মুসলিম উম্মাহকে নানারূপ বিচ্যুতি বিভ্রান্তি এবং অবক্ষয় ও পতন থেকে উদ্ধার করে রেনেসাঁর পথে পরিচালিত করতে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু যুগ-প্রবর্তক মনীষী অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে জাফর সাদিক (৬৯৯-৭৬৫) আবু হানিফা (৬৯৯-৭৬৭), মালিক বিন আনাস (৭১১-৭৯৬), শাফেয়ী (৭৬৭-৮২০), আহমদ ইবনে হাম্বল (৭৮০-৮৫৫), গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১), ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬), শায়খ আহমদ সরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফিসানী (১৫৬৪-১৬২৪), শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬৩), মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (১৭০৩-১৭৯২), শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (১৭৪৬-১৮২৩), হাজী শরীয়তউল্লাহ (১৭৮১-১৮৩৯), সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী (১৭৮৬-১৮৩১), শাহ ইসমাইল শহীদ (১৭৮২-১৮৩১), সৈয়দ জামাল উদ্দীন আফগানী (১৮৩৯-১৮৯৭), বদিউজ্জামান সাইয়েদ নূরসী (১৮৭৩-১৯৬০), আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৭), সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯), শহীদ হাসানুল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯), শহীদ সাইয়েদ কুতুব (১৯০৬-১৯৬৬), আলী শরীয়তী (১৯৩৩-১৯৭৭) প্রমুখকে ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ধ্রুবতারার মতো সহজে শনাক্ত করা যায়।
মধ্যযুগে পশ্চিম গোলার্ধ অন্ধকার, পূর্ব গোলার্ধ ছিল ইসলামের আলোক প্রভায় উদ্ভাসিত। সাত শতক থেকে আট শতকের মাত্র একশ’ বছরের মধ্যে প্রাচ্য দুনিয়ায় আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও বস্তুগত উন্নতি ও সমৃদ্ধির জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সে ধারা অব্যাহত থাকে কয়েকশ’ বছর। চৌদ্দ ও ষোল শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁর পেছনেও ছিল মুসলিম বিশ্বের মধ্যযুগীয় সাফল্যেরই প্রেরণা। টমাস কার্লাইল, এইচ জি ওয়েলস, এইচ ল্যামেনস, ফন ক্রেমার, জর্জ বার্নাড শ, ফিলিপ কে হিট্টি, উইলিয়াম ড্রেপার, এডওয়ার্ড গিবন, এইচ আর গিব, আর্নল্ড টয়েনবি ও এম এন রায়সহ অসংখ্য পশ্চিমা ও প্রাচ্য পন্ডিত-গবেষক বিশ্ব সভ্যতার উৎকর্ষ ও উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতির বিকাশে ইসলামের এই যুগান্তকর অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের অনেকে এ কথাও স্বীকার করেছেন, মুসলমানদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার নেতৃত্ব গ্রহণে সমর্থ হয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতার ক্ষেত্রে মুসলমানদের এ উন্নতির ভিত্তি ও প্রেরণা ছিল আল কুরআন ও রসূলের (সা.) আদর্শ। আল কুরআনের সাথে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হওয়ার কারণেই পরবর্তীতে মুসলমানগণ বিশ্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশে নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা হারান। এ অবস্থায় তেরো শতকের মধ্যভাগে বাগদাদ ও মধ্য এশিয়া হালাকু খানের হাতে ধ্বংস হয়। বাগদাদের পর কর্ডোভা, দিল্লী, ইস্তাম্বুল একে একে সব ক’টি বড় কেন্দ্রের পতন হয়।
চৌদ্দ ও ষোল শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন নতুন ও বিক্রম নিয়ে অগ্রসরমান , মুসলমানগণ তখন ইসলামের উদার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উম্মা-চেতনা ও ভ্রাতৃত্ববোধ হারিয়ে অনৈক্য ও বিভেদে লিপ্ত এবং ভৌগোলিক জাতীয়তার ধারণা ও ইসলাম-পরিপন্থী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কাছে সমর্পিত। ত্যাগ, সাহস ও সংগ্রামের ঐতিহ্য ভুলে তারা ভোগবাদী জীবনধারায় আচ্ছন্ন।আর মুসলিম শাসকগণ তখন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুলে পরিণত হয় ।
ভারতবর্ষের অবস্থা ও আল্লামা ইকবালের প্রাসঙ্গিকতা:
মোগল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) ইসলাম-বৈরী তথাকথিত দ্বীন-ই-ইলাহীর তুমুল ঝড়ো-তাণ্ডবে ভারতবর্ষের মুসলমানদের দ্বীনি সংহতি ও স্বাতন্ত্র্য-চেতনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুজাদ্দিদে আলফিসানী (১৫৬৪-১৬২৪), আওরঙ্গজেব আলমগীর (১৫৫৮-১৭০৭) ও শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবীর (১৭০৩-১৭৬১) সংস্কার আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের দ্বীনি চেতনার অনেকাংশে পুনর্গঠন হয়। তাদের দ্বীনি শিক্ষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব-কলহ এবং মুসলিম শাসকদের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ-শক্তির অবক্ষয় রোধ করা তখন আর সম্ভব হয়নি। এ যুগের মুসলিম শাসকরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। জাতির সাংস্কৃতিক সীমানা পাহারা দেয়ার ব্যাপারে ছিলেন অসচেতন ও অমনোযোগী। তাদের এ ব্যর্থতার কারণেই ভারত-বর্ষে আটশ’ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে ।
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসান মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বাধীনতাই শুধু হরণ করেনি, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো, তাদের শিক্ষার ঐতিহ্য এবং তাদের সাংস্কৃতিক পাটাতন ও ধ্বংস করে। মুসলমানগণ একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন উদ্যমশীল জাতি হিসেবে সামনে চলার গতি ও গৌরব হারিয়ে পদানত হতোদ্যম সম্বিতহীন মৃতপ্রায় জাতিতে পরিণত হয়।
এই পটভূমিতে আল্লামা ইকবালের (১৮৭৭-১৯৩৮) আবির্ভাব। ইকবালের আবির্ভাবকালে মুসলিম বিশ্বের অবস্থা ছিল টালমাটাল। পূর্ব ইয়োরোপ থেকে ইসলামের প্রভাব বিলিয়মান। দক্ষিণ রাশিয়ার মুসলিম রাজ্যগুলো রুশ সাম্রাজ্যের গ্রাসের শিকার। চীনের মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা হারিয়ে হতোদ্যম। মিসর হয়ে পড়েছে ব্রিটিশ পদানত। মরক্কো ফরাসী আগ্রাসনের শিকার। ইরানের সামরিক ও সাংস্কৃতিক তেজ নিষ্প্রভ । ওলন্দাজদের উৎপীড়নে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা মাথা উচুঁ রাখতে ব্যর্থ। আর ভারতবর্ষে দিল্লীর লাল কেল্লায় উড়ছে ব্রিটিশ পতাকা। রেঙ্গুন থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। এমনি অবস্থায় মুসলমানদের আশা-ভরসার উৎস নামেমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র উসমানিয় তুর্কি রাজত্বও হুমকির সম্মুখিন। মুসলমানদের এই শেষ শক্তিকেন্দ্রটি ধ্বংস করার জন্যও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ গ্রীসকে লেলিয়ে দেয় ।
এমনি এক হতাশা ও নৈরাশ্যজনক অবস্থার মধ্যে ইসলামের যুগোপযোগী ব্যাখ্যাকার, জাগরণের রাহবার ও মানবতার মুক্তিকামী দার্শনিক-চিন্তাবিদ, কবি-কলমযোদ্ধা হিসেবে আল্লামা ইকবাল আবির্ভূত হন। উনিশ শতকের মুজাদ্দিদরূপে পরিচিত জামালউদ্দীন আফগানীর (১৮৩৯-১৮৯৭) অব্যবহিত পরে তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি মুসলিম উম্মাহর নবজাগরণে নকীবের ভূমিকা পালন করেন।
আল্লামা ইকবালের একটি পরিচয় একজন কবি হিসেবে। ইকবাল দার্শনিক কবি। তিনি জাগরণের কবি। ইকবাল একই সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের কবি, সেই সাথে তিনি বিশ্ব মানবতার কবি, বিশ্ব কবি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘যুগ’ তার চাহিদা ও ভাবধারায় সে যুগের কবিকে সৃষ্টি করে। কবি হন যুগের প্রতিনিধি, সংগ্রামপ্রবণ যুগের প্রতিনিধি কবিগণ জাতির বীরত্বের প্রতিনিধিরূপে সংগ্রামের ময়দানে সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করেন। আর নৈরাশ্যকবলিত, আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক ও ভোগলিপ্সাপ্রবণ যুগের কবিরা সমাজের পরগাছারূপে ভোগসর্বস্ব জীবনের দাসরূপে সে সমাজের অবসাদ বয়ে বেড়ান। এদের মাঝে ব্যতিক্রমী কোন কোন কবি নিছক যুগের প্রতিনিধি না হয়ে যুগস্রষ্টারূপে আবির্ভূত হন। পরিস্থিতির ঘেরাটোপ থেকে নিজের চৈতন্যকে মুক্ত করে, অনিঃশেষ দিগন্তের বিস্তৃতি অতিক্রম করে জাতির পতন, দুর্গতি ও হতাশা মুক্তির আবে হায়াত তারা তালাশ করেন। ‘মিল্লাতের মৃত ধমনীতে নব জীবনের তপ্ত শোণিত স্রোত’ তারা প্রবাহিত করেন। এই বিরলপ্রজ কবি হন যুগ-সমস্যার ব্যাখ্যাতা। কর্দম-পিচ্ছিল, শাপদ-সঙ্কুল, বিপদ-বাধার তুফান-সয়লাব কন্টকিত পথ অতিক্রম করে তারা হেরার রাজতোরণ উন্মোচন করেন। আল্লামা ইকবাল সেই বিরলপ্রজ কবিদের একজন। তাই কবি ও দার্শনিক ইকবালের ভূমিকা রেনেসাঁর তূর্জ বাদকের। যে অর্থে জামালউদ্দীন আফগানী উনিশ শতকের মুজাদ্দিদ, আল্লামা ইকবাল সেই একই তাৎপর্যে বিশ শতকের সংস্কার ধারার মুয়াজ্জিন ।
ইকবাল তাঁর পূর্বসূরী কবি হালী, শিবলী, আকবর এলাহাবাদী কিংবা তাঁর সমসাময়িক সৈয়দ সোলায়মান নদভী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মতোই কুরআন ও হাদীসের মর্মবাণী এবং ইসলামের ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সারাৎসার আহরণ করেন এবং সেই অধ্যয়নের আলোকে জনগণকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও জাতির চিকিৎসার জন্য রোগ নির্ণয়ের নিপুনতায় ও চিকিৎসা-বিহিতের পারঙ্গমতায় ইকবাল হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র ।
আল্লামা ইকবাল জীবনবোধের গভীরতা এবং দার্শনিক প্রজ্ঞায় সময়ের তুলনায় অগ্রণী ছিলেন। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ আবিষ্কারে তাঁর অবদান ছিল মুজতাহিদের পর্যায়ের। ইকবাল তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘পবিত্র ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা সর্বপ্রথম বিশ্ব মানবকে এই বাণী শুনিয়েছে যে, ধর্মের ভিত্তি জাতীয়তা বা গোত্র-বর্ণের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এবং তা নিছক ব্যক্তিগত বা আধ্যাত্মিকও নয়, বরং তা আন্তর্জাতিক মানবতাকেন্দ্রিক। সমগ্র মানব জাতিকে সকল প্রকার প্রকৃতিগত বৈষম্য সত্ত্বেও একই জীবন বিধানের অধীনে সংঘবদ্ধ করাই ধর্মের প্রধান লক্ষ্য। আর যে ধর্মের ভিত্তি এরূপ ব্যাপক ও সুবিস্তৃত, তা নিছক কতিপয় আকিদা-বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানে সীমিত থাকতে পারে না। তার কর্মক্ষেত্র সমান ব্যাপক ও বিস্তৃত, তেমনি এর লক্ষ্যও ব্যাপক ও সামগ্রিক।’ (আল্লামা ইকবাল : গৌরবের উৎস মহানবী; আল্লামা ইকবাল সংসদ পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর’ ৯৪ সংখ্যা)
ইকবালের ‘জাভিদনামা’য় আফগানীর ‘উম্মাহ’ বা ‘মিল্লাত’ চেতনা চমৎকারভাবে ভাষা পেয়েছে। মওলানা রুমির জবানীতে ইকবাল ‘প্রাচ্যের যুগোত্তরণের পথিকৃত’রূপে অভিহিত করেছেন আফগানীকে। পাশ্চাত্যের গড়া ফাঁদে বন্দী ‘অধর্ম আর ভূগোলের পীড়নে ক্ষত-বিক্ষত’ পৃথিবীর নিরাময় ও মুক্তির জন্য আফগানীর আহবান ফুটে উঠেছে ইকবালের নিম্নোক্ত কালজয়ী কবিতায়:
‘‘উঠ!
ছুঁড়ে ফেল এই বন্দী কারাগারের ঘেরাটোপ
ছড়িয়ে পড় মুক্ত বিশ্বে।
মুসলমানের কাছে সব দেশই তার স্বদেশ।
তার স্থান দেশাতীত।
যদি তোমরা বুদ্ধিমান হও, ভেঙে দাও
ইট আর পাথরের তৈরি পৃথিবীর সীমানা।
এসো, সবাই মিলে আমরা ধৌত করি বস্তুতান্ত্রিকতার ক্লেদাক্ত শরীর।”
সর্বহারা সাধারণ মানুষের আত্মার বাণীকে ইকবাল তাঁর কাব্যে উচ্চারণ করেছেন এভাবে:
‘‘ কুরআন হলো ধনিকের মৃত্যু পরোয়ানা
আর যারা সর্বহারা দাস, কুরআন তাদের আশ্রয়।
....এই পৃথিবী মানুষের, আর মানুষ একই পরিবারভুক্ত।”
কুরআনের আশ্রয়ে সকল মানুষকে একই পরিবারভুক্ত দেখতে চেয়েছেন ইকবাল। তাঁর ‘মিল্লাতে ইসলামিয়া’ ধারণা সেই ঐক্য চেতনারই নির্যাস। ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে ঐক্যের একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইকবালের আহবান আফগানীর উনিশ শতকীয় প্যান ইসলাম আন্দোলনের বিশ শতকীয় বাণীরূপে উচ্চারিত। মুসলিম উম্মার ঐক্য, কুরআনী জীবন ব্যবস্থার রূপায়ণ, মুসলিম সমাজকে অনৈসলামী চিন্তা ও পাশ্চাত্য বস্তুতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ইকবাল আমৃত্যু কাজ করেছেন ।
বাংলার মুসলিম নবজাগরণ ও ইকবাল:
আল্লামা ইকবালের আবির্ভাবকালে বাংলার মুসলমানদের অবস্থা অন্যান্য এলাকার তুলনায় আলাদা ছিল না। বরং ভারতবর্ষে বাংলায়ই মুসলিম শাসনের ওপর প্রথম আঘাত এসেছিল। খ্রিস্টান-বিজিত ভারতে প্রথম একশ’ বছর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নামক একটি খ্রিস্টান কোম্পানির শাসন। পরবর্তী নব্বই বছর ব্রিটিশ খ্রিস্টান সরকারের উপনিবেশিক শাসন। এডামস্মিথের ভাষায়, পৃথিবীর যে কোন শাসন ব্যবস্থার মধ্যে নিকৃষ্টতম হলো কোম্পানীর শাসন। ভারতবর্ষে কোম্পানী শাসনের সবটা ধকল বাংলার মুসলমানদেরকে পোহাতে হয়েছে।
আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, সূর্যাস্ত আইন, লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াফত আইন, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর প্রভৃতি একটির পর একটি ঘটনা বাংলার জনজীবনকে শোষণ-লুন্ঠনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। তার প্রতিবাদে একটির পর একটি কৃষক বিদ্রোহ সমগ্র বাংলাকে যখন আলোড়িত করছিলো, তখন ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে সংস্কৃত পন্ডিতদের সহযোগিতায় মুসলমানী ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে সংস্কৃত প্রভাবিত এক নতুন গদ্য-ধারার প্রবর্তন করা হয়। সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী (১৭৮৬-১৮৩১) বালাকোটে এবং সৈয়দ নেসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) নারকেলবাড়িয়ায় ১৮৩১ সালে যখন ইংরেজবিরোধী সংগ্রামে জীবন দিচ্ছেন, তখন রামমোহন রায়ের চেষ্টায় ১৮৩৭ সালে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে মুসলমানদেরকে সরকারী চাকুরী থেকে উৎখাত করা হয়। একই সময় বর্ণহিন্দু জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ‘জমিদার সভা’ গঠন করা হয়। জেহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের পতাকাতলে বাংলার কৃষক-কামার-কুমার-কলু-জেলেরা যখন আপোষহীন সংগ্রামে লিপ্ত, তখন ১৮৪৩ সালে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি এবং ১৮৫৩ সালে বেঙ্গল ল্যান্ড লর্ডস এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু রিভাইভ্যালিজমেরও পতাকা উড়িয়েছিল। সিপাহী বিপ্লবের প্রাক্কালে ১৮৫৬ সালে কলকাতার বর্ণহিন্দু নেতৃত্ব ইঙ্গ-হিন্দু স্বার্থের দুর্গরূপে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’। এ সময় রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দের নেতৃত্বে নব-উত্থিত হিন্দু মধ্যশ্রেণী তাদের জাতীয় জীবনে সম্পন্ন করছিল রেনেসাঁ।
উইলিয়াম জোনস, ম্যাক্সমুলার, কর্নেল টড প্রমুখ ইংরেজ লেখকের চরম মুসলিম বিদ্বেষী ও প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যভিত্তিক রচনাসমূহকে উপজীব্য করে উনিশ শতকের মধ্যভাগে শতচ্ছিন্ন হিন্দু সমাজে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উগ্র জাতীয়তার সূচনা হয়। রাজনারায়ণ বসু, ননীগোপাল মিত্র, ঈশ্বরগুপ্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র সেন প্রমুখ লেখক তাদের নাটকে, গানে, কবিতায় মুসলিম বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে থাকেন। কুড়ি দশকের গোড়ার দিকে ১৯০২ সালে কলকাতায় শিবাজী উৎসব চালু হয় এবং কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা নাটক-কবিতা-গানগুলো এ সময় থেকে ছত্রপতি শিবাজীর বন্দনায় মুখর হয়ে ওঠে। বস্তুত, উনিশ শতকের শেষ নাগাদ হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন তার চূড়া স্পর্শ করে।
ইতোমধ্যে উনিশ শতকের সত্তরের দশকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-৯৮), নওয়াব আবদুল লতিফ (১৮২৮-৯৩) ও সৈয়দ আমীর আলীর (১৮৪৯-১৯২৮) নেতৃত্বে মুসলিম সমাজে নতুন সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্ব ইসলামী পুনর্জাগরণের নকীব, প্যান ইসলামী আন্দোলনের নেতা সৈয়দ জামালউদ্দীন আফগানীর চিন্তা এ ক্ষেত্রে নতুন গতি ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের একটি নির্দেশনা প্রদান করে। ১৮৮৪ সালে আফগানী কলকাতা সফর করেন। এ সময় তাঁর আলবার্ট হলের ভাষণ বাংলার জাগরণকামী মুসলমানদেরকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। এই পটভূমিতে বাংলার শিক্ষিত মুসলমানগণ বিভিন্ন সংবাদ সাময়িকপত্র প্রকাশের কাজে উদ্বুদ্ধ হন। তারা নসীহতমূলক এবং ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্যমূলক ও জাতীয় জাগরণমূলক বই-পত্র লিখতে শুরু করেন। তিলক যে বছর শিবাজী উৎসব প্রবর্তন করেন, সেই বছরই ১৮৯৫ সালে কায়কোবাদের ‘অশ্রুমালা’ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের লেখা হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী ‘কথা ও কাহিনী’ ১৮৯৯ সালে প্রকাশের পরপরই ১৯০১ সালে ওসমান আলীর ‘দেবলা’ কাব্য প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা ১৯০৪ সালে প্রকাশের একই বছর ওসমান আলীর ‘আলোকসভা’ ও কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’ প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন: ‘বাংলার হিন্দু লেখকেরা (সাম্প্রদায়িকতার) সূত্রপাত করেন। তারপর মুসলমান লেখকরা গালির বদলে গালি দিতে শুরু করেন।’
১৯০৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রিক পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠনের মধ্য দিয়ে পৌনে দু’শ’ বছর পর মোগল আমলের প্রাচীন রাজধানী ঢাকা আবার রাজধানী হয়। ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার কৃষক মুসলমানদের জীবনক্ষেত্রে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ বাতিলের পর নবাব সলিমুল্লাহর পুরনো দাবি অনুসারে পূর্ব বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত বিকাশের সুতিকাগাররূপে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । এ সময় খিলাফত আন্দোলন বাংলার মুসলিম সমাজে ঢেউ তোলে। ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১) জাতীয় জাগরণের আকাংখা উচ্চকিত করেন। নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬) এ ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেন এক বলিষ্ঠ ও বেগবান ধারা। ইতিবাচক ও গঠনমূলক গভীরতর দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটতে থাকে তিরিশের দশকের মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের রচনায়। এ সময় ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের ভিত্তিতে ১৯৩৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগুরু বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষকপ্রজা লীগ ও মুসলিম লীগের যৌথ মন্ত্রী সভা গঠিত হবার ফলে বাংলার মুসলমানরা পৌনে দু’শ’ বছর পর আবার শাসন ক্ষমতা ফিরে পাবার গৌরববোধ অর্জন করেন। এ শাসনামলে বঙ্গীয় কৃষিখাতক আইন, কুসীদজীবী আইন, বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব সংশোধন আইন এবং ঋণ সালিশী বোর্ডের সুফলগুলো মুসলিম কৃষক-প্রজাদের মাঝে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। বাংলার কৃষক-প্রজাদের ওপর দেড়শ’ বছর জেঁকে থাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জগদ্দল পাথর এ সময় একের পর এক সরে যেতে থাকে।
এই সব অর্জন ও ইতিবাচক অভিজ্ঞতা বাংলার মুসলমানদের স্বতন্ত্র মঞ্জিল চিহ্নিত করাকে সহজ করে দেয়। ৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের গণতন্ত্রে ৯ কোটি মুসলমানের জন্য রক্ষাকবচ লাভের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর আল্লামা ইকবালের প্রেরণায় তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পর ১৯৪০ সালে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত স্থির হয়। নিজেদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রবল গণজোয়ার তখন উত্তাল তরঙ্গের রূপ লাভ করে সর্বত্র আছড়ে পড়ে। আল্লামা ইকবালের রচনা এ সময়ই বাঙলার মুসলমানদেরকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। ইকবালের কবিতার পংক্তিমালা বিভিন্ন মাহফিলে-সমাবেশে কবিতা ও গানের সুরে কিংবা বক্তৃতায় উদ্ধৃত হয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণও তাঁদের সাহিত্য-সাধনায় ইকবালের রচনার দ্বারা প্রভাবিত হন। ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, শাহাদাত হোসেইনসহ রেনেসাঁ যুগের কবিরা ইকবালকে অধিকতর আত্মস্থ করে জাতীয় জাগরণের বাণী প্রচার করেন।
নজরুলের আবির্ভাবে বাংলার জাগরণকামী মুসলমান কবিগণ আলোড়িত হয়েছেন আর ইকবালের মাঝে তারা পেয়েছেন এক নতুন আবে হায়াত। ফররুখ আহমদ এ সময়ই জাতির মুক্তির প্রশ্নে নজরুলের পাশাপাশি ইকবালের নাম উচ্চারণ করেছেন। ‘নজরুল প্রসঙ্গ’ নামে একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: ‘পলাশীর আম্রকাননে মুসলমানের যে সৌভাগ্য সূর্য পরাজয়ের যবনিকায় ঢাকা পড়েছিল, ওহাবী আন্দোলন ও সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতায় মুসলমানের সেই যৌবনে যে তুহিন পাথর নেমেছিল, সেই স্থবিরত্বে অধীর গতিবেগ সঞ্চার করলেন কবি নজরুল ইসলাম। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে মহাকবি ইকবাল অবশ্য অনেক আগেই সন্ধান দিয়েছিলেন আবে-হায়াতের।’
ফররুখ আহমদ তাঁর আকাংখার পূর্ণ প্রতিফলন লক্ষ্য করেছিলেন আল্লামা ইকবালের মধ্যে। স্বাপ্নিক ও দার্শনিক, ‘আসরারে খুদি’ ও ‘রমুজ-ই বেখুদী’র স্রষ্টা আল্লামা ইকবালের কাব্যের অনুরাগী পাঠক এবং সার্থক অনুবাদক ছিলেন ফররুখ আহমদ। ইকবালের কবিতায় আশাবাদ, স্বপ্ন, আনন্দ, গভীর জীবনদৃষ্টি, ব্যক্তিত্ববাদ ও সংগ্রামী চেতনায় ফররুখ আহমদ বিমুগ্ধ ছিলেন। ফররুখের মানবতাবাদ ইসলামী জীবনবাদের মধ্যে যে স্পষ্টত লীন হয়েছে এবং সময়-স্বভাবকে অতিক্রম করেছে তা অনেকখানি ইকবালের প্রভাবজাত বলেই মনে হয়। ফররুখ আহমদ ইকবালের বহু কবিতা শুধু যে সার্থকভাবে অনুবাদ করেছেন তা-ই নয়, তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থ তিনি ইকবালকে উৎসর্গও করেছেন। ফররুখের চোখে ইকবাল ছিলেন স্বর্ণ ঈগল। আল্লামা ইকবাল প্রসঙ্গে ফররুখ আহমদ লিখেছেন: ‘ঊনিশ শতকের প্রাচ্যের অগ্নিপুরুষ সৈয়দ জামাল উদ্দিন আফগানী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন মুসলিম প্রধান দেশগুলিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে। তাঁর সে চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে বিফল হয়নি। পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্ত পর্যন্ত তিনি যে প্রাণ বন্যার সঞ্চার করেছিলেন, ঊনিশ শতকের শেষ দিকে তাঁর দেহাবসানের পর ইকবাল এলেন তাঁরই উত্তরাধিকারী হয়ে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দর্শনে সমান অভিজ্ঞ আল্লামা ইকবাল প্রচার করলেন মূল ইসলামের প্রাণবাণী।’ [ফররুখ আহমদ: ইকবাল প্রসঙ্গ: আল্লামা ইকবাল সংসদ পত্রিকা, জানু-জুন ২০০৭ (সংকলিত), পৃ. ৩১]
আল্লামা ইকবালের রাষ্ট্রচিন্তায় রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্যে উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হবার পরপরই কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ (১৯৪২) আর ঢাকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ (১৯৪২) প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংগঠন দুটোকে ঘিরে বাঙালি মুসলমান কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীগণ ঐক্যবদ্ধ হন। পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির নায়কদের মধ্যে ছিলেন মুজিবর রহমান খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ বাহার, মোহাম্মদ মোদাব্বের, জহুর হোসেন চৌধুরী প্রমুখ আর ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে’র সভাপতি ছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (১৯২১) এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান (১৯২১-২০০৪)।
পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আবুল কালাম শামসুদ্দীন ‘অতীত দিনের স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন:
‘এরপর পাকিস্তান আন্দোলনে দেশ সরগরম হয়ে উঠে। …আমরা সে পরিস্থিতিতে আর একটা নতুন সাহিত্য-সংস্কৃতি সংস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করি– যার উদ্দেশ্য ছিল নিছক প্রচলিত সাহিত্যের আলোচনা নয়, বরং ভবিষ্যতের একটা নতুন সাহিত্য সংস্থার পত্তন করা। আমরা বুঝেছিলাম, পাকিস্তানের ডাক শুধু রাজনীতিভিত্তিকই নয়, এ ডাকে আছে আমাদের পরানুকরণমুক্ত সুস্থ সাহিত্য সংস্কৃতি সাধনার নয়া প্রেরণাও। …‘পাকিস্তান’ আমাদের বুঝিয়েছে, ভারত একটা দেশ নয়, একটা উপমহাদেশ। কাজেই সমগ্রভাবে ভারতের জাতির একটি মহাসমাবেশ ক্ষেত্র। হিন্দু-মুসলমান শুধু দু’টো ‘রেশিয়াল’ জাতিই নয় টেরিটরিয়াল জাতি হিসেবেও এতদুভয়ের সত্তা বিভিন্ন এবং এই কারণে ভারতীয় মুসলমানের একটা স্বতন্ত্র হোমল্যান্ড দাবি করার সঙ্গত ও যৌক্তিক অধিকারও রয়েছে। দশ কোটি মুসলমানের এক বিরাট মানব সমবায় একটা দেশের একটি ‘সম্প্রদায়’ মাত্র হয়ে থাকবে, এ নিতান্তই অযৌক্তিক বিশেষ করে যেখানে হিন্দু মুসলমানের জীবনধারায় প্রভেদ দুস্তর, সমাজক্ষেত্রে এ দু’য়ের একত্র সমাবেশ যেখানে অবাস্তব ব্যাপার, সেখানে এ দু’য়ের একটা মিলিত জাতি আকাশ-কুসুম কল্পনামাত্র। এই কারণেই সম্রাট আকবর থেকে মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত ভারতে একজাতি গঠন প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থতাবরণ করতে বাধ্য হয়েছে।… পাকিস্তান শুধু রাজনীতি ক্ষেত্রেই ভারতীয় মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতিত্বের সত্তা আবিষ্কার করলো তা নয়। তাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছিল একটা নতুন দৃষ্টি। এই দৃষ্টিলাভের ফলে মুসলমান বুঝতে পারল, বাঙলা ভাষা সাহিত্য হলেও উভয়ের জীবন-দর্শন ও সামাজিক পরিবেশের পার্থক্যহেতু উভয়ের ভাষা ও সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ভাষা ও রচনার একটা মৌলিক পার্থক্য অবশ্যম্ভাবী। রসের ক্ষেত্রে সাহিত্যের সর্বজনীনতা স্বীকার্য নিশ্চয়ই, কিন্তু রূপ ও প্রকাশভঙ্গীর দিক দিয়ে সেখানেও মৌলিক পার্থক্য অনস্বীকার্য।… পাকিস্তান রাজনীতিক্ষেত্রে যেমন আমাদের স্বাতন্ত্রের এবং নয়া জাতিসত্তার সন্ধান দিয়েছে, তেমনি সাহিত্যক্ষেত্রেও আমাদের অনুকরণ-মোহ-মুক্ত স্বচ্ছতা ও স্বকীয়তার উদ্বোধন করেছে। পাকিস্তানকে এই দিক দিয়ে আমরা ভারতীয় মুসলমানদের চিন্তাক্ষেত্রে একটা বিপ্লবাত্মক ঘটনা বলেই গ্রহণ করেছিলাম। এ ভাবেরই বাহন করে আমরা পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির পত্তন করেছিলাম।’ (আবুল কালাম শামসুদ্দীন: অতীত দিনের স্মৃতি, খোশরোজ পাবলিকেশন্স লিঃ, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০১, পৃ. ১৬৮-১৭০)
ঊনিশ শতকের সত্তুরের দশক থেকে শুরু করে জামালউদ্দীন আফগানীর আদর্শিক বুনিয়াদের ওপর বাংলার মুসলমান সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের চিন্তা-চেতনার যে পাটাতন নির্মিত হয়েছিল কুড়ি শতকের চল্লিশের দশকে সেই ভিত্তির ওপরই এক বিরাট ইমারত গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। তাতে ইকবাল যুগিয়েছেন শক্তি ও সরঞ্জাম। সৈয়দ আলী আহসান ‘বাংলা কবিতার আসরে ইকবাল’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বিচিত্রভাবে বাংলা কবিতার আসরে আমরা ইকবালকে পেয়েছি। বাংলার হাওয়ায় তার গান ভেসেছে, বাংলার জলকল্লোলে তাঁর কণ্ঠ শুনেছি। তাঁর হৃদয়ের বিপুলতা দেখেছি বাংলার আকাশে। যেমন নবোদিত সূর্য সমুদ্রের কল্লোলের যেমন পরিমাপ হয় না অথচ তা দেখে বিহবল ও আনন্দিত হওয়া যায়, তেমনি ইকবালের গভীরতা, ব্যাপকতা ও বিপুলতা আয়ত্তাতীত কিন্তু আমাদের জন্য সংবেদনশীল ও আনন্দদীপ্ত।’ [আল্লামা ইকবাল সংসদ পত্রিকা, জানুয়ারি-জুন ২০০৭, পৃ. ১৪৬] কথা সাহিত্যিক শাহেদ আলী ‘কাব্য, অনুবাদ ও পাঠক’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘ইকবালের কবি-খ্যাতি পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে উপমহাদেশে তার একটা বিরাট পরিচিতি ও স্থান আছে এবং পাকিস্তানে আছে একটা অতুলনীয় মর্যাদা। একজন কবির স্বপ্ন থেকে একটা রাষ্ট্রের জন্ম পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল ব্যাপার। এ জন্য পাকিস্তানীদের কাছে তো বটেই, বিশ্বের রাষ্ট্রনীতি তত্ত্বের দার্শনিকদের কাছেও তাঁর রয়েছে এক বিস্ময়কর এবং কৌতুহলোদ্দীপক মর্যাদা। কিন্তু কাব্য-রসিক এবং সাহিত্য-মোদীদের কাছে ইকবাল মূলত এবং প্রধানত একজন কবি, যিনি উর্দু এবং ফার্সী ভাষায় কবিতা রচনা করলেও, তাঁর কাব্যের আবেদন ভাষার গণ্ডি ডিঙিয়ে তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। সত্য ও সৌন্দর্য সীমা মানে না। ইকবালের কাব্যে সত্য ও সুন্দরের যে প্রবল অভিব্যক্তি ঘটেছে তা ভাষার বন্ধন অতিক্রম করে, বন্যাবেগে আছড়ে পড়েছে, দেশে দেশে মানুষের হৃদয় তটে।’
লেখক পরিচিতি:
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
লেখক
গবেষক
ইতিহাসবিদ
তথ্য সূত্র: [আল্লামা ইকবাল সংসদ॥ নভেম্বর’ ১৯৯২, পৃ. ১৮]