The Development of Metaphysics in Persia-Muhammad Iqbal

ইরানবাসীদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের সবিশেষ উল্লেখযােগ্য দিক হলো তাদের প্রজ্ঞান চিন্তা প্রবণতা। কিন্তু আজকের দর্শনের ছাত্রেরা যদি কপিল বা কা’ন্ট এর বেলায় যেমন সম্ভব তেমন কোনাে সুনির্দিষ্ট ও সুসজ্জিত দার্শনিক প্রথার খোঁজ এ-ক্ষেত্রে করতে যান, তবে তাঁদেরকে বিফল মনােরথ হতে হবে। ইরানীয় দর্শন সম্পর্কীয় সে সব পুরােনাে পুঁথি-পুস্তকের অস্তিত্ব এখনও রয়েছে, তাতে বুদ্ধির দীপ্তি বা চিন্তার নৈপুণ্যের পরিচয় যতই থাকুক না কেন, তা নিয়ে কোনো সামগ্রিক দর্শন পদ্ধতি গড়ে তােলা কষ্টসাধ্য ।

আমার মনে হয় ইরানীদের মন ধৈর্যের সাথে পা বাড়াতে অনভ্যস্ত। সে জন্যে পরিদৃষ্ট জগতের ঘটনাবলীকে কতকগুলি মৌলিক নীতির আওতায় এনে এবং যথাযথ সাজিয়ে, সে পশ্চাৎভূমি থেকে বহির্বিশ্বের দিকে তাকাবার মতো যােগ্যতা সাধারণভাবে তারা রাখে না। সুক্ষ্মবুদ্ধি ব্রাহ্মণ সর্ববস্তুর মধ্যে গূঢ় ঐক্য দেখতে পান ; ইরানীরাও তাই। কিন্তু ব্রাহ্মণ চান মানুষের সমগ্র অনুভূতির ক্ষেত্রে এ সত্যকে দেখতে এবং বস্তুজগতে এর অন্তর্নিহিত প্রতিফলন বিভিন্নরূপে প্রমাণিত করতে। আর ইরানীরা প্রকৃতিতে একটি মােটামুটি বিশ্বজনীনতার প্রকাশ দেখেই সন্তুষ্ট ; তার আভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তিতে যে বিশ্ব ঐক্যের এক অবিচ্ছিন্ন সূত্র অপূর্ব বৈচিত্র্যে বিরাজ করছে, সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই।

ইরানী প্রজাপতিমন যেন নেশার ঘােরেই ফুল থেকে ফুলে উড়ে বেড়ায় ; সামগ্রিক দৃষ্টি দিয়ে বাগানটিকে দেখতে চায় না। এই কারণেই তার চিন্তার ও ভাব প্রবণতার গভীরতম প্রকাশ ঘটে গযল এর খাপছাড়া পদসমষ্টিতে ।
এতে তার শিল্প সমৃদ্ধ অন্তরের সুক্ষ্ম অভিব্যক্তি থাকলেও, দর্শনের প্রগতি দিশাহারা। ইরানীদের ন্যায় হিন্দুরাও জ্ঞানের একটি উচ্চতর উৎসে বিশ্বাসী । কিন্তু লব্ধ জ্ঞান নিয়ে হিন্দুমন মেতে ওঠে না । প্রাথমিক অভিজ্ঞতা থেকে যাত্রা করে সে অভিজ্ঞতা পরম্পরার দিকে ধীর ও সাবধানী পদক্ষেপে এগুতে থাকে এবং প্রত্যেকটি অভিক্ততাকে যুক্তির নির্মম অস্ত্রোপচারে বিমুক্ত করে তার অন্তর্নিহিত সাধারণ যােগসূত্র আবিষ্কার করে।

