Message from the East- Muhammad Iqbal

একটি প্রাচ্য-বার্তা লেখার প্রেরণা উৎসারিত হয় জার্মান “জীবনঘন দার্শনিক” গােয়েথের প্রতীচ্য -প্রাচ্যদেশীয় কৌচ (West-oestlicher Diwan)- যা সম্পর্কে জার্মানীর ইহুদি কবি হাইনে (Heine) লেখেন :

“ইহা প্রাচ্যের প্রতি পাশ্চাত্যজগতের একগুচ্ছ প্রাপ্তি স্বীকার … কৌচ এই সত্যের সাক্ষ্য করে যে, তাদের দুর্বল এবং শীতল আধ্যাত্মিকতায় নিদারুণ বিরক্ত হয়ে পাশ্চাত্যজগৎ প্রাচ্যের বক্ষমাঝে অনুপ্রেরণা খুঁজছে।”

কীসের প্রভাব এবং কীরূপ পরিস্থিতি কবিতা সমাহার কৌচ- গােয়েথের স্বয়ং চয়নকৃত শিরােনাম- লেখায় ব্রতী করে- যেগুলাে তার উত্তম সাহিত্যকর্মগুলাের অন্যতম- সে প্রশ্নের উত্তরের জন্য জার্মান সাহিত্য আন্দোলন যা’ জার্মান-সাহিত্য ইতিহাসে “প্রাচ্যজগতীয় আন্দোলন” (Oriental Movement) নামে পরিচিত, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া প্রয়ােজন। মূলত আমার ইচ্ছা ছিল উল্লিখিত আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই ভূমিকায় আলােচনা করা, কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই কাজে প্রয়ােজনীয় বেশির ভাগ উপাদান ভারতে দুষ্প্রাপ্য। ‘এ হিস্টোরি অব পরসিয়ান লিটারেচার’র লেখক পল হরন (Paul Horn), পারস্য কবিদের কাছে গােয়েথে কতটা ঋণী সে সম্পর্কে তার এক নিবন্ধে আলােচনা করেছেন, কিন্তু আমি ‘নড়ড উন্ড সুদ’ (Nord und Sud)’র যে সংখ্যায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল তা ভারত বা জার্মানীর কোনাে লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করতে অসমর্থ হই। ফলে এই ভূমিকা লিখতে আমি অংশত অতীতে আমার ব্যক্তিগত অধ্যয়নের স্মৃতি এবং অংশত মি. চার্লস রেমি’র (Charles Remy) সংক্ষিপ্ত কিন্তু উপযােগী এ বিষয়ে লেখা এক প্রবন্ধের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হই।

যৌবনের প্রথম থেকে গােয়েথের বহুমুখ-কর্মশক্তিসম্পন্ন মন প্রাচ্যজগতের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়। স্ট্রাসবুর্গে আইনশাস্ত্র অধ্যয়নকালে তিনি জার্মান সাহিত্যের বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব, হেরডার (Herder)’র সাক্ষাৎ লাভ করেন, যার সাহচার্যের প্রভাব তিনি তার জীবনীগ্রন্থে স্বীকার করেছেন। হেরডার ফার্সী জানতেন না। তৎসত্ত্বেও, তার নৈতিক আবিষ্টতার কারণে, তিনি সাদি’র লেখার প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, এতদূর যে তিনি গুলিস্তাঁ’র অংশবিশেষ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। খা’জা হাফিজের কবিতা তাকে খুব বেশি আকৃষ্ট করেনি। সাদি’র প্রতি তার সমসাময়িকদের দৃষ্টি আকষর্ণ করে তিনি লেখেন :
“হাফিজের ধরণে আমরা অনেক কবিতা লিখেছি। এখন আমাদের যা’ করণীয় তা’ হলাে সাদি’কে অনুসরণ করা।” যা হােক, পারসীয় সাহিত্যে তার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও, সেই সাহিত্যের প্রভাবের সামান্য উপস্থিতি তার কবিতায় বা তার গদ্য রচনায় পাওয়া যায়। একইভাবে, গােয়েথের অন্যান্য সমসাময়িক, শিলার (Schiller), যার মৃত্যু প্রাচ্যজগতের আন্দোলন শুরুর আগেই হয়েছিল, তাই প্রাচ্য-প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন, যদিও এটা উপেক্ষা করা উচিত হবে না যে মওলানা নিজামী’র চতুর্থ রাজ্যের (Haft Paikar) রাজার কন্যা সম্পর্কীয় গল্প অবলম্বনে তার নাটক তুরানদুখত (জার্মান ভাষায় Turandot)’র মুসাবিদা করেছিলেন এবং শুরু করেছিলেন এক পদ্য দিয়ে, যা (ভাষান্তর করলে দাঁড়ায়)। এইরূপ :

“সে বলে যে রুশীয় ভূমির মধ্যে,
ছিল এক নগরসুন্দর যেন এক নববধু।”

১৮১২ সালে, ফন হামার (Von Hammer) হাফিজের দিভানের পূর্ণ অনুবাদ প্রকাশ করেন এবং এটিই ছিল ঘটনাক্রম যা’ জার্মান সাহিত্যে প্রাচ্যজাগতিক আন্দোলনের সূচনা করে। সে সময় গােয়েথে পঁয়ষট্টি বছর বয়স্ক ছিলেন- একটা সময় যখন জার্মান জাতি পতনের সকল ক্ষেত্রে শেষবিন্দুতে উপনীত হয়েছিল। গােয়েথে মেজাজগতভাবে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তার অবিচল এবং অত্যুচ্চ মনন, ইউরােপে বিস্ততিলাভ করা কলহে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি প্রাচ্যজাগতিক পারিপার্শ্বিক প্রশান্তি এবং স্থিরতার মাঝে খুঁজে পান নিজের জন্য এক স্বর্গ। হাফিজের সুর গােয়েথের চেতনায় এক শক্তিশালী ঝড়ের সৃষ্টি করে, যা’ এক স্থায়ীরূপ নেয় প্রতীচ্য-প্রাচ্যদেশীয় কৌচ (Westoestlicher Diwan)-এ। ফন হামারের অনুবাদ- অবশ্য গােয়েথের জন্য নিছক প্রেরণাই ছিল না, বরং এটা তার অনন্যসাধারণ ধ্যান-ধারণার সূত্রও ছিল। দিভানে এমন কিছু স্তবক আছে, যা পড়তে হাফিজের কবিতার উদার অনুবাদের মতােই মনে হয়। সেখানে আরও কিছু স্তবক আছে, যেখানে তার কল্পনা, হাফিজের দিগরেখার পাশে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়ে জীবনের জটিল এবং অন্তর্নিহিত সমস্যাদির উপর আলােকপাত করেছে। গােয়েথের বহুলপরিচিত জীবনীকার, বিয়েলশােভস্কি (Bielshowsky) লিখেছেন :

“সিরাজের নাইটিংগেলের গানে গােয়েথে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান। এমন অনেক সময় ছিল যখন তিনি অলীক কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাসে অভিজ্ঞতা লাভ করেন যে, তার আত্মা পূর্বজন্মে, সম্ভবত প্রাচ্যজগতে হাফিজের দেহে আবাসিত ছিল। তার মধ্যে ছিল একই পার্থিব আনন্দ, একই স্বর্গীয় প্রেম, একই গভীরতা, একই উষ্ণতা এবং উৎসাহ একই সর্বজনীন উদারতা, একই খােলামন, বিধিনিষেধ এবং প্রথা থেকে একই স্বাধীনতা, সব কিছুর মাঝে আমরা তাকে পাই এক দ্বিতীয় হাফিজকে। হাফিজ গুপ্ততার মুখপাত্র এবং রহস্যমতবাদের এক ব্যাখ্যাতা ছিলেন, এবং গােয়েথেও তাই। বাস্তবত হাফিজের সাধারণ কথা যেমন এক বিশাল অর্থবােধক হয়ে উঠেছে তেমনি গেয়েথের আন্তরিকতাপূর্ণ উচ্চারণে লুকানাে সত্য আপনা থেকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। উভয়ে একাধারে বিত্তবান ও বিত্তহীনের আশা-আকাঙ্ক্ষা উন্মােচন করেছেন। উভয়ে তাদের ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাদের সময়ের মহান বিজেতাদের (যেমন হফিজের ক্ষেত্রে তৈমূর, এবং গােয়েথের ক্ষেত্রে নেপােলিয়ন) প্রভাবিত করেছেন, এবং সাধারণ ধ্বংস ও অবক্ষয়ের সময়ে তাদের অন্তঃস্থ শান্তি এবং আত্মসংবরণ অক্ষুন্ন রেখে স্বীয় গান গেয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন ।”

হাফিজ ছাড়াও গােয়েথে তার ধারণার জন্য সাইখ, আতার, সা’দি, ফেরদৌসী এবং সাধারণভাবে ইসলামী সাহিত্যের নিকট ঋণী। এমনকি তিনি ধ্বনিসঙ্গতিপূর্ণ এবং ধ্বনি আনুষঙ্গিক কিছু গজল রচনা করেন। তিনি অবাধে তার কবিতায় পারসীয় রূপকালঙ্কার এবং প্রতিরূপ ব্যবহার করেছেন। (উদাহরণস্বরূপ, ‘ছন্দের রত্ব,’ ‘অস্তিপক্ষ্ম বাণ’, ‘কুঞ্চিত কেশদাম’) প্রকৃতপক্ষে, পারসীকীয়তায় প্রবল আকুলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি যৌনসংসর্গের দিকে ইঙ্গিত করতেও নিজেকে বিরত রাখেননি। দিভানের বিভিন্ন খণ্ডের নাম পারসীয় যেমন, “মুঘানীনামাহ”, “সাকিনা নামাহ”, “ইশক-নামাহ”, “তিমুর-নামাহ”, “হিকমত-নামাহ”। এই সব সত্ত্বেও, গােয়েথে কোনাে পারসীয় কবির অনুকরণকারী ছিলেন না; তার সহজাত কাব্যিক সৃজনী ক্ষমতা পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র । প্রাচ্যের টিউলিপ-বাগানে তার গান গাওয়া নিখাদ একটি সাময়িকপর্ব। তিনি কখনই তার পাশ্চাত্য জাতীয়তা ত্যাগ করেননি, এবং তার ঝলকানি সেই সব প্ৰাচ্য সত্যের উপর নিবিষ্ট ছিল, যা তার পাশ্চাত্যমননের তূল্য হতে পারে। পারসীয় অতীন্দ্রিয়তাবাদে তার কোনােই আগ্রহ ছিল না। যদিও তিনি জানতেন যে, প্রাচ্যে হাফিজের কবিতা অতীন্দ্রিয়তাবাদের নিরিখে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে; তিনি নিজে খাঁটি ও সাধারণ গজলে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন এবং হাফিজের অতীন্দ্ৰয়তামূলক ব্যাখ্যায় সহানুভূতিশীল ছিলেন না। রুমি’র দার্শনিক সত্য এবং বিজ্ঞতাপূর্ণ উক্তি তার কাছে শুধুই অস্পষ্ট মনে হত। এটা, অবশ্য, প্রতীয়মান যে, তিনি যত্নসহকারে রুমিচর্চা করেননি; কারণ এটা অসম্ভব যে, একজন যিনি স্পিনােজার (ওলন্দাজ দার্শনিক, যিনি অস্তিত্বের একত্বে বিশ্বাসী ছিলেন) গুণমুগ্ধ ছিলেন এবং যিনি ব্রুনাের (ইতালির অস্তিত্ববাদি দার্শনিক) সমর্থনে লিখেছিলেন তিনি রুমিকে স্বীকার করেননি, যদি তিনি তাকে যথেষ্টভাবে জেনে থাকেন।

সংক্ষেপে বলা যায়, গােয়েথে ‘ভেস্ট-ওয়েস্টলিশার ডিভান’র মাধ্যমে পারসীয় উদ্দীপনাকে জার্মান সাহিত্যে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তী কবিরা, যেমন প্লাটেন, রুয়েকার্ট এবং বোদেনস্টেট, ডিভান সূচিত প্রাচ্যদেশীয় আন্দোলন পূর্ণাঙ্গ করেন। প্লাটেন তার সাহিত্যচর্চার নিমিত্ত ফার্সী শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি গজল এবং রুবাইয়াত রচনা করেন যাতে তিনি ধ্বনিসঙ্গতিপূর্ণ এবং ধ্বনিআনুষঙ্গিক এবং এমনকি ফার্সী ভাষার ছন্দপ্রকরণ অনুসরণ করেন। তিনি এমনকি নেপােলিয়নের উপর এক ‘কাশিদাহ’ লিখেছিলেন। গােয়েথের ন্যায় তিনি অবলীলাক্রমে পারসীয় রূপকালঙ্কার, যেমন, ‘গােলাপ-বধূ’, ‘মৃগমদীয় কুঞ্চিত কেশ’ এবং ‘টিউলিপ-মুখী’, এবং তিনি ছিলেন খাঁটি অথচ সাধারণ গজলের ভক্ত। রুয়েকার্ট আরবী, ফার্সী এবং সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি রুমির দর্শনকে উচ্চে স্থান দিয়েছেন এবং রুমির অনুকরণে তার বেশিরভাগ গজল রচনা করেন। যেহেতু তিনি প্রাচ্য ভাষায় একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তার প্রাচ্যের কবিতার সূত্রও ছিল আরও বহুমুখী। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, যেমন, নিজামীর মাখজাম আল আসরার, জামীর বাহারিস্তান, আমির খসরু’র কুলিয়াত, সাদি’র গুলিস্তা থেকে এবং মানাকীর আল আরিফিন, আয়ার দানিশ, আন্তিক আল-তাহির ও হেফট কুলজুম থেকে, সেখান থেকেই গভীর জ্ঞানের মুক্তা আহরণ করেছেন। বস্তুত এমনকি প্রাক-ইসলামিক প্রথা এবং পারসীয় গল্প থেকেও তিনি তার রচনা অলঙ্কৃত করেছেন। তিনি ইসলামের ইতিহাসের কিছু ঘটনারও সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন, উদাহরণস্বরূপ মাহমুদ গজনভির মৃত্যু, মাহমুদের সােমনাথ মন্দির ধবংস, সুলতানা রাজিয়ার সাহসিকতা। প্রাচ্যজাগতিক আন্দোলনে গােয়েথের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি বোদেনস্টেট, যিনি ‘মির্জা শাফি’ ছদ্মনামে কবিতা প্রকাশ করেন। এটা এক ছোট সঞ্চয়িতা ছিল কিন্তু এত জনপ্রিয়তা পায় যে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে এর ১৪০ সংস্করণ বের করতে হয়। বােদেনস্টেট এত নিপুণভাবে পারসীয় ভাবধারা আত্মস্থ করেছিলেন যে, জার্মানীতে দীর্ঘদিন যাবৎ লােকে তার কবিতাকে পারসীয় কবিতার অনুবাদ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। তিনি আমির মুইজী এবং আনবারী থেকেও সমৃদ্ধ হয়েছিলেন।

আমি ইচ্ছাকৃতভাবে এ প্রসঙ্গে গােয়েথের সমসাময়িক খ্যাতনামা আইনের উল্লেখ থেকে বিরত থেকেছি। যদিও তার কবিতা সঞ্চয়ন ‘নিউ পােয়েমস’-এ পারসীয় প্রভাব লক্ষণীয় এবং তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মাহমুদ এবং ফেরদৌসীর গল্প বর্ণনা করেছেন, যদিও, মােটের উপর, প্রাচ্যজাগতিক আন্দোলনের সাথে তার কোনাে যােগাযােগ ছিল না। বস্তুত তিনি গােয়েথের দিভান ছাড়া প্রাচ্যআন্দোলন সম্পৃক্ত জার্মান কবিতাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। অবশ্য স্বাধীনচেতা জার্মান কবি পারসীয় জাদুকরি চমৎকারিত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। নিজেকে জার্মানীতে নির্বাসিত পারসীয় কবি ভেবে নিয়ে লেখেন; “ও ফেরদৌসী, ও জামী, ও সা’দি, তােমাদের ভাই আবদ্ধ এক নিরানন্দ বন্দিখানায়, সিরাজের গােলাপের লাগি অধীর অপেক্ষায়।”

আরাে উল্লেখ্য যে, প্রাচ্য আন্দোলনের কবিগণ হলেন দাউমার, হাফিজের অনুকরণকারী, হারমান স্টাল, লােয়েশকে, স্টিগলিটস, লেন্টহােন্ড এবং ফন শাক। শেষােক্ত জন জ্ঞানাহরণের জগতে উচ্চাসনে আসীন ছিলেন। তার কবিতার মধ্যে দুটি, ‘দি জাস্টিস অব মাহমুদ গজনভী’ এবং ‘দি স্টোরি অব হারুত অ্যান্ড মারুত ‘সুবিদিত এবং তার কবিতা, সামগ্রিকভাবে, ‘উমর খইয়াম’র প্রভাবের চিত্র বহন করে। যাহােক, প্রাচ্য-আন্দোলনের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এবং জার্মান এবং পারসীয় কবিদের পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলনা এবং পারসীয় প্রভাবের প্রকৃত মাত্রা নিরূপণের জন্য এক বিস্তৃত পর্যবেক্ষণ প্রয়ােজন যে কাজের জন্য আমার পক্ষ থেকে না-আছে সময় না-আছে সহায়-সম্বল। এটা হতে পারে যে, এখানে যে সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হলাে তা আমার থেকে নবীন কাউকে প্রয়ােজনীয় গবেষণায় অনুপ্রাণিত করবে।

“ভেস্টওয়েস্টলিশার দিভান”র শতকের কিছু বাড়তি বছর পরে রচিত ‘পাইয়াম-ই-মাশরিক’ (প্রাচ্যবার্তা) সম্পর্কে আমার বেশি কিছু বলার প্রয়ােজন দেখছি না। আমার পাঠকবৃন্দ নিজেরাই উপলব্ধি করবেন যে, এর অন্তর্নিহিত প্রধান উদ্দেশ্য হলাে ব্যক্তি এবং জাতীয় জীবনের অন্তঃস্থ উন্নয়নে নীতিবােধ, ধর্মীয় এবং সামাজিক সত্যোপলব্ধি জাগ্রত করা। শতবর্ষ আগের জার্মানী এবং এখনকার প্রাচ্যের নিঃসন্দেহে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। সত্য হলাে, অবশ্য, এই যে, বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, যা’ আমরা যথাযথভাবে নিরূপণ করতে পারি না ;কারণ আমরা নিজেরা এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং এটা এক মহৎ সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক বিপ্লব। ইউরােপের বিশ্বযুদ্ধ ছিল এক প্রলয়ঙ্করী, যা’ পৃথিবীর সনাতন ব্যবস্থাকে ধবংস করে প্রায় সকল ক্ষেত্রে এবং এখন সভ্যতার এবং সংস্কৃতির ভষ্ম থেকে প্রকৃতি জীবনের গভীরে নির্মাণ করছে এক নতুন আদম এবং এক নতুন পৃথিবী তার বাসের নিমিত্ত, যার সম্পর্কে আমরা আইনস্টাইন এবং বার্গসনের লেখায় ধূসরিত চিত্ররূপে দেখতে পাই। ইউরােপ তার নিজের চোখে দেখেছে এর ধীশক্তি, নীতিবােধ এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যের করুণ পরিণতি এবং সিগনাের নিত্তি (ইতালীর সাবেক প্রধানমন্ত্রী) থেকেও শুনেছে পাশ্চাত্যের পতনের হৃদয়বিদারক কাহিনী। এটা অবশ্য, করুণাকর যে, ইউরােপের স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন কিন্তু রক্ষণশীল রাষ্ট্রনায়কগণ মানুষের মনে সেই অবিশ্বাস্য বিপ্লব যে সংঘটিত হচ্ছে তা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে ।

এক বিশুদ্ধ সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষা পরবর্তী ইউরােপীয় জীবনীশক্তির দৌর্বল্য একটি সঠিক ও পরিপক্ক সাহিত্যিক আদর্শ উন্নয়নের সহায়ক নয়। বস্তুত, ভয় হয় যে, রাষ্ট্রগুলাের মানবিকতায় সেই ধীর স্পন্দন ধমনী ‘আযামিয়াত’ যা’ জীবনের সংকট থেকে পালিয়ে যায় এবং যা হৃদয়ের আবেগ এবং মস্তিষ্কের চেতনার পার্থক্য অনুধাবনে ব্যর্থ। যা হােক, পশ্চিমা সভ্যতায় আমেরিকাকে স্বাস্থ্যবান অনুপান বলে মনে হয় এর কারণ সম্ভবত এই যে এটা পুরনাে ঐতিহ্যের বাধাবিপত্তি থেকে মুক্ত এবং এর সমষ্টিগত অন্তর্জ্ঞান নতুন ধারণা এবং প্রভাব গ্রহণােন্মুখ ।

প্রাচ্য, এবং বিশেষত মুসলিম প্রাচ্য, শতাব্দি দীর্ঘ সুখনিদ্রা থেকে তাদের চোখ খুলেছে। কিন্তু প্রাচ্যের জাতিগুলােকে অনুধাবন করতে হবে যে জীবন তার পরিপার্শ্বে কোনাে বিপ্লব আনতে পারে না, যতক্ষণ না অন্তরের গভীরে বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং কোনাে নতুন বিশ্বই পারে না বাহ্যিক অবয়ব নিতে,যতক্ষণ না এটা মানুষের মনে গঠিত হয়। এই অনবক্রম বিধান ,যা কোরান সাধারণ অথচ বাঙ্ময় ভাষায় বলেছে, “যথার্থই ঈশ্বর একটি জাতির পরিবর্তন আনে না, যতক্ষণ না ইহা নিজেই পরিবর্তিত হয়।” [এয়ােদশ -১১]এটা ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক উভয়ের জীবন পরিক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে; এবং এই বিধানের এই সত্য, যা আমি আমার পারসীয় কর্মে দৃশ্যমান রাখার চেষ্টা করেছি।

বর্তমান বিশ্বে, এবং বিশেষত পূর্বাঞ্চলীয় দেশসমূহে, সকল প্রয়াস যার লক্ষ্য ব্যক্তি ও জাতির দৃষ্টিভঙ্গির ভৌগােলিক সীমানার বাইরে সম্প্রসারণ করা এবং তাদের মধ্যে এক স্বাস্থ্যবান ও রজ্জু মানবিক বৈশিষ্ট্য পুনরুদ্ধার বা উৎপন কর তা’ প্রশংসাযােগ্য । এ কারণে আমি এই কয়েকটি পাতা আফগানিস্তানের মহামান্য রাজাকে উৎসর্গ করেছি, যিনি তার সহজাত জ্ঞান এবং ধীশক্তি দ্বারা এই সত্য সম্পর্কে অবহিত মর্মে প্রতীয়মান এবং যিনি আফগানদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে এক বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। এই মহান ব্রত সাধনে আল্লাহ তার সহায় হন ।

পরিশেষে, আমি অবশ্যই আমার বন্ধু, চৌধুরী মুহাম্মদ হুসাইন, এম, এ, কে ধন্যবাদ জানাই; তিনি এখানে সন্নিবেশিত কবিতাগুলাের পাণ্ডুলিপির প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি এই কাজ করার কষ্ট স্বীকার না করলে এই কবিতা সমাহার প্রকাশে অনেক বিলম্ব ঘটতাে।

মুল :মুহাম্মদ ইকবাল
তর্জমা: নজরুল ইসলাম

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *