Political Philosophy of Allama Iqbal
১৯৪৭ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা । হিন্দু- মুসলমান জাতির সংকট উত্তরণের একটা সফল আখ্যান । একদিকে হিন্দু- মুসলমান দাঙ্গা অন্যদিকে ব্রিটিশ নিপীড়নে দিশেহারা ভারতীয় মুসলমান । দুইশ বছরের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস যা আজও আমাদের ব্যথিত করে । ৮০ কোটি হিন্দুর সাথে পনেরো কোটি মুসলমান । শত শত দাঙ্গায় হিন্দুরা মুসলমানদের কচুকাটা করেছে । মুসলমান হিসেবে ধর্ম ,রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি পালনের চেয়ে জীবন বাঁচানোই ছিল তাদের কাছে মূখ্য বিষয় ।
এই অবস্থা কোন ভাবেই জাহেলিয়াত থেকে কম নয় । ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই নয়া ক্রুসেডের ডাক দিয়ে হিন্দু স্থান থেকে মুসলমান শূন্য করতে চেয়েছে এবং সফলও হয়েছে ।
এলিট ব্রাহ্মণ্যবাদীরা হিন্দু জাতীয়তাবাদের ডাক দিয়ে অশিক্ষিত, অজ্ঞ, গোঁড়া ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দিয়ে দাঙ্গা বাধিয়ে মুসলমান নিধন করতো ।
হিন্দু- মুসলিম রায়টের সময় মুসলমানদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হতো, মসজিদ পুড়িয়ে দেয়া হতো, মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা হতো। কিন্তু এই খবর ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী মাসীদের গোচর হতো না। একদিকে ভারতীয় জঙ্গীবাদ ফুঁসে উঠছিল অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদী মৌলবাদীরা উল্টো মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে মুসলমানদের ভিটে ছাড়া করতো । ঠিক এমন মনে করতো তারা যে, ভারত হিন্দুদের ভূমি সেখানে মুসলমান অবৈধ ভাবে দখল করে আছে তাই মুসলমানদের উচ্ছেদ করে পবিত্র ভূমির মর্যাদা ফিরিয়ে আনা হয়েছে ।
এই ভয়াবহ অবস্থার কথা একটু ভেবে দেখেন ?
আজ ভারতের হিন্দুত্ববাদী জায়োনিস্টদের দিকে দেখেন তারা এখনো সেই বর্বরতা থেকে উঠে আসতে পারেনি । আজও ভারতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরা আত্মপরিচয়ের সংকট ও জাতিগত বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে ।
সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে হত্যা জুলুম আর নৈরাজ্য লেগেই থাকতো । হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানের রক্ত মেখে ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার সাথে হৃদয়ে ক্রুসেড ধারণ করতো ।
এমনকি আজও গোপন বৈঠকে বসে কিভাবে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ভূমিকে হিন্দু রাষ্ট্রে(অখণ্ড ভারত) ফিরিয়ে আনা যায় । আজও ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ মুজিব নগর সরকারের সাথে সংগঠিত সাত দফা চুক্তি হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশকে দাসত্বের শৃঙ্খলে রেখে শোষণ করতে চায় ।
সুভাষ চন্দ্র বসুর বিপ্লব ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অখণ্ড ভারত নীতি, জওহরলাল নেহরুর কূটকৌশল ও মহাত্মা গান্ধীর অনশন আন্দোলন হিন্দু -মুসলমান সংকট নিরসনে কোন কাজে আসেনি । কাজে আসেনি এজন্য বলবো যে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের যারা নিয়ন্ত্রণ করতো তারা নেহরু ও গান্ধীর অনুসারী হিসেবেই পরিচিত ছিল । এত বড় বড় দাঙ্গা কেন ঘটেছিল?
যে ব্যক্তি হিন্দুদের মহাত্মা তার কথা এই নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা কেন শোনেনি ?
মহাত্মার সাথে নিম্নবিত্তের হিন্দুদের যোগাযোগ কেন বিলম্বিত হতো ?
দাঙ্গা ঘটার পর গান্ধী হাঁটা শুরু করতেন তারপর লাশ গলে পঁচে যাওয়ার পর সেখানে উপস্থিত হয়ে সান্ত্বনা দিতেন ।
আমি বলছি না যে তারা সম্মুখে শান্তি ও একতার ডাক দিয়ে পেছনে দাঙ্গার হুকুম দিয়েছেন ।
তবে ঘটনা যেহেতু ঘটেছে তাই এটাকে বিভিন্ন দিক দিয়ে দেখা যেতে পারে । তবে মহাত্মার অনুসারী হিসেবে যারা সারাক্ষণ তার আশে পাশে ঘুরঘুর করত তারা ভিন্ন বার্তা দিয়ে নিম্নবিত্তের হিন্দুদের ব্যবহার করতো । তাই মহাত্মা গান্ধীর কোন প্রচেষ্টাই হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গা নিরসনে সফল হতে পারেনি ।তবে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে সত্যাগ্রহ, অসহযোগ আন্দোলনের মতো দলীয় কর্মসূচি(কংগ্রেস) ভারতীয় মুসলমানরা ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে পালন করেছে ।
এই ক্ষেত্রে আমার ভাবনায় গান্ধী একজন ব্যর্থ মানবতাবাদী মানুষ । তার প্রচেষ্টা ও উদ্দেশ্য সফল হয়নি । সে কট্টরপন্থী হিন্দুদের মনুষ্যত্ব ও মানবিক হতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়নি । উদ্দেশ্যহীন মানুষ আর লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে চলা মানুষ এক নয় । যেহেতু তার উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু সেই উদ্দেশ্য লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি তাই বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনাও ঘটেনি । যারা গান্ধীকে হিন্দু -মুসলিম সংকট নিরসনের জন্য মহাত্মা জ্ঞান করেন ;
গান্ধী কি আদৌ সেই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন ?
যেহেতু হিন্দু- মুসলিম একসঙ্গে মিলেমিশে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না তাহলে ভিন্ন কোন চিন্তা কেন করেননি গান্ধী ?
দুইশত বছর ধরে ভারতীয় মুসলমান অস্তিত্বের লড়াই করেছে ।
একদিকে কট্টর পন্থী হিন্দুদের সাথে লড়েছে অন্যদিকে ব্রিটিশ দানবদের সাথে ।
এই পরিস্থিতিতে অখণ্ড ভারত চিন্তা ,হিন্দু- মুসলমান সংকট নিরসন নীতি ও জনমনে মিলেমিশে থাকার নীতিবোধ জাগরণের চেষ্টা- প্রচেষ্টা নেহাতই সমস্যা জিইয়ে রেখে সমাধানের চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছু না ।
মনে করেন হিন্দু- মুসলমান জাতির সংকট নিরসনে দশ জন চিন্তাবিদের ভূমিকা ছিল কিন্তু সফল হয়েছে একজন তাহলে চেষ্টা প্রচেষ্টার জন্য গান্ধীকে মহাত্মা বলব আর যে হিন্দু- মুসলিম সংকট নিরসন করতে সক্ষম হয়েছিল তাকে আড়াল করে রাখব । তাকে ইতিহাস থেকে ঘার ধরে বের করে দেব ।
তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ অচ্ছুত ও ভয় ভীতির মতো আদিমতম বর্বর পথ বেছে নেবো ।এমনকি তার মুসলিম পুনর্জাগরণ চিন্তা ও প্যানইসলামিক ভাবনার চর্চাও নিষিদ্ধ । এই হচ্ছে আমাদের অন্ধকার জ্ঞান রাজ্য । যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতীয়তাবাদীরা রসদ সরবরাহ করছে আর আমরা গোগ্রাসে গিলেই যাচ্ছি ।
ব্রাহ্মণ্যবাদী নীতিনির্ধারকেরা আমাদের চিন্তা শক্তি ও বিবেক নিয়ন্ত্রণ করছে । কখনো ভয়ভীতি দেখিয়ে কখনো লোভের মুলো ঝুলিয়ে আমাদের চিন্তার কাণ্ড দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করছে।
ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ মুসলিম জাতীয়তাবাদকে বিবস্ত্র করে সেই মুলো মুসলমানদের মুখের উপর ঝুলিয়ে নয়া হিন্দুত্ববাদ কায়েম করে চলেছে ।আর সেই ষড়যন্ত্র আতিথেয়তা ভেবে আমরা পুলকিত হচ্ছি । গান্ধী যদিও একজন মানবতাবাদী চিন্তাবিদ ছিলেন কিন্তু তার সব ধরণের কর্মসূচি কংগ্রেসের কর্মসূচি হিসেবেই বিবেচিত হতো ।
পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক যে হত্যাকাণ্ড হয় তার ফলেই কংগ্রেস ব্রিটিশদের উপর অসন্তুষ্ট হয় । কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড যদি মুসলমানের উপর দিয়ে যেতো তাহলে কি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কোন কর্মসূচি ঘোষণা হতো?কারণ মুসলমান হত্যার নজির শত শত । ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতিগত বৈষম্যে মুসলমানের রক্ত ছিল হালাল । এমনকি কংগ্রেসের রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্গও এটা বিশ্বাস করত বললে ভুল হবে না ।
পাকিস্তান আন্দোলন কি ধর্ম ভিত্তিক আন্দোলন ছিল ? আমি বলব না । যদিও ইসলামকে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজে লাগিয়ে আলাদা মুসলিম সাম্রাজ্য গঠনের কথা ভাবা হয়েছে।
ভাষাগত, জাতিগত ও ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে মুসলিম জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে নয়া রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করা হয়েছিল । সংখ্যালঘুত্ব,মুসলিম পরিচয় সংকট ও হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের জুলুম নিপীড়নের ভয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন ইকবাল। যদিও ক্বায়েদ -ই আযম ১৯২৯ সালে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, হিন্দু- মুসলমান জাতির সংকট নিরসনে ইকবালের চিন্তার কোন বিকল্প নেই । এবং এ কথা তিনি স্বীকার করে দ্বিজাতিতত্ত্বে মনোনিবেশ করেন।
ইকবাল ভেবেছিল আলাদা রাষ্ট্র গড়ে সেখানে ইসলামী মতাদর্শে একটা গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সরকার গঠন করা সম্ভব হবে । আমি বলব ইকবাল এই ক্ষেত্রে সফল । তিনি এই সমাধানে এসে হিন্দু- মুসলিম সংকট নিরসন করতে সক্ষম হন । দুই জাতির সংঘাত, একশো কোটি মানুষের জাতিগত দ্বন্দ্ব ও হত্যা নৈরাজ্যের এমন সমাধানকারীই হতে পারে মহাত্মা । হিন্দু- মুসলমান জাতির সংকট নিরসনে এই যে সমাধান তত্ত্ব দিলেন ইকবাল আমার কাছে এই জন্য ইকবালই মহাত্মা । মহাত্মা ইকবাল মুসলিম শিবিরে যে চিন্তার জাগরণ ঘটালেন সেই চিন্তার সম্মুখে বাঁধ নির্মাণ করতে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ সক্ষম হয়নি । সব ষড়যন্ত্র চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে আলাদা রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে ।
ভারতীয় মুসলমানরা দুইশত বছর ধরে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ ও ব্রিটিশদের হাতে নির্যাতন ও নিপীড়নের স্বীকার হয়েছে । অবশেষে মুক্তি মিলেছিল । পনেরো কোটি মুসলমান অস্তিত্বের সংকট থেকে মুক্তি পেয়েছিল । এই জন্যই ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদের কাছে মহাত্মা । এই সংকট নিরসন করতে সক্ষম না হলে কি অবস্থা হতো সেটা পরের কথা যদিও তবু বর্তমান হিন্দুস্থানে বিশ কোটি মুসলিমের অস্তিত্বের সংকট পঠনপাঠন প্রণিধানযোগ্য । তবে ভারতীয় মুসলমানদের কাছে ইকবাল মহাত্মা না হয়ে গান্ধীকে মহাত্মা করে প্রচার করা কেন হলো?
কেন ইকবালের এই ডায়নামিক চিন্তা ও তার বাস্তবায়ন মুসলমান জাতির কাছ থেকে আড়াল করা হলো? ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের এটাও জাতিগত ষড়যন্ত্র যা শত বছর ধরে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে ;কখনো গোপনে কখনো সম্মুখে ।
একদিকে কট্টর পন্থী হিন্দুরা দাঙ্গা বাধিয়ে মুসলমান মুক্ত হিন্দুস্তান গড়তে চেয়েছে অন্য দিকে ব্রিটিশ দানবেরা আযাদী চাওয়া আলেমদের জুলুম নির্যাতন ও হত্যা করেছে । ইংরেজ ঐতিহাসিক মিস্টার টমসন তার স্মারকলিপিতে লিখেন “১৮৬৪ খৃস্টাব্দ থেকে ১৮৬৭ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত আলেমদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে ইংরেজরা । এই তিনটি বছর ছিল ভারতীয়দের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক ।এই তিন বছরে ইংরেজরা ১৪ হাজার আলেমকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছে ।”[১]
ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে মুসলমানরাই বেশি প্রতিবাদ করেছে ।অন্যদিকে হিন্দুরা ব্রিটিশদের ধামাধরা হয়ে ব্রিটিশ শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে ।
মিস্টার টমসন দিল্লি থেকে খাইবার হত্যার চিত্র তুলে ধরেন এভাবে “দিল্লির চাঁদনীচক থেকে খাইবার পর্যন্ত এমন কোনো গাছ ছিল না যার শাখায় ওলামায়ে কেরামের গর্দান ঝুলেনি । আলেমদের শূকরের চামড়ার ভেতরে ভরে জ্বলন্ত চুলায় দগ্ধ করা হয়েছিল । তামা গরম করে তাদের শরীরে দাগ দেওয়া হতো। ফাঁসির মঞ্চ করা হয়েছিল লাহোরের শাহী মসজিদের বারান্দায়, ইংরেজদের ফাঁসির কাষ্ঠে প্রতিদিন আশি জন আলেমকে ঝুলানো হতো । চাটাইয়ের মধ্যে পুরে আশি জন আলেমকে রাবী নদীতে নিক্ষেপ করে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হতো । আমি দিল্লিতে আমার তাবুর ভেতর প্রবেশ করলে আমার কাছে মুর্দারের দুর্গন্ধ অনুভব হয় । তাই তাবুর পেছনে গিয়ে দেখলাম সেখানে জ্বলন্ত অগ্নি স্ফূলিঙ্গে চল্লিশজন আলেমকে বিবস্ত্র করে জ্বালানো হচ্ছে ।কিছুক্ষণ পরে আরো চল্লিশজন আনা হলো এবং আমার সামনেই বিবস্ত্র করা হলো । এবং আলেমদের উদ্দেশ্য করে বলা হলো হে মৌলভীর দল উক্ত চল্লিশজনকে যেভাবে আগুনে পোড়ানো হয়েছে তোমাদেরকে অনুরূপ জ্বালানো হবে । তোমরা যদি শুধু বলো যে,আমরা আযাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিনি তাহলে তোমরা মুক্তি পাবে । কিন্তু কেউই ইংরেজদের কাছে মস্তক নত করেনি পূর্বের চল্লিশ জনের মতোই পরবর্তী চল্লিশ জনও আযাদীর জন্য নিজেদের উৎসর্গ করল।”[২]
দুইশত বছরের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস এভাবেই চিত্রিত হয়েছে । ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের গোলামী ও মুসলমানদের উপর জুলুম নির্যাতন এই হচ্ছে ৪৭ পূর্ববর্তী ইতিহাস । এই বিষয় গুলোই ইকবাল প্রত্যক্ষ করেন । ভারতীয় মুসলিমদের সংকট নিরসনের পাশাপাশি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কথাও ভাবেন । সেই ভাবনা থেকেই বেরিয়ে আসে আলাদা জাতি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা । সোজা বাংলায় যাকে দ্বিজাতিতত্ত্ব বলে ।
১৯০৫ সালে ইউরোপ যাওয়ার পূর্বে ইকবালের চিন্তা ও মননে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত ছিল । প্রথম জীবনের কবিতায় ইকবাল অখণ্ড ভারতীয় চেতনা ও আবেগ ধারণ করতো । তিনি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে লিখলেন “সারে জহাঁ সে অচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা” । ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ সাধকদের মতো তিনিও হিন্দু- মুসলমান ঐক্যের সাধনায় ব্রতী ছিলেন ।যাকে বলে পাক্কা ন্যাশনালিস্ট । “ইকবাল জন্মভূমির ধূলিকণাকে দেবতা তুল্য জ্ঞান করে মন্দির মসজিদ কোথাও আমার ভক্তি নেই বলে আক্ষেপ করেন।
ঐক্য ও প্রেমের আহ্বান করে হিন্দু- মুসলিম ভেদাভেদ মিটিয়ে এক সাথে থাকার কথা বলেন।”[৩]
ইকবাল ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপীয় সংস্কৃতি -সভ্যতা ও ধর্মীয় বিষয় গুলো উপলব্ধি করেন । এবং তার মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মনোভাবে পরিবর্তন আসে ।ইকবাল নিজেই বলতেন “আতঙ্কিত হয়ে তিনি লক্ষ্য করেন দেশপ্রেমের প্রবল ব্যাধিজ্বরের উত্তাপে শক্তিমান সব জাতি রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটিয়েছে ইউরোপ । এই সব নেশনের মধ্যে রেষারেষির ফল হলো প্রাধান্য লাভের নতুন উপনিবেশ অধিকারের উন্মত্ত প্রতিযোগিতা । ইউরোপের ইতিহাস বিশদ বিশ্লেষণ করে যুক্তিবিচার সহকারে ইকবাল দেখানোর চেষ্টা করেন মার্টিন লুথারের আবির্ভাবের ফলে খ্রিস্টধর্ম আর ইউরোপের ঐক্যবিধায়ক শক্তি রইলো না । ইকবাল আধুনিক সভ্যতার সংকট প্রত্যক্ষ করলেন এর সাম্রাজ্যবাদ ,জাতীয়তাবাদ ও ধনতন্ত্রী চরিত্রের ভেতর। তিনি গভীর প্রজ্ঞার সাথে বিশ্লেষণ করে দেখলেন ইউরোপীয় সভ্যতার যে চাকচিক্য তা নির্মিত হয়েছে ধর্মহীনতার সৌধের উপর যার শুরু হয়েছিল ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার পদ্ধতির ভিতর দিয়ে ।”[৪]
ইকবাল নিজেই বলতেন “ইউরোপে অবস্থানের পূর্বেকার কবিতা আমার অন্ধকার যুগের কবিতা ।*
ইকবাল ইউরোপে গিয়ে জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক ফলাফল উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।যার কারণে এই সংকীর্ণ চিন্তা পরিহার করে তিনি বিশ্ব মুসলিম পুনর্জাগরণ চিন্তায় মনোনিবেশ করেন ।
ইকবালের পরবর্তী চিন্তা গুলো পরখ করলে দেখা যায় তিনি জাতীয়তাবাদের চেতনা ও আবেগ থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চতর মূল্যবোধ ও মহৎ কর্মের দিকে ধাবিত হন । এবং ইসলামই যে এই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার নতুন কাঠামো গড়ে তুলবে তিনি সেই স্বপ্ন ও বিশ্বাস ধারণ করতেন । ইকবাল নিশ্চিত ছিলেন যে কাবাকে কেন্দ্রে রেখে বিশ্বজোড়া এক ধর্মরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হবে একদিন ,যেখানে দেশ আর জাতির সমস্ত বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে সমস্ত মুসলিম সমাজ, যে ভবিষ্যতকে মনে রেখে বলা যাবে ,ভোলো এই নাম ডাকা -সিরিয়া ইরাক প্যালেস্টাইন, যেখানে বলা যাবে ‘মুসলিম হ্যয় হম ওয়তন হ্যয় সারে জাহাঁ হমারা ।'[৫]
জাতীয়তাবাদী ইকবাল বিশ্ব ইকবাল হয়ে ওঠেন যখন উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ইউরোপ যাত্রা করেন।
তবে আর্নল্ড সাহেব অবসরে যাওয়ার পর বিলেতে চলে যান ,ইকবাল এই বিচ্ছেদে খুব ব্যথিত হন।
এর পর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি ইউরোপ গমন করেন।
ইকবাল সেখানে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন । তার অধ্যাপক ছিলেন দার্শনিক ম্যাকটাগার্ট । তারপর জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পারস্যের দর্শন শাস্ত্র নিয়ে “Development of Metaphysics in Persia” নিবন্ধ লিখেন ।
তারপর বিলেতে বসে ডক্টর নিকলসনের সাথে পরিচয় ঘটে । ইতিহাস লেখক E G Browne প্রভাবে পারস্য ভাষা চর্চায় পুনরায় মনোনিবেশ করেন । এই বিবর্তন পক্রিয়ায় ইকবালের চিন্তার জগতে পরিবর্তন ঘটে । জাতীয়তাবাদী আবেগ থেকে বিশ্ব মুসলিম ঐক্য ও ইসলামের পুনরুত্থানে মনোনিবেশ করেন । জামাল উদ্দীন আফগানীর প্যান ইসলামিজম লক্ষ্যে এবং মৌলনা জালাল উদ্দিন রুমিকে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্ব মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান ।
ইকবালের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি মুসলিম জাতীয় আবাসভূমির পত্তন করা যেখানে শরীয়তের মৃলনীতি অনুযায়ী ইসলাম ধর্ম আচরিত হতে পারবে এবং এজন্য তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যে কোনো প্রকারের দেশ বিভাগের দ্বারাই তা সম্ভব হতে পারে।
ইকবাল ১৯৩০ সালের ২৯ ডিসেম্বর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের এলাহবাদ অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন । সেখানে ভাষণে তিনি বলেন,To base a constitution in the conception of a homogenous India,or to apply to India the principles dictated by British democratic sentiments unwittingly to prepare her for a civil war. “[৬]
যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, এক অখণ্ড ভারত এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ভারতবর্ষের জন্য তার নীতি প্রয়োগ করলে,তা অজানত গৃহযুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার সামিল হবে ।
।এটি লক্ষ্যণীয় যে ,যে সময়ে জওহরলাল নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতন্ত্রবাদ ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল সমর্থন লাভ করেছিল,সেই সময়ে ইকবাল পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে এ মতবাদ ভুল । ১৯৩১ -সালে ক্বায়েদ- ই আযমকে লিখিত এক চিঠিতে তিনি যুক্তি তর্ক দিয়ে প্রমাণ করতে প্রয়াস পান যে ইসলামী শরীয়তে সর্বস্তরের মানুষের জন্যে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে, তাই হলো জওহরলাল নেহরুর নাস্তিকতা মূলক সমাজবাদের যোগ্য প্রত্যুত্তর ।[৭]
ক্বায়েদে আযমকে লিখিত সেই চিঠিটি ২৮শে মে ১৯৩১ সালে লেখেন ইকবাল ।
তিনি যা লিখেন,”ইসলামী আইন বহুদিন ধরে এবং পরম অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করে আমি এ সিদ্ধান্তে এসেছি যে যদি এই কানুন পদ্ধতি যথাযথ ভাবে হৃদয়ঙ্গম ও কার্যকরী করা হয়, তবে প্রত্যেকের জন্যে অন্ততঃপক্ষে জীবন যাপনের অধিকার সমূহ সংরক্ষিত হবে ।কিন্তু স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রাবলীর পত্তন ব্যতীত এ দেশে ইসলামী শরীয়তের প্রয়োগ ও বিকাশ সাধন কিছুতেই সম্ভব হবে না ।ইসলামী কানূনের নীতি অনুযায়ী সামাজিক গণতন্ত্র পদ্ধতি গ্রহণ বিপ্লবাত্মক কিছুই নয়;বরঞ্চ এ হলো ইসলামের প্রাথমিক মৌলিক নীতির দিকে প্রত্যাবর্তন ।”[৮]
I have selected the Islamic community as my starting point not because of any national or religious prejudice, but it is the most practicable line of approach to the problem. [৯]
ইকবালের চিন্তা ভাবনা জুড়ে হিন্দু -মুসলিম সংকট নিরসনের আকুতি ছিল । তার সব চেষ্টা প্রচেষ্টা লেখনী,বক্তৃতা ও ভাষণে এই সংকট সমাধান সূত্র তুলে ধরে সমাধানের পথ খুঁজেছেন ।
“Jinnah meets Sir Muhammad Iqbal many times in London and they were good friends. But despite this disillusionment, Jinnah did not yield to Iqbal’s arguments. Almost a decade was to pass before he admitted that he had “finally been led to Iqbal’s conclusions, as a result of careful examinations and study of the constitutional problems facing India. “[১০]
যার ভাবানুবাদ এমন, জিন্নাহ স্যার মুহম্মদ ইকবালের সহিত বহুবার লন্ডনে দেখা করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব ছিল । তাঁহার ভুল ভাঙ্গিলেও জিন্নাহ ইকবালের যুক্তির নিকট নতি স্বীকার করেন নাই । প্রায় এক যুগ গত হওয়ার পর তিনি স্বীকার করলেন যে,’ভারতে যে শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমূহের সম্মুখীন হইতেছে তাহা ভালো ভাবে বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক ইকবালের সিদ্ধান্তেই তাঁহাকে পৌছতে হইল”। ১৯৩৪ সালে ক্বায়েদ ই আযম ভারতে ফিরে এসে ইকবালের পরিকল্পনাই মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য গ্রহণ করেন । মুসলিম লীগের এ একটি মহৎ কৃতিত্ব যে এর নেতৃত্ব মুসলিম সংখ্যা গুরু ও সংখ্যা লঘু উভয় শ্রেণীর প্রদেশে স্বীকৃত হয়েছে । যদিও সে সময়ে লোকসমক্ষে প্রকাশ করা যায়নি ,তবুও এ কথা সম্পূর্ণ সত্য যে স্যার মুহাম্মদ ইকবালের অবদান এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।তার চিন্তাশীল মনন আমার নিজের চিন্তাধারার সাথে বিশেষ ভাবে সুসামঞ্জস্য ছিল এবং শেষ পর্যন্ত আমাকে তাঁরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে ।”[১১]
১৯৩২ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ইকবাল অক্লান্তভাবে দুইটি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন । প্রথমে ক্বায়েদ -ই আযমকে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন এবং মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বীকৃত মুখপাত্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন ।
২১ শে জুন ১৯৩৭ সালে ইকবাল ক্বায়েদ -ই আযমকে চিঠিতে বলেন,
“আমি যেভাবে প্রস্তাব করেছি সেভাবে পুনর্গঠিত মুসলিম সংখ্যা গুরু প্রদেশ সমূহের একটি আলাহিদা যুক্তরাষ্ট্রই হলো একমাত্র উপায় যা দ্বারা একটি শান্তিপূর্ণ ভারত গড়ে উঠতে পারে এবং সাথে সাথে অমুসলিম আধিপত্য থেকে মুসলমান সম্প্রদায়কে বাঁচানো যেতে পারে । উত্তর পশ্চিম ভারত ও বাংলার মুসলমানদেরকে কেন এক একটি জাতি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবেনা-যাতে তারা ভারতের এবং ভারতের বাইরের অন্যান্য জাতি সমূহের মতো আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পেতে পারে।”[১২]
তবে অক্টোবর ১৫,১৯৩৭ খৃস্টাব্দে লক্ষ্ণৌর বক্তৃতায় জিন্নাহ বলেন, “The majority community have clearly shown their hand that Hindustan is for the Hindus.” [১৩]
সোজা করে বললে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় তাহাদের কার্য্যকলাপে ইহাই পরিষ্কাররূপে বুঝাইয়াছে যে হিন্দুস্তান শুধু হিন্দুদের ।
ইকবালের ১৯৩৮ সালে মৃত্যু বরণ করেন । তিনি তার চিন্তার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি । তার মৃত্যুর দুই বছর পর ১৯৪০ সালে ক্বায়েদ- ই আযম বললেন পাকিস্তান অপ্রতিরোধ্য । ইকবালের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার ছেলে জাভিদ ইকবালকে এক চিঠিতে বলেন ,”আমার কাছে তিনি বন্ধু, নেতা এবং দার্শনিক গুরুর স্থলাভিষিক্ত ছিলেন।মুসলিম লীগের চরমতম সংকটকালে তিনি পর্বতের মতো অটল থেকে তাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এবং কখনো এক মূহুর্তের জন্যেও তিনি সংকল্পচ্যূত হননি ।”১৪
গ্রন্থঋণঃ
১ মিস্টার টমসন স্মারকলিপি
২ প্রাগুক্ত
৩ বঙ্গ- ই দরা -আল্লামা ইকবাল
৪ উত্তর আধুনিক মুসলিম মন-ফাহমিদ-উর -রহমান
*যিন্দা রোদ (প্রথম খণ্ড)- ডঃ জাভিদ ইকবাল
৫ ইকবাল থেকে- সঙ্খ ঘোষ
৬ ইকবাল- ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
৭ অধ্যাপক রাশব্রুক উইলিয়ামস
৮ ইকবালের চিঠিপত্র
৯ ইকবালের কাব্য সঞ্চয়ন- মনিরুদ্দীন ইউসুফ (ভূমিকা)
১০ Jinnah creation of Pakistan- Hector baligo
১১ letters of Iqbal to jinnah- introduction (jinnah) 1942
১২ প্রাগুক্ত
১৩ ইকবাল- ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
১৪ অধ্যাপক রাশব্রুক উইলিয়াম
আবদুল কাদের জিলানী
সম্পাদক