্জ, জলপাই ও ডালিম-বিথী এবং অন্য ও অনুরূপ জিনিস সৃষ্টি করি। তাদের ফলগুলো যখন পাকে তখন সেগুলো তোমরা লক্ষ্য করো। সত্যিই এতে বিশ্বাসীদের জনা নিদর্শন রয়েছে। (৬: ৯৭-৯৯)
তোমাদের প্রভু কীভাবে ছায়াকে দীর্ঘায়িত করেন, তা কি তোমরা দেখোনি? তিনি ইচ্ছা করলে একে নিশ্চল করে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু আমরা সূর্যকে এর পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করেছি, তারপর একে আমরা সহজ আকর্ষণে নিজেদের ভেতর টেনে নিই । (২৫: ৪৭)
কীভাবে উট সৃষ্টি করা হয়, কীভাবে আকাশকে উত্তোলিত করা হয়, কীভাবে পর্বতকে মূলবদ্ধ করা হয় এবং কীভাবে পৃথিবীকে বিস্তারিত করা হয়, তা কি তারা লক্ষ করে দেখতে পারে না? (৮৮ : ১৭-২০)
এবং আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম হচ্ছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও গাত্রবর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এর মধ্যে সকল মানুষের জন্য ইঙ্গিত রয়েছে। (৩০-২২)
সন্দেহ নেই, কোরআনের আশু উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ দ্বারা মানুষের মধ্যে সেই সচেতনতা জাগিয়ে দেওয়া, যাতে প্রকৃতি তার কাছে প্রতীক বলে প্রতীয়মান হয়। তবে প্রত্যক্ষবাদী মনোভাবই হচ্ছে কোরআনের প্রধান লক্ষণীয় বিষয়। এই মনোভাবই কোরআন অনুসারীদের মনে বাস্তবের প্রতি করেছিল গভীর শ্রদ্ধার সৃষ্টি। তার ফলেই পরিণামে তারা হয়েছিল আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা। যে যুগে মানুষ আল্লাহর অনুসন্ধান করতে পরিদৃশ্যমান বস্তুসমূহকে মূল্যহীন মনে করে বর্জন করেছিল, সেই যুগে এই প্রত্যক্ষবাদের উন্মেষ সাধন প্রকৃতই এক মহান ব্যাপার ছিল। আমরা আগেই দেখেছি যে কোরআনের মতে বিশ্বের রয়েছে একটা মহান উদ্দেশ্য। বিশ্বের পরিবর্তনশীল বাস্তবই আমাদের সত্তাকে নব নব রূপ পরিগ্রহ করতে বাধ্য করেছে। বিশ্ব আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত যেসব বাধার সৃষ্টি করছে, তা অতিক্রম করার মানসিক প্রচেষ্টাতেই আমাদের জীবন সমৃদ্ধ ও বিকশিত হচ্ছে, উপরন্তু আমাদের অন্তর্দৃষ্টিও হচ্ছে প্রখরতর।
এভাবেই আমরা মানবীয় অভিজ্ঞতার সূক্ষ্মতর দিকগুলো আরও গভীরভাবে আয়ত্ত করার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠছি। পার্থিব জগতের পরিবর্তন-প্রবাহের সঙ্গে মনের সংযোগই আমাদের অপার্থিবকে মানস-চোখে দেখতে শিখিয়ে তোলে; সত্তা তার নিজ অভিব্যক্তির মধ্যেই বিদ্যমান। মানুষকে জীবন ধারণ করতে হয় প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে। কাজেই, দৃশ্যমান জগৎকে উপেক্ষা করে চলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। পরিবর্তনের মতো একটা বিরাট ব্যাপারের প্রতি কোরআন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পরিবর্তন হৃদয়ঙ্গম ও নিয়ন্ত্রণের দ্বারাই শুধু স্থায়ী সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব। এশিয়া এবং বস্তুত গোটা প্রাচীন জগতের সংস্কৃতিসমূহ ব্যর্থ হয়েছিল। এই কারণে যে তারা সত্তাকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিল ভেতর থেকে এবং ভেতর থেকে অগ্রসর হয়েছিল বাইরের দিকে। এই পদ্ধতিতে তারা শুধু অন্তঃসারশূন্য থিওরি বা মতবাদেরই সৃষ্টি করেছিল । কিন্তু নিছক মতবাদের ওপর ভিত্তি করে তো কোনো স্থায়ী সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না।
ইতিহাসে দেখা যায়, দিব্যজ্ঞানের উৎস হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতারই ব্যবহার করা হয়েছে, তবে সবার আগে ব্যবহার করা হয়েছে ধর্মীয় অভিজ্ঞতার । প্রত্যক্ষবাদী মনোভাবকে কোরআন মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের একটি অপরিহার্য স্তর হিসেবে স্বীকার করেছে এবং পরম সত্তা-সম্পর্কীয় জ্ঞানের পথ হিসেবে মানুষের সব রকম অভিজ্ঞতাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ, পরম সত্তা কেবল ভেতরের প্রতীকে নয়, বাইরের প্রতীকেও আত্মপ্রকাশ করে থাকে। সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটি পরোক্ষ উপায় হচ্ছে, আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে তার যেসব প্রতীক স্বতঃপ্রকাশিত, তার মানস-পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ; আর একটি উপায় হচ্ছে, সত্তার যেসব প্রতীক অন্তরে প্রতিভাত তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন। কোরআনের প্রকৃতিবাদের মানে হচ্ছে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এই যে সম্বন্ধ তাকে স্বীকার করা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যেই প্রকৃতির শক্তিসমূহ আয়ত্ত করার উপায় নিহিত। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই সম্বন্ধের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে; তবে তা আধিপত্য বিস্তারের অন্যায় আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য নয়, বরং আধ্যাত্মিক জীবনের স্বাধীন গতিকে উধ্বর্তম স্তরে উন্নীত করার মহান উদ্দেশ্যে। সত্যের পূর্ণ ধারণা লাভের জন্য ইন্দ্রিয়ানুভূতির সঙ্গে যোগ করতে হবে কোরআনে বর্ণিত কালব বা হৃদয়ের অনুভূতি :
আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা তিনি একান্ত উত্তম করেই বানিয়েছেন; তিনি মৃত্তিকার দ্বারা মানুষের সৃষ্টি শুরু করেছিলেন, তারপর জীবনের বীজ, অপবিত্র পানি থেকে তার সন্তানসন্ততির বিধান করেছিলেন, এরপর তাকে রূপদান করেছেন ও প্রশ্বাসযোগে তার মধ্যে প্রবিষ্ট করিয়েছেন আপন রুহ এবং তোমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয় দান করেছেন। পরিবর্তে তোমরা কতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো? (৩২: ৭-৯)
হৃদয় হচ্ছে একধরনের অন্তর্নিহিত স্বজ্ঞা বা অন্তদৃষ্টি। রুমি সুন্দর বলেছেন, এই অন্তর্দৃষ্টি সূর্যরশ্মি পান করে পুষ্টি লাভ করে এবং সত্তার যেসব বৈশিষ্ট্য আমাদের। ইন্দ্রিয়ানভূতিতে ধরা পড়ে না, সেই সব বৈশিষ্ট্যের সংস্পর্শে আমাদের নিয়ে আসে। কোরআনের মতে, এই কালব হচ্ছে এমন একটা জিনিস যা দেখতে পায় এবং সে দেখাকে যদি উপযুক্তরূপে ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে তা কখনো ভুল বলে প্রতিপন্ন হয় না। তবে আমরা যেন এই হৃদয়কে কোনো রহস্যময় বিশেষ বৃত্তি বলে মনে না করি। বরং এটা হচ্ছে সত্তাকে জানার একটা পথবিশেষ, যাতে এ দেহের। ইন্দ্রিয়ানুভূতি’র কিছু করার নেই। তবু এই প্রণালিতে যে অভিজ্ঞতার রাজ্য। আমাদের সামনে উদঘাটিত হয়, তা অন্য যেকোনো অভিজ্ঞতার মতোই সত্য ও বাস্তব। আমরা যদি একে আত্মিক, মরমি বা অতীন্দ্রিয় বলে বর্ণনা করি, তাহলেও অভিজ্ঞতা হিসেবে এর মূল্যহানি হয় না। আদিম যুগের মানুষের কাছে সব অভিজ্ঞতাই ছিল অতিপ্রাকৃতিক। জীবনের আশু প্রয়োজনের তাগিদে তারা তাদের। অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করত। এই বিশ্লেষণের ফলেই ক্রমে আমরা যাকে প্রকৃতি বলি, তার উদ্ভব হলো। গোটা সত্তা আমাদের চেতনায় প্রবেশ করে এবং বিশ্লেষণের পর একটা প্রত্যক্ষ সত্যের মতো প্রতীয়মান হয়। অন্যবিধ উপায়েও সত্তা আমাদের চেতনার অধিরূঢ় হয়ে থাকে। তখন তাকে বিশ্লেষণ করে দেখার অধিকতর সুযোগ উপস্থিত হয়। মানবজাতির ধর্মীয় ও মরমি সাহিত্যে প্রমাণের অভাব নেই যে তার ইতিহাসে ধর্মীয় অভিজ্ঞতা এত বেশি স্থায়ী ও প্রবল হয়ে বিরাজ করছে যে তাকে নিছক মায়া বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। মানবজাতির প্রত্যাদিষ্ট এবং মরমি সাহিত্য এর পর্যাপ্ত সাক্ষ্য বহন করছে। কাজেই মানবীয় অভিজ্ঞতার সাধারণ স্তরকে সত্য বলে গ্রহণ করা এবং অন্যান্য স্তরকে অতীন্দ্রিয় ও আবেগমূলক বলে বর্জন করার কোনো হেতু আছে বলে মনে হয় না। ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সত্যও মানুষের অন্যান্য অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত সত্যসমূহেরই অন্তর্গত। বিশ্লেষণের সহায়তায় জ্ঞানদানের শক্তির দিক দিয়ে একটা সত্য অন্য যেকোনো সত্যের মতই কার্যকর। আর মানবীয় অভিজ্ঞতার এই দিক নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করার মধ্যে অশ্রদ্ধারও কিছু নেই।
ইসলামের নবী ছিলেন আত্মিক অবস্থার প্রথম সত্যসন্ধ পর্যবেক্ষক। রসুলুল্লাহ ইবনে সাইয়াদ নামের একজন আত্মিকভাবাপন্ন ইহুদি যুবকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। বুখারি এবং অন্য হাদিসবেত্তাগণ এই ঘটনার একটা পূর্ণ বিবরণ আমাদের দান করেছেন। এই ইহুদি যুবকের ভাবাবিষ্ট অবস্থা রসুল করিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বিভিন্ন মানসিক অবস্থায় যুবকটিকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ, পরীক্ষা ও যাচাই করে দেখেছিলেন। সমাধিস্থ অবস্থায় তার অনুচ্চ উক্তিগুলো শোনার জন্য রসুলুল্লাহ একটি বৃক্ষ-কাণ্ডের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। বালকটির মাতা রসুলুল্লাহর আগমন সম্বন্ধে তাকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ায় সে তৎক্ষণাৎ তার ভাবাবিষ্ট অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলে। এতে রসুলুল্লাহ বলেছিলেন : যদি সে (মহিলাটি) তাকে একা থাকতে দিত তাহলে ব্যাপারটি পরিস্ফুট হয়ে উঠত। ইসলামের ইতিহাসে এটাই হচ্ছে প্রথম মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ । সে সময় রসুলুল্লাহর কয়েকজন সাহাবা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাহাবাগণ এবং এমনকি পরবর্তী মুহাদ্দিসগন যত্নের সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
তবে তারা রসুলুল্লাহর মনোভাবের তাৎপর্য সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছিলেন এ নিজেদের স্বাভাবিক সারল্যের সঙ্গে এর বিশ্লেষণ করেছিলেন। অধ্যাপক ম্যাকডোনাল্ডও এই ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে মরমি ও প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তিসুলভ চেতনার মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্যের কোনো ধারণা তার ছিল বলে মনে হয় না। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা সমিতির (সোসাইটি অব সাইকিক্যাল রিসার্চ পদ্ধতি অনুযায়ী তিনি এক পয়গম্বরের অবস্থা সম্বন্ধে অন্য পয়গম্বরের এই পর্যবেক্ষণের মধ্যে যথেষ্ট হাস্যরসের খোরাক পেয়েছেন। অধ্যাপক ম্যাকডোনাল্ড যদি কোরআনের মর্ম ভালোরূপে উপলব্ধি করতেন, তাহলে আত্মিকভাবাপন্ন ইহুদি যুবক সম্বন্ধে রসুলুল্লাহর পর্যবেক্ষণের মধ্যে নিশ্চয়ই তিনি খুব অর্থপূর্ণ কিছু দেখতে পেতেন। সুষ্ঠুরূপে কোরআনের মর্ম অনুধাবনের ফলে এমন একটা তামদুনিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, যার পরিণতি হচ্ছে আধুনিক প্রত্যক্ষবাদী মনোবৃত্তির উদ্ভব। এ সম্পর্কে আমি পরবর্তী এক বক্তৃতায় আলোচনা করব । মুসলমানদের মধ্যে যিনি প্রথম রসুলুল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ ও মূল্য উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন ইবনে খালদুন। সূক্ষ্মতর বিচার-বিশ্লেষণের সাহায্যে তিনি মরমি চেতনার মর্মভেদ করতে চেয়েছিলেন এবং অবচেতন সত্তা সম্পর্কে আধুনিক মতবাদের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছিলেন। অধ্যাপক ম্যাকডোনাল্ড বলছেন, ইবনে খালদুনের কতকগুলো অতি আকর্ষণীয় মনস্তাত্ত্বিক ধারণা ছিল এবং সম্ভবত মি. উইলিয়াম জেমসের ‘ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য (ভ্যারাইটিজ অব রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স)-এর সঙ্গে তার নিবিড় মতৈক্য ছিল।
লেখক পরিচিতি:
মুহাম্মদ ইকবাল
বই – ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন
তর্জমা: মোহাম্মদ মোকসেদ আলী