One of the pioneers of the Muslim Awakening in Bengal: Jamaluddin Afghani

শতাব্দীর সংকট ও আফগানী:

বিশ্ব প্যান-ইসলামী আন্দোলনের পথিকৃৎ সাইয়েদ জামালউদ্দীন আফগানী (১৮৩৯-১৮৯৭) ছিলেন উনিশ শতকের মুসলিম ঐক্যের বাণীবাহক ও রেনেসাঁর অগ্রদূত। তিনি মুসলিম বিশ্ব ইতিহাসের এক গভীর সংকটকালে জন্মগ্রহণ করেন এবং জাতিকে উত্তরণের পথে পরিচালিত করতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।

১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে বিশাল ভারতবর্ষে ইংরেজদের হাতে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৮৫০ সালে উত্তর আফ্রিকা ও আলজেরিয়ায় ফরাসী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৯ থেকে ১৮৮৬ সালের মধ্যে ককেশীয় ও উজবেক অঞ্চলে রুশ দখল কায়েম হয়। ১৮৮১ সালে ফরাসীরা তিউনিশিয়া এবং ১৮৮২ সালে ইংরেজরা মিসর অধিকার করে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এ সময় ঔপনিবেশিক শক্তির দখলে চলে যায়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও বুলগেরিয়াসহ বহু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা অমুসলিম শক্তির কুক্ষিগত হয়।

পূর্ব ইউরোপে এ সময় উসমানীয় খিলাফতের দুর্দিন আর শতচ্ছিন্ন আরব উপদ্বীপে চলছিল সার্বিক বিপর্যয়। তুরস্কের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক পশ্চাদপদতা এবং বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও বিশ্বব্যাপী সচেতন মুসলমানদের আশা-ভরসার উৎস ছিল মুমূর্ষু উসমানীয় সাম্রাজ্য। বৃটিশ শক্তি গ্রীকদেরকে তুরস্কের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে মুসলমানদের এ কেন্দ্রভূমির পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। মুসলিম দুনিয়ার এমনি এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে প্রাচ্যের অগ্নি-পুরুষ সৈয়দ জামালউদ্দীন আফগানীর আবির্ভাব ঘটে।

আদর্শের পতাকা ও ঐক্যের মনযীল:

মুসলিম উম্মাহর বেদনার্ত ও বিপর্যস্ত মুহূর্তগুলোর নীরব পর্যবেক্ষক না হয়ে আফগানী এ সংকট থেকে মুসলমানদেরকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নিজের মেধা,মনন, লেখনী, বাগ্মিতা, চারিত্রিক প্রভাব ও সাংগঠনিক শক্তি পূর্ণরূপে নিয়োজিত করেন। মুসলমানদের রাজনৈতিক বিপর্যয় সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে তাঁর এ অনুভূতি জন্মে যে, মুসলমানদের অনৈক্যই তাদের সকল দুরবস্থার মূল কারণ । তিনি লক্ষ্য করেন যে, মুসলমানদের ওপর বিজয়ী হতে শত্রুদেরকে কোথাও কোনো সমন্বিত প্রতিরোধের মুকাবিলা করতে হয়নি। তাঁর মতে, আত্মরক্ষাই ছিল ইসলামী দুনিয়ার জন্য সার্বিক ও অবিভাজ্য সমস্যা। প্রতিটি মুসলিম দেশের পরম ও চূড়ান্ত স্বার্থ বাকি মুসলিম দুনিয়ার সাথে ওতপ্রোত ও অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। কেননা, ইসলামের সমগ্র ইতিহাস হলো এক ও অভিন্ন ধারাবাহিকতা ।

বিভিন্ন জাতির উন্নতি ও অবনতির ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যয়ন, অন্বেষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েই মুসলমানরা আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, স্বাধীন, উন্নত জাতিরূপে মাথা উঁচু করতে পারে। নিছক ভাষা, ভূগোল কিংবা নৃতত্ত্বগত ঐক্যের ভিত্তিতে কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়া সম্ভব নয়। তিনি আফগানিস্তান, ভারত, ইরান, মিসর ও উসমানীয় সাম্রাজ্যসহ গোটা মুসলিম বিশ্বকে ইসলামী আদর্শের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান।

জামালউদ্দীন আফগানী মুসলিম বিশ্বে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি স্থাপন এবং মুসলিম দেশগুলোকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার লক্ষ্যে সংগ্রাম করেন। তাঁর চিন্তাধারার প্রভাবে মুসলিম দেশসমূহের যুবসমাজ বিপ্লবী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। তাদের মাঝে ইসলামী চেতনা, স্বদেশপ্রেম ও স্বাতন্ত্রবোধ জাগ্রত হয় ।

মুসলিমবিশ্বের শিক্ষিত শ্রেণীকে ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা এবং মুসলিম বিশ্বকে পাশ্চাত্যের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে আফগানীর অবদান ছিল অপরিসীম। আফগানী তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, বিপুল জীবনীশক্তি, বিশ্বাসের গভীরতা, দূরদর্শী নেতৃত্ব, গভীর জ্ঞান ও জ্বালাময়ী বাগ্মিতাকে সম্বল করে ছুটে বেড়িয়েছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন জনপদে। তিনি বিভেদ-আক্রান্ত মুসলিম দুনিয়ার ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং ঐক্যের মধ্যেই তিনি ভবিষ্যৎ মুসলিম উম্মাহর মুক্তিকে চিহ্নিত করেন।

আফগানী উপলব্ধি করেন যে, ইসলামী ব্যবস্থাপনার সমন্বিত ও সামগ্রিক চিন্তার ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের কারণে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ফাটল ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামী দুনিয়া ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার কারণে এসব রাষ্ট্রের ধর্মীয় চিন্তাবিদ ও সাধারণ মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। উম্মাহর সদস্যদের এ চিন্তার বিচ্ছিন্নতাই তাদের বিপর্যয়ের প্রধান কারণ।

আফগানী ইসলামী আইনের যুগোপযোগী ব্যাখ্যার জন্য ইজতিহাদ এবং মুসলিম প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের পুনর্গঠন এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে ইসলামের সমন্বয় বিধানের আহ্বান জানান। এ লক্ষ্যে তিনি বিশ্বজনীন একজন নেতা বা খলীফার নেতৃত্বে অভিন্ন পতাকা ও প্রতীকের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান। তিনি এ প্রতীকী নেতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, বিভিন্ন মুসলিম ভূখন্ডের জন্য ইসলামের ব্যাখ্যা প্রদানের ব্যাপারে আঞ্চলিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বৈধ কর্তৃত্ব তাঁর থাকবে।

‘ওয়াহদাত আল ইসলামিয়া’ বা প্যান ইসলামী আন্দোলন:

জামালউদ্দীন আফগানী আল-কুরআনের আয়াতসমূহের আলোকে তাঁর বক্তব্যকে যুক্তি ও প্রজ্ঞার দৃঢ় ভিত্তির ওপর উপস্থাপন করেন। সমসাময়িক মুসলিম শাসক, আলিম-বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ জনসমাজকে তিনি ইসলামের সত্যে প্রত্যাবর্তনের আহবান জানান। তাঁদের কাছে তিনি নবুওয়াতের ধারায় খিলাফত ব্যবস্থা কায়েমের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

আল-কুরআনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে খ্রীষ্টান সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী শক্তির সমুত্থিত অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তিনি বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। পশ্চিমা সমালোচকরা তাঁর এ ‘ওয়াহদাত আল ইসলামিয়া’ বা ইসলামী ঐক্য আন্দোলনকে ‘প্যান ইসলামিজম’ নামে অভিহিত করে।

জামালউদ্দীন আফগানীর ‘ওয়াহদাত আল ইসলামিয়া’ আন্দোলনের মূলকথা ছিলঃ
ক. সকল মুসলিম রাষ্ট্র নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে পশ্চিমা আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গঠন করবে,

খ. নিজেদের মধ্যে একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে এবং

গ. তারা একে অন্যের অভ্যন্তরিণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।

এ ঐক্যের ভিত্তি নির্দেশ করে মুসলিম শাসকদের লক্ষ্য করে আফগানী বলেনঃ

“আমি আশা করি, কুরআন হবে তাঁদের পথ প্রদর্শক, ইসলাম হবে তাঁদের একতার ভিত্তি এবং প্রত্যেক দেশের শাসক তাঁর প্রতিবেশীকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।”

খিলাফতের আদর্শে দায়িত্বশীল সরকার:

আফগানী রাজতন্ত্র বা পশ্চিমা গণতন্ত্রের পরিবর্তে ইসলামের সামাজিক ন্যায়-বিচারভিত্তিক কল্যাণমূলক সরকার ব্যবস্থার কথা বলেছেন। তিনি উসমানীয় সুলতান আবদুল হামীদকে মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীকরূপে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। খিলাফতের প্রক্রিয়া চালু রেখে তিনি এর মধ্যে সৃষ্ট বিচ্যুতিগুলোরও সংস্কার চেয়েছেন ।

তিনি সুলতান আবদুল হামীদকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে খিলাফতের আদর্শে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। মিসরের রাজতান্ত্রিক শাসক তওফীক পাশাকেও তিনি মাজলিসে শূরার মাধ্যমে জনগণকে সরকারে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে বলেছেন। এ উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচন করে তার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং শাসনব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য তিনি আহ্বান জানান।

আলিমদের ভূমিকা প্রসঙ্গে:

জামালউদ্দীন আফগানী মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণী তথা আলিমগণকে মুসলিম সমাজের ঐক্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের লক্ষ্যে যথাযথ নেতৃত্ব দানের আহ্বান জানান। যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দানে সমসাময়িক আলিমদের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার জন্য তিনি তাদের কঠোর সমালোচনা করেন। মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার জন্য তিনি প্রধানত জাতির অভিভাবক এ আলিমদেরকে দায়ী করেন।

সমসাময়িক আলিমদের প্রসঙ্গে আফগানী বলেনঃ

“তাদের দেখলে মনে হয়, পার্থিব বিষয়গুলোর সমাধান করতে না পেরে তাঁরা যেন গর্ববোধ করেন। … বাস্তবিকপক্ষে একজন সত্যিকার বিজ্ঞ ব্যক্তি হলেন আলোর মতো, যিনি পৃথিবীকে আলোকিত করবেন। তা যদি না পারেন অন্তত নিজ দেশ, নিজ শহর, নিজ গ্রাম কিংবা অন্তত নিজের বাড়ীটিকে তিনি আলোকিত করুন।”

আফগানী বলেনঃ

“আমাদের বর্তমানকালের আলিমদের সবচে অদ্ভত বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁরা জ্ঞানকে দু’ ভাগে ভাগ করেন। একটিকে তাঁরা বলেন মুসলিম জ্ঞান, অন্যটিকে বলেন ইউরোপীয় জ্ঞান। এ কারণে তাঁরা অন্যদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করতে জনগণকে নিরুৎসাহিত করেন। …. তাঁরা ইসলাম রক্ষার নামে আধুনিক জ্ঞান অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সাথেই শত্রুতা করেন। অথচ ইসলাম হচ্ছে জ্ঞান ও শিক্ষার সবচে সহায়ক ধর্ম। জ্ঞান ও ইসলামের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে এ ধরনের পার্থক্য সৃষ্টির কোন অবকাশ নেই।”

তিনি আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দান ও যুগের চাহিদা পূরণে আল-কুরআনের কালজয়ী শিক্ষা ও আদর্শকে ব্যাখ্যা করার জন্য আলিমদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয়ে আধুনিক শিক্ষা:

শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের দুর্বলতা দূর করা ছিল জামালউদ্দীন আফগানীর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মিশন। ভারতবর্ষে প্রচলিত ‘দারসে নিজামী’ শিক্ষা ব্যবস্থাসহ মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত তৎকালীন শিক্ষা পদ্ধতিকে তিনি মুসলমানদের জন্য যুগোপযোগী বিবেচনা করেননি। অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাও তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। একদিকে তিনি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলেন, অন্যদিকে পশ্চিমা ভাবধারার শিক্ষার কাছে সমর্পিত হওয়ারও তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্যের কাছ থেকে আধুনিক বিজ্ঞান শেখার আহ্বান জানান। সাথে সাথে তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতি ও রীতিনীতির কাছে সমর্পিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দেন।

সাম্রাজ্যবাদ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে:

পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের প্রয়োজনে তাদের প্রজাদের জন্য যে অদ্ভুত শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী করেছে, সে সম্পর্কে আফগানী বলেন, এ শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের কাপুরুষ হিসাবে গড়ে তুলছে। এ শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানরা বিদেশী শাসকদের রীতিনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করছে। সাম্রাজ্যবাদীদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা একদল আত্মপ্রবঞ্চিত পরাজিত মনোভাবের লোক তৈরী করছে, যারা নিজস্ব রীতি-নীতি ও গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণা পোষণ করতে শিখেছে। বরং নিজস্ব রীতি- নীতির প্রতি বিশ্বস্ত ও দেশপ্রেমিকতায় উদ্বুদ্ধ লোকদেরকে তারা ঘৃণা করতে শিখেছে ।

পশ্চিমাদের কাছ থেকে তারা ‘স্বাধীনতা’ ও ‘জাতীয়তা’র মতো কিছু বুলি শিখে নিয়েছে। পশ্চিমাদের পোষাক-আশাকের রীতি তারা গ্রহণ করেছে। পশ্চিমা জিনিসপত্রে নিজেদের বাড়ি-ঘর সাজিয়ে তারা গৌরববোধ করে। এসব করতে গিয়ে তারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে। তাদের কারণে স্থানীয় শিল্পী ও কর্মজীবী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুসলমানদের সংগ্রামের শক্তি ও জাতীয় মর্যাদার ধারণাকে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রবর্তিত এ শিক্ষা ব্যবস্থা লুপ্ত করে দিয়েছে বলে আফগানী উল্লেখ করেন।

আত্মবিশ্বাসের শক্তি:

জামালউদ্দীন আফগানী মুসলমানদেরকে আত্মবিশ্বাসে স্থিত হয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ও রীতিনীতির উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। কেননা, আত্মবিশ্বাস ছাড়া মুসলমানগণ জ্ঞানের কোন শাখায়ই সাফল্য লাভ করতে পারবেন না। আত্মবিশ্বাসের অভাবেই মুসলমানরা জীবনের নানাক্ষেত্রে চরম মূল্য দিয়েছে বলে তিনি সকলকে সতর্ক করে দেন।

বিপরীত স্রোতের যাত্রী:

চলতি হাওয়ার বিপরীতে লড়াই করতে গিয়ে আফগানীকে পদে পদে নানা ধরনের যুলুম-নির্যাতন, নির্বাসন ও অব্যাহত বাধা-বিপত্তি মুকাবিলা করতে হয়। বিপদাপন্ন মুসলিম জাতির প্রতি নিজ দায়িত্ব পালনে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়ে তিনি তাঁর সকল শক্তি-সামর্থ মুসলিম জাতির পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে নিয়োজিত করেন। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি মুসলমানদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ব্যাপারে হতাশ হননি। প্রাচ্যের আকাশে নতুন সূর্যোদয়ের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা তিনি কখনও ত্যাগ করেননি।

মুসলমানদের মুক্তির নিশানবাহী এ রাহবার ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখনো স্বস্থিতে স্থিত হবার সুযোগ পাননি। বিত্ত ও প্রতিপত্তির হাতছানি পায়ে ঠেলে তিনি সারাজীবন লড়াইয়ের ময়দানে অবস্থান করে অকৃতদার অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন । সাহস ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত আর মুক্তির দিশা ছাড়া অন্যকিছুই তিনি উম্মাহর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাননি।

আফগানীর জীবন পরিক্রমা:

হিজরী ১২৫৪ সনের শাবান মাসে (১৮৩৯ সালে) আফগানিস্তানের কাবুল জেলার কানারের নিকট আসাদাবাদে জামালউদ্দীন আফগানীর জন্ম হয়। তাঁর পূর্বপুরুষ সাইয়্যেদ আলী তিরমিযী দশম হিজরী শতাব্দীতে তিরমিয অঞ্চল থেকে আফগানিস্তানে আসেন। আলী তিরমিযী এ এলাকায় ইসলাম প্রচার ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

আফগানীর পিতা সাইয়্যেদ সাফদার একজন প্রতিভাবান আলিম ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আফগানী তাঁর প্রাজ্ঞ পিতার কাছে এবং স্থানীয় আরো কয়েকজন নেতৃস্থানীয় আলিমের কাছে সমসাময়িক শিক্ষার ধারায় হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ, উসুল, আরবী সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, এনাটমি, দর্শন, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।

উচ্চ শিক্ষার্থে ভারতে আগমন ও আন্দোলনের বাইআত:

আঠারো বছর বয়সে আফগানী উচ্চতর শিক্ষার জন্য হিন্দুস্তানে আসেন। তিনি দিল্লী ও আজমীরের প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রে ইংরেজী সাহিত্য, তর্কবিদ্যা, গণিত ও ইতিহাসের ওপর গবেষণা ও অধ্যয়ন করেন। এ সময় মুসলমানগণ ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম শাসন পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য ভারতে সিপাহী বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিলেন।

ইংরেজ কবলিত হিন্দুস্তানকে ১৮০৩ সালে শাহ আবদুল আযীয দারুল হরব ঘোষণার পর থেকে একের পর এক লড়াই চলছিল স্বাধীনতার জন্য। বালাকোটে ১৮৩১ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর শাহাদত এবং ১৮৩৯ সালে বাঙলায় হাজী শরীয়তউল্লাহর ইনতিকালের পর তাঁদের সংগ্রামী উত্তরসুরীগণ আজাদী সংগ্রামের ধারাবাহিকতা তখনো অব্যাহত রেখেছিলেন। সারা ভারতে সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে তাঁরা তখন সিপাহী বিপ্লবের একটি নবতর পটভূমি তৈরী করছিলেন।

ভারতবর্ষে শিক্ষার্থী হিসাবে অবস্থানকালে আফগানী ইসলামী আন্দোলনের এ পর্যায় সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন।

হজ্জ সফর: আন্তর্জাতিক যোগাযোগ

বিদেশী শাসনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নিগ্রহের শিকার ভারতের মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে জামালউদ্দীন আফগানী ১২৭৩ হিজরীতে (১৮৫৭ সালে) হজ্জ পালন করেন। হজ্জের এ সফরকালে তিনি বিভিন্ন জনপদের মানুষের জীবনাচার ও রীতিনীতি সম্পর্কে পরিচয় লাভ করেন। হজ্জের সময় তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলমানদের সাথে মিলিত হন এবং নানা দেশের মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন।

তিনি উপলব্ধি করেন, মুসলমানগণ পশ্চিমা শক্তির দ্বারা সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সারাবিশ্বে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিতাড়িত হয়ে এশিয়ার দুরতিক্রম্য স্থানসমূহে তাঁরা আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
হজ্জের পর তিনি সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি দেশ সফর করে মুসলিম বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাপকতর ধারণা লাভ করেন।

আফগানিস্তানে মন্ত্রীপদে যোগদান:

মুসলিম দুনিয়া সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে আফগানী দেশে ফিরেন। আফগানিস্তানের দেশপ্রেমিক আমীর দোস্ত মুহাম্মদ খান আফগানীর যোগ্যতা, প্রতিভা, প্রজ্ঞা, পাণ্ডিত্য, সাহসিকতা ও জাতির প্রতি তাঁর দরদ ও ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মন্ত্রী নিযুক্ত করেন। আফগানীর পরামর্শ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী দোস্ত মুহাম্মদ আফগানিস্তানের সংস্কার ও আধুনিকায়নের কর্মসূচী নেন। আফগানী আমীরকে ব্রিটিশদের মুকাবিলায় রাশিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপনের পরামর্শ দেন বলেও ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে ধারণা পাওয়া যায়। আফগানীর মন্ত্রীত্বকালে হিরাত রাজ্য দোস্ত মুহাম্মদের অধীন হয়।

দ্বিতীয়বার ভারতে:

আমীর দোস্ত মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র আযম খান ও শের আলী খানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ব্রিটিশ অনুরাগী শের আলীর মুকাবিলায় আফগানী আযম খানকে সমর্থন করেন। ইংরেজদের সমর্থনপুষ্ট শের আলী ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জয়ী হন। ফলে আফগানী দেশ ত্যাগ করে ১৮৬৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতবর্ষে আসেন। এর দু বছর আগে ইসলামী বিপ্লবের কর্মী তৈরীর লক্ষ্যে জিহাদ আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে ১৮৬৭ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা চালু হয়।

ইংরেজরা আলেম সমাজের তৎপরতা মুকাবিলায় হিমসিম খাচ্ছিল। এ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে আফগানীর উপস্থিতিকে বিপদজনক বিবেচনা করে। তাঁর কাজে তারা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইংরেজরা আফগানীর সাথে হিন্দুস্তানের আলেমদের সাক্ষাৎও নিষিদ্ধ করে এবং মাত্র দু’মাস পর তাঁকে তারা ভারত ত্যাগে বাধ্য করে।

মিসরে আফগানী :ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন

হিন্দুস্তান থেকে আফগানী মিসরের কায়রো চলে যান। কিছুকাল তিনি আল-আযহারে অবস্থান করেন এবং সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। বিভিন্ন সমাবেশে ভাষণের মাধ্যমে তিনি শিক্ষিত জনগণের কাছে মুসলিম বিশ্বের বিদ্যমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। এভাবে তিনি মুসলমানদেরকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সজাগ ও উজ্জীবিত করতে থাকেন।

তিনি কিছুদিন কায়রোয় শিক্ষকতার দায়িত্বও পালন করেন। মিশরের শীর্ষস্থানীয় আলিমসহ বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁর জ্ঞান ও প্রতিভার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশের তরুণগণ অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে তাঁর ক্লাসসমূহে অংশগ্রহণ করেন। এভাবে তাঁরা ইসলামী পুনর্জাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হতে থাকেন।

এ সময়ই আফগানীর সাথে মিসরের প্রতিভাদীপ্ত তরুণ ও ভবিষ্যৎ রেনেসাঁর নায়ক মুহম্মদ আবদুহুর (১৮৪৯-১৯০৫) পরিচয় হয়। তাঁরা মুসলিম বিশ্বের জাগরণের ব্যাপারে তাঁদের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পান। ইংরেজরা মিসরে জামালউদ্দীন আফগানীকে বিপজ্জনক বিবেচনা করে তাঁকে সে দেশ থেকে বহিষ্কারের ব্যবস্থা নেয়।

মিসর থেকে ইস্তাম্বুল: মাজলিস আল মাহরিফ

১৮৭১ সালে আফগানী মিসর থেকে মুসলমানদের তৎকালীন রাজনৈতিক কেন্দ্রভূমি তুরষ্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে পৌছেন। তুরষ্কের প্রধানমন্ত্রী আলী পাশা তাঁকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন। তুরষ্কের বুদ্ধিজীবী ও আলেমগণও তাঁকে সংবর্ধিত করেন। তাঁকে তুরষ্কের ‘মাজলিস আল মাহরিফ’ বা বিজ্ঞান পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। আয়া সুফিয়া ও সুলতান আহমদের মসজিদে খুতবা প্রদানের দায়িত্বও তাঁর ওপর বর্তায়।

একশ্রেণীর আলেমের বিরোধিতা:

ঘুমন্তপ্রায় মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে আফগানীর অদম্য আগ্রহ, স্পষ্টবাদী বক্তব্য, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দৃঢ় মনোভাব তাঁকে জনগণের কাছে প্রিয় করে তোলে। কিন্তু শায়খুল ইসলাম ও তাঁর একদল স্তাবক আফগানীর প্রতি রুষ্ট হন। স্বাধীন চিন্তার অধিকারী, কর্তব্যে দৃঢ়চেতা আফগানী দার আল ফুল্লানে যে বিখ্যাত বক্তৃতা দেন, তাতে একশ্রেণীর সংকীর্ণমনা আলেম আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাদের দুশমনীর কারণে সুলতান আবদুল হামীদ ‘প্রশাসনিক শৃঙ্খলার স্বার্থে’ আফগানীকে তুরস্ক ত্যাগের নির্দেশ দেন।

মিসরে দ্বিতীয় মুদ্দত :আরবে নতুন স্বপ্নের বিস্তার

তুরস্ক থেকে বিতাড়িত হয়ে আফগানী ফিরে আসেন কায়রোতে । মিসরের যুব সমাজ, আলেমগণ এবং স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগণ তাঁকে সাদরে সংবর্ধিত করেন। মিসরের খাদিব ইসমাইল তাঁকে বৃত্তি মঞ্জুর করেন এবং শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।

আফগানী সেবা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ধারায় ‘মাহফিলে ওয়াতানী’ নামে একটি সংগঠন কায়েম করেন। এ সংগঠনের ছায়াতলে সমবেত যুব-জনতাকে তিনি ইসলামী উম্মাহ-চেতনায় উজ্জীবিত ও স্বাধীনতার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করে তোলেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি দ্বীনি শিক্ষা বিস্তার এবং চিকিৎসা ও অন্যান্য জনসেবামূলক কার্যক্রমও জোরদার করেন।

মিসরে সাংবাদিকতা :‘আল মিসর আশ-শারক’

সেবা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করা এবং মিসরে ইসলামী পুনর্জাগরণ ও স্বাধীনতার চেতনা বেগবান করা এবং সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মিসরবাসীদের জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে আফগানী ‘আল মিসর আশ শারক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আফগানী ঘোষণা করেন : “মিসর লিল মিসরিয়ীনা ওয়ামা সাহামা ফিহা লিল ওবরিয়ীন”। অর্থাৎ মিসর হলো মিসরীদের; তাতে ইউরোপের কোন অংশ নেই।

আফগানীর বাণী ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবে এ সময় দলে দলে লোক তাঁকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। তিনি ইসলামী দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্বাধীনভাবে শিক্ষা দান করেন এবং সাহিত্য সাধনায় শিক্ষিতদের উদ্বুদ্ধ করেন। আফগানীর শিক্ষা ও প্রেরণার প্রভাবে আরব তরুণদের দৃষ্টি ও চিন্তাধারা প্রসারিত হতে থাকে। তাঁরা সামগ্রিকভাবে মুসলিম সমাজের ভাল-মন্দ বিচারে দক্ষতা অর্জন করেন। বিদেশী প্রভাব ও শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত করার ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্য সাধনে তাঁরা সংকল্পবদ্ধ হতে থাকেন।

মিসর থেকে দ্বিতীয় দফা বহিষ্কার:

একটানা আট বছর ধরে আফগানী শিক্ষা, সাংবাদিকতা, বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে মিসরবাসীর মধ্যে নবচেতনা ও জাগরণ সৃষ্টি করেন। ফলে ফরাসী ও ইংরেজরা আফগানীকে মিসরে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিরূপে বিবেচনা করে। তাদের চাপে মিসরের খেদিব তাওফিক পাশা আফগানীকে মিসর ত্যাগের নির্দেশ দেন। আফগানী কাবুল থেকে নির্বাসনের বারো বছর এবং তুরষ্ক থেকে নির্বাসনের নয় বছর পর ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দে তৃতীয় বার মিসর থেকে বহিষ্কৃত হন।

ভারতে নির্বাসিত জীবন :

ইংরেজরা আফগানীকে ১৮৭৯ সালে মিসর থেকে ভারতবর্ষে নির্বাসিত করে। আফগানী প্রথমে হায়দরাবাদে নিজামের দরবারে আসেন। পরে তিনি কিছুদিন ইংরেজদের তৎকালীন ঔপনিবেশিক রাজধানী কলকাতায় অবস্থান করেন। ভারতে তাঁর এ তৃতীয় দফার অবস্থানও নিরুপদ্রব ছিল না। কিন্তু নির্বাসিত জীবনের সকল বাধা উপেক্ষা করে তিনি সর্বত্র মুসলমানদের মাঝে তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করতে ভূমিকা পালন করেন।

হায়দরাবাদে আফগানী: ডারউইনবাদ খণ্ডন

হায়দরাবাদে অবস্থানকালে আফগানী ‘রাদ্দে দাহরিয়্যীন’ বা ‘ডারউইনবাদের অসারতা’ নামে একটি পুস্তক রচনা করে ডারউইনের বিবর্তনবাদ খণ্ডন করেন। তিনি দাবি করেন যে, ধর্মই মানব সমাজের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও জাতীয় শক্তি নিশ্চিত করতে পারে। অপর দিকে ধর্মহীনতা ও বস্তুতন্ত্র মানব জাতির অধপতন ও ধ্বংসের কারণ। এ বইয়ে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে আধুনিককালে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের জবাব দান করেন এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন।

স্যার সৈয়দের নীতির সমালোচনা:

তিনি ভারতের আপোসকামী ধারার মুসলিম নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ইংরেজ তোষণ নীতিরও সমালোচনা করেন। তিনি হায়দরাবাদ থেকে প্রকাশিত ‘মুআল্লিম-ই-শফিক’ পত্রিকায় ১৮৭৯ সালে প্রবন্ধ লিখে ইসলামের ব্যাপারে স্যার সৈয়দ আহমদের আত্মরক্ষামূলক ব্যাখ্যা এবং ইংরেজদের ব্যাপারে তাঁর আপোসকামী নীতির কঠোর সমালোচনা করেন।

কলকাতায় আফগানী :বাংলায় মুসলিম রেনেসাঁর সূচনা

আফগানী মিসরে যে জাতীয় জাগরণের সূচনা করেছিলেন, তার প্রভাবে ১৮৮২ সালে কর্নেল আহমদ আরাবী পাশার নেতৃত্বে সেখানে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। আরাবী পাশা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করেন। এ অবস্থায় ইংরেজরা আফগানীকে ভারতবর্ষ ত্যাগের অনুমতি দেয়া বিপজ্জনক মনে করে। কিন্তু তাঁর হায়দরাবাদ অবস্থানকেও তারা সন্দেহের চোখে দেখে।

হায়দরাবাদ থেকে মিসরের জন-বিপ্লব যাতে কোন সাহায্য পেতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য ১৮৮২ সালে তাঁকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর ও নযরবন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু আফগানী কলকাতায় চুপ করে বসে থাকেননি। মুসলমানদের জাগরণের লক্ষ্যে এখানেও তিনি নানাভাবে কাজ করেন।

তিনি বিশেষত শিক্ষিত মুসলমানদের সচেতন ও জাগ্রত করতে চেষ্টা করেন। তিনি ভারতের মুসলমানদের সামনে ইসলামের আলোকে মুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন। তাঁর চিন্তাধারা এ সময় ভারতের বিরাট সংখ্যক মুসলমানকে রেনেসাঁর পথে নতুন সংগ্রামে পথ দেখায়।

এলবার্ট হলের ভাষণ:

নওয়াব আব্দুল লতিফ (১৮২৮-৯৩) ১৮৮২ সালের ৮ই নভেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে (এখন কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউজ) শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতি বিষয়ে আফগানীর একটি বক্তৃতার ব্যবস্থা করেন। এ বিখ্যাত ভাষণে আফগানী পুরনো ধারার মুসলিম শিক্ষা-পদ্ধতির সমালোচনা করেন। তিনি বলেনঃ

“বর্তমানে মুসলমানদের শিক্ষা-পদ্ধতির কোন মূল্য নেই … আমাদের আলিমগণ ‘ছদরা’ এবং ‘শামসী বাজিগা’ পাঠ করে দাম্ভিকতার সাথে নিজেদেরকে দার্শনিক হিসাবে প্রচার করেন। কিন্তু কার্যত তাঁরা তাঁদের ডান হাত ও বাম হাতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। তাঁরা কখনও নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করেন না আমরা কারা, আমাদের অবস্থা কিরূপ হওয়া উচিত এবং আমাদের কি করা উচিত …।”

আফগানীর বক্তব্য বাংলার তৎকালীন জাগরণকামী মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নবতর এক বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের পথে পরিচালিত করে।

কেশবচন্দ্রের সাথে সাক্ষাৎ:

কলকাতায় থাকাকালে আফগানী ভারতীয় বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায় ও বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। তিনি নব-বিধান ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরে গিয়ে কলকাতাকেন্দ্রিক রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান নেতা আচার্য কেশবচন্দ্রের সাথেও আলোচনা করেন।

ভারতে শেষবারের মতো স্বল্পকাল অবস্থানকালে জামালউদ্দীন আফগানী যে-সব বক্তৃতা করেন তার বেশীর ভাগই তাঁর জীবদ্দশায় ‘মুকালাতে জামালিয়া’ নামে ফারসী ভাষায় গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়। তাঁর এসব ভাষণে মুসলিম জাহানের মুক্তির আকুতি ও পথ নির্দেশনা শুধু নয়, বহু ভাষা-বর্ণ-সংস্কৃতিতে বিভক্ত ভারতের গভীর সামাজিক বিন্যাস চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে ।

প্যারিসে সাংবাদিকতা :‘আল উরওয়াতুল উসকা’

কর্নেল আহমদ আরাবী পাশা আলেকজান্দ্রিয়া ও তেল আল-কবীরের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হয়ে সিংহলে নির্বাসিত হন। এরপর আফগানী হিন্দুস্তান থেকে বেরোনোর অনুমতি পান। কলকাতা থেকে তিনি কাবুলে ফিরে যান।

বৃটিশ কূটরাজনীতির শিকার আফগানিস্তানে তখন নৈরাজ্য বিরাজ করছে। সেখানে সংস্কার আন্দোলনের কাজের পরিবেশ ছিল না। এ কারণে আফগানী ভুপাল হয়ে লন্ডনে চলে যান। ১৮৮৩ সালে তিনি কিছুদিন লন্ডনে অবস্থান করেন।

লন্ডন থেকে ১৮৮৪ সালের মার্চ মাসে আফগানী প্যারিসে যান। মিসরের সিংহপুরুষ মুহম্মদ আবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫) মিসরের বিদ্রোহে অংশগ্রহণের অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়ে এ সময়ে প্যারিসে এসে তাঁর সাথে মিলিত হন। সেখান থেকেই তাঁরা তাদের বিপ্লবী আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক আরবী পত্রিকা ‘আল-উরওয়াতুল উসকা’ বা ‘সুদৃঢ় বন্ধন’ প্রকাশ করেন।

আফগানী প্রায় তিন বছর ফ্রান্সে ছিলেন। এ সময় তাঁর সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা নিয়োজিত ছিল ‘আল উরওয়াতুল উসকা’ সম্পাদনা ও প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে।

কিছু সংখ্যক ভারতীয় মুসলমানের আর্থিক সাহায্যে প্রকাশিত এ পত্রিকায় ভারতবর্ষ ও মিসরসহ মুসলিম দেশগুলোতে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ভারতবর্ষে ইংরেজদের প্রতি স্যার সৈয়দ আহমদের আপোসমূলক ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে আফগানী ‘আল উরওয়াতুল উসকা’য় বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেন।

আল উরওয়াতুল উসকার প্রভাব:

‘আল-উরওয়াতুল উসকা’ অতি অল্প সময়ের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশে দেশে মুসলিম সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং স্বাধীনতাকামী মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়। তাতে ইংরেজরা আতংকিত হয়। তারা মিসর ও ভারতবর্ষে পত্রিকাটির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। তারপরও বন্ধ লেফাফায় ডাকযোগে এ পত্রিকাটি ভারতবর্ষে বেশ কিছু গ্রাহকের হাতে পৌঁছত। নানা বাধার মধ্যে আট মাসে আঠারো সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এ স্বল্পস্থায়ী পত্রিকা বিপুল প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মুসলমানগণ ‘আল উরওয়াতুল উসকা’র প্রদর্শিত পথে সাংবাদিকতায় অংশগ্রহণ করেন। এ পত্রিকা সারা বিশ্বে ইসলামী চেতনার জাগরণ ও মুসলমানদের মাঝে নব রেনেসাঁ সৃষ্টিতে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে। এখনো প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আরবী ভাষায় এ নামে সংবাদপত্রের নব সংস্করণ মুদ্রিত হয়। এটা মুসলিম মানসে আফগানীর বিপুল প্রভাবেরই প্রমাণ।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বুদ্ধিবৃত্তিক হামলার মুকাবিলা:

‘আল উরওয়াতুল উসকা’ বন্ধ হবার পরও জামালউদ্দীন আফগানী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাপারে অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জ্ঞাপন করতে থাকেন। সে সময়কার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ স্থান পেতে থাকে। রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের প্রাচ্যনীতি, তুরস্ক ও মিসরের অবস্থা এবং তৎকালীন সুদানের মাহদি আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর মতামত ছিল সবার কাছে বিবেচ্য। এছাড়া পশ্চিমা তথাকথিত ওরিয়্যান্টালিস্ট বা প্রাচ্যবিদদের ইসলামবিরোধী বুদ্ধিবৃত্তিক হামলারও তিনি মুকাবিলা করেন।

আর্নেস্ট রেঁনা নামক একজন প্রাচ্যবিদ এ সময় সোরবোন-এ ইসলাম ও বিজ্ঞান সম্পর্কে এক বক্তৃতায় ইসলামকে ‘বিজ্ঞানবিরোধি’ আখ্যায়িত করে বলেন, ইসলাম বৈজ্ঞানিক তৎপরতা সমর্থন করে না। আফগানী প্যারিসের ‘ডিবেটস ’ নামক জার্নালে প্রবন্ধ লিখে জোরালোভাবে তা খণ্ডন করেন। আফগানীর প্রবন্ধ জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়। পরে রেঁনার লেখা ও আফগানীর জবাব আরবীতে অনুবাদ করে একসাথে প্রকাশ করা হয়। এভাবে আফগানী বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে সমসাময়িক পশ্চিমা হামলার মুকাবিলা করে মুসলমানদের আত্মপ্রত্যয় জাগিয়ে তুলতে ভূমিকা পালন করেন।

রাশিয়ায় আফগানী :মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা আদায়

‘আল উরওয়াতুল উসকা’ বন্ধ হবার পর প্যারিস থেকে আফগানী রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গে যান। রাশিয়া মুসলমানদের মিত্র ছিল না। তারা ক্রমশ মুসলিম এলাকাগুলো গ্রাস করেছিল। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৪ সালের মধ্যে ককেশাস এবং ১৮৮৬ সালের মধ্যে উজবেকিস্তান রুশ পদানত হবার ফলে রুশদের থাবা আফগান ও ইরান ভূখণ্ডের প্রান্তসীমা স্পর্শ করেছিল। এমনি পরিস্থিতিতে আফগানীর রাশিয়া সফর ছিল তাৎপর্যপূর্ণ এক সাহসী ঘটনা।

১৮৮৯ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় অবস্থানকালে তিনি মুসলমানদের কল্যাণের লক্ষ্যে সে দেশের শাসকদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সমর্থ হন। তিনি রুশ নেতৃত্বকে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরামর্শ দেন।

আফগানীর আন্দোলনের ফলে রুশ-জার নিকোলাস তাঁর রাজ্যে মুসলমানদেরকে ধর্ম বিষয়ে স্বাধীনতা দান করেন। রাশিয়ার মুসলমানদের জন্য কুরআন শরীফ ও অন্যান্য ইসলামী বইপত্র প্রকাশের ব্যাপারে তিনি রুশ সরকারের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করতেও সমর্থ হন।

ইরানে আফগানী:সংস্কারের বাণী

রাশিয়া থেকে প্যারিসের বিশ্বমেলায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে জার্মানীর মিউনিখে ইরানের নাসিরুদ্দীন শাহের সাথে আফগানীর সাক্ষাৎ হয়। শাহ তাঁকে ইরানে যেতে সম্মত করেন।

আফগানী অধঃপতিত ইরানের জন্য প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে নীতি ও কাঠামো প্রণয়ন করেন। ইরানের জাতীয় স্বার্থে তিনি বিভিন্ন কর্ম-পরিকল্পনা পেশ করেন। সে সাথে তিনি শাহের ব্রিটিশ তোষণ এবং ইংরেজদেরকে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সমালোচনা করেন।

এ পরম হিতৈষীর ভূমিকার কারণে কায়েমী স্বার্থের ষড়যন্ত্র ও সন্দেহের মুখে তিনি শাহেরও বিরাগভাজন হন। তারপরও তিনি তেহরানের অদূরে একটি খানকায় আশ্রয় নিয়ে সংস্কারের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।

১৮৯১ সালের শুরুর দিকে মুসলিম বিশ্বের মুক্তির এ পথ প্রদর্শককে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেফতার ও শৃঙ্খলিত করে ঘোর শীত মওসুমে তুরস্ক-পারস্য সীমান্তবর্তী খানিকীন শহরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি বসরায় এবং কিছুদিন পর বসরা থেকে ইংল্যান্ডে চলে যান।

ইরানে গণজাগরণ ও তামাক বিদ্রোহ:

আফগানী বহিষ্কৃত হলেও তাঁর আন্দোলনের প্রভাব থেকে যায় ইরানে। সেখানকার সংস্কারকামী দলগুলো একত্রিত হয়ে প্রকাশ্যে আন্দোলন চালাতে থাকে। আফগানী ইংল্যান্ড থেকেই ইরানের গণ-আন্দোলনকে বিপুলভাবে উৎসাহিত করেন। ১৮৯০ সালে পারস্য সরকার ইংরেজদেরকে তামাক ব্যবসায়ের একচেটিয়া সুযোগ প্রদান করেছিল। দেশের সম্পদ ইসলামের শত্রুদের হাতে তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে জনতা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। সরকারের কুশাসন ও নিষ্ঠুরতা এবং ইংরেজ তোষণের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এ প্রতিরোধের ফলে সরকার ইংরেজদের সাথে তামাক চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর ইরানের সংস্কার আন্দোলন বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ধর্মীয় নেতারা এ আন্দোলনের সাথে একাত্ম হন ।

‘তামাক বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত এ আন্দোলন ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। আফগানী এ বিদ্রোহে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তুরস্কে শিকলবন্দী সিংহ:

১৮৯২ সালে তুরস্কের সুলতান আবদুল হামীদ জামালউদ্দীন আফগানীকে তুর্কী রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে স্থায়ীভাবে বসবাস করার আমন্ত্রণ জানান। সুলতানকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী মুসলিম ঐক্য ও ইসলামী জাগরণের স্বপ্ন নিয়ে আফগানী লন্ডন থেকে ইস্তাম্বুল যান । কিন্তু সে স্বপ্ন নস্যাৎ করে প্রতারণামূলকভাবে তাঁকে সেখানকার একটি বিলাসময় প্রাসাদে নযরবন্দী করে রাখা হয়।

মুসলিম জাগরণের তূর্যবাদক জামালউদ্দীন আফগানী তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছর ইস্তাম্বুলে এ ‘সোনার পিঞ্জরে’ বন্দী অবস্থায় অতিবাহিত করেন। ১৮৯৭ সালের ৯ই মার্চ উনিশ শতকের বিশ্ব মুসলিম জাগরণের এ মহা নকীব ইনতিকাল করেন। নিশানতাশের কবরস্থানে এ মর্দে মুমিনের লাশ দাফন করা হয়।

সুলতান আবদুল হামীদের অপরিণামদর্শী ভূমিকার ফলে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সুলতান আবদুল হামীদের ধ্বংসও এর ফলে ত্বরান্বিত হয়।

লেখক পরিচিতি:
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
লেখক
গবেষক
ইতিহাসবিদ

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *