বেশ কয়েক বছর আগে মেয়ে ঐশীর ছুরিকাঘাতে পুলিশের বিশেষ শাখার ( এস বি)পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের খুন হওয়ার ঘটনাটি সমগ্র জাতিকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। এভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে এমন ঘটনা । সমাজের বিভিন্ন স্তরে সম্পর্কের বন্ধনে ভাঙন কেন ?
সম্পর্কের শিকড়ে পঁচন কেন ?

মুস্তফা জামান আব্বাসীর লেখা পড়েছিলাম,”যে পথ আল্লাহর, সে পথই আমার।” তিনি একটি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ পান আল -কুরআনের তাফসির, লিখে গেছেন- মু. সা’ল আব্দুল্লাহ আল তুশতারি,২৭৫ হিজরীতে । আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে ২০১১ সালে।এই বইটি তার মেয়ে লাবনী সারা রাত পড়তে পড়তে ফজর করে ফেলে। সকালে বাবাকে বলে,আব্বা আমি আজ রোজা। কারণ, এতো ভাল তাফসির কখনো পড়িনি। আব্বাসী সাহেবের কাছে প্রশ্ন, লাবনীর মতো সন্তান কিভাবে তৈরি করা যায় ?
নবীনদের কাছে আপনি চেয়েছেন তারা যেন প্রতিদিন আল- কুরআনের কাছ থেকে জেনে নেয়, কি তাদের কর্তব্য ,কিভাবে বর্বরতা ও আধুনিক দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব ?

তবে এখানে প্রশ্ন থেকেই যায় কিভাবে নবীনদের হাতে কুরআন পৌছে দেওয়া যায় ?
কিভাবে এই নবীন প্রজন্মকে কুরআন পড়ার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া যায়?
এই বিষয় নিয়ে ভাবনা শুরু করা যেতে পারে ।

২০১৩ সালের ১৭-ই মে বোয়িং স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মিশেল ওবামা বক্তৃতা দিতে যেয়ে ফ্রেডারিক ডগলাসের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,”শিক্ষা মানে মুক্তি। এর মানে আলো আর স্বাধীনতা। এর মানে নিজের আত্মাকে সত্যের আলোয় আলোকিত করা। একমাত্র সেই সত্যই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে।” কিন্তু কোন পথ দিয়ে সেই সত্যের আলো মিলবে ?
সেই আলো কিভাবে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করবে ? যদিও তিনি বিস্তারিত ভাবে সেই আলোচনা করেননি ।তবে তিনি তরুণ প্রজন্মকে পথপ্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানিয়েছেন ।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মু. তাজুল ইসলাম, “অভিভাবকদের করণীয় “বিষয়ে এক নিবন্ধে বলেছেন; “স্নেহ ভালোবাসায় সিক্ত রাখা, প্রকাশ্যে প্রশংসা করা, সবার সামনে সমালোচনা করা, তিরস্কার বা অপমান না করা, মন্দ আচরণ চিহ্নিত করে সংশোধনের পরামর্শ দেওয়া, নিজের মেজাজ শান্ত রাখা,নিজেকে আদর্শের মডেল হিসেবে পেশ করা, নিরাপত্তা বোধ তৈরি করা, নিজেকে দায়িত্ববান করে গড়ে তোলা এবং সময়কে গুণগতভাবে ব্যবহার করার কথা বলেছেন ।”দেখা যায় এসব নীতি ও আদর্শিক কথনের পরেও সন্তান সঠিক পথে চলে না ।

এই জাস্ট ফ্রেন্ড নামক আধুনিক সভ্যতায় তারা কেবল ততটুকুই গ্রহণ করে যতটুকু দিয়ে বল্গাহীন জীবন যাপন করা যায় ।
ঐশীদের কাছে স্বাধীনতা মানে গভীর রাত অবধি পার্টি ,নৃত্য ও মাদকাসক্ত বন্ধুদের সাথে অবাধ মেলামেশা। সফটওয়্যার আপডেটের মতো ইয়াবা সেবনের মাধ্যমে নিজেদের আপডেটেড করে। আহ এটা কিভাবে আধুনিকতা হয় বলুন তো !
আর অন্য দিকে লাবনীরা সারা রাত তাফসির পড়ে ফজর করে , ঠোঁটের কোনে একটা হাসি মেখে বলে ” আব্বা আমি রোজা।”

একদিকে ঐশীরা যেমন পার্টি মদ ও মাদকে ডুবে জীবন পার করছে,
অন্যদিকে লাবনীদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তরুণী জয়নব আর গাজালীরা আল- কুরআনের আলোকে জীবন গড়ার দাওয়াত দেওয়ার অপরাধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত নিপীড়িত ও নিগৃহীত হচ্ছে।
ড. জাফর ইকবাল স্যার যশোরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবর্তনে বলেছেন,”আজ তোমাদের ছাত্রজীবনের একটি অংশের সমাপ্তি হয়েছে। নিজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তোমাদের অসংখ্যবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সেই পরীক্ষায় তুমি তোমার সহপাঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছ । সেই প্রতিযোগিতায় তোমরা কেউ কেউ তোমাদের সহপাঠীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছ।আমি তোমাদের মনে করিয়ে দিতে চাই,সত্যিকারের জীবন কিন্তু প্রতিযোগিতার জীবন নয়।সত্যিকারের জীবন হচ্ছে সহযোগিতার।”
কিন্তু সহযোগিতার জীবন কিভাবে গড়া যায়? কিভাবে সহযোগিতা মূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে?

মিশরের কাশেম আমীন বেগ এর তাহরীরুল মারআত ( নারী স্বাধীনতা) আল মারআতুল জাদীদাহ ( আধুনিক নারী)এর জবাবে ফরিদ বেজদী আফেন্দীর “ইসলামের দৃষ্টিতে নারী “মুসলিম জাহানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।তিনি বলেছেন স্বাধীনতা মানে স্ব দায়িত্বের অধিকার। আল্লাহ আমাদের যার যার দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছেন। সেই দায়িত্বের বাইরে গেলে সমাজে স্বেচ্ছাচারি তরুণ- তরুণীর সংখ্যা বেড়ে যাবে । নারীর পুরুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে । সৃষ্টিকর্তা নারীর মর্যাদা কোন ভাবেই ছোট করে দেখেননি।কুরআন নারী পুরুষের মর্যাদা সমানভাবে প্রকাশ করেছেন ।”

জড় বিজ্ঞানে পারদর্শী ইউরোপের সাহিত্যিক সোল সায়মন “রিভিউ অব বিভিউজ”পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক ক্রশিয়ার পুস্তক সমালোচনা করে বলেছেন, নারীর নারী থাকাই উচিৎ।
প্রকৃতির এটাই বিধান এবং এভাবেই প্রকৃতি তাদের পথের নির্দেশ দিয়েছে। তাই তারা যতখানি প্রকৃতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে চলবে, ততখানি তাদের সাফল্য ও মর্যাদা সুস্পষ্ট ভাবে বেড়ে চলবে। আর যতই তারা প্রকৃতির ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে থাকবে,ততই তাদের বিপদ বেড়ে যাবে।”

তবে নারী সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে যে দায়িত্ব- কর্তব্য পালন করে থাকে তা কোন ভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই । পৃথিবীতে মানব সম্পদ প্রজননে নারীর ভূমিকা কিভাবে ছোট করে দেখা যেতে পারে?
নারী তার কর্তব্যে যেভাবে সম্মানিত ঠিক তেমনি পুরুষও তার কর্তব্যে সম্মানিত । এখানে কেবল কাজের ভিন্নতা ।
সোল সায়মন বলেন,”যে নারী স্বীয় ঘর ছেড়ে বাইরের কাজে মত্ত হতে চায়,সন্দেহ নাই যে,সে পূর্ণাঙ্গ কর্মী হিসেবেই দায়িত্ব পালন করে ।” নারীরা সন্তান ধারণ থেকে শুরু করে মানব জাতির সব রকমের বুনিয়াদি দায়িত্বের গুরুভার কাঁধে বয়ে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে ।
কিন্তু যখনই ঘর ও সন্তান কম গুরুত্ব দিয়ে বাইরের কাজে বেশি সময় ও গুরুত্ব দেয় তখনই সন্তান বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় ।

স্যামুয়েল স্মাইলার (আমেরিকার আধুনিক সাংস্কৃতিক জনক),”The character”এ ইংল্যান্ডের নারী স্বাধীনতা আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেছেন, “প্রাচীন রোমানদের দৃষ্টিতে শালীন মেয়েদের সব চাইতে প্রশংসনীয় উঁচু স্তরের কাজ হচ্ছে ঘরের দায়িত্ব পালন করা এবং বাইরের টানা হেঁচড়া থেকে মুক্ত থাকা। আমাদের এ যুগেও বলা হয়,নারীদের ভূগোল শিক্ষা এ জন্য অপরিহার্য যে,তারা নিজ নিজ ঘরের দরজা জানালাগুলো যথাযথ স্থানে বসাবার ব্যবস্থা করতে সামর্থ্য হবে।রসায়ন শাস্ত্র তাদের এজন্য শেখা দরকার যে,ডেকচির রান্নার সামগ্রী উথলে উঠলে যেন যথাসময়ে তার ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয় ।”

জড়বাদী দার্শনিক প্রুডেন “ইবনে কারুনিযাম “গ্রন্থে লিখেছেন, সমাজ সৃষ্টির মূলে রয়েছে তিনটি উপাদান -জ্ঞান, কাজ ও ন্যায়নীতি। এখন ভেবে দেখুন নর ও নারীর কোন শ্রেণির ভেতরে এ তিনটি উপাদানের কতটুকু অংশ রয়েছে এবং সেদিক থেকে পারস্পরিক পার্থক্য কতটুকু?মানব সভ্যতার ইতিহাস আমাদের বলে দেয়, জ্ঞান, কর্ম ও ন্যায়নীতির বাস্তবায়নে নর ও নারীর অংশগ্রহণের পার্থক্য হচ্ছে ৩/৩/৩ এর সাথে ২/২/২ ।তাই যারা কেবল নারীবাদের জন্য স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রের দাবিদার, তারা মূলতঃ নারীদের অনাচারের কয়েদখানায় আবদ্ধ করতে চায় ।সে কয়েদখানা তাদের কল্পিত দাসত্বের কয়েদখানা থেকে মোটেও কম নয়;বরং অধিকতর ভয়াবহ ।

আজ ইউরোপে যে বল্গাহীন নারী স্বাধীনতার বাতাস বইছে যার ফলে নারী- পুরুষের সম্মিলিত সংসার গড়ে উঠছে না । শতকরা ৭০ শতাংশ পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে ছয় মাসে । আর বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া কেবল নাম মাত্র । এসব ভয়াবহ রূপ দেখে সেখানকার মনীষীবৃন্দ সেই পথ বেছে নেবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন যা ১৪ শ বছর আগে মুহাম্মদ স. গোটা দুনিয়াকে শিক্ষা দিয়েছিলেন।

ইসলাম বলেছে, অসহায় ও অরক্ষিতা নারীর ভরণ পোষণের ব্যবস্থা “বাইতুল মাল”হতে করা হবে,যেন পেটের দায়ে তাকে ঘর ছেড়ে বাইরের স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করতে গিয়ে সীমাহীন দুর্যোগ পোহাতে না হয়।

নিছক দাসীবৃত্তি চালানোর জন্য খোদা নারীদের সৃষ্টি করেননি। খোদাই তাদের বিশেষ ধরণের আজাদি দান করেছেন, যা আদায়ের জন্য তাদের পুরুষদের সাথে সংগ্রাম চালানো প্রয়োজন। ম্যাডাম হীরকুর এর নারী আন্দোলন সম্পর্কে প্রুধো বলেন,”আমার মতে নারীদের এ স্বাধীনতা আন্দোলন নগ্ন উন্মত্ততা ছাড়া কিছুই নয়।দুঃখের বিষয়, তারা আজ ভয়াবহ উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে। তাদের এ অজ্ঞতা পরিষ্কার প্রমাণ করছে যে,তারা নিজেদের মূল্য বুঝবার ও দায়িত্ব পালনের যে ক্ষমতা তা হারিয়ে বসেছে । নারীকে কয়েদি সাজানোর নিকৃষ্টতম নজির হচ্ছে, তার জীবিকার বোঝা তারই ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া এবং সেই বিনম্র শরীর ও প্রেম প্রীতিপূর্ণ কোমল অন্তঃকরণ নিয়ে কঠোর দেহী পুরুষদের সাথে জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হচ্ছে ।”

নারীরা যে বেশি স্বাধীন হয়ে গেছে তাই নয়,পরন্তু তারা নারী সুলভ স্বভাব হারিয়ে ফেলছে স্ব-ইচ্ছায়।মূলতঃ নারীত্বের সীমাই তারা লঙ্ঘন করে চলেছে। কিছু ভোগবাদী পুরুষ সুবিধা নিচ্ছে। তাদের রাতের ঠিকানা নাইট ক্লাবে আর দিনে নারী মুক্তির স্লোগান তুলে পুরুষের ইচ্ছার দাসীবৃত্তি করা । আজ তসলিমা নাসরীন স্বীকার করছে যে,তিনি সারা জীবন ভুল মানুষের সাথে প্রেম করেছেন।
মানুষের ভেতরে কামনা বাসনার তীব্রতা তখনই বাড়ে যখন চারপাশে তার উপকরণ ঘিরে থাকে ।যখন মানুষ নির্বিঘ্নে কামনা চরিতার্থ করার সুযোগ পায়,তখন স্বভাবতই তার জ্ঞান ও বিবেক লোপ পেয়ে থাকে।

সন্দেহ নেই যে, যদি আমেরিকায় নারী জীবনের উপর আধুনিকতার বন্যা নেমে না আসতো তাহলে প্রতি রাজ্যে লক্ষ লক্ষ পরিবার গড়ে উঠত। সত্যি কথা হচ্ছে, খোদা যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তাকে ভেতরে ও বাইরে সেভাবেই গড়ে তুলেছেন।
কুরআনে প্রথম নাজিল হওয়া সুরা আলাক।”পড়,তোমার প্রভু আল্লাহর নামে,যিনি সৃষ্টি করেছেন। “এই কুরআন অনুযায়ী দেশ শাসন করলে হযরত ওমর রা. এর সাম্রাজ্য হয়।আল কুরআনের শিক্ষা পরিবারে থাকলে আমাদের সন্তানেরা বিপথগামী হয়ে যায় না । ঐশীর মতো মেয়েদের সাথে খোদার পরিচয় হয়নি, এজন্য পরিবার, পিতা- মাতা তার দায় অস্বীকার করতে পারে না ।আল্লাহর একমাত্র পথ আল- কুরআন,তা তারা জানেন না। তাই তারা অনেক পথে গমন করে।

আল -কুরআন’কে আঁকড়ে ধরে থাকলে সে বিপথগামী হবেনা ।আমাদের সমাজের পরতে পরতে জাহিলিয়াত বাসা বেঁধেছে। যারা ক্ষমতায় বসে তারা ফেরাউন -নমরুদের মুখোশ পরে আছে।এই সমাজ পরিবর্তন করতে একজন ইমাম মাহদি চাই।তাই অভিভাবকদের কাছে আহ্বান, ঐশিদের তৈরি না করে মা ফাতেমা তৈরি করেন,তাহলে আমরা ইমাম মাহাদি পেয়ে যাব ইনশাআল্লাহ !

আব্দুর রহমান রনী
প্রভাষক (বাংলা বিভাগ)
হাজী মিছির আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *