মিথের মাহাত্ম্য

ডিউডেলাস ছিলেন তাঁর সময়ের বিখ্যাত আবিষ্কারক। ঘটনাক্রমে ক্রিটের রাজার বিরাগভাজন হন। রাজা মিনোস ডিউডেলাস এবং তাঁর পুত্র ইকারাসকে কয়েদ করে রাখলেন ল্যাবিরিন্থে। এ এক ধাঁধাঁলো কারাগার, বের হওয়া অসম্ভব। তবুও হতাশ হননি জ্ঞানী ডিউডেলাস। প্রতিদিন অল্প অল্প করে মোম নিয়ে পাখা বানালেন নিজের ও পুত্রের জন্য। তারপর একদিন উড়াল দিলেন আকাশে। পুত্র ইকারাসের প্রতি উপদেশ ছিলো বেশি নীচে বা উপরে না ঊড়ার। নীচে সাগরজলে পাখা ভিজে যাবার সম্ভাবনা আর উপরে সূর্যের উত্তাপে গলে যাবার। ইকারাস কিন্তু ওই ভুলটাই করলো। উড়ার জোশে উপরে যেতে যেতে চলে গেলো সূর্যের কাছাকাছি। পরিণামে পাখা গলে আছড়ে পড়লো সাগরজলে- মৃত্যু।
প্রথম পাঠেই গল্পটাতে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের ইঙ্গিত চোখে পড়ে। এরিস্টটল যখন তাঁর নিকোমেকিয়ান ইথিক্স-এ “Golden mean” এর কথা বলেন, আরব উপদ্বীপের নবি মুহম্মদ সা. যখন সাহাবিদের মধ্যবর্তী পথের ডাক দেন, শাক্যমুনি বুদ্ধ যখন মধ্যমপন্থার ধারণা দেন- তখন ইকারাসের প্রতি ডিউডেলাসের উপদেশ আরো বিস্তৃত অর্থ লাভ করে। অন্যদিকে ইকারাসের মৃত্যু ইকারাসের জন্য ছিলো বুদ্ধিভ্রষ্ট হবার পরিণাম এবং ডায়ডেলাসের জন্য পূর্বকৃত পাপের। চোখের সামনে পুত্রের মৃত্যু দেখা যেকোনো পিতার জন্য শাস্তিই বটে। যাই হোক, একটা মিথ কীভাবে ধর্ম, দর্শন আর বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে, তাঁর উৎকৃষ্ট নজির ইকারাসের মিথ। প্রত্যক্ষ কিংবা প্রচ্ছন্নভাবে মিথের গন্ধ মিশে থাকে ধর্ম, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির শরীরে।

সবার আগে আসে ধর্মের নাম। নৃতত্ত্ববিদগণ টোটেম-ট্যাবু ধারণার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। প্রাচীন সেই বিশ্বাসই কাঠামো দিয়েছে ট্রাইবকে। গড়ে উঠেছে নানা আচার ও বিঁধি-নিষেধ। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত নিয়াণ্ডার্থাল মানুষের কবর এবং মিসরীয় মমি তাদের ধর্মবিশ্বাসকেই প্রতিফলিত করে। সত্যি বলতে ধর্মের সামগ্রিক ইতিহাসে মিথের আধিপত্য ছিলো একচেটিয়া। নবি মুসা ফেরাউনের গোলামী থেকে বনী ইসরাইলকে রক্ষা করে কেমন ঐতিহ্য চালু করেছেন, সে পরের কথা। কিন্তু পারস্য, আসেরীয়, রোমান এবং হাল আমলের হিটলারের আঘাতও যে তাঁদের ঐতিহ্য উপড়ে ফেলতে পারেনি, তার কারণ তাঁদের পেছনে খোদা তা’লার বিশেষ প্রতিরক্ষা নয়। কারণ নিজেদের ঐতিহ্য ও মিথের প্রতি কঠোর আনুগত্য।

আবার একটা গোত্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা স্থাপন, বাহিরের গোত্রের সাথে টিকে থাকার স্বার্থে সম্পর্ক নির্ধারণ, মিত্রতা কিংবা যুদ্ধ- যে কোনো পরিস্থিতিতে দারুণভাবে ব্যবহৃত হতে পারে মিথ। সম্রাট কনস্টানটাইন যখন ধর্মন্তরিত হন কিংবা ব্রিটিশরাজ যখন “Defensor fidei” অর্থাৎ ‘বিশ্বাসের রক্ষক’ নামধারণ করেন, অথবা মুসলিম শাসক ‘আমিরুল মু’মেনীন’ নাম নেন, তখন কেবল ধর্ম সামনে আসে না। আসে রাজনীতি, ক্ষমতা আর মিথের ধারণাও। চতুর্থ আমেনহোটেপের ইখনাটন অর্থাৎ ‘এটন যার উপর সন্তুষ্ট’ -নাম নেবার সাথে তাৎপর্যগতভাবে এর খুব বেশি ফারাক নেই। একটা মিথ একটা সমাজ তৈরি করে। দুটি সমাজের ভেতরে যার মিথ শক্তিশালী, সেই-ই বিজয়ী হবে। কেননা, শক্তিশালী মিথ ভেঙে দিতে পারে রক্তের সম্পর্ককেও। বশীভূত করে রাখে অচেনা ব্যাক্তিকেও। সার্থক মিথ তৈরি করার মাধ্যমে শাসক কেবল স্বীয় রাজ্যে বিদ্রোহের রাস্তাই বন্ধ করেন না। পাশাপাশি জনতাকে পক্ষে রেখে তখতের মেয়াদ দীর্ঘ করেন। একটা মিথিকাল ফিগার দাঁড় করাতে পারাটা রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার সার্থক অস্ত্র। যুদ্ধের মাঠে নিজের দলকে চাঙা রাখার চাবি। ধর্মের ময়দানে এর প্রয়োজন অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি।

গ্রীক শষ্যের দেবী দিমিতিরের কন্যা পার্সিফোনিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পাতালে। ক্রোধান্ধ দিমিতির এবং তাঁর পরবর্তী আখ্যান নির্দেশ করে গ্রীসের ঋতুবৈচিত্র্য। অন্যদিকে প্রমিথিউসের আগুন আনবার ঘটনা সামনে আনে মানুষের সাথে আগুনের সম্পর্ক। ক্রুদ্ধ জিউসের প্লাবন দিয়ে পৃথিবী ধ্বংসের সিদ্ধান্ত আঙুল তুলে বন্যার দিকে। বলে রাখা ভালো, মহাপ্লাবনের স্মৃতি প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য প্রায় প্রতিটা সংস্কৃতিই বলে গেছে। মোদ্দাকথা, মিথ ছিলো প্রাকৃতিক অলঙ্ঘ নিয়মগুলোকে ব্যাখ্যা করার বিশ্বস্ত সূত্র। একে একদিক থেকে বিজ্ঞানের শিশু অবস্থা বলা যেতে পারে। অন্যদিক থেকে বলা যেতে পারে দর্শন ও সমাজধারণার আদিরূপ। সবচেয়ে সত্য হয় মানুষের অস্তিত্বচেতনা এবং উপলব্ধির দিকে আঙুল তুললে।
পূর্বের মহাভারত আর রামায়ণ, পশ্চিমের ইলিয়াড আর ওডিসি। গ্রীসের নাটক এমনকি দর্শনেও মিথের প্রভাব ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ। এজন্য জেনো বা এরিস্টটলেরাও পিঠ ঘুরিয়ে থাকেননি অথবা থাকতে পারেন নি। প্লেটোর গুরু সক্রেটিস মৃত্যুকালে বলেছিলেন –
“Crito, we owe a cock to Asclepius. Do pay it. Don’t forget.”
বলা বাহুল্য, এখানে উল্লেখিত এস্ক্লিপিয়াস আরোগ্যের দেবতা। দেবতা এপোলো এবং করোনিস এর পুত্র। অনুরূপ কাহিনী দেখা যায় এখনো। এপোলো কিংবা এস্ক্লিপিয়াস নেই হয়তো। কিন্তু নতুন সময়ে নতুন সংস্কৃতিতে নতুনরূপে সামনে এসেছে সেই পুরোনো মিথ।
ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দিমাতে একটা নতুন রাজবংশ উত্থানের পেছনে প্রোপাগাণ্ডার ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন। মেসিয়ানিক প্রোপাগাণ্ডা কীভাবে রোমান সাম্রাজ্যকে গরম করে ফেললো আর মাহদী প্রোপাগাণ্ডা কীভাবে ফাতেমীয় বংশকে রাজক্ষমতা দিলো- তার সাক্ষী ইতিহাস। এরচেয়ে পোক্ত প্রমাণ বর্তমানের বায়তুল আকসা এবং জেরুজালেম সংকট। আন্তঃআব্রাহামিক ধর্মের ফ্যাকচুয়াল এবং নমিনাল মিথের সংঘর্ষ। পেছনে আমরা প্রোপাগাণ্ডাকে মিথ বলে এসেছি। দুই লাইনের সংজ্ঞায় না দাঁড় করিয়ে একটা স্বতন্ত্র জগৎ হিশেবে সামনে ধরলে মিথ পাঠ অনেকাংশে অর্থপূর্ণ হবে। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে মিথ সভ্যতার অন্যতম নিয়ামক হিশেবে ছিলো, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সে অর্থে Homo Sapiens –কে অসংকোচে Homo Muthos বলা যায়।

লেখক পরিচিতি :
আহমেদ দীন রুমি
লেখক,
চিন্তাবিদ,
ইসলামী স্টাডিস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *