Concept of torture
ভারতের আখলাককে পিটিয়ে খুন করার পর মিডিয়ার আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘আখলাকের বাসায় গরুর মাংস ছিল কি ছিল না’। লালমনিরহাটের শহিদুন্নবীর বীভৎস হত্যার ঘটনার পরও একটা পাবলিক তর্ক দেখছি ‘সে নাস্তিক ছিল কি ছিল না’। পাবলিক পেইন আর নির্যাতন বিষয়ে এই ধরণের পাবলিক ডিবেট দেখে ফরাসি নাগরিক জ্যা কালা (Jean Calas)র ঘটনাটা মনে পড়ল। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলসের ইতিহাসের অধ্যাপক লিন হান্টের এই নিয়ে ‘Bone of their bone: Abolishing torture’ নামে দারুণ একটা কাজ আছে।
কালার ঘটনাটা হচ্ছে, ১৭৬২ সালে নিজ সন্তানকে হত্যার অভিযোগে কালাকে ‘ক্যাথরিন হুইল’এ নির্যাতন করে জনসম্মুখে ‘আইনি প্রক্রিয়ায় হত্যা করা হয়েছিল। কালা ছিলেন একজন প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান। কিন্তু তার ছেলে প্রটেস্ট্যান্ট ছেড়ে ক্যাথলিক ধর্মমত গ্রহণ করে। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সামাজিক নিগ্রহ আর অস্থিরতার নানান বেড়াজালে আত্মহত্যা করে বসে সে। কিন্তু ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী সেসময় আত্মহত্যা ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ। যে আত্মহত্যা করেছে, তাকে কবর দেয়া যেত না। এমনকি যদি জানা যেত যে কেউ আত্মহত্যা করার পর তাঁকে সমাধিস্ত করা হয়েছে, তা হলে কবর থেকে তার লাশ তুলে শহরের মাঝপথে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে ময়লার স্তুপে ফেলা হত। লাশের এমন অবমাননার ভয়ে কালা নিজের সন্তানের আত্মহত্যাকে হত্যা বলে প্রচার করে।
সে সময়ে ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রটেস্ট্যান্ট ক্যালভিনিস্টদের প্রকাশ্যে এবাদাত করা নিষিদ্ধ ছিল বিধায়, পুলিশ ধরে নেয় কালা নিজ ধর্ম হেফাজতের নামে নিজেই তার সন্তানকে হত্যা করে। আদালতে বলা হয় কালাকে ক্যাথরিন হুইলে চড়ানো হোক, যতক্ষণ পর্যন্ত সে স্বীকার না করে কারা কারা তাকে এই হত্যায় সহযোগিতা করেছিল। ক্যাথরিন হুইল এমন একটা চাকা যেটাতে অভিযুক্তের হাত পা বাঁধা হত এক্স(X) এর মত করে, এরপর এটা ঘুরালে ঘাড় থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে হাত পা সব ভেঙ্গে যেত।
এখানে দুইটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, একটা অপরাধের শাস্তি, আরেকটা শাস্তি দেয়ার আগে সমাজে সবার সামনে নির্যাতন- যেটা আবার বিচারিক প্রক্রিয়ার একটা অংশ ছিল। ফ্রান্সে সেসময়ে ক্যাথরিন হুইলের মত অভিযুক্তদের আরও নানান পদ্ধতিতে নিষ্ঠুর ধরণের নির্যাতন করা হত ,স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য- টানা কয়েকদিন শূলে আটকে রাখা হত, কখনো পানিতো চুবানো, কখনো ইস্ত্রীর গরম চ্যাকাসহ নির্মম সব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো। শাস্তি দেয়া হত, চারটা ঘোড়ার সাথে চার হা-পা বেঁধে ছেড়ে দেয়া হত। মাথাকাটাসহ আরও নানান বীভৎস ধরণ।
কালাকে জনসম্মুখে যখন এভাবে নির্যাতন করা হচ্ছিল সে বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিল। কালার মৃত্যুর পর এই ঘটনা ফরাসী সমাজে দারুণ নাড়া দেয়। অসংখ্য তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। কালার মৃত্যুর আগে পরে অবশ্য এমন অসংখ্য নির্যাতনের ঘটনা ফরাসি সমাজে হরহামেশা ছিল। কিন্তু কালার ঘটনার মত বাকী নির্যাতনগুলো নিয়ে এমন তর্ক-বিতর্ক ছিল না। কালাকে নিয়ে এতসব তর্ক-বিতর্ক হলেও এর কেন্দ্রবিন্দু কালার নির্যাতন নিয়ে ছিল না, ছিল কালা নির্দোষ নাকি দোষী ।ঠিক শহীদুন্নবির মৃত্যুর পরের আলাপের মত।
কালার নির্যাতন নিয়ে কেন সেসময়ে ফরাসি সমাজে সংবেদনশীলতা তৈরি হল? লিন হান্টের মত হচ্ছে, ফরাসি সমাজে তখন ব্যক্তি আর ব্যক্তির শরীরের ধারণার বোঝাবুঝির বিষয়ে অদ্ভুত এক ধরণের রুপান্তর ঘটছিল। আগে ফরাসি চিত্রকল্প ছবিতে স্রেফ রাজ-রানীদের চেহারা থাকত, এসময়ে এসে সমাজের সাধারণ মানুষের চেহারা আঁকা হয়। মানুষ তখন নিজের শরীর এবং নিজেকে নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে শুরু করে। আগে এক ঘরে অনেকে মিলেমেশে থাকলেও এসময়ে ঘরে আলাদা রুমে আলাদা আলাদা থাকা শুরু করে। রাস্তায় জনপরিসরে থুথু ফেলা এসব খারাপ চোখে দেখা শুরু হয়।
চারিদিকে সাইলেন্স (নীরবতা)। ফলে ব্যক্তি মানুষের শরীর আর দেহের প্রতি আলাদা নজর আর সংবেদনশীলতা তৈরি হয় মানুষের। ঠিক এসময়ে কালাকে যখন মিথ্যা অপবাদে হাড়-গোড় ভেঙ্গে ঘুরানো হচ্ছিল কালার শরীরের সাথে সাধারণ মানুষ এই প্রথম নিজের শরীরকে মিলাচ্ছিল। এটাকে হান্ট বলছেন ‘Bone of their Bone’, অপরাধীর শরীরও আমাদের মতন। তুমুল আলোচনা শুরু করেন ভলতেয়ার প্রথম “এসময়ে সবচেয়ে আলোচিত লেখা ছিল দার্শনিক ভলতেয়ারের “Treaties on Tolerance on the Occasion Of the Death of Jean Calas” লিখে। ভলতেয়ারের লেখারও মুখ্য বিষয় ছিল কালা নির্দোষ ছিল নাকি ছিল না। নির্যাতনের বিষয়টা না। এতদসত্ত্বেও এই তর্ক-বিতর্ক কিছুদিনের মধ্যেই আস্তে আস্তে পুরো ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য লেখক চিন্তক কিছু সুর্নিদিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শাস্তি এবং নির্যাতনের প্রয়োগ বিধি নিয়ে আলাপ শুরু করেন।
দেখা যায় তিরিশ বছরের মধ্যেই পুরো ইউরোপজুড়ে (কলোনিগুলো বাদে) এই ধরণের অমানবিক সকল নির্যাতনের আইনি ধারা-উপধারা বন্ধ হয়ে যায়।
এইসবরেই ধারাবাহিকতা আমরা লক্ষ্য করি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে, যেখানে বলা হয় সমগ্র মানব সমাজ একটা পরিবারের মত। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। কেউ কাউকে দাস বানাতে পারবেনা। কাউকে টর্চার করতে পারবেনা। টর্চারের সাথে সাথে আরও চার পাঁচটা বিষয় বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে ওঠে— বিচার কেমন হবে? বিচারের মধ্যে কি নিশ্চিত করতে হবে? কোনো পর্যায়ে কাউকে এমনভাবে গ্রেফতার করা যাবেনা বা এমনভাবে বন্দী করা যাবেনা বা এমন ধরণের আচরণ করা যাবেনা যেটা তার মানবিক মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক।
ফলে নির্যাতনের বিষয়ে মানুষের মানবিক মর্যাদা এবং সমতা এই দুইটা খুব-ই জরুরি বিষয়। কেননা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে মানুষের ফিজিক্যাল ইন্টিগ্রিটি ধ্বংস করা যায় আবার নির্যাতন ছাড়াও এমন আচরণ করা যায় (যেমন উলংগ করে ফেলা) যার মধ্য দিয়ে তার ইজ্জত সম্মান শেষ করা যায়। এমন ধরণের আচরণ আবু গারিবে ঘটেছে, সম্প্রতি বেগমগঞ্জে ঘটেছে, এটা মেরে ফেলার চাইতেও ভয়ানক অনেকের কাছে।
ফলে ইউরোপে আধুনিক আইন-আদালতের তর্ক-বিতর্ক যখন হচ্ছিল তখন এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যখন কাউকে প্রশ্ন করা হবে তখন তার শরীর এমন কোন ধরণের আঘাত করা যাবেনা যেটা তার সম্মানে আঘাত হানবে। (অবশ্য ইউরোপ-আমেরিকার মাটিতে এমন ধরণের ইন্টারোগেশন নিষিদ্ধ বলে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের অভিযুক্ত মুসলিম বন্দীদের নির্যাতনের জন্য আমেরিকাকে এইজন্য আমেরিকার বাইরে গুয়ান্তানামো বে আর আবুগারিব নামক আলাদা কারাগার বানাতে হয়েছিল- সেটা ভিন্ন আলাপ)।
কাউকে নির্যাতন করে সে অপরাধী কি না, তার সহযোগী কারা– এসব জানাটা বিচারিক প্রক্রিয়ায় উপযোগী কিনা এটা খুব-ই গুরুতর প্রশ্ন। এসব নিয়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে ইতিমধ্যেই অনেক রায়-নির্দেশনাও আছে। আমি এসবে আজ আলাপ করছিনা। কিন্তু যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে অথবা বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে কাউকে নির্যাতন করার ইস্যুটা। বাংলাদেশে এটা নিয়ে অল্প কিছু শ্রেণীর মানুষ ছাড়া নাগরিকদের একটা বড় অংশ-ই এখনও সংবেদনশীল না।
অনেকেই শহীদুন্নবীর হত্যার বিষয়ে গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ মানুষের অসংবেদনশীলতা আর ধর্মীয় চেতনার কথা বলবেন। বাস্তবতা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রাঙ্গনেই এইরকম গণপিটুনি দেয়ার কমপক্ষে পনেরটা ঘটনা আমি চাক্ষুষ দেখেছি। হলে উঠার পরের মাসেই এসএম হলের বারান্দা থেকে দেখি একটা মেডিকেলের ছাত্রকে পিটিয়ে মেরেই ফেলা হয়েছিল মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে। হিজবুত করার অপরাধে ব্যবসায়ী প্রশাসনের একটা ছেলেকে কি বীভৎসভাবে পিটিয়েছিল বটতলার পাশে। একজনকে দেখেছি মহসিন হল থেকে লাফ দিয়ে সূর্যসেনে পড়ে হাত পা ভেঙ্গে যাওয়ার পরও তাকে আবার মেরেছিল অসুস্থভাবে। এসব গণপিটুনি আর মবেও স্লোগান ছিল, জাতীয়তাবাদী স্লোগান অবশ্য। আয়রনি হচ্ছে জাতীয় পত্রিকা থেকে শুরু করে এখন যারা মব জাস্টিসকে প্রশ্ন করছেন, তাদের অনেকেই এইসব মব জাস্টিসকে ‘গণধোলাই’ শব্দ ব্যবহার করে বৈধতা দিয়েছিল সেসময় হরহামেশা।
ফলে দেখা যাচ্ছে আমাদের উচ্চ শিক্ষিতদের এলাকা থেকে শুরু করে একদম সমাজের প্রান্তিক এলাকা সবখানেই ধর্মের স্লোগান, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান,কিংবা এসব কিছুর-ই সংবেদনশীলতা আছে। কিন্তু নিরীহ কিংবা অভিযুক্ত মানুষের দেহের মানবিক মর্যাদার সংবেদনশীলতা এখনও তৈরি হয়নি সেই অর্থে। অসংখ্য লোক এখনও বিচারবহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করে, নাস্তিক বা শিবির মেরে ফেলা সমর্থন করে, উল্লাস করে। এইগুলা সমাজের অসুখ।
লালমনিরহাটের ঘটনায় মওলানা মামুনুল হকসহ বড় বড় অনেক উলামা নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। উনাদের উচিত উনাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মানুষের মাঝে এইসব বিষয়ে সংবেদনশীলতা তৈরিতে কাজ করা। সমাজ রুপান্তরে সময় লাগে , লাগে তর্ক-বিতর্কও। যারা এখন তর্ক করছেন শহীদুন্নবী নাস্তিক ছিলেন না আস্তিক ছিলেন আশা রাখি তারা-ই কয়েক বছর পর আলাপ করবেন শহীদুন্নবীর উপর ঘটা নির্যাতন নিয়ে। স্রেফ বেআইনিভাবে ঘটা নির্যাতন নিয়েই না, যাতে করে আইনি প্রক্রিয়ায়ও কোন মানুষের চরম অমর্যাদা না ঘটে সেটা নিয়েও।
লেখক পরিচিতি:
খন্দকার রাকিব
সিনিয়র লেকচারার
নৃবিজ্ঞান বিভাগ
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
2 Comments