সন্তান বড় হয়ে শিক্ষিত না অশিক্ষিত হবে,সেটার পিছনে বাবা-মায়ের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে,তেমনি একটা শিশু মানবিক, জ্ঞানসম্পন্ন বিবেক নিয়ে বড় হবে(মানুষ), না অমানবিক সব আচরণ নিয়ে বেড়ে উঠবে(অমানুষ),সেক্ষেত্রেও পরিবার তথা বাবা-মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ,সন্তান তা’ই শিখবে,যা তার পরিবার তাকে শেখাবে। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। তারা উপদেশ খুব কম পছন্দ করে,বরং পরিবারের সদস্যদের  যা করতে দেখে,তাই সে করতে চায় বা করে ।
আপনি যদি বই পড়েন,আপনার সন্তানটিও বই পড়তে আগ্রহী হবে। আপনি যদি নামায পড়েন,আপনার সন্তানও পাশে দাঁড়িয়ে আপনার মতো হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টা করে নামায পড়তে চাইবে ।
আপনি যদি টিভি দেখেন,সে-ও টিভি দেখায় মনোযোগী হবে ।আবার আপনি যদি মোবাইল নিয়ে বসে থাকেন,দু’দিন পর সে-ও মোবাইল নেয়ার জন্য কান্নাকাটি করবে।

আবার,আপনি যদি সন্তানকে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করেন,বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ তার কখনোই জেগে উঠবেনা।যদি আপনার সন্তানকে নিজ দেশের গল্প না বলে অন্য দেশের গল্প শোনান,সে কখনো দেশপ্রেমিক হতে পারবেনা।
আর সারাদিন যদি সংসারে ঝগড়া-বিবাদ চলে,ছোট্ট শিশুটি রগচটা মেজাজ নিয়ে বড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। এইজন্য অনেক সময় অস্বাভাবিক ভাবেও সন্তান বেড়ে উঠে।
কারণ,বাবা-মা কিংবা পরিবারের বড় সদস্যরা যা’ই করতে যাক-না কেন,যদি ছোট বাচ্চা থাকে  তাহলে সে তা অনুকরণ করবেই।
ঠিক তেমনি,আপনার সন্তানের আচরণগত শিক্ষাটাও কিন্তু আপনার আচরণ থেকেই সে পাবে।আপনি যদি কোনো অসহায়কে কিছু দান করেন অথবা সাহায্য করেন,এবং এই কাজটি যদি আপনার সন্তান আপনাকে করতে দেখে,তাহলে বড় হয়ে সে-ও অসহায়দের দান করবে,সাহায্য সহযোগিতা করবে । অনেক পরিবারের বাচ্চাকে বাল্যকাল কিংবা কৈশোরকাল থেকেই মানুষকে সাহায্য করতে দেখা যায়। কারণ সে তার বাবা-মা’কে দেখেছে মানুষকে সাহায্য করতে এবং তার বাবা-মা তাকে ছোট সময়েই মানুষকে সাহায্য করার শিক্ষা দিয়েছেন।

আপনি যদি আপনার চেয়ে দুর্বল কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন,কাউকে অপমান করেন,কটুবাক্য বলেন, নিজের চেয়ে ছোট আর তুচ্ছ করেন অন্যদের ;আপনার সন্তানও কিন্তু তেমনটাই শিখবে। তারাও ঠিক এই কাজটাই করবে।
কেননা,আপনি যদি সন্তানকে সামনে রেখে রিক্সাওয়ালা/গাড়ির ড্রাইভার বা আপনার চেয়ে নিম্নবিত্তের কাউকে ‘তুই-তুকারি’ করেন,বড় হয়ে সে-ও তেমনটা করবে আর করাই স্বাভাবিক।
অথচ আপনি যদি অন্যকে সম্মান দিয়ে কথা বলেন,পাশে দাঁড়ানো আপনার ছেলে বা মেয়েটিও কিন্তু বড় হয়ে মানুষকে সম্মান দিতে জানবে বা শিখবে।

আপনার সব কথায় অহঙ্কার ঝরে পড়ে। আপনি প্রচুর অর্থের মালিক। মানুষকে সম্মান করা তো দূরের থাক,কাউকে সাহায্য করতেও আপনি নারাজ। তাহলে আপনি আপনার ঘরে সুযোগ্য ভালো সন্তান আশা করেন কিভাবে? অবশ্য সুযোগ্য একদিক দিয়ে,আর তা হল সে আপনার মতো কথিত সুন্দর স্বভাব নিয়ে বড় হয়েছে! পরে আফসোস করলেও লাভ নেই। কারণ সে আপনার অনুকরণীয় গুণটাই রপ্ত করেছে ।
যে বাচ্চা মেয়েটি তার মাকে সবসময় সাজগোজ, রূপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত এবং সংসারের প্রতি উদাসী থাকতে দেখে, সে মেয়েটি বড় হয়ে সেটাই করে বা করবে।আর যে মেয়ে তার মা’কে সংসারের কঠিন সময়েও সংসার আগলে রাখতে দেখে,সে মেয়েটি বড় হয়ে সংসারি হবে,এটাই স্বাভাবিক!

যে সন্তানকে কখনো অভাব বুঝতে দেননি,সে সন্তান আপনার খারাপ সময়েও অভাব বুঝার চেষ্টা বা অনুধাবন করতে পারবেনা। বরং চাওয়া মাত্র তাকে আগে যেমন দিয়েছেন,আপনার খারাপ সময়েও সে সেটাই প্রত্যাশা করবে। না দিতে পারলে আপনার সন্তান যদি ভাংচুর করে,বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় কিংবা আপনাদের গালিগালাজ করে,তাহলে কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ দোষ দিতে পারবেননা ।
আপনি যদি অভাব শেখাতেন,অপচয়  করার শিক্ষা না দিতেন,বাস্তবতা কি তা বুঝাতেন,তাহলে সে তা’ই বুঝতো!
এটা তো জানার কথা। আপনি যা করবেন,যা দেখাবেন,যা শেখাবেন,যা উপদেশ দিবেন;তা’ই আপনার সন্তান শিখবে।ঐ যে বাচ্চারা অনুকরণপ্রিয় আর মানবিক গুণগুলো সে পরিবার থেকেই প্রথম শেখে ।দুঃখজনক হলেও সত্য,আজকাল অধিকাংশ বাবা-মা ক্যারিয়ারে মনোযোগী হতে যেয়ে সন্তানের প্রতি অমনোযোগী। ছেলে বা মেয়েটি কি খাচ্ছে,কোথায় যাচ্ছে,কাদের সঙ্গে মিশছে,কখন ঘুমচ্ছে ,পড়াশোনা কেমন করছে,সেসব খেয়াল করার সময় এখন আর বাবা-মায়ের নেই বললেই চলে । মাস শেষে টিউটর বেতন, বাসায় কাজের মেয়েটির বেতন এবং স্কুল বেতন দিয়েই বাবা-মা’রা ভাবেন,দায়িত্ব বুঝি শেষ!
কিন্তু সন্তানের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সবসময়ই যে বাবা-মা’কে পাশে থাকা দরকার,সেটা ওনারা ভুলে যান!
আমরা তাহলে কি শিক্ষা দিচ্ছি ওদেরকে?এভাবেই হয়তো সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব বেড়ে যায়।কিন্তু আজ যেহেতু ছোট বাচ্চার আচরণ কেমন হবে,সেটা নিয়ে কথা বলছি;তাই ঐদিকে আর না যাই।

বলছি,বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে মানুষ করার পিছনে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। কারণ,বাবা-মা’য়ের আচরণ আর শিক্ষা দেয়ার ধরণের উপর নির্ভর করছে সন্তানের অজানা ভবিষ্যত কেমন হবে ।
হ্যাঁ, এটা সত্য যে কিছু পরিবারে এর বিপরীতটাও দেখা যায় ।যেমন,বাবা-মা যেমনই হোক না কেন,সন্তান ভালো তথা মানুষ হয়ে ওঠে ।আবার বাবা-মা অসম্ভব ভালো মানুষ,কিন্তু সন্তান  পারিপার্শ্বিক, বন্ধুবান্ধবের সংস্পর্শসহ নানা কারণে অমানুষ হয়ে যায় ।কিন্তু সেটা হাতে গোণায় খুবই সামান্য।
সেজন্য প্রথমেই বাবা-মা’র সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত,তাঁরা তাঁদের সন্তানকে মানবিক জ্ঞাণ দিয়ে বড় করে তুলবে;নাকি অহমিকা আর অমানবিক গুণ দিয়ে বড় করবে ।

দুঃখজনক হলেও সত্য,বাবা-মা অধিকাংশ সময়ই সন্তানকে ভুল শিক্ষায় মানুষ করতে যায়। অধিকাংশ বাবা-মা’ই আজকাল সন্তানকে অভাব শেখাতে চায়না। কোনোকিছু চাওয়া মাত্রই দিয়ে দেয়। না দিতে পারলে আফসোস করে !অথচ সন্তানকে এটা শেখানোর দরকার,”তুমি যখন যা চাইবে,তখন তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সবসময় সম্ভব না। অন্যের সঙ্গে কখনো নিজেকে তুলনা করবেনা। বরং দেখবে,তোমার প্রতি আমাদের(বাবা-মার) ভালোবাসা কেমন। তোমাকে যেমন আমরা ভালোবাসি,বুঝার চেষ্টা করি ।তুমিও সন্তান হিসেবে বাবা-মার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবে।”
যে সন্তান অন্যের গাছ থেকে বিনা অনুমতিতে গাছের ফল পেড়ে নিয়ে আসে,আপনি যদি তাকে শাসন না করে চুপ থাকেন বা খুশিমনে ফলটা নিয়ে তাকে কেটে খাওয়ান,আপনি নিশ্চিত থাকুন,বড় হয়ে এই ছেলে বড় চোর হবার সম্ভাবনাই বেশি।
আবার যদি দেখেন,আপনার সন্তান বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলছে,তাহলে অবশ্যই সেজন্য তাকে বাহবা দেয়া দরকার। আর যদি দেখেন,কারো সঙ্গে সে খারাপ ব্যবহার করছে,তার বয়সী’ই কোনো বাচ্চার পরনে ছেঁড়া শার্ট প্যান্ট দেখে ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছে ,সেটার জন্য আপনি যদি তাকে কিছুই না বলেন,তাহলে বড় হয়ে তার পক্ষে কখনো অসহায়দের জন্য কিছু করার আগ্রহ বা মানসিকতা তৈরি হবে না । অমানুষের কিছু গুণাবলী তারমাঝে ঢুকে যাবে।

ধরুন,আপনার সন্তান কোনো অন্যায় করে বসলো;সেজন্য তাকে অনুতপ্ত হতে শেখান।’স্যরি’ বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন। যদি তা না পারেন,বড় হয়ে যদি আপনাদের সঙ্গেও কোনো অন্যায় করে বসে;তাহলে যেন আপনাদের খারাপ না লাগে,আগেই মানসিক প্রস্তুতি নেন।
যে পুরুষ বা যে বাবা পরিবারের নারী সদস্যদের সঙ্গে(হতে পারে স্ত্রী,বোন,মা) ভালো আচরণ না করে,সে পরিবারের ছেলে শিশুটিও কিন্তু একই কাজ করবে।সে-ও নারীদের সম্মান দিতে জানবেনা!
অধিকাংশ পরিবারে কিন্তু তা’ই হচ্ছে।মা যখন মেয়ের থালায় ছোট মাছের পেটি দিয়ে ছেলের পাতে মাছের বড় মাথাটা দেয়;তখন ছেলেটা ছোট সময়ই শিখে যায়,এই পরিবারে তার বোনের চেয়েও ওর গুরুত্ব বেশি। ফলে তার আচরণটাও হবে ঠিক তেমনি ।
অথচ অনেক বাবা-মা’কেই শেষ বয়সে আফসোস করতে দেখা যায় ।বাবা-মাকে আফসোস করে বলতে শোনা যায়,”কম আদর যত্নে তো রাখিনি,চাওয়া মাত্র সব দিয়ে দিয়েছি। এখন কিনা আমাদের সন্তান আমাদেরকেই চিনেনা!”
হুম,আপনি হয়তো আদরযত্নে বড় করেছেন,কিন্তু মানবিক গুণের শিক্ষা কি দিয়েছেন? হ্যাঁ যে বাবা-মা সন্তানকে মানবিক জ্ঞান দিয়ে বড় করা সত্ত্বেও বিগড়ে যায়,তাদের প্রসঙ্গ আলাদা। সেটা সংখ্যায়ও সামান্য। কিন্তু যাকে আদরযত্নে বড় করেও মানবিক শিক্ষা দেননি,তার জন্য পরে আফসোস করলে এক প্রকার অন্যায়’ই হবে বলে মনে করি।
তাই,সময় থাকতেই আপনার সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেন। তাকে মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ হবার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেন।সন্তানের সামনে এমন কিছু করবেননা,যা সন্তানকে মানুষ হিসেবে বড় হতে বাঁধা দেয়।ঘরে নতুন শিশুর আগমনের পর নিজেদের মধ্যে থাকা বদভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করুন। কারণ,নতুন শিশু আপনার থেকেই শিখবে।বাইরের মানুষ তাকে যতোটানা প্রভাবিত করে বা করবে,বাবা-মা হিসেবে আপনারা প্রায় নিরানব্বই শতাংশ তাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। আপনার আচরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সন্তান ভবিষ্যতে কেমন হবে। তাই,বাবা-মায়ের উচিৎ সন্তানকে সময় দিয়ে,যত্ন নিয়ে, বাস্তবতা শিখিয়ে,ন্যায়-নীতির আদর্শে বড় করে গড়ে তোলা। যেখানে থাকবে শুধু কল্যাণ,ভালোবাসা,মানবিকতা আর বিবেকবোধ । যে সন্তান শুধু পরিবারের জন্য নয়,দেশের জন্যও সুনাম বয়ে নিয়ে আসবে।
আমরা চাই,আমাদের সন্তানরা ভালো থাকুক।মানুষের মতো মানুষ হোক। কিন্তু বাবা-মা হিসেবে সন্তানের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালনে আমরা কয়জন মনোযোগী ?

লেখক পরিচিতি:
মাহবুবা স্মৃতি
কবি,
ছোট গল্পকার
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *