Political Philosophy of Allama Iqbal

আল্লামা ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ:

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। এই সময় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। যা দেশভাগ বলে পরিচিতি পেয়েছে। দ্বিতীয় বারের মত বঙ্গভঙ্গ-ও এই সময় সংঘটিত হয়। পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিমদের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেয়। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই রাষ্ট্র যে রাজনৈতিক চেতনার আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা দ্বিজাতিতত্ত্ব নামে পরিচিত।

এই দ্বিজাতিতত্ত্বের দার্শনিক প্রস্তাবনা করেছিলেন কবি ও দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল। ১৯৩০ সালে এলাহাবাদ ভাষণে তিনি এই প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার সাহিত্যিক ও দার্শনিক অবদানকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা ও পথনির্দেশনা হিশেবে গণ্য করা হয়।

আল্লামা ইকবাল ফারসি ও উর্দু ভাষায় তার মূল রচনাগুলি লিখেছিলেন। ইংরেজী ভাষাতেও লেখা আছে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা ও চিঠি। কিন্তু তার সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিম বিদ্বজ্জনেরা ১৯৪৭ এর পূর্বে ও অব্যবহিত পরে যথেষ্ট সমাদর দেখিয়েছেন। সেই সময়ে তার অনেক রচনার বাংলা অনুবাদ হয়েছিল। অনেক যোগ্য ও খ্যাতিমান বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক ও লেখক এই অনুবাদ কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। যেমন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, মনিরউদ্দীন ইউসুফ প্রমুখ।

কিন্তু আজকের বাংলাদেশে আল্লামা ইকবালের সাহিত্য ও চিন্তা কেন প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে? এই প্রশ্নের উত্তর হল — ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে পূর্ব বাংলায় যে বাঙালিত্ব-ভিত্তিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির জোয়ার চলেছে তারই ক্রমবর্ধিষ্ণু অভিঘাতে এটি ঘটেছে। সেই সঙ্গে যোগ করা যায় ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে এই বাঙালিত্ব-ভিত্তিক চেতনার আরো প্রচার ও প্রসার-কে। এরই ফলশ্রুতিতে বিগত ষাটের দশকে আমরা দেখতে পাই বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি একদিকে ৬ দফা কর্মসূচির আলোকে উদীয়মান আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ও তৎপর; আবার অন্যদিকে এর সমান্তরালে বাঙালি শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত মননশীল ও সৃজনশীল শ্রেণি রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী ও পহেলা বৈশাখ পালন এবং সাধারণভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চায় ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষিতে ছায়ানটের ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনেরা পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত বিদগ্ধ নাগরিক শ্রেণির সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি রবীন্দ্র-নজরুল-কেন্দ্রিক বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন।

এই কেবলি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের শিল্পরুচিস্নিগ্ধ মানস পরিমন্ডলে স্বতন্ত্র মিল্লাতী রাষ্ট্র ও উম্মাহচেতনার ধারক ও বাহক আল্লামা ইকবাল ক্রমাগত উপেক্ষিত হতে থাকলেন। একথা বললে ভুল হবে না যে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে রবীন্দ্র-নজরুল যুগলবন্দী দিয়ে আল্লামা ইকবালকে ম্রিয়মান করে ফেলা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা এভাবে পশ্চিম বঙ্গ থেকে রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে রবীন্দ্র-নজরুল এই দুই আইকনকে আমদানী করে তাদের সাংস্কৃতিক চাহিদা মিটিয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল এই যে আল্লামা ইকবালকে প্রতিস্থাপনে তারা পূর্ব বাংলার কোন সাংস্কৃতিক আইকনকে খুঁজে পায়নি কিংবা তৈরিও করতে পারেনি। তাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্য গঠিতই হল পরদেশনির্ভরতা দিয়ে। এই পরদেশনির্ভর মানস ও সংস্কৃতি দিয়ে আর যাই হোক পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। বরঞ্চ পরনির্ভর সংস্কৃতি পরনির্ভর রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির জন্ম দেয়।

বাঙালি মুসলমানের এই সংকীর্ণ এবং আঞ্চলিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চেতনা এবং মানস থেকে ১৯৭১-উত্তর বাংলাদেশে আল্লামা ইকবাল সম্পূর্ণ বর্জিত হলেন। কারণ দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামো থেকে একটি গণহত্যামূলক স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে। পূর্ব বাংলার বাঙালির উপরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই অন্যায় বৈষম্য, বঞ্চণা, নিপীড়ন ও গণহত্যার দায় এই বাঙালি জাতিবাদীরা পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা হিশেবে আল্লামা ইকবালের উপরেও বর্তিয়েছে। কাজেই ১৯৭১-উত্তর বাংলাদেশে আমরা দেখতে পেলাম যে আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নাম থেকে আল্লামা ইকবালের নাম প্রত্যাহার করে নেয়া হল।

বাঙালি মুসলমান তার দার্শনিক দারিদ্র্যের কারণে নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে সর্বদা দোদুল্যমান ও সংশয়গ্রস্ত। এই বাঙালি মুসলমান কি কখনো এই আত্মজিজ্ঞাসা করেছে যে আল্লামা ইকবালকে অপাংক্তেয় করে রাখায় তাদের কি ক্ষতিটা হচ্ছে? ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপরে ভিত্তি করে গঠিত স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছিল। কিন্তু একটি উগ্র বাঙালিত্ববাদী গোষ্ঠী এই সুযোগে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় থেকে মুসলমানত্বকে বিসর্জন দিয়ে তাকে সম্মিলিত জাতীয়তার নামে কারো গোলাম করে রাখতে চায় কিনা — সেই ব্যাপারেও তো তাকে যথেষ্ট সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। আর এই সতর্কতা ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আল্লামা ইকবালের সাহিত্য ও দর্শন বাঙালি মুসলমানের জন্য এখনো অনেক প্রযোজ্য ও প্রাসঙ্গিক।
আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম আত্মপরিচয় এবং মিল্লাত ও উম্মাহচেতনা কুর’আন এবং সুন্নাহর আলোকে উপস্থাপন করেছিলেন। তা বাঙালি মুসলমানের জাতীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্র্য ও কর্তাসত্তা সুরক্ষায় প্রণোদনা যোগাতে পারে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের তাগিদেই তাই আল্লামা ইকবালকে এখনো প্রয়োজন।

আল্লামা ইকবাল, কলকাতামুখী পূর্ব বঙ্গীয় এলিট বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশ:

পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান এক ধরনের দোদুল্যমান ও সংশয়গ্রস্ত আত্মপরিচয় নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দিয়েছিল। এই দ্বিধা ও সংশয়ের উৎস ও সূত্র হল এ অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানের দীর্ঘদিনের শিক্ষা, জ্ঞান ও সংস্কৃতিচেতনায় ইসলামের অগভীর ও উপরিতলীয় অবস্থান। ধর্মীয় শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা- এই দুটি পরিমন্ডলেই এই অগভীর এবং ত্বকভেদে অক্ষম অপর্যাপ্ত ইসলামায়ন প্রক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। ফলে এদেশে ইসলাম বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ থেকেছে; ইসলামের চেতনা পূর্ব বাংলার মুসলমানের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানস কাঠামোর ত্বকভেদ করে গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি।

ফলে পূর্ব বাংলায় বিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে পঞ্চাশ ও ষাট দশক অবধি যে এলিট বাঙালি মুসলিম শ্রেণি গড়ে উঠছিল তার মানস ও চেতনা জগতে ইসলামের নিমজ্জন ছিল অগভীর ও উপরিতলীয়। বরঞ্চ তার মানস ও চেতনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল ইংরেজী শিক্ষা সূত্রে পাশ্চাত্য ভাবধারা এবং সেইসঙ্গে কলকাতায় উদ্ভূত এবং বিকশিত বাঙালি হিন্দু “বাবু” বা “ভদ্রলোক”-এর ভাবধারা ও চেতনা। এর কারণ হল বাঙালি মুসলমানের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রমে এই দুই উৎসের একচ্ছত্র প্রাধান্য ও প্রভাব। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উপজাত হিসাবে উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে কলকাতায় বাঙালি হিন্দু এলিটের মাধ্যমে যে আধুনিক “বাঙলার রেনেসাঁ” বা নবজাগরণ সাধিত হয়েছিল বিশ শতকের পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিম এলিট শ্রেণি সেই কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের ছায়াতলেই বিকশিত হচ্ছিল।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে বাঙালি মুসলিম শ্রেণি যদি এই কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু “বাংলার রেনেসাঁ”র অনুপ্রেরণাতেই গঠিত হচ্ছিল তবে তারা কেন অখন্ড ভারতের অধীনে অবিভক্ত বাংলা গড়ে তোলেনি? এর উত্তর হল ১৭৯৩ সালে সূচিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অভিঘাতে পূর্ব বাংলার বৃহত্তর মুসলিম কৃষক সমাজ হিন্দু জমিদার শ্রেণির অধীনস্ত জমির মালিকানাবিহীন প্রজায় পরিণত হয়েছিল। কাজেই হিন্দু জমিদার রুপী এলিট শ্রেণির সঙ্গে তার একটি অর্থনৈতিক ও শ্রেণিগত বিরোধ দেখা দিয়েছিল। [১] ফলে তার কাছে স্বতন্ত্র মুসলিম পরিচয় ভিত্তিক পাকিস্তানের ধারণা অত্যন্ত আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল। [২]

কিন্তু তার এই স্বাতন্ত্র্যচেতনা তার উল্লিখিত পর্যাপ্ত ইসলামায়নের অভাবে কেবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে সে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চিন্তার ক্ষেত্রে কলকাতায় উদ্ভূত এলিট হিন্দু বাঙালির ঔপনিবেশিক এবং আধুনিক চেতনা ও ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছিল। আর এটিই ছিল তার দোদুল্যমান ও দ্বিধাগ্রস্ত আত্মপরিচয়ের মূল কারণ।

এই প্রেক্ষিতে মিল্লাতী রাষ্ট্র ও উম্মাহচেতনার ধারক আল্লামা ইকবাল কলকাতা প্রভাবিত উদীয়মান বাঙালি মুসলিম এলিট শ্রেণির কাছে ক্রমাগত উপেক্ষিত হতে থাকলেন। বাঙালি মুসলিম তার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাচ্ছিল সেখানে একধরনের উর্দু ভাষা বিরোধীতা ও ঘৃণা তৈরি হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে কয়েকজন বাঙালি মুসলিম নিহত হবার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় এমন একটি আবেগী মিথিক পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছিল।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬১ সালে জন্মশতবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের সাহিত্য ও সঙ্গীত স্রষ্টা পশ্চিম বঙ্গের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব বাংলার মঞ্চে প্রবল উত্থান ঘটে। রবীন্দ্রনাথ একজন উৎকৃষ্ট কবি ও সঙ্গীতকার এতে কোন সন্দেহ নেই; কিন্তু তার জাতীয় চেতনা ও আদর্শ অখন্ড ভারতের আওতায় অবিভক্ত বাংলার পক্ষে-ই অবস্থান নিয়েছিল; তিনি যেহেতু বাংলা ভাষায় লিখে একজন বিশ্বমানের শিল্পস্রষ্টা হতে পেরেছেন সেহেতু তার প্রতি বাঙালি মুসলমানের-ও আকর্ষণ থাকবে নিশ্চয়ই; কিন্তু তাই বলে তাকে পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্র্যকে ভিত্তি করে যে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তার জাতীয় চেতনার প্রতিভূ মনে করা অযৌক্তিক। আর তাকে সম্মান জানাতে গিয়ে কেন মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার প্রতীক আল্লামা ইকবালকে বিসর্জন দিতে হবে? কেন উর্দু ভাষাকে ঘৃণা করে উপমহাদেশের মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি উজ্জলতম ঐতিহ্য থেকে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানকে বঞ্চিত রাখা হবে?

এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বাঙালি মুসলমান তার জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাবার ফলে উপমহাদেশের মুসলিম ঐক্য ও সংহতি বিঘ্নিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শক্তি দুর্বল হয়েছে। আজকে যে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে তা এখনো তার পরিচয় সংকট থেকে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এদেশের জনগোষ্ঠী এর প্রভাবে আজো বিভক্ত ও পরস্পর নির্মূল অভিযানে লিপ্ত। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র ও স্বকীয় চেতনার আলোকে জাতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার বিচ্ছিন্নতার মোচন এবং পুনর্গঠন। বাংলাদেশের এই পুনর্গঠনে আল্লামা ইকবালের সাহিত্য ও দর্শন আমাদের জন্য নিশ্চিতভাবে উপকারী পথনির্দেশনা। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

রেফারেন্স:
[১] বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক, মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১২২-১৩৩।
[২] Taj ul-Islam Hashmi, Pakistan as a Peasant Utopia: The Communalization of Class Politics in East Bengal 1920-1947, Westview Press, 1992, p. 219-262.

আল্লামা ইকবাল এবং বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ভাষা ও সাহিত্য প্রশ্ন:

আল্লামা ইকবাল বাংলাদেশে কেন ও কিভাবে প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ের আলোচনার সূত্রে এখানে অবতারণা করা যেতে পারে পূর্ব বাংলার সাধারণ প্রমিত ভাষা এবং বিশেষভাবে সাহিত্যের ভাষার প্রশ্নটি। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে পূর্ব বাংলার প্রমিত ভাষা ও সাহিত্যের ভাষায় পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু বাঙালি “বাবু” বা “ভদ্রলোক” শ্রেণির সংস্কৃত প্রভাবিত আধুনিক বাংলা ভাষার অনেক প্রভাব রয়েছে। পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক শব্দ এবং এদেশে প্রচলিত আরবি, ফারসি, উর্দু ও তুর্কী শব্দ বিবর্জিত এই “প্রমিত” ভাষা আসলে একটি কৃত্রিম ভাষা। এই ভাষা তৈরি হয়েছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে ব্রিটিশ প্রাচ্যবাদীদের উদ্যোগে সংস্কৃত পন্ডিতদের মাধ্যমে। এরা প্রাক-আধুনিক বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকদের আরবী-ফারসি শব্দ প্রভাবিত বাংলা ভাষাকে “মিশ্র ভাষা” বলে বর্জনীয় মনে করলেও তাদের সৃষ্ট সংস্কৃত শব্দ প্রভাবিত বাংলা ভাষাকে মিশ্র ভাষা না বলে “প্রমিত ভাষা” মনে করেছেন। এখানেই নিহিত রয়েছে প্রমিত ও সাহিত্যের ভাষা প্রশ্নে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক কর্তাসত্তার বোঝাপড়ার বিষয়টি।

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের হাতে এই সংস্কৃত প্রভাবিত মিশ্র বাংলা ভাষাটি একটি শৈল্পিক উৎকর্ষ লাভ করেছে। পশ্চিম বঙ্গের এই সংস্কৃত প্রভাবিত মিশ্র বাংলা ভাষাকেই ভাষা আন্দোলন-উত্তর পূর্ব বাংলা তার প্রমিত ও সাহিত্যের ভাষা হিশেবে বরণ করে নিয়েছে।

জসীম উদ্দীন, আল মাহমুদ, আহমফ ছফা, হুমায়ুন আহমেদ ও সাম্প্রতিক কালের অনেক তরুণের হাতে পূর্ব বাংলা/বাংলাদেশের প্রমিত ও সাহিত্যের ভাষায় একটি আঞ্চলিক শব্দ ভিত্তিক বাচন ও লেখন রীতি বেশ প্রচলিত হয়েছে। এটিকে নিঃসন্দেহে এক কদম অগ্রগতি বলা যায়; কিন্তু এরপরেও পূর্ব বাংলা/বাংলাদেশের প্রমিত ভাষা ও সাহিত্য স্বকীয় ভাষাগত ও চেতনাগত বৈশিষ্ট্যে এখনো একটি উৎকৃষ্ট বিশ্বমানে পৌঁছাতে পারেনি। এর কারণ হল পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্য এখনো বাঙালি মুসলমানের ইসলাম-ভিত্তিক জীবনচর্যা ও চেতনার আলোকে পর্যাপ্ত পরিগঠিত হয়নি।

ভারতীয় আলেম মওলানা আবুল হাসান আলী নাদভীর পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে অনেক প্রাসঙ্গিক। তিনি বাঙালি মুসলমানকে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক নেতৃত্ব অর্জনে সচেষ্ট হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। যেভাবে উত্তর ভারতের মুসলিমেরা উর্দু ভাষাকে ইসলামের সংস্কৃতি ও চেতনার আলোকে জারিত করে এই ভাষার নেতৃত্ব অর্জন করেছে, তেমনিভাবে বাংলা ভাষার সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যকেও ইসলামের আদর্শ ও চেতনা দিয়ে রাঙিয়ে বাঙালি মুসলমানকে বাংলা ভাষার কর্তাসত্তা হয়ে ওঠার তাগিদ মওলানা নাদভী এদেশের মুসলিমদেরকে দিয়েছিলেন। আর এই বৃহৎ ও মহৎ কর্মে আল্লামা ইকবাল হতে পারেন একজন উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা ও বাতিঘর।

এই লক্ষ্য নিয়ে মওলানা আকরম খাঁ, ইবরাহীম খাঁ, গোলাম মোস্তফা, আবদুল কাদির, আবুল মনসুর আহমদ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ফররুখ আহমদ, মনিরউদ্দীন ইউসুফ, মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, সৈয়দ আলী আশরাফ, আল মাহমু্দ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, এবনে গোলাম সামাদ, মাহমুদুর রহমান, ফাহমিদ-উর-রহমান প্রমুখ অনুসৃত স্বাতন্ত্র্যবাদী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ঐতিহ্য হিশেবে বরণ করে নিতে হবে। এভাবে পূর্ব বাংলার/বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যকে মুসলিম আদর্শ ও চেতনার অসমাপ্ত পথপরিক্রমার সঙ্গে পুনঃসংযোগ সাধন করতে হবে। সমকালীন বৈশ্বিক মিল্লাত ও উম্মাহচেতনার সংশ্লেষে এই ধারাটিকে পুনর্গঠিত ও পরিপুষ্ট করতে হবে। তাহলে বাঙালি মুসলিম একটি বিশ্বমানের অস্তিত্বে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ!

আল্লামা ইকবাল ও আনমারি শিমেলের যুগনামকরণ- “দ্য এজ অফ ইকবাল”
প্রখ্যাত জার্মান গবেষক ও লেখক আনমারি শিমেল তার বিদ্বজ্জন মহলে স্বীকৃত উপমহাদেশের মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘ইসলাম ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ (১৯৮০) গ্রন্থে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে “ইকবালের যুগ” বা “দ্য এজ অফ ইকবাল” বলে চিহ্নিত করেছেন।

অথচ আমরা বাংলাদেশীরা তার মৃত্যুর ৩৩ বছর পরে ১৯৭১ সালে সংঘটিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবাদের দায় তার উপরে চাপিয়ে তাকে বর্জন করেছি। ১৯৭১ সালে যে কামালবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পূর্ব বাংলায় একটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল সেই সামন্ত, ঔপনিবেশিক, আমলাতান্ত্রিক ও সেনাতান্ত্রিক পাকিস্তানের দায় কি আল্লামা ইকবালের উপরে বর্তায়?

এইসব বিষয়ে স্থূল, বর্ণবাদী ও জাতিবাদী ঘৃণায় আক্রান্ত হলে একধরণের অন্ধত্ব ও মূঢ়তায় নিমজ্জিত হতে হয়। ফলে এক পক্ষপাতদুষ্ট ন্যায়বিচারহীন সিদ্ধান্তের অন্ধকারে ডুবে যেতে হয়। এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত জাতিকে শুধু বঞ্চিত-ই করে না; বরঞ্চ জাতির জন্য চলমান বিভেদ ও বিভক্তির উৎস হয়ে ওঠে।

লেখক পরিচিতি:
মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত
লেখক
কবি
গবেষক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *