The philosophical basis of Western civilization- Maulana Muhammad Abdur Rahim

মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেব যে কত উঁচুমানের চিন্তক, সেটির প্রমাণ তাঁর “পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি” বইটির প্রতিটি পাতায়-পাতায় পাওয়া যায়।

            বইটিতে মূলত তিনি পশ্চিমে উদ্ভাবিত চারটি মতবাদকে অত্যন্ত ক্ষুরধার মুন্সিয়ানার সাথে কাউন্টার করেছেন। জ্যাকব হলিউকের "সেকুলারিজম", ডারউইনের "বিবর্তনবাদ", ফ্রয়েডের "মনস্তত্ত্ব ও যৌনতত্ত্ব" এবং মার্কসের "শ্রেণীবৈষম্য ও সমাজ দর্শন" তার এ বইটির মূল উপজীব্য। 

            সেকুলারিজমকে তিনি দেখিয়েছেন স্রেফ বিবেক, বুদ্ধি বা যুক্তির (Reason) উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দর্শন হিসেবে। এর সাথে স্রষ্টা কিংবা পরকালের কোনো সম্পর্ক নেই। সাইন্স এবং যুক্তির বিচারে দুনিয়ার সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে, সেকুলারিজমের এটাই দাবী।

তিনি বলেছেন- “সেকুলারিজম কোনো আদর্শ নয়, বরং আদর্শের অস্বীকৃতি (Negetion)”।[১] তিনি আরো বলেছেন, সেকুলারিজমকে আলাদা কোনো শিরোনাম দিয়ে দর্শনের কোনো বইতেই আলোচনা করা হয়নি। এমনকি বার্ট্রান্ড রাসেলের “History of Western Philosophy” বইতেও এটি অনালোচিত থেকেছে।
ডারউইন সহ সমস্ত বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে – প্রতিটি প্রাণীই তার পূর্বসূরি অন্য কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তিত।

              মাওলানা আব্দুর রহীম প্রশ্ন তুলেছেন- তাহলে এরকম করে পেছনে যেতে যেতে সর্বশেষ যে প্রাণীটা পাওয়া যাবে, তার সৃষ্টি কিভাবে হলো? অনেকটা 'ডিম আগে না মুরগী আগে'র মত। 

অর্থাৎ ডারউইনের তত্ত্ব যে স্রষ্টায় অবিশ্বাসী এক অন্তঃসারশূণ্য দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত এটি তিনি অসংখ্য বৈজ্ঞানিক থিওরি দিয়েও প্রমাণ করেছেন। অবশ্য বিবর্তনবাদের বিপরীতে লেখা ওনার একটি স্বতন্ত্র বইও রয়েছে।

           যৌনতার ব্যাপারে অস্ট্রিয় ডাক্তার ও মনস্তত্ত্ব গবেষক সিগমন্ড ফ্রয়েড বলেছে- এমনকি ছেলে শিশুরও তার মায়ের প্রতি যৌনাকাঙ্খা থাকে, শুধুমাত্র তার যৌনাঙ্গের অপরিপক্কতা ও অদৃঢ়তার কারণে সে কামনা চরিতার্থ করতে পারে না। 

চেতন, অবচেতন ও অনবচেতন এ তিনটি ক্যাটাগরিতে ফ্রয়েড মানব মনকে বিভক্ত করেছে। যৌনতা ও মানবমন নিয়ে এ জাতীয় হাস্যরসাত্নক আরো বেশকিছু থিওরি ফ্রয়েডীয় দর্শনে পাওয়া যায়।

                  সুলেখক মাওলানা আব্দুর রহীম ফ্রয়েডের শিশুর যৌনতা বিষয়ক তত্ত্ব খন্ডন করে বলেছেন- "বিভিন্ন বৃত্তি বা আবেগ বিভিন্ন স্নায়ুতন্ত্রীর আলাদা আলাদা রাসায়নিক পদার্থ থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে। যৌনবৃত্তির আবেগ যৌবনপ্রাপ্তির আগে কখনোই সৃষ্টি হতে পারেনা"।[২] 

তিনি আরো বলেছেন- “৫/৬ বছরের একটি শিশুর যৌনস্পৃহা জাগা দূরের কথা, পিতা-মাতাকে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত দেখেও তারা কি করছে সেটি অনুধাবন করতে অক্ষম। পিতা-মাতার সঙ্গমকালীন নড়াচড়া দেখে তার মধ্যে বিস্ময়বোধ জাগতে পারে, যৌনস্পৃহা জেগে ওঠা অসম্ভব”।[৩]

            মার্কসীয় দর্শনের পর্যালোচনায় তিনি কার্ল মার্কসের আদর্শিক গুরু হেগেলের দ্বান্দ্বিক তত্ত্বকে (Dialectic) সামনে এনেছেন।

“হেগেল বলেছে, “Thesis” এবং “Antithesis” এর সমঝোতায় আরেকটি নতুন ধারণা তৈরি হয় সেটি হলো “Synthesis”। আবার এই Synthesis এর বিপরীতে নতুন আরেকটি দাবী উত্থাপিত হয়” ।[৪] আব্দুর রহীম র. এর বিপরীতে বলেছেন- যদি প্রথমটি দ্বিতীয়টির বৈশিষ্ট্যের কিছু অংশ নিয়ে পরস্পর সমঝোতা করে তাহলে এটাকে দ্বান্দ্বিক (Dialectic) বলা যায়না।

মার্কসের সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, পরিবার সহ বেশ কয়েকটি অনুষঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি এ আলোচনায় অর্থনীতি ও শ্রেণিসংগ্রামকে প্রাধান্য দিতে চাই। মার্কসীয় দর্শনের মূল উপজীব্য ‘শ্রেণিবৈষম্য’। তিনি মানবেতিহাসে কেবল শ্রেণিসংগ্রামকেই খুঁজে পেয়েছেন। সংঘাত-সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে মার্কস সমাধান দেখেননি। সমাজ বিবর্তনের একমাত্র নিয়ামক হিসেবে তিনি শ্রেণিবৈষম্যকে দেখেছেন। আর এ শ্রেণিবৈষম্যের মূল হিসেবে তিনি দেখেছেন অর্থনীতিকে।

মাওলানা আব্দুর রহিম বলতে চেয়েছেন- সমাজের সার্বিক সমস্যা শুধু অর্থনীতি বা শ্রেণিবৈষম্যের কারণে নয়। আদর্শিক-রাজনৈতিক কারণেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ সংগ্রাম নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতা কিংবা আলোচনার মাধ্যমেও সমাধান করা সম্ভব। ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে যারা তৎকালীন ফ্রান্স সরকারের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিল, তারা সবাই দরিদ্র ছিল না। বরং সেখানে ধনশালী বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিয়েছিল। সুতরাং অর্থনীতিকেই সামাজিক অসাম্যের একমাত্র কারণ বলা যেতে পারে না।

                   বইটি আরো বিশদ আলোচনার দাবী রাখে, সংক্ষেপে সকল বিষয়কে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। আজ যদি মাওলানা আব্দুর রহীম, মার্কস, ফ্রয়েড এবং ডারউইন বেঁচে থাকতো! আর এ চারজনের একটি গোলটেবিল মিটিংয়ের আয়োজন করা যেতো! মাওলানা এক এক করে প্রত্যেকের আনীত মতবাদকে যুক্তির মারপ্যাঁচে অসার প্রমাণ করতেন; আর আমরা মার্কস, ফ্রয়েড আর ডারউইনদের চেহারার দিকে তাকিয়ে তাদের সলাজ প্রতিক্রিয়া দেখতাম।

পরিশেষে বলতে চাই, মাওলানা আব্দুর রহীম বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম শুধু নয়, মুসলিম উম্মাহর এক অমূল্য সম্পদ। তার এ বইটি পাঠে পাঠক পশ্চিমা মতবাদ সমূহের একটি জ্ঞানগর্ভ পর্যালোচনা ও যুক্তিময় প্রত্যাখ্যান দেখতে পাবে।

তথ্য সূত্র:
[১]পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি- পৃ. ৩২
[২]প্রাগুক্ত- পৃ. ৮৩
[৩]প্রাগুক্ত- পৃষ্ঠা. ৮৫
[৪]প্রাগুক্ত- পৃ. ১০১

লেখক পরিচিতি:
নূরুল হুদা হাবিব
ইউনিভার্সিটি অব সারাজেভো,
সারাজেভো, বসনিয়া হার্জেগোভিনা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *