Relevance of Iqbal in Bangladesh - Manohar Shamsi Sakhawat

আল্লামা ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং বাঙালি মুসলমানের দার্শনিক দারিদ্র:


পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা আল্লামা ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্বকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দিয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক মুসলিমদের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু জমিদারদের শোষণ ও জুলুম। এই প্রধানত হিন্দু উচ্চবর্ণের অর্থনৈতিক অত্যাচার ও জুলুম এই অঞ্চলের বিপুল কৃষিজীবী বাঙালি মুসলিমদের কাছে আল্লামা ইকবালের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের ধারণাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। এই স্বকীয় পরিচয় ভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েমের পরিকল্পনার মধ্যে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গীয় মুসলিম কৃষকেরা একটি মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বাংলার প্রধানত মুসলিম কৃষকদেরকে একটি অমানবিক কৃষিপ্রজায় (সার্ফ) পরিণত করেছিল। কাজেই আল্লামা ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্বকে বাঙালি মুসলমান প্রথমত স্বাগত জানিয়েছে একটি শ্রেণিগত অর্থনৈতিক স্বার্থের অবস্থান থেকে। এই প্রসঙ্গে বামপন্থী ও একাডেমিক উভয় ধারার বুদ্ধিজীবিদের ব্যাখ্যা ও ভাষ্যের মধ্যে আশ্চর্যজনক ঐক্য লক্ষ করা যায়। যেমন বদরুদ্দীন উমর তার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৮), ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (১৯৭০), ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক’ (১৯৭২) প্রভৃতি বইয়ের মাধ্যমে এই প্রসঙ্গে যে বয়ানটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন সেখানে দ্বিজাতিতত্ত্বের এই মার্কসবাদী অর্থাৎ শ্রেণিবাদী অর্থনৈতিক আকর্ষণকেই উচ্চকিত করে তুলে ধরেছেন। আবার একাডেমিক স্কলার তাজ উল-ইসলাম হাশমি-ও তার ‘Pakistan as a Peasant Utopia: The Communalization of Class Politics in East Bengal, 1920-1947’ (1992) গ্রন্থে বাঙালি মুসলমানের আল্লামা ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্ব বোঝাপড়া নিয়ে মোটামুটি একইরকম ব্যাখ্যা ও ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে এই প্রসঙ্গে বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী উভয় বয়ানই প্রায় একই ধরনের।
তাহলে লক্ষ করা যায় যে আল্লামা ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্বের বোঝাপড়ায় বাঙালি মুসলমান তার শ্রেণিগত অর্থনৈতিক স্বার্থচিন্তা দ্বারাই মূলত প্রভাবিত হয়েছিল। অর্থাৎ তাদের জীবন জীবিকার উপরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকারী বর্ণ হিন্দুর বিতাড়নের একটি সুযোগ হিশেবেই তারা দ্বিজাতিতত্ত্বকে দেখেছে। এ কারণে হিন্দু-মুসলিম বাইনারিতে তারা আল্লামা ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্বকে বুঝেছিল; কিন্তু আল্লামা ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্বের আসল আদর্শিক উৎকর্ষ যেখানে নিহিত অর্থাৎ তার জাতি, বর্ণ, নৃগোষ্ঠী, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক সীমানা নিরপেক্ষ যে উম্মাহচেতনা বা বিশ্বমুসলিম আন্তর্জাতিক চেতনা সেটি বাঙালি মুসলমানের বোঝাপড়ায় সম্যকভাবে ধরা পড়েনি।
অতএব একথা বলা যায় যে শায়েরে মাশরিক হিশেবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালের তৌহিদ-ভিত্তিক ভৌগোলিক অঞ্চল নিরপেক্ষ বিশ্বায়িত ওয়াতান-চেতনা বা দেশ ও বিশ্বসম্প্রদায়চেতনার প্রতি বাঙালি মুসলিম যতটা না আনুগত্য প্রদান করেছিল তার চাইতে তারা এই মহান আদর্শের একটি বৈষয়িক জীবিকা-নির্ভর স্বার্থ-তাড়িত আঞ্চলিক বোঝাপড়ায় উপনীত হয়েছিল।
আল্লামা ইকবালের এই উৎকৃষ্ট ইসলাম-অনুপ্রাণিত ও দার্শনিক প্রস্তাবনাকে বাঙালি মুসলমান দার্শনিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি তাদের দার্শনিক দারিদ্রের কারণে। আর তাদের এই দার্শনিক দারিদ্রের কারণেই তারা যখন পঞ্চাশ দশকে হিন্দু জমিদারদের চলে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তাদের প্রাথমিক স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে বলে মনে করেছে তখন থেকেই ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্বকে উপেক্ষা করে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক/নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতা এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বঞ্চণা ও বৈষম্যের বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানে আকর্ষিত হওয়া শুরু করেছে। এর অনিবার্য পরিণতিই ছিল ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন।

আল্লামা ইকবালের এলাহাবাদ ভাষন:


আল্লামা ইকবাল ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ সম্মেলনে উপমহাদেশের মুসলিমদের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের উপরে জোর দিয়ে তাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেন। এই অধিবেশনে দেয়া ভাষণে তিনি যে যুক্তিকাঠামো বিন্যাস করে তার এই সুচিন্তিত প্রস্তাবটি পেশ করেন তা ছিল এরকম:
“It cannot be denied that Islam … has been the chief formative factor in the life-history of the Muslims of India. It has furnished those basic emotions and loyalties which gradually unify scattered individuals and groups, and finally transform them into a well-defined people, possessing a moral consciousness of their own. Indeed it is not an exaggeration to say that India is perhaps the only country in the world where Islam, as a people-building force, has worked at its best.” [১]
অনুবাদ: “একথা অস্বীকার করা যায় না যে, একটি নৈতিক আদর্শ ও বিশেষ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসাবে ইসলামই ভারতের মুসলিম জনগণের জীবন-ইতিহাসে প্রধান গঠনমূলক উপাদান হয়ে আছে। … … …তা থেকে এমন সব মৌলিক আবেগ ও আনুগত্য জন্ম নিয়েছে, যা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ও শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে এক সুনির্দিষ্ট জাতিতে পরিণত করে। প্রকৃতপক্ষে একথা বললে মোটেই অতিরঞ্জন হবে না যে, সম্ভবতঃ ভারতই দুনিয়ার একমাত্র দেশ, যেখানে ইসলাম জাতিগঠনকারী শক্তি হিসাবে সব চাইতে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।“ [১]
ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ না থেকে সমষ্টিগত পরিসরেও পরিব্যাপ্ত থাকে। এই প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন:
“… … … Is religion a private affair? Would you like to see Islam as a moral and political ideal, meeting the same fate in the world of Islam as Christianity has already met in Europe? Is it possible to retain Islam as an ethical ideal and to reject it as a polity, in favour of national polities in which the religious attitude is not permitted to play any part? This question becomes of special importance in India where the Muslims happen to be a minority. … … … The religious ideal of Islam, therefore, is organically related to the social order which it has created. The rejection of the one will eventually involve the rejection of the other. Therefore, the construction of a polity on national lines, if it means a displacement of the Islamic principle of solidarity; is simply unthinkable to a Muslim. This is a matter which, at the present moment, directly concerns the Muslims of India.” [২]
অনুবাদ: “… … … ধর্ম কি একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার মাত্র? আপনারা কি দেখতে চান যে, ইতিপূর্বে ইউরোপে খৃষ্টধর্ম যে পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে, ইসলামী বিশ্বেও নৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে ইসলাম সেই একই পরিণতি লাভ করুক? ধর্মীয় মনোভাব কোনো ভূমিকা পালন করবে না এমন ধরনের জাতীয় শাসনব্যবস্থা চালু করার জন্য ইসলামের শাসনব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে নৈতিক আদর্শ হিসাবে ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখা কি সম্ভব? ভারতে যেখানে মুসলিম জনগণ সংখ্যালঘু হয়ে আসছে, সেখানে এ প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।… … …
সুতরাং ইসলামের ধর্মীয় আদর্শ মৌলিক দিক থেকেই তার সৃষ্ট সামাজিক কাঠামোর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। একটিকে অগ্রাহ্য করলে পরিণামে অপরটিকেও অগ্রাহ্য করতে হয়। সুতরাং জাতীয় ধারা অনুসরণে রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গেলে যদি তার অর্থ হয় ইসলামী সংহতির নীতিকে বিপর্যস্ত করা, যেকোনো মুসলিম সে ধরনের ব্যবস্থা অবলম্বনের কথা চিন্তাও করতে পারে না। এই সমস্যাই আজকের দিনের ভারতীয় মুসলিম জনগণের সামনে প্রত্যক্ষভাবে ধরা দিচ্ছে।” [২]
উপমহাদেশের সম্প্রদায়গুলির মধ্যকার সম্পর্ক ইতিবাচক না হবার প্রেক্ষিতে আল্লামা ইকবাল বলেন:
“Experience … shows that the various caste units and religious units in India have shown no inclination to sink their respective individualities in a larger whole. Each group is intensely jealous of the collective existence. … … … It is … painful to observe that our attempts to discover … a principle of internal harmony have so far failed. Why have they failed? Perhaps, we suspect each other’s intentions, and inwardly aim at dominating each other. Perhaps, in the higher interests of mutual cooperation, we cannot afford to part with the monopolies which circumstances have placed in our hands, and conceal our egoism under the cloak of a nationalism, outwardly simulating a large-hearted patriotism, but inwardly as narrow-minded as a caste or tribe. Perhaps, we are unwilling to recognize that each group has a right to free development according to its own cultural traditions.” [৩]
অনুবাদ: “অভিজ্ঞতায় অবশ্য দেখা যায় যে, ভারতের বিভিন্ন জাত ও ধর্মীয় দলের মধ্যে তাদের নিজ নিজ স্বতন্ত্র সত্তাকে এক বৃহত্তর সমগ্রে বিলীন করে দেবার কোনো প্রবণতার আভাস পাওয়া যায় না। প্রত্যেক দল তার সমষ্টিগত অস্তিত্ব সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন।
এটা অবশ্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে, এমনি একটা অভ্যন্তরীণ ঐক্যের নীতি খুঁজে বের করার জন্য আমাদের এতদিনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কেন সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো? সম্ভবতঃ, আমরা পরস্পরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করি এবং ভিতরে ভিতরে পরস্পরের উপর আধিপত্য বিস্তার করার লক্ষ্য পোষণ করি। অবস্থা বিশেষে আমরা যেসব একচেটিয়া অধিকার লাভ করেছি, পারস্পরিক সহযোগিতার উচ্চতর স্বার্থের খাতিরেও আমরা সম্ভবতঃ তা ত্যাগ করতে পারছি না এবং আমরা আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতাকে গোপন করছি জাতীয়তাবাদের আবরণে। বাইরে আমরা মহান দেশাত্মবোধের প্রেরণা যোগাই, কিন্তু ভিতরের দিকে আমরা জাত বা গোত্র বিশেষের মতোই সংকীর্ণমনা। সম্ভবতঃ আমরা স্বীকার করতে চাই না যে, প্রত্যেক দলেরই তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী অবাধ আত্মবিকাশের অধিকার রয়েছে।” [৩]
আল্লামা ইকবাল জাতীয়তাবাদকে এভাবে পর্যালোচনা ও পাঠ করে উপমহাদেশের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে এর সমাধান হিশেবে একটি শুভ ও স্বতন্ত্র সম্প্রদায়চেতনা উপস্থাপন করেন। তিনি একে জাতীয়তাবাদ না বলে সম্প্রদায়চেতনাই বলেন। তিনি বলেন সম্প্রদায় ভাল ও মন্দ দুরকমেরই হতে পারে এবং তিনি ভাল ও শুভ সম্প্রদায়চেতনার কথাই বলছেন। একইসঙ্গে তিনি মন্দ ও সংকীর্ণ সম্প্রদায়চেতনাকে পরিত্যাগ করতে বলেছেন:
“But whatever may be the causes of our failure, I still feel hopeful. As far as I have been able to read the Muslim mind, I have no hesitation in declaring that, if the principle that the Indian Muslim is entitled to full and free development on the lines of his own culture and tradition in his own Indian homelands is recognized as the basis of a permanent communal settlement, he will be ready to stake his all for the freedom of India. The principle is not inspired by any feeling of narrow communalism.
There are communalism and communities. A community which is inspired by a feeling of ill-will towards other communities is low and ignoble. I entertain the highest respect for the customs, laws, religious and social institutions of other communities. Nay, it is my duty, according to the teaching of the Qur’an, even to defend their places of worship if need be. Yet I love the communal group which is the source of my life and behaviour; and which has formed me what I am by giving me its religion, its literature, its thought, its culture and thereby recreating its whole past, as a living operative factor, in my present consciousness.
… … … Communalism in its higher aspect, then, is indispensable to the formation of a harmonious whole in a country like India. The units of Indian society are not territorial as in European countries.” [৪]
অনুবাদ: “কিন্তু আমাদের ব্যর্থতার কারণ যা-ই হোক, আমি এখনো আশান্বিত। ঘটনাপ্রবাহ কোনো বিশেষ ধরনের অভ্যন্তরীণ ঐক্য প্রতিষ্ঠার দিকেই প্রবাহিত হচ্ছে বলে মনে হয়। মুসলিম মন সম্পর্কে আমি যতোটা বুঝতে সক্ষম হয়েছি, তাতে আমার একথা ঘোষণা করতে কোনো দ্বিধা নেই যে, ভারতীয় মুসলিম তার নিজস্ব ভারতীয় আবাসভূমিতে নিজস্ব তমদ্দুন ও ঐতিহ্যের ধারা অনুযায়ী পূর্ণ ও অবাধ আত্মবিকাশের অধিকারী, স্থায়ী সাম্প্রদায়িক মীমাংসার বুনিয়াদ হিসাবে এই সত্য স্বীকৃত হলে সে ভারতের আযাদীর জন্য তার সর্বস্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকবে। প্রত্যেক গোষ্ঠী তার নিজস্ব ধারায় স্বাধীনভাবে আত্মবিকাশের অধিকার রাখে, এই নীতি কোনো সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব দ্বারা অনুপ্রাণিত নয়।
সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। যে সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের প্রতি খারাপ মনোভাব পোষণ করে সে নীচ ও ঘৃণার্হ। অপর সম্প্রদায়সমূহের রীতিনীতি, কানুন, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের প্রতি আমি উচ্চতম শ্রদ্ধা পোষণ করি। এমন কি, কুর’আন শরীফের শিক্ষা অনুযায়ী প্রয়োজন হলে তাদের উপাসনাগারসমূহ সংরক্ষণ করাও আমার কর্তব্য। তথাপি যে সাম্প্রদায়িক দল আমার জীবন ও আচরণের উৎস এবং যার ধর্ম, যার সাহিত্য, যার চিন্তাধারা, যার তমদ্দুন আমায় বাস্তবে রূপায়ন করেছে এবং আমার চেতনায় যার সম্পূর্ণ অতীত এক জীবন্ত কার্যকরী উপাদান হিসাবে পুনরুজ্জীবন লাভ করেছে, সেই বিশেষ সাম্প্রদায়িক দলটিকে আমি ভালোবাসি।
… … … সুতরাং ভারতের মতো দেশে এক ঐক্যবদ্ধ সমগ্র গঠনের জন্য উচ্চতর বৈশিষ্ট্য-সহকারে সাম্প্রদায়িকতা অপরিহার্য। ভারতীয় সমাজের ইউনিটসমূহ ইউরোপীয় দেশসমূহের মতো আঞ্চলিক নয়।” [৪]
ইউরোপ ও উপমহাদেশের মধ্যে পার্থক্য আরো স্পষ্ট করে তিনি বলেন:
“The principle of European democracy cannot be applied to India without recognizing the fact of communal groups. The Muslim demand for the creation of a Muslim India within India is, therefore, perfectly justified. … … … this noble ideal of a harmonious whole which, instead of stifling the respective individualities of its component wholes, affords them changes of fully working out the possibilities that may be latent in them.” [৫]
অনুবাদ: “সাম্প্রদায়িক দলসমূহের অস্তিত্ব স্বীকার না করে ভারতে ইউরোপীয় গণতন্ত্রের নীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে না। সুতরাং ভারতের ভিতরে এক মুসলিম ভারত গড়ে তোলার জন্য উত্থাপিত মুসলিম দাবী সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত। … … … [এই] গৃহীত প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে এক ঐক্যবদ্ধ সমগ্র গঠনেরই মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং তা তার অন্তর্গত বিভিন্ন সমগ্র দল নিজ নিজ সত্তাকে বাধাগ্রস্ত করার পরিবর্তে বরং তাদের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে পূর্ণ বিকশিত করার পরিপূর্ণ সুযোগ তাদেরকে দেবে।” [৫]
ইউরোপ ও উপমহাদেশের বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা যেমন ক্রিশ্চিয়ানিটি ও ইসলামের বিভিন্নতা, উপমহাদেশে অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের অপ্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশে ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়ের পরস্পরমুখী বৈপরীত্যের মীমাংসাকল্পে একটি অভূতপূর্ব প্রস্তাব পেশ করেন:
“… I would like to see the Punjab, the North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan amalgamated into a single state. Selfgovernment within the British Empire, or without the British Empire, the formation of a consolidated North-West Indian Muslim state appears to me to be the final destiny of the Muslims, at least of North-West India.” [৬]
অনুবাদ: “… আমি পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে একটি একীভূত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে অথবা বৃটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে স্বায়ত্তশাসন, এক ঐক্যবদ্ধ উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্রগঠন, আমার কাছে মুসলমানদের, অন্ততঃ উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের চূড়ান্ত ঠিকানা বলে মনে হয়।” [৬]
মুসলিম সম্প্রদায়ের পূর্ণ বিকাশের জন্য উপমহাদেশে কেন একটি রাজনৈতিক কেন্দ্র প্রয়োজন সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি আরো বলেন:
“… … … India is the greatest Muslim country in the world. The life of Islam as cultural force in this living country very largely depends on its centralization in a specified territory. … … … The Muslim demand….is actuated by a genuine desire for free development, which is practically impossible under the type of unitary government contemplated by the nationalist Hindu politicians with a view to securing permanent communal dominance in the whole of India.
….Indeed, the Muslims of India are the only Indian people who can truly be described as a nation in the modern sense of the word. The Hindus, though ahead of us in almost all respects, have not yet been able to achieve the kind of homogeneity which is necessary for a nation, and which Islam has given you as a free gift. No doubt they are anxious to become a nation, but the process of becoming a nation is kind of travail, and in the case of Hindu India, involves a complete overhauling of her social structure.” [৭]
অনুবাদ: “… … … ভারত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দেশ। এ দেশে সাংস্কৃতিক শক্তি হিসাবে ইসলামের জীবনশক্তি সব চাইতে বেশী করে নির্ভর করে একে এক নির্দিষ্ট অঞ্চলে কেন্দ্রীভূতকরণের উপর। ভারতীয় মুসলিমদের সর্বাধিক অংশের এই কেন্দ্রীভূতকরণে ভারতের ও এশিয়ার সমস্যার সমাধান হবে। … … …[এই] মুসলিম দাবী[র] … মূলে রয়েছে অবাধ আত্মবিকাশের অকৃত্রিম আকাঙ্ক্ষা, যা সমগ্র ভারতের উপর স্থায়ী সাম্প্রদায়িক আধিপত্য লাভের উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদী হিন্দু রাজনীতিকদের পরিকল্পিত ইউনিটারী ধরনের শাসনব্যবস্থায় প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব।
….প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় মুসলিমরাই একমাত্র ভারতীয় জাতি যাদেরকে আধুনিক শাব্দিক তাৎপর্য অনুযায়ী সঠিকভাবে একটি জাতি বলে অভিহিত করা যেতে পারে। হিন্দুরা যদিও প্রায় সবদিক দিয়েই আমাদের তুলনায় অধিকতর অগ্রগামী, তথাপি তাঁরা একটি জাতির পক্ষে অপরিহার্য একজাতিত্ববোধ এখনো পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি, অথচ ইসলাম তা আপনাদেরকে তোহফা হিসাবে দান করেছে। নিঃসন্দেহে তাঁরা (হিন্দুরা) একটি জাতিতে পরিণত হবার জন্য আগ্রহান্বিত, কিন্তু একটি জাতিকে রূপায়ন করার বিবর্তনধারা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার এবং হিন্দু ভারতের ক্ষেত্রে এর জন্য তাঁদের সামাজিক কাঠামো পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে।“ [৭]
আল্লামা ইকবালের এই ফর্মুলা শুধু উপমহাদেশের সম্প্রদায়গত সমস্যারই সমাধান করবে না। তিনি মনে করতেন যে এই প্রস্তাব সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি ইতিবাচক দিকনির্দেশনা হতে পারে। তিনি বলেন:
“… I, therefore, demand the formation of a consolidated Muslim State in the best interests of India and Islam. For India, it means security and peace resulting from an internal balance of power; for Islam, an opportunity to rid itself of the stamp that Arabian Imperialism was forced to give it, to mobilize its laws, its education, its culture, and to bring them into closer contact with its own original spirit and with the spirit of modern times.” [৮] … … …
“… We have a duty towards Asia, especially Muslim Asia. And since seventy millions of Muslims in [a] single country constitute a far more valuable asset to Islam than all the countries of Muslim Asia put together … [৯]
অনুবাদ: “…সুতরাং আমি ভারতের ও ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থেই একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবী জানাচ্ছি। ভারতের পক্ষে এর ফলে সম্ভব হবে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার ভারসাম্য বিধান করে নিরাপত্তা ও শান্তি কায়েম করা। আর ইসলাম এতে আরব সাম্রাজ্যবাদের ছাপ থেকে মুক্তি লাভের এবং তার কানুন, তার শিক্ষা ও তার সংস্কৃতিকে সুসংহত করে তার নিজস্ব বুনিয়াদী ভাবধারা ও আধুনিক কালের ভাবধারার সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ বিধানের সুযোগ পাবে।” [৮]
“…এশিয়ার প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম এশিয়ার প্রতিও রয়েছে আমাদের কর্তব্য। যেহেতু মুসলিম এশিয়ার সবগুলি দেশের সম্মিলিত শক্তির তুলনায় একটি মাত্র দেশের সাত কোটি মুসলিম অধিবাসী ইসলামের জন্য অধিকতর মূল্যবান সম্পদ …” [৯]
তিনি ইসলামের মৌল চেতনায় উদবুদ্ধ হয়ে তাদেরকে সক্রিয় হতে বলেন এবং বৈশ্বিক উম্মাহচেতনার প্রতি উপমহাদেশের মুসলিমদের উদাত্তভাবে আহবান জানিয়ে বলেন:
“In the near future our community may be called upon to adopt an independent line of action to cope with the present crisis. And an independent line of political action, in such a crisis, is possible only to a determined people, possessing a will focalized by a single purpose. … Rise above sectional interests and private ambitions….Pass from matter to spirit. Matter is diversity; spirit is light, life and unity … …
….one lesson I have learnt from the history of Muslims. At critical moments in their history, it is Islam that has saved Muslims and not vice versa. If today you focus your vision on Islam and seek inspiration from the ever vitalizing idea embodied in it, you will be only reassembling your scattered forces, regaining your lost integrity, and thereby saving yourself from total destruction…” [১০]
অনুবাদ: “অদূর ভবিষ্যতে বর্তমান সংকট পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য মুসলিম মিল্লাতের পক্ষে স্বতন্ত্র কার্যক্রম অবলম্বনের প্রয়োজন আসতে পারে। অনুরূপ সংকট পরিস্থিতিতে স্বতন্ত্র ধারায় রাজনৈতিক কার্যক্রম অবলম্বন কেবল একটিমাত্র উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীভূত একটি মাত্র আকাঙ্খাসম্পন্ন দৃঢ়-সংকল্প জাতির পক্ষেই সম্ভব হতে পারে। … দলীয় স্বার্থ ও ব্যক্তিগত আকাঙ্খার উর্ধ্বে উঠুন; … বস্তু থেকে আত্মার দিকে ফিরে আসুন। বস্তু হচ্ছে বৈচিত্র্য, আত্মা হলো আলো, জীবন ও ঐক্য।
মুসলিম জাতির ইতিহাস থেকে একটি শিক্ষা আমি পেয়েছি। ইতিহাসের যে কোনো সংকটময় মুহূর্তে ইসলামই মুসলিম জাতিকে রক্ষা করেছে, মুসলিম জাতি ইসলামকে রক্ষা করেনি। আজও যদি আপনারা ইসলামের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং ইসলামে মনোনীত চিরন্তন প্রাণসঞ্চারী ধারণা থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করার চেষ্টা করেন, তাহলে তার ফলে আপনারা কেবল আপনাদের বিচ্ছিন্ন শক্তিকেই পুনরায় সুসংবদ্ধ করবেন, আপনাদের হারানো সততা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন এবং তা দ্বারা আপনারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবার বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন।…” [১০]
রেফারেন্স:
ইংরেজী উদ্ধৃতি: [১] থেকে [১০] Allama Muhammad Iqbal’s 1930 Presidential Address, 25th Session of All India Muslim League, December 29, 1930, Allahabad, India
বাংলা অনুবাদ: [১] থেকে [১০] মুহাম্মদ ইকবাল, এলাহাবাদ অধিবেশনে ইকবালের ঐতিহাসিক ভাষণ, সঞ্চারণ, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯, [এই লেখক কর্তৃক ভাষা স্বল্প পরিমাণে সম্পাদিত]

লেখক পরিচিতি:
মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত
লেখক
কবি
চিন্তাবিদ
গবেষক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *