হয়তো তার মৃত্যুর কথা মনে পড়ে;কারণ বারেক আলী আবার সেই স্বপ্নটা দেখে,বারবার দেখে;যে স্বপ্নে লম্বা লেজওয়ালা একপাল বুনো শেয়াল ধস্তাধস্তি করে ছিঁড়ে খায় তার ঝুলে পড়া চামড়ার কোঁচকানো শরীর ।সময়ের বিবর্তনে শুকিয়ে আসা চামড়াবহুল শিকার হয়তো তাদের কাছে বিস্বাদ লাগে,ফলে চিবানোর পর গিলতে না পেরে বা দাঁতে না কাটায় ক্ষোভে বিরক্তিতে থুতুর মতো ছুঁড়ে দেয় আকাশের দিকে।কয়েক হাত দূরে গিয়ে সে থ্যাবড়ানো টুকরাগুলো ধূলার সাথে পলোট দিয়ে দলা পাকায়। নরম মাংস না পেয়ে তাদের হিংস্রতা চরমে ওঠে ।ভগ্ন-নিথর ও অসহায় দেহটা টানাহেঁচড়া না করে সমর্পিত করে ক্ষুধার্ত হাড্ডিসার মুখগুলোর সামনে।
বারেক আলী এ স্বপ্নটা শেষ হলে প্রতিদিনের মতো ভয় পায়,বুকে থুতু ছিঁটিয়ে বিড়বিড় করে- জলপানির ওয়াক্তে দ্যাকা স্বপন ছ্যাঁচা হয়! শব্দকটা শেষ হলে কেমন হাঁপিয়ে ওঠে, দাঁতহীন চোয়ালের ফাঁক গলে ঘোগলা গড়াতে থাকে; সিথানের নোংরা ত্যানা দিয়ে তা মুছে, এবং নিজেকে চিমটি কেটে জীবিত না মৃত পরখ করার ইচ্ছা জাগে কিন্তু করেনা; শনের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভোরের অরুণ রাঙা সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে নির্লিপ্তভাবে।
আজ একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছে ,যা দেখার পরই সে সিদ্ধান্তটা নিল। সে দেখে কোন এক জনমানবহীন নদীর পাড়ে মাছ ধরতে গিয়ে প্রাচীন একটি নাম না জানা উঁচু ও সরু লাল ইটের প্রাসাদে উঠে পড়েছে ।প্রাসাদের সিঁড়িগুলো ঠিক যেন চিপা গলি,শ্যাওলায় প্রচন্ড পিচ্ছিল ।পা পিছলে পড়ে যাবার সময় শক্ত একটি পাথরের ভাঁজ ধরে অনেক কষ্টে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে। আর একটু হলেই কয়েকশত ফুট নিচে পড়ে যেত। হঠাৎ সে নিজেকে আবিষ্কার করে মাটি থেকে অনেক অনেক উপরে নাম না জানা এক মন্দিরে ,অচেনা এক দেবতার কুঠুরি সেটা। যে পাথর ধরে নিজেকে রক্ষা করেছিল তা কালো পাথর নির্মিত দেবতার কনুইয়ের ভাঁজ ।মন্দিরের সম্মুখটা যেন গর্ভবতীর পেট, সেখানে একটি শরীর বসবার মতো সংকীর্ন স্থান; একটু এদিক ওদিক হলে নিচে পড়ে নিশ্চিত বিভৎস মৃত্যু! দেবতাকে ছুঁতে তার ভয় হয়। ফেরার সিঁড়িগুলো উধাও,তার পরিবর্তে গাঢ় কালো অন্ধকার ছেয়ে ফেলেছে সে পথ । মন্দিরের কুঠুরিতে দেবতার সাথে আলো-আঁধারের মাঝে আটকে পড়ে বারেক আলী। স্বপ্নটা শেষ হলে সে তিনবার নাউজুবিল্লাহ্ ও তিনবার আস্তাগফিরুল্যাহ্ পাঠ করে এবং অস্থিগুলো কবরে ফেরত দিয়ে মাফ করে দেবার অনুরোধ জানায় । সে এবার যাবেই শহরে,এতোদিন কোনো অংশীদার পাইনি বলে যাওয়া হয়নি এবং বড় ব্যবসাটাও শুরু করা হয়নি; অবশেষে এতোদিনে সে একজন পেয়েছে ।
প্রতিদিন সকালে সূর্যের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় তা বেড়ার ফাঁক অতিক্রম করে। ঠিক এর পরপরই মৃত বাহার চৌকিদারের বউ ‘শকেলা’ খোঁড়াতে খোঁড়াতে এ পথ দিয়ে দূর গ্রামে যায়,প্রতিদিন যায়। সে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে বারেক বুঝতে পারত তখন তার উঠার সময় ।”শহরত যাওয়া লাগবে,পরামানিকের যুবক ছাওয়ালডা অ্যালো কি অ্যালো ।”
দশ পঁনেরো বছর পূূূূর্বে নিরুদ্দেশ হওয়া আয়ান প্রামানিকের ছেলে লাদু কদিন থেকে এদিকে আসেনা,অথচ বারেক আলী সব প্রস্তুতি শেষ করে তার জন্য অপেক্ষারত ।কারণ,সে এবার শহরে যাবেই এবং এবার তাকে পেলে সে কথাটা শক্ত করেই বলবে যে- “ব্যাটা, শহরত যামুই চল,তুর সাথে হামিও ব্যাপসা শুরু করমু;বাপ মা নাই,হামারে আর কিসের আগপাছ টান?” সপ্তাহখানেক আগে তার বাড়িটা পুড়ে যাওয়ার পর থেকেই সে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা পাকাপোক্তভাবে নিয়ে নিয়েছে এবং গ্রামের মসজিদে সেই থেকে রাত কাটছে তার ।
“শকেলা” চলে যাওয়ার পর পরই আয়ান মন্ডলের ছেলে লাদু মসজিদ সংলগ্ন তার বাড়ির পথ ধরে শহরে যায় ,কখনো দুপুরে বা বিকালেও যায় ।ঠিক কবে থেকে তা আরম্ভ হয়েছিল তা মনে পড়েনা বারেক আলীর, বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতি নিজের সাথে শত্রুতা করে। কোনো এক সকালে লাদু শনের শীর্ণ জানলা দিয়ে উঁকি দেয় , “লতুন একটা ব্যাপসা শুরু করমু কাকা,যাবেন নাকি শহরত?” বারেক আলী কন্ঠটা শুনে চমকে ওঠে। দ্রুত সচল হয়ে ওঠে অর্ধমৃত দেহ। হন্তদন্ত হয়ে লুঙ্গি পরতে গিয়ে বারবার খুলে যায়,গভীর আগ্রহ নিয়ে বলে,”আয় বাপো বসেক,গপ্প আচে।” তারপর একটি জীর্ন পাটি বারান্দায় বিছিয়ে শরিষার তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খেতে দেয়, খায়া লে ব্যাটা,হামি শরীলডা ধুইয়া তৈরি হয়্যা আসি।”
বারেক আলী হাতমুখ ধুয়ে এলে দু’জনে একসাথে মুড়ি খায় ।বারেক আলী অত্যন্ত আনন্দের সুরে বলে, “যাও শহরত যাও,কামের অভাব নাই ঐখানে,ভালোই থাকপিন।”এরপর একসাথে পান্তা ভাতও খায় ।পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব যুবক সবুজ কাঁচা মরিচে কামড় দিয়ে বলে, “বুজিচেন কাকা,পন্তার ম্যালা গুন,হামার দাদায় তো পন্তা খায়াই ড্যাড়শো বচর বাঁচলো। ” বারেক আলী আরেক হাতা পান্তা দিয়ে বলে, “খায়া লে,শরীল ঠান্ডা থাকপে ” আসমানের দিকে চেয়ে বলে ,”যে রোদ শুরু হচেরে,এব্যার গরমডা খুব চ্যাতা।”
পান্তা খাওয়া শেষ হলে বারেক আলী আর একটু বসার অনুরোধ করে বলে “জিরায়া লে,বহুদূরের পথ,তামুক খাবু! যুবকের চোখ লক লক করে।তামুক আচে নাকি কাকা! জিনিসডা পাওয়াই যায়না ।তারপর দুজনে তামুক খায়। খাওয়া শেষ হলে দুটি প্রাণী রোগা মুরগীর মতো ঝিম মেরে বসে থাকে। সূ্র্য মাথার উপর উঠে যায় ।বৃদ্ধ মনে করিয়ে দেয় ,”শহরত যাবু ন্যা ব্যাটা”?
যুবক তার লাল চোখ দুটো ডলতে ডলতে বলে, “ম্যালা রোদ,তাছাড়া গাও গরম,শরীলডা ভাল লয়,অ্যাজ থ্যাক।কাল যামু,তুমি তৈরি থ্যাইকো।” তারপর লাদু টলতে টলতে যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়ে ফিরে যায়।
যুবক চলে গেলে বারেক আলী কখনও তার হাঁড়ির ভেতরে থাকা ধূলিজমা মানব কঙ্কালের মাথার খুলি ও হাড়-গোঁড় গুলো পরিষ্কার করে বা মদক বানানোর ফরমায়েস যোগাড় করে বা মনোযোগ দিয়ে লাল কালিতে তাবিজের জন্য দোয়া লেখে।আগের মতো শরীরে আর বল নাই,কথা বললে শরীর হাঁপিয়ে ওঠে,দাঁতগুলো মোটামুটি পড়ে যাওয়ায় কথার পরিবর্তে বাতাস বেরোয়। ফলে তাবিজ-কবজ, মদক আর শেকড়বাকড়েই যা একটু আয়। যৌবন শেষে শরীর যেভাবে নেতিয়ে গেছে তাতে কি করা যায় তা যখন নতুন চিন্তার বিষয় হল,ঠিক তখন থেকেই শকেলার কথা মনে পড়ত বারেক আলীর,সে তো তার সাথে যেতেই পারে! তাছাড়া শরীয়তেও জায়েজ আছে। কিন্তু কি ভেবে যায়না।
আবার কোনো একদিন বারেক আলী তাল গাছ থেকে তালের তাড়ি নামায়। গ্রামের আরেক প্রান্ত থেকে লাদু হয়তো দেখতে পায় যে তালগাছে একটা মানুষ। তারপর সে দেরি না করে সেই পথ দিয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে শহরে যেতে চায় ।তাল গাছের নিচে পৌঁছালে বারেক আলী জিজ্ঞাসা করে, “ব্যাটা শহরত যাস নাকি?দাঁড়া তাড়িডা খায়া যা।ভ্যাপসা গরম অ্যাজ,শান্তি পাবু।”
তার কথা শুনে লাদুর হয়তো লোভ হয় এবং মুখ ফসকে বলে ফেলে,তাড়ি খাবার পারি,তুমি যদি হামার সাথে শহরত যান।
বারেক আলী মুচকি হেসে বলে “আই,তাড়িডা খায়া লিই,তারপর বার হমু।”
এরপর তারা সেদিন দুপুরে রোদের তাপে তালের স্বচ্ছ রস সাদা হয়ে বিশ্রী স্বাদ ও গন্ধ ধারণ করলেও ঢক্ ঢক্ করে গিলতে থাকে। ব্যাগের ভিতর থেকে কড়া মসলা মাখা তেল জবজবে আলুভাজা বের করে বলে,ল্যাও পাঁপড় দিয়্যা খাও,ভাল লাগব।খিদা ল্যাগবার পারে তাই রাস্তায় খামু বুল্যা নিছি ।তারা পাঁপড় দিয়ে তালের তাড়ি খায়। খাওয়া শেষ হলে লাদু বলে কাকা, মাতাডা ক্যামন পাকড়ায়;এনা শুতমু। বারেক আলী পাটি বিছিয়ে দিলে লাদু ক্ষণিকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে এবং গ্রীষ্মের রৌদ্রমাখা দুপুরে বিকট শব্দে নাক ডাকে। ঘুম ভাঙলে হয়তো সে দেখে মাগরীবের আজান দিয়ে দিয়েছে,লাদু বলে কাকা,আইজ আর শহরত না যাই,সাপ টাপ আচে রাস্তাত,আন্ধার হয়্যা অ্যালো। এই বলে সে চলে যায় ।
লাদু যখন আসে,বারেক আলী কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়;লাদুর অনেক প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে যায় বা বলতে ভয় পায় ।কারণ,লাদু আজগুবি কথাবার্তার পাশাপাশি অদ্ভুত সব আবদার করে। বলে, কাহা হামি তুমার মুতো বান্দর পালমু,হামাক এনা শিকায়া পড়ায়া দ্যাও না।আবার কোনোদিন বলে—তুমার বিজিডা মরলো ক্যাঙ্কা করা কাকা?হামার একটা বিজি পালার খুব সক। না হয় বাটি চালানাডা শিক্যাও,চুর ধরব্যার পারমু ।বারেক আলী লাদুকে তখন সন্দেহ করতে থাকে,চ্যাংড়াডা আসলে কি চায়?শহরত যাবার নাম দিয়্যা হামার জন্যে বস্যাই বা থাকে ক্যান?
লাদু যখন এসব প্রশ্নের কোন উত্তর পায় না,তখন বলে , না কাকা থ্যাক,হামি লতুন ব্যপসাডাই শুরু করমু। বারেক আলীর তখন জানতে ইচ্ছা হয় কি ব্যপসা ব্যাটা? লাদু এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেনা বা হয়তো সে চেপে যায় বা যায়না। শুধু বলে,বড় ব্যাপসা;তুমি হামার সাথে খালি চলো। শীতের সময়ে যখন গ্রামে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে তখনও কোন একদিন লাদু এ পথ দিয়ে শহরে যায়।জানালাতে উঁকি দিয়ে বলে , কাকা,শহরত একদুম ঠান্ডা নাই,চলো শহরত যাই;ঠান্ডার কালে ব্যপসার অভাব নাই। তুমি আর হামি বড় একটা ব্যপসা শুরু করমু। শীতের সময়ে সূর্য অনুমান করতে না পারায় ঠিক কয়টা বাজে বোঝা যায় না। তারা এরকমই একদিন শহরে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।কি ব্যপসা শুরু করবে তা নিয়ে আলাপ করতে থাকে।লাদু বলে, শাকসবজির ব্যপসা করা যায় কাকা,গাঁওত থ্যাকা ট্রাক ট্রাক সবজি শহরত লিয়্যা গেনু! হেব্বি চাহিদা সবজির ।ধান,গম,শরষ্যারও ব্যপসা করা যায়। গেল বচর পাটের দাম খুব ভাল গেচে,হামরা সামনের সিজনে পাট কিন্যা বেশী দামে শহরত বেচপ্যার পারি। বারেক আলী তাতে সম্মতি দেয়,হুঁ, শুরু করব্যার তো পারি;একটা কামের জন্যেই আইটক্যা আচি,কামডা হলেই যামু ভাবিচি।কাম থ্যাক,চল যাই।কি কাজ প্রশ্ন করলে তা আর সে খোলসা করেনা। কথা প্রসঙ্গে সেদিন শকেলার কথা আসে।কাকা,শকেলা বুড়িডা কয়দিন থ্যাকা অসুস্থ,তুমারই নাকি খালাত বোইন একবার দেক্যা আসো,ভিক্ষা করতে করতে শরীলডা আর নাই। আল্লায় আবার কি একটা অসুক দিচে,ভিক্ষা চাবার গেলে বাড়ির বার হয়না কেউ। বিদাশত মানুষ নাকি মরতে মরতে ছয়লাব।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে তারা ম্যাটাল পাড়ার মোড়ে এসে পৌঁছে। যেখানে হঠাৎ একটি বিচ্ছিন্ন পাড়া তৈরী হয়েছে। কয়েক ঘর নিম্নবিত্ত হিন্দুর বাস এখানে,যারা মাছ ধরার ফাঁদ তৈরী করে জীবিকা চালায় ।বেঁত ও ফাঁদের কাজ করে সংসার চলেনা দেখে সামান্য লাভের আশায় দুই একজন চিটাগুঁড় দিয়ে সামান্য দেশী মদ তৈরী করে ।পুলিশ এ নিয়ে জ্বালাতন কম করেনা ,কিন্তু ফিরে এসে ক’দিন বন্ধ রাখার পর আবার শুরু করে। অনেক সময় ধরে নিয়ে জেলে ভরে, হাঁড়ি পাতিল ভেঙে দিয়ে যায়।
লাদু হাসতে হাসতে বলে—কাকা,এ জাগা দিয়া গেলে কিচু লোক গুয়ের গন্দ পায়,আবার কিচু লোক ফুলের গন্দ, হামি কিন্তু অদ্ভুত গন্দ পাই,ফুল বা গু লয় ! বারেক আলী তার দিকে একবার তাকায়,তার গর্তের ভেতর ঢুকে যাওয়া চোখগুলো জ্বলজ্বল করে এবং বলে,চল ব্যাটা দু গেলাস খায়ায় আসি।ঠান্ডার মদ্যে গরম ধরবে। চুয়ানি খেয়ে বের হবার পর তাদের আলাপচারিতা আরও বাড়ে ।গল্প করতে করতে এন্দ্রাতলার বটগাছটা পেরিয়ে আসে এবং বিলের মধ্যে গ্রামের ধারে বড় তালগাছটা চোখে পড়লে লাদু বুঝতে পারে যে পথ ভুল করে তারা বারেকের ভাঙা ছনের ঘরের কাছেই চলে এসেছে।
দূর থেকে গ্রামের লোকজন বলাবলি করে,ঐ যে সালার মাতাল দুইডা যাচ্চে ।তাদের মধ্যে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা কেউ হয়তো বলে যে সে মাতাল ও দুইডা! গুমা সাপে কাটলেও মরবেনা,যম। এভাবে মাস যায়,বছর যায় অথচ লাদু বারেক আলীর রহস্য উন্মোচন করতে পারেনা ।তাকে কোনভাবেই শহরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়না। বারেক আলীর নানা অযুহাতে বা তার পাতা নানা ফাঁদে পড়ে লাদু আবার ফিরে আসে ।তারপর থেকে সে সুযোগ খোঁজে যে কবে বারেক আলীর মুখোশ উন্মোচন করা যায়।
এক গ্রীষ্মের দুপুরে এন্দ্রাতলার বড় বটগাছের নিচে বসে তারা কল্কে ভরে তামুক খায় ।খেতে খেতে বলে, কাকা শকেলা বুড়িডা আচক্যা মরলো ।সেই দু’ বছর থ্যাকা অসুস্থ। বারেক আলী তার কথায় নিস্পৃহ থাকে। বলে ,বুড়ি মানুষই তো মরবে,ছুঁড়ি মানুষ মরে? আল্লার ধন আল্লায় নিচে,হামার কি। তখন লাদু বলে ,কাকা,চলো শহরত যাই। হামি একটা লতুন ব্যপসা পাচি।
উদাস দৃষ্টি ফসলের মাঠের উপর দিয়ে এদিক থেকে ওদিকে ছুটে যায় বারেক আলীর,ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে ,শহরত যায়া কি করমু ব্যাটা,আর কয়দিন আচি? কথাটা শুনে লাদুর রাগ হয় এবং মুখ ফসকে প্রশ্ন করে বসে, তুমি কি সত্যিই শহরত যাবার চান কাকা? এ প্রশ্নে বারেক হকচকিত হয়ে ওঠে,কন্ঠটা সংযত করে বলে ,হামাক দিয়া কি আর ব্যপসা হবে? ডেট অভার হয়্যা যাইনি? তাদের কথা আস্তে আস্তে জটিল থেকে জটিলতর হয় এবং কথার কোনো সুরাহা হয়না। এক পর্যায়ে তারা এন্দ্রাতলার বিশাল বটবৃক্ষের ছায়ায় মৃদু বাতাসে ঘুমিয়ে পড়ে এবং লাদু বুঝতে পারে যে এতোকিছুর পরও তাকে রাজি করানো সম্ভব হয়নি।
পরদিন বারেক আলী বাতের কবিরাজী ঔষধের খোঁজে দূর গ্রামে যায়,ফিরে এসে দেখে যে তার বাড়ি পুড়ে গেছে এবং বাঁশের খুঁটিগুলো পুড়ে তখনও ধোঁয়া উঠছে ।শুধু কবিরাজি ঔষধ আর অস্থির পাতিল ব্যতীত সব পুড়ে শেষ ।ঘটনা যেন তুচ্ছ এবং বারেক আলীকে সামান্য পরিমান বিচলিত মনে হয়না। এ ঘটনার পর সপ্তাহ পেরোলো,লাদুর খোঁজ নেই। নেশা-জাতীয় সব বাদ দিয়ে নামাজ-কালাম বাড়িয়ে দিয়েছে বারেক আলী,বাড়ি পুড়ে যাবার পর থেকে মসজিদেই রাত কাটলো।আজ স্বপ্ন দেখার পর বারেক আলী তার কাছে থাকা অস্থিগুলো জঙ্গলে পুঁতে মাফ চেয়ে এসেছে কবরের কাছে। ফজরের নামাজ শেষ করে আর ঘুমায়নি,সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে এবার শহরে যাচ্ছেই। লাদু আজ আসলেই এ গ্রামের মায়া ছিন্ন করে শহরে যাবে।
লাদুর না আসা দেখে বারেক আলীর মধ্যে অস্থিরতা বাড়ে ।ছাওয়ালডা গত দশ-পঁনেরো বচরে এমন কাম করেনাই তো কুনোদিন !ফলে তার অজানা উৎকন্ঠা বাড়লে এবং নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হলে, হন্যে হয়ে রওনা দেয় লাদুর খোঁজে।
গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে সে যখন কালিতলার জঙ্গল পার হয়, তখন দেখে যে কয়েকজন ঘরামী ফাতেমার নতুন খড়ের চাল উঠাতে ব্যস্ত। স্বামী মারা যাবার পর শ্বাশুড়ীর অত্যাচারে থাকতে না পেরে বাপের বাড়ি এসে ঘর তুলছে। সেখানেই চোখে পড়ে লাদুকে,সে ঘর বানানোর খরচ জানার চেষ্টা করছিল চালার উপরে বসে থাকা ঘরামীর কাছে।
লাদুর সাথে চোখাচোখি হলে,ইশারায় কাছে ডাকে আয়,বিড়ি দেখিয়ে বলে খায়া যা।লাদু যেন এ ক্ষণটার অপেক্ষায় ছিল। তারপর বিড়ি ধরিয়ে কালিতলার জঙ্গলের ধারে বড় শিমুল গাছটার নিচে বসে ঘটনা খুলে বলে, সপ্তাহখানেক আগে তার বাড়ি পুড়ে গেছে এবং সে সব ধরণেরর ধান্দা ছেড়ে দিয়ে নামাজী এখন এবং শহরে গিয়ে তার সাথে ব্যপসা করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নাই।
লাদু এবার সুযোগ পেয়ে যায়।সে বলল ,তাইলে চলো কাকা,কালই যাই ।আজকা রাত হামার বাড়িত থাকলেন,কাল সকাল সকাল দুই চাচা ভাতিজা কানাই দার হোটেলত গরম গরম ডাল পরাটা খায়া রওনা দিমু।
বারেক আলী রাজি হয় এবং লাদুর বাড়ি গিয়ে দেখে যে তার থাকার জাইগা একটা আম গাছের নিচে। সম্বল বলতে খোলা বিছানা,উপরে জোড়াতালি দেওয়া অর্ধেক ভাঁজ করা একটি মশারী,তেলচিটচিটে প্রাচীন লেপ,বাঁশের চাটাইয়ের চৌকির নিচে একটি মাটির কলস এবং তার মুখ ঢাকা প্লাস্টিকের গেলাস।
সেদিন তারা তামুক বা অন্যকিছু খায়না।পরদিন সকালে কানাই ঘোষের হোটেলে পেট ভর্তি পরোটা খেয়ে শহরে রওনা দেয় ।শহরে পৌঁছা পর্যন্ত তারা কেউ কারও সাথে কথা বলেনা।
শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছানোর পর লাদু হঠাৎ জিজ্ঞেস করে কাকা ,শহরডা চিনেন তো?
বারেক বলে না তো বাপো ,তুই না বুললু চিনিস,তাই আনু।হামি তো হামার কাকার সাথে আলচুনু একবার এ পর্যন্ত।
লাদু কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করে এবং তারপর বলে,কাকা,চলো ফিরা যাই;শহরত থাকমু কুনটে?এবং তারপর রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে তুমার ঘরডা হামি তুল্যা দিমু। তুমি খালি বাটি চালানডা শিখ্যা দিও।
তারপর তারা প্রত্যাবর্তন করে এবং ম্যাটাল পাড়ার কাছে পৌঁছালে সুঘ্রাণ অনুভব করে এবং বারেক আলী বলে চল ব্যাটা,দু গেলাস খায়া যাই ।সেদিন তারা বেশি খেয়ে ফেলে এবং আসার পরদিনই অসুস্থ হয়ে পড়ে বারেক আলী,আর এর কদিন পরেই মারা যায়। তার ভিটেটাতে নতুন ঘর ওঠে তখন ।ঘরের ভেতর শুয়ে শুয়ে লাদু নতুন ব্যপসার স্বপ্ন দেখতে থাকে কিন্তু কাউকে সেটা বলেনা।
তারপর থেকে ভোরবেলা লাদু অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে, সে মারা গেছে এবং তার শরীরে পোকা কিলবিল করছে, শরীর থেকে মাংশ নাই হয়ে গেছে আর তার মাথার খুুুলি বারেক আলীর পাতিলে রাখা অস্থির মতো বাদামী বর্ণ ধারণ করেছে। ঠিক সেই দিন থেকে সকালে ঘুম থেকে উঠলে সে দেখতে পায় ফাতেমা খোঁড়াতে খোঁড়াতে কই যেন যাচ্ছে। তার সাথে যেতে লাদুরও লোভ হয় কিম্তু কেন জানি পারেনা ।ঠিক এর পর পরই বা দুপুরেে বা বিকালে পূব পাড়ার মছির নাপিতের যুুুবক ছাওয়ালডা এ পথ দিয়েই শহরে যায়। যাবার সময় হয়তো তার শীর্ণ চাটাইয়ের উন্মুক্ত জানালা দিয়ে শেয়ালের মতো লম্বাটে চোওয়ালখানা উঁকি দেয় ,কাকা শহরত যাচ্চি,লতুন একটা ব্যাপসা শুরু করমু,যাবেন নাকি? লাদু প্রামানিক তখন হয়তো তাকে আগ্রহ নিয়ে কাছে ডাকে এবং বলে,আয় বাপো গপ্প আচে,তুই বস্যা মুড়ি খা,হামি এনা শরীল ধুইয়া ছাফ হয়া আসি। যুবক ছাওয়ালডা হয়তো তখন অপেক্ষা করে এবং লাদুর দেওয়া কাদিরগঞ্জের হাট থেকে আনা খাঁটি শরিষার তেল দিয়ে ভালোভাবে মুড়ি মাখতে থাকে।
লেখক পরিচিতি :
নাসিমুজ্জামান নীরব
লেখক
গল্পকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়