Allama Iqbal

ইকবালের পুনর্জাগরণ ভাবনা:


অধ্যাপক উইলফেড কান্টওয়েল স্মিথ তাঁর বিখ্যাত মর্ডান ইসলাম ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে ইকবালকে শতাব্দীর প্রখ্যাত মুসলিম কবি ও চিন্তাবিদ বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন বিশ্বব্যাপী তিনি যে স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন তা থেকেই উপলদ্ধি হবে তাঁর মহত্ত্বের বিশালতা । নিকলসন বলেন ইকবালের বহুমুখী প্রতিভার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় তার ফার্সি গ্রন্থ আসরারে খুদীর মাধ্যমে ।
আসরার এর প্রধান বিষয় বস্তু হলো খুদী বা ব্যক্তিত্বের বিকাশ । এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন যে মানুষের নৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শ আত্ম-অস্বীকৃতে নয় ,বরং আত্মপ্রতিষ্ঠায় ; মানুষ এ আদর্শে উপনীত হয় অধিক থেকে অধিকতর বৈশিষ্ট্য অর্জনের মাধ্যমে । তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, একমাত্র আদর্শ ইসলামী সমাজেই ব্যক্তি এ রকম পরিপূর্ণ আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করবার আশা করতে পারে । ইকবাল কেবল শুধু ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও আত্মপ্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়েই চিন্তা করেননি, সাথে সাথে একটি আদর্শ সমাজ -তাঁর কথায় আদর্শ সম্প্রদায় উদ্ভবের কথা বলেছেন । এই মতবাদ তিনি তার রমূয-ই বেখুদীতে দেখান । ইকবাল একদিকে যেমন ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে এবং ব্যক্তিকে একটি সুসমঞ্জস সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে অতি উদারপন্থীদের দল থেকে আলাদা রয়েছেন, অন্যদিকে তেমনিই ব্যক্তির ওপর সম্প্রদায়ের অধিকারের ব্যাপারে শর্ত আরোপ করে এবং সম্প্রদায়কে ব্যক্তির আত্ম প্রতিষ্ঠা প্রয়াসের ক্ষেত্রে উপলক্ষ্যরূপে দাঁড় করিয়ে, আর ব্যক্তির জন্যে সে বাধা বিপত্তির সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দিয়ে সমাজ সর্বস্বতার খপ্পর থেকেও নিজেকে মুক্ত রেখেছেন ।[১৫]
ইকবালের চিন্তার জগতে ইসলামকে কিভাবে বিশ্বজনীন ভিত্তিতে দাঁড় করানো যায় ; কিভাবে খেলাফতের পুনরাবির্ভাব ঘটিয়ে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানদের একত্রিত করা যায় এই চিন্তাই করেছেন তিনি ।
“বর্তমানে প্রত্যেকটি মুসলিম জাতিকে তার নিজ দেহের অভ্যন্তরে দৃষ্টিপাত করতে হবে; কিছুকালের জন্যে তার চিন্তার পর্দায় নিজেরই ছবি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তুলতে হবে । এ ভাবে সব কয়টি মুসলিম জাতি দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিমান হবার পরই তারা একটি জীবন্ত গণতন্ত্র সমাহার গড়ে তুলতে পারবে । জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদদের ধারণানুযায়ী সত্যিকারের এবং জীবন্ত একতা শুধু একটি প্রতীক নির্ভর অধিস্বামীত্ব আরোপ করে অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করা চলে না।”[১৬]
ইকবালের চিন্তা, পুনর্জাগরণ ভাবনা এটাই বলে যে ইসলাম স্পষ্ট ভাষায় দাবী জানায় ইসলামই হলো মানুষের জন্যে আল্লাহর দেওয়া শেষ ঐশী ব্যবস্থাপত্র এবং এই আবির্ভাব অন্য সব ধর্ম বিধানকে বাতিল করে দেয় ।

কবিতায় লিখেন কর্মের কথা কিন্তু ব্যক্তি জীবনে তিনি ধ্যানী :


ইকবাল ‘আর্ট ফর আর্টস সেক ‘(ললিত কলার বিকাশেই ললিত কলার চরিতার্থতা ) পণ্ডিতদের একজন ছিলেন না ;কেবল আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রচারণার উদ্দেশ্যও তিনি লেখনী ধারণ করেননি। তিনি বরঞ্চ তাদের দলের একজন যাঁদের অন্তরে সৃষ্টিশীল আবেগ দুঃখজনক হয়ে দেখা দেয়।[১৭]
ইকবালের জীবন দর্শন বোধ চেয়েছিল স্বাধীনতা সাম্য ও প্রেমের ভিত্তিতে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে । নিকলসন দার্শনিক কবির আসরারই খুদি অনুবাদ করে তার মধ্যে ভ্রমণ শুরু করেন ।
সেই ভ্রমণে ইকবালকে দেখেন একজন ত্রাতা হিসেবে যিনি পুনরুত্থানের আগুন প্রজ্জ্বলিত করতে আবির্ভূত হয়েছেন ।
নিকলসন জানান সেকালীন মুসলিম যুব সমাজের এই মন্তব্য যে ‘Iqbal has come amongst us a Messiah and has strirred the dead with life” [১৮]
ইকবাল সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন । তিনি ধনিক শ্রেণীর ধ্বংস চেয়েছেন এবং গরীবের সর্বাত্মক মঙ্গল । ইকবাল মানবিক এই ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মের বাইরে গিয়ে নয় ,ধর্মীয় এই সমাজকে ধর্মের ভিতর থেকেই ডাক দিতে চাইলেন তিনি ,কিন্তু চাইলেন সেই ধর্মের এক সংস্কৃত রূপ । এইভাবে ইকবালের কাছে ধর্ম এসে পৌঁছায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াবারই একটা পদ্ধতি হিসেবে ।[১৯]
ইকবাল ধর্মকে গ্রহণ করেছিলেন জীবনকে সুস্থ করার উদ্দেশ্যে । অলীক কল্পনা ও গোঁড়ামী নয় ,উদাসীনতা ও অবাধ্যতা নয় তিনি ধর্মকে গ্রহণ করেছেন জীবনের নিগূঢ় তত্ত্ব উদ্ভাবনের আহ্বানে।আমরা ইকবালের নিজের পরিচয় পাই তার মুখেই ,
“রবীন্দ্রনাথ কবিতায় লেখেন ধ্যানের কথা,কিন্তু ব্যক্তি জীবনে তিনি কর্মী । আর আমি কবিতায় লিখি কর্মশক্তির কথা,কিন্তু ব্যক্তি জীবনে আমি ধ্যানী ।” [২০]
ইকবালের এতো শক্তিই বা কোথা থেকে ! তার এই শক্তির উৎসই বা কোথায় ? কোন চিন্তার তেজস্ক্রিয়তায় তিনি প্যান ইসলামিজমের স্বপ্ন দেখেন ।
খুদী আর বেখুদী,
আত্ম আর নৈরাত্মের মিনারে ইকবাল গড়ে তুললো আত্মশক্তি ।
একদিকে ব্যক্তির আত্ম বিসর্জনে গড়ে ওঠে সংঘ
এবং সঙ্ঘ সাহায্য করে ব্যক্তির স্বকীয় অস্তিত্ব গড়ে তুলতে ।
খুদীতে বললেন স্রষ্টার খলিফা রূপে প্রতিনিধিত্ব করতে আর বেখুদীতে এসে বললেন তোমার ব্যক্তিত্ব সঙ্ঘের মধ্যে আত্মবলশালী হয়ে উঠবে ।
“এই যে এগিয়ে যাওয়া কর্মষনা, বিকাশের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠা এর প্রাণ কথা হচ্ছে নিষ্ক্রিয়তা থেকে তেজস্ক্রিয়তা ,ভাববাদ নয় জীবনবাদ।[২১]
ইকবালের কাব্য গড়ে উঠত ব্যক্তিত্ব ও আত্মপ্রতিষ্ঠার নতুন স্তবক হয়ে । “The “remarkable point about Iqbal’s poetry in the sense of newness ” [**]

জীবন ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি:


“Iqbal philosophy has sometimes been characterized as the philosophy of Islam. It is no doubt a philosophy of Islam but this Islam should not be taken as something communal or sectarian: Islam seen from one angle of history is a religion preached by Prophet Muhammad (peace be upon him). But from another angle of history, Islam is not that alone. It is the right way of life coming down from the dawn of humanity. It is this Islam that Iqbal preaches in his philosophy. Iqbal’s philosophy is neither communal nor sectarian; it is cosmopolitan and universal.”[২২]
ইকবালই সর্বপ্রথম বলেছেন যে মানুষকে একটি সার্বজনীন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যমানের সহায়তা নিয়ে একটি মাত্র বিশ্ব সম্প্রদায় গড়ে তুলতে হবে । আর তার এই এক বিশ্ব ও এক মানব সম্প্রদায়ের মূল ভিত্তি হলো একেশ্বরবাদ ।
“ইকবাল এ প্রসঙ্গে এই কুরআনীয় উক্তিটি অনেকবার উদ্ধৃত করেছেন: অতএব আল্লাহর মহিমা শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিকর্তা তিনি “।[২৩]
ইকবাল মরদে মুমিনের উপর এই দায়িত্ব অর্পণ করে বলেছেন; আর তোমরা হারিয়ে যাবে না বরং বিশ্ব জগত আত্মস্থ করবে ।
ইকবালের কাছে জীবন হলো একটি নিরবচ্ছিন্ন গতি ,আর তার মূল অভিব্যক্তি হলো আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের সৃষ্টিতে । আর এই আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে ব্যক্তি । তারপর সে হয়ে ওঠে সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ববান।তাইতো ইকবাল বলেছেন:জীবন হলো ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি । ইকবাল অস্তমিত সূর্যের পুনরুত্থান আকাঙ্ক্ষা করেছেন । তিনি ইসলামের পুনরুজ্জীবন চেয়েছেন বুদ্ধি, যুক্তিযুক্তা, স্বাধীন চিন্তা এবং জীবনায়োজনে যথার্থের ওপর ভিত্তি করে । তিনি হযরত মুহাম্মদ স. কে মুসলিম সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল উৎস ও প্রাণস্বরূপ জ্ঞান করেছেন।
“আজ তোমাদের জন্যে তোমাদের ধর্মবিধানকে পূর্ণাঙ্গ করলাম । তোমাদের ওপর আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম ।ইসলাম অর্থাৎ আল্লাহতে পরিপূর্ণ সমর্পণকেই তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম ।”[২৪]
এ থেকেই বোঝা যায় ইকবালের কাছে ধর্ম জীবনের একটি আংশিক অধ্যায় মাত্র নয় , একটি নিরেট চিন্তা, মনোভাব বা কর্মও নয় । এ হলো মানুষের সার্বিক প্রকাশ স্বরূপ ।

বিশ্ব ভাবনায় একজন মুসলিম তাজদিদ:


ইকবাল একদিকে মুসলিম চিন্তাধারার পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করলেন অন্যদিকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন ।ইকবাল ইউরোপীয় ও মুসলিম সংস্কৃতির ব্যাখ্যাদান প্রসঙ্গে বলেন যে ,বিগত পাঁচ শতাব্দী ধরে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় চিন্তাধারা সুপ্তিমগ্ন অবস্থায় ছিল ;কিন্তু ইউরোপীয়রা এই মুসলিম চিন্তাধারা থেকেই প্রেরণা গ্রহণ করেছে ।[২৫]
কিন্তু মুসলমানদের দিকে তাকালে দেখা যায় তারা ইউরোপ থেকে কেবল সংস্কৃতির বাহ্যিক জাঁক জমক গ্রহণ করে সত্যিকারের মৌলিক গুণাবলী আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হলেন । আমরা ইকবালের চিন্তাধারার দিকে তাকালে দেখতে পাই সেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় ঘটেছে । “জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটে, দার্শনিক নিটশে এবং ফরাসি দার্শনিক অঁরি বের্গসঁ আল্লামা ইকবালের এই প্রতীচ্য পর্যালোচনায় অনুপ্রেরণা ও পুষ্টি জুগিয়েছিলেন। অন্যদিকে ইমাম গাজালী, ইবনুল আরাবী, মওলানা রুমী এবং ল্যাটিন মহাকবি দান্তে তার সৃজনশীল রচনার বিষয়, ভাষা, আঙ্গিক, প্রকরণ ও শৈলীর উপরে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এইসব কিছু বিবেচনায় আল্লামা ইকবাল হলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আধুনিক যুগের মুসলিম তাজদীদি চিন্তা, রচনা ও কর্মকান্ডের প্রধানতম নকীব — একথা বললে খুব বেশি আপত্তি উঠবে বলে মনে হয় না” ।[২৬]
ইকবালের এই পুনরুজ্জীবন চিন্তা জীবনের প্রচণ্ডতম প্রগতিশীলতার ভিত্তি আবিষ্কার করেছে । তাই বলা যায় বস্তুজগতে নিউটনের এবং প্রাণীজগতে ডারউইনের আবিষ্কৃতির সমধর্মী । ইকবালের মতে বিশ্ব প্রকৃতি অযথা সৃষ্টি হয়নি । এতে মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে; এবং এই পার্থিব জীবনেই সেই উদ্দেশ্য সাধন করতে হবে । ইকবাল বিশ্বাস করেন যে খুদীর শ্রেষ্ঠতম আকাঙ্ক্ষা হলো কোন কিছু দেখা নয় বরঞ্চ কোন কিছু হওয়া । এই কোন কিছু হওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যেই খুদী খুঁজে পায় নিজের অন্তর্মুখিতা অর্জনের এবং পরিপূর্ণতা লাভের সুবর্ণ সুযোগ । খুদীর সত্যরূপ প্রতিফলিত হয়েছে দেকার্তে বর্ণিত আমি চিন্তা করি বাক্যে নয় ,বরঞ্চ কান্ট কথিত আমি পারি বা দুজনের পূর্বে গাযালী কথিত আমি ইচ্ছা করি-তে ।

দার্শনিক কবি :


ইকবাল কোন সংকীর্ণ বিবেচনায় ইসলামের কথা বলেননি ইকবাল ইসলামকে দেখেছেন এক আন্তর্জাতিক সমাজ শক্তি হিসেবে । তিনি চেয়েছিলেন মুসলমানদেরকে সচলতার ধর্মে দীক্ষিত করে বিশ্বমানবের কল্যাণ নিশ্চিত করতে । ইসলামকে তিনি এক বৈশ্বিক পটভূমিতে দেখতে চেয়েছিলেন । জাতীয়তাবাদ ,গোত্রপ্রীতি আর ক্ষুদ্র রাজনীতির কারণে ক্ষতবিক্ষত ইসলামের কথা তিনি বলেননি । তাঁর ইসলামের ধারণা এক বিশ্বজনীন মানব ধর্মের ধারণা । ইকবাল রাজনীতির ভিতর দিয়ে তার কবি ও দার্শনিকতাসুলভ মনোভাব ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন । এ কারণে রাজমোহন গান্ধী তার সম্পর্কে “Understanding the Muslim Mind” গ্রন্থে লিখেছেন ,Iqbal was more a visionary than a politician “.[২৭]
ইকবাল কি কবি- দার্শনিক ছিলেন নাকি দার্শনিক- কবি ছিলেন এই প্রশ্নের চেয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন তিনি যখন তার চিন্তায় দ্বিজাতিতত্ত্বের নিগূঢ় ভাবনা তুলে ধরেন । ইকবাল একদিকে যেমন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন অন্যদিকে কবিতা ও বক্তৃতা দিয়ে মুসলিম মনে পুনর্জাগরণ আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছেন । তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের অবনতির কারণ দেখিয়ে বলেছেন,
এক. প্রকৃতিকে আয়ত্তে আনতে এবং বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে অবহেলা
দুই. আধ্যাত্মিক বীর্য ও মুসলিম মননে পুনরুজ্জীবন আকাঙ্ক্ষার অভাব ।[২৮]
“মহাকাশ ও পৃথিবী এবং এর মধ্যবর্তী কোনকিছুই আমি খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।অবশ্যই আমি এই দুইয়ের কোন কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করিনি।কিন্তু ওদের অধিকাংশই তা বোঝে না ।”[২৯]
ইসলাম বস্তু জগতকে অস্বীকার করে না । বরং বিশ্বজগত থেকে জ্ঞান আহরণ করে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তাকে কাজে লাগাতে বলে । আর এটাই ইসলামের মূল শিক্ষা ।

প্রেম তত্ত্ব:


গ্রীক দর্শনের সব চিন্তা কেবল বিমূর্তকে নিয়ে বাস্তবতাকে তারা অস্বীকার করেন । মুসলিম চিন্তা জগতে গ্রীক দর্শন প্রবেশ করে দর্শন ও ধর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করতে চাইল । ইসলামী চিন্তাবিদেরা গ্রিক দর্শনের চাহিদায় ইসলামী দর্শন চর্চাও শুরু করেছিল । কিন্তু তখনই আবির্ভূত হলেন ইমাম গাযালী । তিনি একে একে গ্রিক দর্শন ও ধর্মের মধ্যে অসামঞ্জস্য গুলো তুলে ধরেন । তিনি মুসলিম লেবাসধারী গ্রিক চিন্তাবিদের সামনে “তহাফাতুল ফালাসিফা” জবাব দিলেন । যদিও ইবনে রুশদ গাযালীর যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন কিন্তু তা ছিল নিষ্ফলা ও যুক্তিহীন প্রচেষ্টা (Tahafut al Tahafut)। [***]
এই দিক দিয়ে ইকবালের চেষ্টা প্রচেষ্টাও ইমাম গাযালীর সাথে অভিন্ন ছিল । তিনি চাইলেন ইসলামী চিন্তাধারায় গতিশীলতা ও উদ্যমের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে । সপ্তম হিজরিতে ইবনে তাইমিয়াও এই প্রচেষ্টায় আত্ম নিয়োগ করেছিলেন । ইকবাল বললেন মানুষ স্বভাবতঃই একটি সৃষ্টিধর্মী ও বিকাশমান শক্তি স্বরূপ, যা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে এগিয়ে যায় আর বিশ্ব প্রকৃতিও একটি সক্রিয় ও গতিশীল গৃহ । “ইমাম গাযালী ও ইবনে তাইমিয়ার পথ ধরে তিনিও ভারতীয় মুসলমানদের নিদ্রাভঙ্গ করতে চেয়েছেন। তিনি আযাদী সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ, কর্মে চাঞ্চল্য ,সৌর্য্য বীর্যে অনুপ্রাণিত ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিড়ে রাজনীতি শিক্ষা দিতে চেয়েছেন “।[৩০]
কখনো প্রেম ,কখনো খুদী তত্ত্ব, কখনো আকাঙ্ক্ষার ঢেউ তুলে মানব-মানসে আলোড়ন সৃষ্টি করতে চেয়েছেন । প্রেম কর্তব্য পালনে ব্যক্তিকে সক্রিয় করে তোলে , আকাঙ্ক্ষা জীবনের লক্ষ্যে পৌছে দেওয়ার জন্য চেষ্টা ও সাধনার প্রেরণা যোগায় ।
“ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে ‘আমি যখন মনে করি যে আমি আছি তখনই আমি অস্তিত্বশীল ‘। তিনি এই সিদ্ধান্তকে এভাবে প্রকাশ করেছেন,
আমার অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল দোদুল্যমান;
কিন্তু প্রেমই আমার মনে এ প্রতীতি জন্মিয়েছে যে আমি আছি ।”[৩১]
ইকবাল এভাবেই মুসলিম মননে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তিনি সমুদ্র মধ্যে ক্ষুদ্র বারিবিন্দু থেকে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে সমুদ্রের সাথে একীভূত হতে চেয়েছেন ।

গ্রন্থঋণঃ

১৫ আর্থার জে আরবারি
১৬ ইকবাল থেকে- সঙ্খ ঘোষ
১৭ ডঃ মিস শীলা ম্যাকডোনাল্ড ১৯৬৬
১৮ ইকবাল থেকে- সঙ্খ ঘোষ
১৯ প্রাগুক্ত
২০ প্রাগুক্ত
২১ উত্তর আধুনিক মুসলিম মন- ফাহমিদ -উর-রহমান
** Iqbal his art and thought- S.A Vahid
২২ The political philosophy of Allama Iqbal -Abdul kader zilani (Research proposal)
২৩ মুহম্মদ আলী আল হাবরুক ১৯৬৬
২৪ সূরা মায়েদা আয়াত- তিন
২৫ আবদুল কাদির মাহমুদ (লাহোর)
২৬ মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত- আল্লামা ইকবাল ও বাংলাদেশ।
২৭ ফাহমিদ উর রহমান- উত্তর আধুনিক মুসলিম মন ।
২৮ ডঃ আহমদ আলী খান (তিউনিসিয়া)
২৯ সূরা দোখান আয়াত ,৩৮-৩৯

***Tahafut al Tahafut – Ibn rushd
৩০ ডঃ মুহম্মদ হুসাইন ইউসুফী (ইরান)
৩১ মোহাম্মদ গোলাম হোসাইন মুজাদ্দীদ( আফগানিস্তান)

লেখক পরিচিতি:

আবদুল কাদের জিলানী
সম্পাদক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *