বই পড়া
বই পড়ার গুরুত্ব বা মাহাত্ম্য নিয়ে বিস্তর কথা রয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন বই পড়লে আলোকিত মানুষ হওয়া যায়, জ্ঞানী হওয়া যায়। আমি এর সঙ্গে আরো যেটা মনে করি তা হলো বই পড়লে আপনার অজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। আমরা কিরূপ সর্ববিধ অজ্ঞতার মাঝে বসবাস করি সে সম্পর্কে পরিচয় লাভ করা যায়। জ্ঞান বলতে যদি কোন কিছু জানাকে বুঝায় তাহলে আমি এর সঙ্গে যোগ করবো জ্ঞান মানে কোন একটা অজ্ঞতাকেও জানা।
আমরা যতো অজ্ঞতার স্বরূপ অবলোকন করি তত জ্ঞান অর্জন করি। একেকটা জ্ঞান মানে একেকটা অজ্ঞতাকে অতিক্রম করা।জ্ঞানী মানুষ তাই অহম থেকে মুক্ত। কারণ তিনি জানেন জ্ঞান ও অজ্ঞতার মধ্যে ব্যবধানটা কত কম।
আচ্ছা, আমরা পড়া বলতে কি বুঝি এবং তার শুরু কবে থেকে? আমি মনে করি মানব সভ্যতা এবং পড়া পিঠাপিঠি করে বড় হয়েছে, আজকের জায়গায় এসে পৌছেছে। আমাদের আদি পিতা মাতারাও এর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এই যে ধরুন, আকাশে মেঘের পরিমাণ দেখে বুঝতে পারা-বৃষ্টি হবে কী হবে না-তা কী পড়ার অন্তর্ভুক্ত নয়? পড়া ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে বেশি ফারাক নাই এবং এটা সৃষ্টির আদিতে তা আরো বড় করে সত্য।
আরও এগিয়ে গিয়ে যদি বলতে চাই তাহলে আমি বলবো অনেক আগে থেকেই মানুষ বই লিখে আসছে, বর্ণমালা সৃষ্টির অনেক আগেই। এই যে গুহাবাসী আমাদের পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন আঁকাআঁকি করেছেন পাহাড়ের গায়ে, গুহার অন্দরে এ সবই তাদের মনের কথা প্রকাশের একটি ভাষা; হউক বা সেগুলো অনেক কাঁচা বা অসম্পূর্ণ। এখনকার গবেষকরা, প্রত্নত্ত্ববিধরা সেই সব গুহাচিহ্ন থেকে, পাথরখন্ড থেকে, হাতিয়ারের ধ্বংসাবশেষ থেকে ইতিহাস লিখছেন। আমরা পড়ছি সেই সব পূর্বসুরীদের কথা।
পড়া বলতে আমরা কোন বই পড়াকে বুঝাতেই থাকতে হবে আলোচনা ছোট রাখার জন্য। তা না হলে আলোচনা বেশ লম্বা হয়ে যাবে। বর্তমানে পড়ার ধারণা অনেক বিস্তৃত হয়েছে। ধরেন, একটা সিনেমা দেখা-সেটা কেন পড়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না? একটা নাটকের মঞ্চায়ন সেটা কেন অন্তর্ভুক্ত হবে না? কিছু গেমস আছে যেখানে আপনাকে পড়তে হয়। আছে ইন্টারনেট, ব্লগ, ওয়েবসাইটস্, কিন্ডল, ইবুক, পিডিএফ।
পড়া আবার পরিচয় ও বটে। পড়ার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন অজানা ও বৈচিত্র্যময় জগতের সঙ্গে পরিচয় লাভ করি। পড়ার মাধ্যমে আমরা অভ্রমণযোগ্য অতীতে ভ্রমণ করতে পারি আবার সুদূঢ় ভবিষ্যতেও গমন করতে পারি। পড়া যেন একটা টাইম মেশিন। সেই টাইম মেশিনে করে আমরা বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন যুগে ভ্রমণ করতে পারি, দেখতে পারি সেই সব যুগের মানুষের জীবনাচার, সভ্যতার রূপ।
পড়তে হবে কেন
অতীতের গভীর জ্ঞান, বর্তমানের ভাল বুঝাপড়া এবং ভবিষ্যতের গভীর দূরদৃষ্টি (ইনসাইট) লাভ করার জন্য আমাদেরকে পড়তে হবে। পৃথিবীর তাবৎ অভিজ্ঞতা বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে এটা বলা যায় কোন ধরণের ইতস্তত না করেই। আমরা বই পড়ার মাধ্যমেই পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়তে পারি। এবং আমাদের অবস্থান নির্ণয় করে সে অনুযায়ী আমাদের কাজ সম্পাদন করে পৃথিবীতে আমাদের স্বাক্ষর রেখে যেতে পারি।
পড়তে হবে জানার জন্য, জানতে হবে ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য এবং ক্রিয়াশীল হওয়া ভালো কিছুর জন্য।
ক্রিয়াশীলতা নিজের জন্য, মানুষের জন্য, দেশ ও মানবতার জন্য।
সৌখিন পাঠ এবং গভীর অধ্যয়নের/স্টাডির মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। আমি মনে করি মনের আনন্দে পড়া সেটা পড়া তবে গৌণ পড়া। আমরা যখন নিজের জীবন গড়তে, সাজাতে ও অর্থবহ করতে পড়ি এবং আমাদের পঠন পাঠনের সঙ্গে দেশ, সমাজ ও জাতি যুক্ত থাকে তখনই তা পরিপূর্ণ পড়া হয়ে উঠে।
আমাদের পড়তে হবে অভিজ্ঞতা লাভ করার জন্য। মানুষ কি স্রেফ বয়সেই বড় হয়? হ্যা, বয়সে শারীরিকভাবে বড় হয়। কিন্তু মানসিকভাবে ও চিন্তাগতভাবে কেউ বড় হয় যখন সে বেশি অভিজ্ঞতা লাভ করে।
আশপাশের জীবন দেখে মানুষ বড় জোড় অল্প বিস্তর অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। কিন্তু বিস্তৃত
অভিজ্ঞতা লাভ করতে গেলে বা হাজার বছরের অভিজ্ঞতা নিজের মধ্যে ধারণ করতে গেলে বইয়ের কাছেই যেতে হবে। বইয়ের মধ্যেই হাজার বছরের মানুষের অগ্রযাত্রার ইতিহাস, তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিবরণ রয়েছে।
যার যত বেশি অভিজ্ঞতা সে তত বেশি জ্ঞানবান। কোন ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান মানুষের কল্যানে না অকল্যাণে ব্যবহার করবে তা ভিন্ন আলোচনার দাবি রাখে।
অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা মজার কথা শুনুন জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের কাছ থেকে। তিনি বলছেন, ‘অভিজ্ঞতা হলো অনেক ভালো স্কুল, কিন্তু এর ফি অনেক চড়া।’ (‘Experience is a good school, but the fees are high’.—Heinrich Heine)
কিছু দার্শনিক প্রশ্ন সব যুগের ভাবুক-চিন্তকদের ভাবিয়েছে। এমন কয়েকটা প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আমি কে?’ ‘এই বিশ্ব চরাচরে আমার অবস্থান কোথায়’, আমি কোথা থেকে আসলাম’, ‘আমি কোথায় যাচ্ছি বা যাবো’, মানুষের/চূড়ান্ত পরিণতি কি’ ইত্যাদি। এরূপ প্রশ্ন ধর্ম ও দার্শনিকতা সব ক্ষেত্রেই এসেছে এবং সেই সৃষ্টির শুরু থেকে শুরু করে মানুষ এখন পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে। একেকজন একেকভাবে সেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে আবার উত্তর খোঁজতে গিয়ে হয়তো অনেকে হারিয়েও গেছে গোলকধাঁধায়।
সভ্যতাকে যদি আমরা একটা বিশাল অট্টালিকা কল্পনা করি তাহলে আমাদের অবস্থান সেখানে কোথায়? আমরা কি অট্টালিকার ইট, শুরকি না পিলার, বিম না মেরুদণ্ড ?
আমাদের একটা না একটা অবস্থান তো আছেই। এখন সেটা খোঁজার জন্যও পড়তে হবে। উইল ডুরান্টের এ কথাটি এখানে প্রাণিধানযোগ্য:
“No, the real history of man is not in prices and wages, nor in elections and battles, nor in the even tenor of the common man; it is the lasting contributions made by geniuses to the sum of human civilization and culture”
বিভিন্ন ধর্ম ও দার্শনিক চিন্তায় বলা হচ্ছে আমরা একটা মহা পরিকল্পনা বা গ্রান্ড ডিজাইনের একটা অংশ। প্রশ্ন হলো সেই গ্রান্ড ডিজাইনে আমার অবস্থান কোথায়? সেই প্রশ্ন আস্তিকতার ভেতর থেকেও তোলা যায়,
নাস্তিকতার ভেতরে থেকেও।
আমরা জ্ঞানী হওয়ার জন্য, পণ্ডিত হওয়ার জন্যই শুধু পড়ি না। আমরা আমাদের অজ্ঞতার স্বরূপ উন্মোচন করার জন্যও পড়ি। আমরা যখন পড়ি তখন আমরা এটাও বের করতে পারি যে আমাদের অজ্ঞতা কত বিশাল,
এটা কত অসম্ভব যে একজন ব্যক্তি সবকিছু জানবে।
পড়াশুনার মাধ্যমে আমরা তাও জানতে পারি অজ্ঞতার কত অতল গহ্বরে আমাদের বসবাস।
জ্ঞান বা জানা কি? জ্ঞানগুরু কনফুসিয়াস বেশ চমৎকার আবার বেশ জটিল একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন জ্ঞানের।
তিনি বলেন- ‘To know that we know what we know, that we do not know what we do not know,
that is true knowledge.’ (Confucius)
সহজ তর্জমা করলে হয় এমন, ‘আমরা যে বিষয়গুলো জানি তা জানতে পারা এবং আমরা যা জানি না তা না
জানা; তাই সত্যিকারের জ্ঞান।’
পড়তে হবে কেন বা পড়ে কি করতে হবে এর জবাবে ইংরেজ চিন্তক ফ্রান্সিস বেকন বলেন, ‘‘Read not to contradict and confute; nor to believe and take for granted; nor to find talk and discourse; but to
weigh and consider.’ (Francis Bacon)
একটা ভালো বই আমার কাছে একটা স্বচ্ছ ঝর্ণাধারার মতো যেখানে পাঠক স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে উঠেন।
আবার একটা ভালো বই পড়ার মানে হতে পারে অমরত্ত্বের সুধা পান করা। আমাদের মনের চীরসজীবতা দান বা মনের সুস্থ্যতার জন্য জ্ঞানের আকর বই সবচেয়ে বড় টনিক।
প্রযুক্তির জমানায় পড়াশুনা
অনেকে বলেন- মোবাইলে, ট্যাবে, কম্পিউটারে, ইবুক, কিন্ডল এই সব যন্তর মন্তরে পড়া কেমন? অবশ্যই ওটাও পড়া, প্রয়োজনীয় পড়া। বর্তমানে ওই মাধ্যমগুলোতে পড়া জরুরী ও প্রয়োজনীয় ঠেকলেও তা বইয়ের প্রয়োজনকে ফুরিয়ে দেয় নাই। কেউ কেউ মনে করেন ইন্টারনেটে, ইবুকে, পিডিএফে বই পড়া প্রিয়তমার সঙ্গে ফেসবুকে বা মেসেঞ্জারে চ্যাট করার মতো। এবং হাতে বই নিয়ে পড়া হচ্ছে প্রিয়তমার সামনে বসে কথা বলার
মতো ব্যাপার। বই পাগল পাঠক বইকে ছুঁয়ে দেখে, গন্ধ শুকে এবং কেউ কেউ বুকে নিয়ে ঘুমাতে যায়। যারা নিয়মিত বই পড়তে অভ্যস্থ তাদেরকে ট্যাবে বা কিন্ডলে বই পড়া এবং অরিজিনাল কপির একটা বই বাছাই করতে বলা হলে বেশিরভাগ পাঠকই বইটা হাতে নেবেন। আবার ইন্টারনেটে বা অত্যাধুনিক ডিভাইসে বই পড়ার কয়েকটা সুবিধা হচ্ছে:
প্রথমত, সহজেই বহন করা যায়। গাড়িতে, বাসে, ট্রেনে পড়তে সুবিধা বেশি মোবাইলে ও ইন্টারনেট মাধ্যমে।
দ্বিতীয়ত, একসঙ্গে অনেকগুলো বই বহন করা অনেক কষ্টকর ব্যাপার কিন্তু বিভিন্ন ডিভাইসে আপনি কয়েক হাজার বই বহন করতে পারবেন। আর ইন্টারনেটে তো পুরো জ্ঞানভাণ্ডার উন্মুক্ত।
তবে এ বিষয়টা মনে রাখতে হবে প্রযুক্তির দুনিয়ায় পুরো জ্ঞানভাণ্ডার উন্মুক্ত থাকলেও বই পড়ার ভালো অভ্যাসটি আগে থেকে গড়ে না উঠলে সেইসব যান্ত্রিক সুবিধা দিয়ে বেশিদূর আগানো যায় না। একজন সিরিয়াস পাঠকই সেই সব ডিভাইসের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারেন।
পাঠক কত প্রকার হতে পারে
এবার আসেন পাঠকের বিভিন্ন রূপ নিয়ে কথা বলি। আমি কিছু মজার নাম খুঁজে পেয়েছি এবং কয়েকটা ধার
করেছি। যেমন-
সর্বভুক পাঠক:
এক ধরণের পাঠক আছেন যারা হচ্ছেন সর্বভুক প্রজাতির পাঠক যারা সব ধরণের বই পড়েন।
অবশ্য সব সিরিয়াস পাঠক-ই শুরুতে এমন পাঠক থাকেন। অথবা পাঠ অভিরুচি তৈরিতে সবধরণের বই পড়ার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এই বিভিন্ন ধারার, বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের বই পড়েই একজন পাঠকের পছন্দ ও রুচি তৈরি হয় ।
দস্যু প্রজাতির পাঠক:
দস্যু প্রজাতির পাঠক অভিধাটি জর্মান দার্শনিক ফ্রেদরিক নিৎসের দেয়া। মহাত্মা নিৎসে সবচেয়ে বাঁজে ধরণের পাঠকদের কথা বলতে গিয়ে এমনতর পাঠকের কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন দস্যু প্রজাতির পাঠকেরা পড়তে গিয়ে অল্প কিছু ব্যবহার করেন আর বেশিরভাগই নষ্ট করেন। নিৎসে তার ‘মিক্সড অপিনিয়নস্ এন্ড ম্যাকি্সমস্’
(প্রকাশ ১৮৭৯) বইয়ে বলেন, ‘The worst readers are those who proceed like plundering soldiers:
they pick up a few things they can use, soil and confuse the rest, and blaspheme the whole’.
পেশাদার পাঠক:
এমন এক পাঠকগোষ্ঠি আছেন যাদের ভালো লাগলেও পড়তে হয়, খারাপ লাগলেও পড়তে হয়। পড়া হচ্ছে তাদের পেশা, সেটা নেশা না ও হতে পারে। আইনজীবি, ডাক্তার, পত্রিকাওয়ালা, প্রুফরিডার,টাইপরাইটার সহ এমন কিছু পেশার মানুষ রয়েছেন যারা ভালো লাগলেও পড়েন, না লাগলেও পড়েন। কেউ কেউ হয়তো প্রতিদিনই শত শত পৃষ্ঠা পড়েন। আবার পড়া যাদের বদভ্যাসের অংশ সেরকম নিয়মিত পাঠকও
পেশাদার পাঠক হতে পারেন। পড়াকে তারা এমন বদভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন যে ইচ্ছে করলেও ছাড়তে পারে না।
তারা অনেক গুরম্নত্বপূর্ণ পাঠক।
মৌয়াল পাঠক:
মৌয়ালরা মধুর চাক থেকে মধু সংগ্রহ করে। মৌয়াল ধারার পাঠকরা পড়া থেকে কেবল মজা নিতে চায়। এজন্য তাদের পড়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই থাকে মজা লওয়া। এটা দোষের কিছু না। সবধরণের পাঠকই পড়া থেকে মজা নিয়ে থাকেন।
লেখক পরিচিতি:
সাবিদিন ইব্রাহিম
লেখক,
অনুবাদক,