The Reconstruction of Religious Thought in Islam- Muhammad Iqbal
এ উপমহাদেশের মহাকবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালের আবির্ভাব সত্যিই এক দিকদর্শনের মতো। ইতিপূর্বে যে সব মহামানব ও মহামনীষী এ দেশের বুকে জন্মগ্রহণ করে তাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন – তাঁরা প্রত্যেকেই মানবজীবনের এক-একটা বিশিষ্ট দিক নিয়ে আলোচনা, গবেষণা ও প্রচার করেছেন। ইসলামি জীবনধারায় অতিমাত্রায় প্রত্যয়শীল আল্লামা ইকবাল জীবনের সবদিক নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং আলোচনার ফল তাঁর বিভিন্ন রচনায় রেখে গেছেন ।
তিনি ছিলেন একাধারে কবি,, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ও মরমবাদী। তাঁর চিন্তার ক্ষেত্র ব্যাপক ও গভীরতর ছিল বলে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর জীবনদর্শনের ফল রেখে গেছেন। এ উপমহাদেশের ইতিহাসে ইসলামি চিন্তাধারার প্রথম প্রবর্তন করেন শায়খ আহমদ সারহিন্দি। তিনি একদিকে আকবর প্রবর্তিত নানাবিধ বিদআতের বিরুদ্ধে যেমন সংগ্রাম করেছিলেন, তেমনি শায়খ মুহিউদ্দীন ইবনে আলী আল-আরবি প্রবর্তিত ‘হামা উস্ত’ নামক মতবাদের বিকৃত রূপের বিরুদ্ধেও সত্যিকার ইসলামি মতবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকল্পে- ‘হামা আয্ উস্ত’২ নামীয় মতবাদের প্রবর্তন করেন। মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের সময় শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ইসলামের তত্ত্বীয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভৃতি নানা দিক নিয়ে গবেষণা করে তার ফল প্রচার করেছেন। সে ক্রান্তিকালে তাঁর মতো মহামনীষীর আবির্ভাব না হলে এ উপমহাদেশে ইসলামের যে কী দশা হতো, তা কল্পনা করতেও শরীর শিউরে ওঠে।
তবে এ দুজন মহামানবের চিন্তাধারা ইসলামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এরা দুনিয়ার বিভন্ন দেশের ও বিভিন্ন ধর্মের নানাবিধ ধ্যানধারণার সঙ্গে ইসলামের কোনো তুলনামূলক আলোচনা করেননি। এঁরা দুজনেই ইসলামি ভাবধারাকে পরিছন্ন করার জন্য সাধনা করেছেন।
ইসলামের ইতিহাসে ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি আগেই পূর্বোক্ত ধারার প্রবর্তন করেন। মনীষার ক্ষেত্রে তাঁর উপস্থিতি পূর্বে নানা দিক থেকেই ইসলামের ওপর প্রত্যক্ষে না হোক পরোক্ষে আঘাত হানার চেষ্টা চলতে থাকে। মুসলিমগণ কর্তৃক সিরিয়া ও ইরান বিজিত হওয়ার পর থেকে, উত্তর দিক থেকে গ্রিক চিন্তাধারা এবং অপর দিক থেকে ভারতীয় চিন্তাধারা ইসলামের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। আব্বাসি খলিফা আবদুল্লাহ আল মামুন (৮১৩-৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) বাগদাদে একাডেমি অব সায়েন্সের প্রতিষ্ঠা করলে মুসলিমরা দেশ-বিদেশের চিন্তাধারার সংস্পর্শে এসে কতকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তার কারণও সুস্পষ্ট। গ্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে ভারতীয় চিন্তার কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও ইসলামি চিন্তাধারার সঙ্গে তার কোনো ঐক্যই নেই। গ্রিক ও ভারতীয় উভয় চিন্তাধারায় জড় পদার্থকে চিরন্তন বলে ধারণা করা হয়েছে।
গ্রীক চিন্তানায়কদের চিন্তার মধ্যে সৃষ্টি সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই। জড় ও আকারের অথবা নির্বিশেষের সঙ্গে জড়ের সংযোগের ফলেই এ বিশ্বের সবকিছুর উৎপত্তি বলে অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর ধারণা ছিল। ভারতীয় চিন্তাধারায় সৃষ্টির অর্থ সমবায়। অর্থাৎ মহাপ্রলয়ের শেষে যখন এ জগতের উপাদানগুলো বিছিন্ন হয়ে যায়, তখন সেগুলোকে পুনরায় বিন্যাস করারই অপর নাম সৃষ্টি। অথচ সব কটি হিব্রুধর্মে সৃষ্টির অর্থ হচ্ছে শূন্য থেকে সৃষ্টি ( ক্রিয়েশন আউট অব নাথিং) তেমনি মানবজীনের বুদ্ধির প্রাধান্য স্বীকার করে তারই আলোকে এ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে চরম সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হওয়া ছিল গ্রিকদের লক্ষ্য। ভারতে বিচারবুদ্ধির প্রাধান্য স্বীকার করা হয়েছে বটে, তবে শুধু বুদ্ধির দৌলতে সত্যিকার জ্ঞানলাভ করা সম্ভবপর নয় বলেও ধারণা রয়েছে। বুদ্ধির প্রয়োগের আগে মানব অন্তরের মধ্যে বিরাজমান নানাবিধ অতীন্দ্রিয় শক্তির বিকাশকে অত্যাবশ্যক বলে ধারণা করা হয়েছে । তার উপর স্বজ্ঞা বা ইনট্যুশনকে জ্ঞানের কাজে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে। ইসলামের ঐতিহ্য অনুসারে কিন্তু মানবজীবনে বুদ্ধিই সর্বশ্রেষ্ঠ বৃত্তি নয়। মানবজীবনে ইচ্ছা বা উইলই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বৃত্তি এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধি ব্যতীত বোধিনামীয় অপর এক মাধ্যম রয়েছে, যার মাধ্যমে বিশ্বের সব কটি বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও ধর্মীয় সত্য আবিষ্কৃত হয়েছে ।
এই সজ্ঞাকে প্রথম প্রাধান্য দান করেন মনীষী প্লটিনাস। মধ্যযুগে তাঁর মতবাদ সম্বন্ধে নানা আলোচনা হলেও আধুনিক যুগের সূচনায় তা একেবারে পটভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে স্পিনোজা ও শেলিং এবং অতি আধুনিককালে বের্গসো ব্রাডলি ও ক্রোচে প্রমুখ চিন্তানায়ক এ সজ্ঞাকে জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।
আধুনিক যুগের মানবজীবনে ইচ্ছাশক্তির গুরুত্ব প্রথম প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন আর্থার শোপেনহাওয়ার। তিনি এ বিশ্বের সর্বত্রই বেচেঁ থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষা বা উইল টু লিভ-এর নিদর্শন পেয়েছেন। তারপরে জার্মান চিন্তাবিদ ফ্রিডরিশ নিৎসে সর্বজীবের মধ্যে শক্তিলাভের জন্য ইচ্ছার ক্রিয়াশীলতা লক্ষ করেছেন এবং তাকে সমর্থনও করেছেন। বিগত শতাব্দীতে আমেরিকার মনীষী উইলিয়াম জেমস আমাদের সবকটি প্রত্যয়ের মূলে ইচ্ছার কার্যকারিতা আবিষ্কার করেছেন। তাঁর মতবাদ অনুসারে আমাদের মানসে বুদ্ধি নয়, ইচ্ছাই কার্যকর। আমাদের নানাবিধ বিষয়ে ইচ্ছাই প্রত্যয়শীল করে তোলে ।
স্থান-কাল সম্বন্ধেও নানা তর্কের উৎপত্তি হয়েছে। বৈজ্ঞানিক জগতে স্থান ও কালকে দুটো স্থিতি হিসেবে গণ্য করা করা হয়। অথচ স্থান ও কালের ধারণাকে কান্ট অভিজ্ঞতাপূর্ব মানসিক বিষয় বলে গণ্য করেছেন। কেবল স্থান ও কাল নয়, বস্তুর স্বরূপ নিয়েও বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক মহলে নানা তর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সুদূর অতীতে বুদ্ধদেব বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার না করে, তাকে ঘটনার সমাবেশ বলতে চেয়েছেন। অতি আধুনিক কালে আলবার্ট আইনস্টাইন বস্তু বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার না করে তাদের ঘটনা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
আত্মা সম্বন্ধীয় ধারণায়ও পুরাকালের ও আধুনিক যুগের ধারণায় রয়েছে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। প্লেটো যে আত্মার ধারণা করেছিলেন, তা ছিল শাশ্বত। এ মায়াময় পৃথিবীতে সে ছিল দেহের কারাগারের বন্দী। তাই যখন সেই শাশ্বত ধারণার রাজ্যের ছায়া তার করাগারের দেয়ালে পড়ত, তখন তার মনে সেই আনন্দলোকে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুল বাসনা দেখা দিত ।
শংকর মানবাত্মার ধারণাকে অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাপ্রসূত বলে বর্ণনা করলেও ব্রহ্মজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত জন্ম-জন্মান্তরের শৃঙ্খল থেকে তার মুক্তি নেই বলে মতবাদ প্রচার করেছেন। প্লেটো বা শংকর যে দেহনিরপেক্ষ আত্মার ধারণা করেছিলেন, বর্তমান যুগের সূচনায় তা দেকার্তে কর্তৃক প্রথম ‘মন’ নামক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারপর স্পিনোজা তাকে তার সারসত্তার (সাবসটেন্স) একটা গুণরূপে ধারণা করেছেন। লাইবনিৎজ এ বিশ্বের সর্বত্রই জীবাত্মার সমাবেশ আবিষ্কার করলেও তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ পরমাণুরূপে তাঁর কাছে প্রতিভাত হয়েছে। তাদের প্রাতিভাসিক রূপ দেহের সঙ্গে তাদের কী সম্বন্ধ বর্তমান, তা তিনি পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেননি। কান্ট আত্মার, আল্লাহর ও জগতের ধারণার মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে বিধায় তাদের গঠনমূলক না বলে নির্ধারণমূলক বলে অভিহিত করেছেন ।
তবে জ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা তুরীয় নীতি যে ক্রিয়াশীল, এ সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে আধুনিক কালে ব্যবহারবাদীরা (বিহ্যাবিয়ারিস্টস) আত্মাকে স্নায়ুরই একট প্রতিক্রিয়া বলে অভিহিত করেছেন। তেমনি আল্লাহ সম্বন্ধে ধারণায়ও নানা মতবাদ দেখা দিয়েছে। এতে এ কথা সুস্পষ্টই প্রমাণিত হচ্ছে, গাজ্জালির কাছে যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, ইকবালের কাছে সে সমস্যাগুলো আরও জটিল রূপ ধরে দেখা দিয়েছে। গাজ্জালি বৌদ্ধদের নির্বাণ ও ফানাফিল্লাহর মধ্যে পার্থক্য, সমবায় ও শূন্য থেকে সৃষ্টির যে পার্থক্য, তা প্রদর্শনে ছিলেন ব্যস্ত। জড় পদার্থের চিরন্তর অবস্থিতিকে কেন স্বীকার করা যায় না এবং দার্শনিকেরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে জড় পদার্থকে প্রথমে আল্লাহর সৃষ্টি এবং পরবর্তীকালে চিরন্তন বলে ধারণা করাতে যে চিন্তার অসামঞ্জস্য রয়েছে, তা প্রদর্শন করতেই ছিলেন তিনি ব্যাপৃত। ইকবালের কাছে সমস্যা দেখা দিয়েছে চরম জটিলরূপে, এ জন্য যে আধুনিক যুগের সূচনা থেকে নানাবিধ অভিনব চিন্তা ও ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমস্যাগুলোকে জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে ফেলে দিয়েছে। এসব ধারণার প্রতিফলন ইসলামের ওপর সুদূর অতীতে যেমন হয়েছে, বর্তমান যুগেও তেমনি হচ্ছে ।
কেবল তত্ত্বীয় জগতে নয়, রাষ্ট্রনীতির জগতেও নানাবিধ মতবাদ, যথা গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ প্রভৃতি নানাবিধ তন্ত্রের উৎপত্তি দেখা দিয়েছে। এগুলোর আলোকেই যেকোনো রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও গতি সম্বন্ধে বিচার করা হয়। এগুলোও ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রের ধারণার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই ইকবাল এগুলো সম্বন্ধেও আলোচনা করে ইসলামি জীবনধারার সঙ্গে এদের ঐক্য ও অনৈক্যের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাধারারা আলোচনা করলে দেখা যায়, তিনি নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে একে একে আলোচনা করেছেন-
১. জ্ঞান ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, ২. দর্শনের চোখে প্রত্যাদেশমূলক ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, ৩. আল্লাহ সম্বন্ধে ধারণা ও ইবাদতের মর্ম, ৪. মানুষের খুদি : তার স্বাধীনতা ও অমরতা, ৫. মুসলিম কালচারের মর্মমূল, ৬. ইসলামি জীবন সংস্থার মধ্যে গতিশীলতা, ৭. ধর্ম কি সম্ভব? উপরিউক্ত প্রতিটি বিষয় সম্বন্ধে প্রাচীন ও আধুনিক নানাবিধ মতবাদের সমালোচনা করে তিনি ইসলামি মতবাদের পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।
প্রথমত, জ্ঞানের রাজ্যে তিনি ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান, যুক্তিলব্ধ জ্ঞান এবং স্বজ্ঞার ক্রিয়াশীলতা স্বীকার করে প্রদর্শন করার চেষ্টা করেছেন যে ইসলাম জ্ঞানের কোনো পদ্ধতিকে তুচ্ছ বলে পরিহার করতে চায়নি। বরং যে ইন্দিয়জ জ্ঞানের ওপর আরোহ পদ্ধতির প্রয়োগ বৈজ্ঞানিক জগতে অনিবার্য, সে জ্ঞান লাভের জন্য কোরআনুল করিমে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তেমনি যুক্তির ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবে ধর্মীয় জ্ঞান লাভের পদ্ধতি হলো স্বজ্ঞা। সে উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এ পদ্ধতিতে যে জ্ঞান লাভ হয়, তাতে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় পরস্পর থেকে ভিন্ন থাকে না, বরং একই সত্তায় পরিণত হয়। এ জ্ঞানের বিষয়বস্তু প্রমাণ করার জন্য কোনো যুক্তিতর্কের অবতারণা করার প্রয়োজন নেই। এ জ্ঞানের বিষয়বস্তু স্বতঃপ্রমাণ। প্রত্যাদেশ এরূপ জ্ঞানেরই একটা রূপ।
দ্বিতীয় বিষয় সম্বন্ধে আলোচনাকালে তিনি নানাবিধ মতবাদের আলোচনা শেষে আমাদের এ সিদ্ধান্তে উপনীত করেছেন যে সারসত্তা যুক্তি দ্বারা পরিচালিত একটা সৃষ্টিধর্মী জীবনীশক্তি। এ জীবনীশক্তিকে আত্মারূপে ব্যাখ্যা করার অর্থ এই নয় যে আল্লাহকে মানুষের আকারে ধারণা করা হয়। এতে আমাদের অভিজ্ঞতার একটা অতি সহজ সত্যকে স্বীকার করে বলা হয়, জীবন উদ্দেশ্যবিহীন তরল পদার্থের মতো গতিশীল নয়। এর বক্তব্য হলো, জীবনে রয়েছে সমবায়মূলক এক ঐক্যের নীতির ক্রিয়াশীলতা এবং জীবন্ত দেহের সব কটি প্রবণতাকে এটা গঠনমূলক উদ্দেশ্যের জন্য কেন্দ্রীভূত করে। দার্শনিক চিন্তার মধ্যে রয়েছে প্রতীক বা সিম্বলিক ক্যারেকটার। এ জন্য ধর্মীয় জীবনে এ মহান ভূয়োদর্শনকে দর্শন সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। তা সম্ভব হয় কেবল স্বজ্ঞা দ্বারা এবং তার ভিত্তি হচ্ছে আমার কলব বা হৃদয়জাত উপলব্ধি।
তৃতীয় বিষয় সম্বন্ধে তিনি বলতে চেয়েছেন- দ্বিতীয় বিষয় সম্বন্ধে আলোচনাকালে আমরা দেখতে পেয়েছি, এ জগতে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে এক সৃষ্টিধর্মী যুক্তি দ্বারা পরিচালিত জীবনীশক্তি। অপর দিকে মানবজীবনে রয়েছে অনন্তকালব্যাপী এ ধরণিতে রাজত্ব করার প্রবৃত্তি। অথচ মানুষ তার অভিজ্ঞতায় সততই মৃত্যুর ভয়াবহ দৃশ্য দেখে সর্বদাই বিচলিত হচ্ছে। এ জন্য মানুষ সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করে অনন্তকালের বুকে অমরত্ব লাভ করতে চায়। তবে ব্যক্তিগত জীবনেই হোক অথবা সংঘবদ্ধ জীবনেই হোক এ নীরব পৃথিবী থেকে মানুষ কোনো সহানুভূতিসূচক সাড়া পায় না বলেই অনন্ত অসীম জীবনীশক্তি থেকে সে অমরত্ব লাভের জন্য শক্তি কামনা করে। এ প্রার্থনার মধ্যে তার স্থিতির ইতিবাচক দিক ও নেতিবাচক দিক উভয়ই রয়েছে। যে ব্যক্তি প্রার্থনা করে, সে তার নিজের অস্তিত্বের অসারতা ব্যক্ত করে সেই চরম ও পরম শক্তিশালী অনন্ত জীবনীশক্তির নিকট থেকে চরম ও পরম শক্তি কামনা করে।
মানবাত্মার স্বাধীনতা ও অমরত্ব সম্বন্ধে আলোচনাকালে তিনি বলতে চেয়েছেন,কোরআনুল করিমের মধ্যে কোন কোন আয়াতে পরিষ্কারভাবে এমন উক্তি করা হয়েছে যে মানুষ আল্লাহর মনোনীত জীব, মানুষের মধ্যে নানা দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সে আল্লাহর প্রতিনিধি- মানুষ নানা বিপদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন সত্তা। তিনি আধুনিক দর্শনের নানা দিকপালের যুক্তি তাঁর এ মতবাদের সমর্থনে পেশ করেছেন। তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো এই – মানবাত্মাকে আমরা যুক্তির দিক থেকে যতই অস্বীকার করি না কেন, তাকে অবশ্যগ্রহনীয় সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া আমাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এ মানবাত্মার পথপ্রদর্শন ও পরিচালনা করার শক্তি থেকে প্রমাণিত হয় মানবাত্মার স্বাধীনতা রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানবাত্মার পক্ষে অমরত্ব লাভ করার ক্ষমতা আছে কি না? ইকবাল কোরআনুল করিমের বিভিন্ন আয়াত থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন মানবাত্মার অমরত্ব তার কর্মফলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ কর্মফলের দরুনই আত্মা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় অথবা ভবিষ্যৎ জীবনে চলার পথে অগ্রসর হয়। এ জন্য ব্যক্তিগত অমরত্ব লাভ আমাদের জন্মগত অধিকার নয়। এ অধিকার আমাদের কর্মফলের দ্বারা লাভ করতে হয়। অমরত্ব লাভ মানুষের জীবনের প্রধান কামনার বিষয়। আমাদের সাধনার দ্বারা তা লাভ করতে হয়।
মুসলিম সংস্কৃতির আলোচনাকালে তিনি বলতে চেয়েছেন-মুসলিম মনীষীগণ নানাভাবে চিন্তা করলেও এ বিশ্বসম্বন্ধীয় চিন্তায় তাঁদের ঐক্য রয়েছে। তাঁরা সবাই এ বিশ্বে এক বিরাট ও বিপুল গতির নিদর্শন পেয়েছেন। মানবজীবনের উৎপত্তিতেও তাঁরা একই ঐক্যসূত্র স্বীকার করেছেন এবং কালকে অতিশয় বিষয়ীমুখ সত্য বলে গণ্য করেছেন।
ইসলামের মধ্যে গতিশীলতা সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ইসলামি সমাজজীবন কোনোকালেই স্থাণু নয়। এ জন্য সে সমাজে নানা যুগে নানা আন্দোলন দেখা দিয়েছে। এ ইসলামি সংস্থার মধ্যেই যুক্তিবাদী মুতাজিলারা যেমন দেখা দিয়েছেন, তেমনি মরমিবাদী সুফিরাও দেখা দিয়েছেন, এ যুক্তিসর্বস্ব মতবাদের বিরুদ্ধ পক্ষ হিসেবে। এসব নানাবিধ মতবাদের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদ ধ্বংস হওয়ার পর ইমাম ইবনে তাইমিয়ার আবির্ভাব হয় এবং তিনিই এসব মতবাদের উৎপত্তির মূলে যেসব বিদআত বা ইনোভেশন রয়েছে, তার মূলোচ্ছেদে অগ্রসর হন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তাঁর পূর্ববর্তী চারটি মাজহাবের প্রদর্শিত নীতিকে সর্বশেষ ও চরম নীতি বলে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি। তিনিই ইজতিহাদের ওপর সম্পূর্ণ গুরুত্ব আরোপ করে ইসলামি নীতিগুলোকে স্বীকার করে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার দ্বারা তাদের পুনরায় পাঠ করতে অগ্রসর হন।
এর ফলে মুসলিম মানস পুনর্বার মুক্তিলাভ করে- এ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে স্বকীয় জ্ঞানের আলোকে নানাবিধ ধারণা গঠন করার স্বাধীনতা লাভ করে। তবে সর্বাবস্থায় এসব ধারণা কোরআনুল করিম বা হাদিস শরীফে বর্ণিত নীতিগুলোর পরিপন্থি হতে পারে না। তবে আপাতদৃষ্টিতে এ আন্দোলন মুক্তির আন্দোলনরূপে দেখা দিলেও অতীত সম্বন্ধে এতে কোনো সমালোচনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় এ আন্দোলনের হোতাগণ পরিশেষে হাদিসের ওপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হতে বাধ্য হন।
অপর দিকে তুর্কিতে যে স্বাদেশিক আন্দোলন দেখা দেয়, তার মূলমন্ত্র হলো রাষ্ট্রকে ধর্মের আওতা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা। ওরা এ আদর্শ ইউরোপ থেকে গ্রহণ করেছে। এ আন্দোলনের নেতা হচ্ছেন কবি ও সমাজতত্ত্ববিদ জিয়া গক্ আল্প। অপর দিকে সাইদ হালিম পাশা ইসলামের মধ্যে ভাববাদ ও বাস্তবতাবাদের (পজিটিভিজম) সন্ধান পেয়ে ইসলামের কোনো বিশেষ স্বদেশবা পিতৃভূমি রয়েছে বলে স্বীকার না করে, তাকে সর্বদেশে কার্যকর বলে গ্রহণ করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন ইসলামি আদর্শকে কোনো বিশেষ দেশে রূপায়িত করে ইরানি, তুরানি বা ভারতীয় রূপ দান করলে তা ইসলাম থেকে দূরে সরে যেয়ে এসব রূপ গ্রহণ করে। ইকবালের ধারণা, এতে জিয়া গকের মতবাদের সঙ্গে সাইদ হালিমের মতবাদের কোনো বিশেষ পার্থক্য দেখা যায় না। কারণ উভয় মতবাদই পরিণামে একইভাবে ফলপ্রসূ হয়। কারণ এভাবে ইসলামের চর্চা হলে তাতে ইসলামের চেয়ে কোনো বিশেষ দেশের রং অধিকতরভাবে ফলে ওঠে।
ইকবালের মত হচ্ছে, আজকের দুনিয়ায় মানবতার দাবি হচ্ছে তিনটি, এ দুনিয়াকে এক আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হবে, ব্যষ্টির আধ্যাত্মিক সত্তার মুক্তি দিতে হবে এবং এমন এক বিশ্বজনীন নীতি গ্রহণ করতে হবে যার কল্যাণে মানবসমাজের বিবর্তন একটা আধ্যাত্মিক ভিত্তিতে হবে।এ কথা অবশ্য সত্য যে আধুনিক যুগে ইউরোপে এরূপ ধারায়ই অনেকগুলো ভাববাদী মতবাদ গঠিত হয়েছে। তবে মানবসভ্যতার অভিজ্ঞতায় এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে যুক্তি দ্বারা প্রত্যাদেশের মতো মানুষের মনে প্রত্যয়ের সে আলোক জ্বালানো যায় না। তাঁর মতানুসারে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের ভিত্তি এমন এক সুদৃঢ় প্রত্যয় যে মানুষ তার জন্য অনায়াসেই জীবনপাত করতে প্রস্তুত হয়। ইসলামের শৈশবাবস্থায় মুসলিমরা জাহেলিয়ার আধ্যাত্মিক দাসত্বের মধ্যে বাস করেছে বলে ইসলামের সত্যিকার স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারেনি। আজকের দিনে মুসলিমদের পক্ষে তার প্রকৃত সত্তা উপলব্ধি করা উচিত এবং তার সামাজিক জীবন পুনর্গঠন করা কর্তব্য। এতে তাদের পক্ষে ইসলাম প্রদর্শিত মৌলিক নীতির আলোকে কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর হবে। এখনো অবশ্য ইসলামের মূল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যক্ত হয়নি। তবে আংশিকভাবে হলেও ইসলামের উদ্দেশ্য যতটুকু ব্যক্ত হয়েছে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, ইসলামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এ বিশ্বের বুকে একটা আধ্যাত্মিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।
সর্বশেষে আধুনিক যুগের একটা মস্ত বড় প্রশ্ন ইকবাল উত্থাপন করেছেন। তা হচ্ছে, এ যুগে কি ধর্মের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভবপর? প্রশ্নের মীমাংসার আগে ইকবাল ধর্মীয় জীবনের অর্থের বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে তিনটি পর্যায় আবিষ্কার করেছেন। তাঁর মতবাদ অনুসারে প্রথম পর্যায়ে ধর্মীয় জীবনে রয়েছে অত্যন্ত জোরালে প্রত্যয়। ধর্মীয় জীবনের এ প্রবণতা সামাজিক জীবন গঠনের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হতে পারে, তবে ব্যক্তিজীবনের বৃদ্ধি বা প্রসারতার পক্ষে এ পর্যায় মোটেই অনুকূল নয়। এ পর্যায়ে ধর্মীয় নীতির কাছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করার পর ধর্মীয় জীবনে দেখা দেয় সে অনুশীলনের মূলনীতির যথার্থ অনুসন্ধান। এ পর্যায়ে ধর্মীয় জীবন তার মূলনীতিকে দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তৃতীয় পর্যায়ে ধর্মীয় জীবনে মস্তাত্ত্বিক প্রবণতা দেখা দেয় এবং ধর্মীয় জীবনের অনুশীলনে লিপ্ত মানুষের মনে সেই আদিম সত্তার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিলিত হওয়ারর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। এ পর্যায়েই ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জীবন ও শক্তি লাভের প্রবণতা দেখা দেয় এবং ব্যষ্টি তার ব্যক্তিজীবনের স্বাধীনতা লাভ করে। ধর্মের এই তৃতীয় পর্যায় সম্ভবপর কি না ইকবাল এখানে সে প্রশ্নই তুলেছেন এবং দেশ- বিদেশের নানা জ্ঞানীর মতবাদ নিয়ে আলোচনা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে ধর্মের পক্ষে আধুনিক যুগেও টিকে থাকা সম্ভবপর ।
তাঁর এ বিভিন্ন বক্তৃতার বক্তব্যের সার হচ্ছে এই- প্রত্যাদেশ বা রিভেলেশন হচ্ছে স্বজ্ঞা নামক জ্ঞানের সর্বোচ্চ পর্যায়। এ জ্ঞানের মাধ্যম আমাদের কলব বা হৃদয়। তার মাধ্যমেই আমরা এ জ্ঞানের মর্ম উপলব্ধি করতে পারি। এ জ্ঞানের সর্বশেষ্ঠ ধারক ও বাহক হচ্ছেন নবী মুরসালগণ। তাঁরাই এ জ্ঞানের আলোকে মানবজীবনকে সুপথে পরিচালনা করেছেন। তাঁদের প্রত্যাদেশলব্ধ জ্ঞানের দ্বারা আমরা জানতে পারি, সতত ক্রিয়াশীল এক অনন্ত শক্তির দ্বারাই এ বিশ্বজাহানের সৃষ্টি। এ সৃষ্টি কিন্তু এ বিশেষ মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়নি, অনন্তকালের অনন্ত ধারা বেয়ে সে সৃষ্টি গতিশীল রয়েছে। আমরা এ সৃষ্টির মধ্যে জড় পদার্থ বলে যে বিষয়কে গণ্য করি, তা প্রকৃতপক্ষে জড় নয়। তাকে অনন্ত প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখি বলে তা জড় বলে আমাদের কাছে প্রতিভাসিত হয় ।
মানুষের সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তনের এক ধারা বেয়ে এবং এ সৃষ্টিতে অর্থহীন অন্ধ কোনো গতি নেই। এর মূল উদ্দেশ্য হলো এ জগতে আল্লাহর প্রতিনিধির উপস্থিতি। মানুষের জীবনে রয়েছে ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং মানুষ তার কর্মের দ্বারা আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারে। এ জন্য মানুষের অমরত্ব লাভ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে। কোনো মানুষই জন্মগতভাবে অমর নয়, তাকে সাধনা করে অমরত্ব লাভ করতে হবে।
মানুষের পক্ষে ইসলামি বিধান পালন করে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা উচিত। সে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনকালে ভৌগোলিক বা ভাষাভিত্তিক কোনো উদ্দেশ্য দ্বারা প্রণোদিত হয়ে চলা মানুষের পক্ষে উচিত নয়। কারণ তার ফলে মানব জাতিতে বহুবিভাগ দেখা দেবে। ইসলামের মহন বিধানগুলোর ভিত্তিতে এবং ইজতিহাদের আলোকে মানবজীবনে নানা যুগে পুনর্বিন্যাস দেখা দিবে, তাতে কোনো সংকীর্ণ মনোভাব যেন কোনো দিনই না আসে।
ধর্মের প্রত্যয়শীলতা বা তার পক্ষে যুক্তির অবতারণা তার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের রূপ। তৃতীয় পর্যায়ে ধর্মের রাজ্যে জ্ঞাতা সে আদিম সত্তার সঙ্গে একীভূত হতে চায়। এ পর্যায়েই তার জীবনের পূর্ণ স্বাধীনতা ও সম্পূর্ণ পরিণতি লাভ করে।
মহাকবি ইকবালের গভীর পান্ডিত্য ও সারা জীবনের সাধনালব্ধ ভূয়োদর্শনের সার রয়েছে এ পুস্তকের মধ্যে। তাই একে এ যুগের মুসলিম জীবনের পথপ্রদর্শক এক মহাগ্রন্থ বলা চলে। ইংরেজী ভাষায় প্রদত্ত তাঁর বক্ তৃতাগুলো তথা এ মহগ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধের অনুবাদ ও অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশের লব্ধপ্রতিষ্ঠ বিদ্বজ্জন। ইকবাল- দর্শনের মর্ম গ্রহণে এ অনুবাদ নিশ্চয়ই সার্থক হবে বলে আমার ধারণা।
লেখক পরিচিতি:
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