প্রজ্ঞানশাস্ত্রের ধারাবাহিকতা ও সামগ্রিক রূপের ধারণা ইরানীয় মস্তিষ্কে পূর্ণায়ত্ব নয় ; কিন্তু তার হিন্দু ভ্রাতার ব্যাপারে আলাদা। হিন্দুরা তাদের অবলম্বিত তত্ত্বকে একটি সুচিন্তিত ও সুমার্জিত পদ্ধতির মাধ্যমে দাঁড় করাবার প্রয়ােজনীয়তার প্রতি বিশেষভাবে সজাগ । দু’জাতির এ মনােভাবগত তারতম্যের ফল সুপরিস্ফুট । একের কাছে আমরা পাচ্ছি একটি অপরিপক্ক চিন্তধারার বিক্ষিপ্ত অথচ বিচিত্র সমাহার ; অন্যের কাছে পাচ্ছি বেদান্তের সুগভীর এবং ভীতিপ্রদ বিশালরূপ । ইসলামী মরমীবাদের দিক থেকে যাঁরা বিশ্ব ঐক্যের পূর্ণরূপ অবলােকন করতে চান, তাঁদের জন্যে আরব-স্পেনীয় দার্শনিক ইবনুল আরবীর বৃহদায়তন পুস্তকাবলীর সহায়তা গ্রহণ অপরিহার্য। তাঁর সে কালীন দেশবাসীরা ইসলামকে যতই নীতিনিবদ্ধ ও কঠোররূপে দেখে থাকুক না কেন, তিনি ছিলেন সে ক্ষেত্রে এক বিশিষ্টতম ব্যতিক্রম ।

মহান আর্য পরিবারের বিভিন্ন শাখা বিভিন্নরূপ প্রবণতা দেখিয়ে থাকলেও তাঁদের চিন্তা চর্চার ফলে আশ্চর্য সামঞ্জস্য রয়েছে । ভারতীয় আদর্শবাদের পরিণত ফল যেমন বুদ্ধ, পারস্যের তেমন ব্যক্তি হলেন বাহাউল্লাহ এবং পাশ্চাত্যের শপেনহাওয়ার । শপেনহাওয়ারের পদ্ধতিকে হেগেলীয় ভাষায় বলা হয়েছে : মুক্ত স্বাধীন প্রাচ্য দেশীয় বিশ্বজনীনতার সাথে প্রতিচ্যের সীমাসীনতার পরিণয় ।

কিন্তু ইরানের চিন্তাধারার ইতিহাসের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট । সম্ভবতঃ সেমিতীয় প্রভাবের ফলেই, ইরানের দার্শনিক চিন্তাধারা ধর্মের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েছে । চিন্তার ক্ষেত্রে যাঁরা নতুন পথের পথিকৃৎ, তাঁদের প্রায় সর্বসময়েই দেখা যাচ্ছে নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের প্রবর্তকরূপে । আরব বিজয়ের পরে অবশ্য মুসলিম নিও-প্লেটনীয় আরস্তু অনুসারীরা বিশুদ্ধ দর্শনকে ধর্মের আওতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন। কিন্তু এ ছিল একটি সাময়িক ব্যাপার। গ্রীক দর্শন আদতে পারস্য দেশের জন্যে বিজাতীয় হয়ে থাকলেও কালে তা ইরানীর দর্শনের সাথে একাকার হয়ে যায় ।
পরেকার ইরানীয় চিন্তানেতা ও সমালােচকেরা আরস্ত (Aristotle) এবং আফলাতুন (Plato)-এর দাশনিক ভাষাতেই নিজেদের ভাব প্রকাশ
করতে থাকেন এবং পূর্বপােষিত ধর্মীয় ধারণাদ্বারা প্রভাবিত হয়ে দার্শনিক সিদ্ধান্তাবলী বিবৃত করেন । ইসলাম পরবর্তী ইরানীয় চিন্তাধারাকে যথাযথ ভাবে বুঝতে হলে এ ব্যাপারটি আগে থেকে মনে রাখা প্রয়ােজন।

পাঠক স্বতঃই বুঝতে পারবেন যে বর্তমান আলােচনার উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতে ইরানীয় প্রজ্ঞান চর্চার ইতিহাস রচনার ভিত্তিপত্তন প্রয়াস । এ প্রচেষ্টা নিছক ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ; অতএব এতে কোনো মৌলিক চিন্তার অবকাশ নেই। তবুও নিম্নোক্ত দুইটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ-

প্রথমতঃ, ইরানীয় চিন্তাধারাকে আমি একটি যুক্তিগ্রাহ্য ধারাবাহিকতায় গ্রথিত করতে চেয়েছি এবং আধুনিক দর্শনের ভাষায় তার অর্থোদ্ধারের চেষ্টা করেছি। যতখানি আমার জানা আছে, এ প্রচেষ্টা পূর্বে হয়নি।

দ্বিতীয়তঃ, সূফীতত্বকে আমি বৈজ্ঞানিক পন্থায় বর্ণনা করবার চেষ্টা করেছি; এবং যে মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর জন্ম হয়েছিল, তাকে পাঠকের গােচরে আনবার প্রয়াস পেয়েছি। অতএব সাধারণ ভাবে গৃহীত মনােভাবের বিরুদ্ধে যেয়ে আমি প্রমাণ করতে চেয়েছি যে কালের বক্ষে মানসিক ও নৈতিক চিন্তা-পরম্পরার ঘাত প্রতিঘাতে মানব মনে যে আলােড়ন সৃষ্টি হয়, তাতে মানুষের স্তিমিত আত্মা সজাগ হয়ে ওঠে এবং উন্নততর জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়। এ হতেই হবে। সূফীবাদের অভ্যুদয়ও এর ব্যতিক্রম নয়।

‘যেন্দ’-এর ভাষা আমার অজ্ঞাত ; সুতরাং যােরো’ষ্টার সম্বন্ধে আমার বক্তব্য দ্বিতীয় পর্যায়ের দলিল নির্ভর। এ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে যা আলােচনা করেছি, সে সম্পর্কে আরবী ও ফারসী মূল পাণ্ডুলিপিগুলি দেখে নেবার সুযােগ আমার হয়েছে। তা -ছাড়া, এ বিষয়ে প্রকাশিত অনেক প্রামাণ্য গ্রন্থের সহায়তাও আমি পেয়েছি। যে সব আরবী ফারসী পাণ্ডুলিপির সাহায্য নেওয়া হয়েছে, সেগুলির নাম নিম্নে দেওয়া হলো :-

[১] তা’রীখে হকুমা -আল, বায়হাকী, বালিন রনাল লাইব্রেরী।
[২] শরহি- আন ওয়ারিয়াহ, (মুল সহ)—মুহম্মদ শরীফ (হিরাট) ঐ
[৩] হিকমাতুল আয়েন – আল কাতিবী
[৪] হিকতুল আয়েন এর ভাষ্য –
মুহম্মদ ইবনে মুবারক আল বুখারী-ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী।

[৫] হিকমতুন আয়েন এর ভাষ্য—আল, হুসায়নী
[৬] আওয়ারিফ আল-মুআরিফ-শাহাবুদ্দীন
[৭] মিশকাতুল আনওয়ার -আল, গাযযালী
[৮] কশফুল মাহজুব—আলী হাজবরী
[৯] রিসালাহ’ই নফস (আরস্তু থেকে অনুবাদ)
—আফযাল কা’শী
[১০] রিসালাহই মীর সৈয়দ শরীফ

[১১] খাতিমা- সৈয়দ মুহম্মদ গিসুদরাজ
[১২] মনাযিলস, সা’রীন -আবদুল্লাহ, ইসমাইল ( হিরাটি)
[১৩] জাভিদন নামাহ,—আফযাল কাশী
[১৪] তা’রীখুল হুকমা—শাহিযুরী- বৃটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরী ।
[১৫] Collected Works of Avicenna
[১৬] রিসালাহ, ফিল ওজুদ -মীর জুরজানী
[১৭] জাবিদানে কবীর- কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরী।
[১৮] জামি জাহান নুমা।
[১৯] মজমুআ-ই-ফারসী রিসালাহ—আন, নসফী
প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা- ট্রিনিটি কলেজ লাইব্রেরী।

তথ্য সূত্র:
[ The Development of Metaphysics in Persia]

তর্জমা: কামালউদ্দীন খান

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *