মিথের মাহাত্ম্য

সময়ের বিভিন্ন বাঁকে মিথকে পাঠ করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। ব্যাক্তি কিংবা সময়ের ভিন্নতায় কখনো ইতিহাস কখনো যুক্তি কখনো বা অন্য কোনো পাটাতনে দাঁড় করানো হয়েছে মিথকে। কখনো ভেঙে ভেঙে, কখনো সামগ্রিক থেকে অর্থ বের করা হয়েছে।
ক্লাসিক্যাল পৃথিবী বলতে আমরা প্রাচীন গ্রীস আর রোমকেই বুঝি, অথবা বলা ভালো- আমাদের বুঝানো হয়। আড়াই হাজার বছর আগের সেই চিন্তাশীল সমাজে মিথের তিন ধরণের পাঠ দেখা যায়। প্রথম পক্ষের দাবী ছিলো মিথ রূপক। অর্থাৎ সকল প্রকার মিথ দার্শনিক সত্যকে রূপক হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়োজনেই গড়ে উঠেছে। এই তত্ত্বের পক্ষে ছিলো প্লেটো, এম্পিডক্লিস এবং হেরাক্লিটাসের মতো বাঘা বাঘা পণ্ডিতেরাও। তাঁদের মতে, হেক্টরবধ, ট্রয়ের যুদ্ধ, বীর ওডিসিয়াসের ঘরে ফিরে আসা নিয়ে বিড়ম্বনা- সব গল্পই মূলত রূপক। ভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, রামের সীতা উদ্ধার এবং রাঁধা-কৃষ্ণের আখ্যান নিয়ে অনুরূপ দাবী করা যায়। সেই চোখ দিয়ে দেখলে মহাভারতের পাণ্ডব-কৌরব দ্বন্দ্ব রূপকভাবে শুভাশুভের চিরন্তন দ্বন্দ্বকে অংকন করা হয়েছে। পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেকে এক একটি বিশেষ গুণের প্রতিনিধিত্ব করে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ফ্যামিনিটি (ধ্রুপদীরূপে) এবং ডিভাইনিটি (কৃষ্ণরূপে)। বিপরীতপক্ষে দুর্যোধন-দুঃশাসনসহ শত কৌরব প্রতিনিধিত্ব করে শত পাপের। এভাবে অর্থ বের করা যায় পূর্ব পশ্চিমের অন্যান্য মিথ থেকেও।

যুক্তির চালুনি হাতে এরপর হাজির হন জেনো। যদি গাধাকে তার স্রষ্টার ছবি আঁকতে দেয়া হয়, তবে আঁকা ছবিটাও একটা গাধারই হবে। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিলো বিপ্লবী। এই চোখে দেখলে- অলৌকিকতার মোড়কে যে গল্পগুলো আমাদের সামনে হাজির, তা মানুষেরই সৃষ্ট। আর এজন্যই দেবতারা মানবিক। খোদাতা’লার গুণাবলি যতোটা না তাঁকে মহিমান্বিত করে, তারচেয়ে বেশি সংজ্ঞায়িত করে মানুষের অনুধাবন ও চিন্তনশক্তিকে। এইজন্যই যতো দিন অতিবাহিত অচ্ছে, ঈশ্বরবাদীদের ঈশ্বরের ধারণা ততো এবস্ট্রাক্ট হচ্ছে। সময়ের সাথে মানুষের বেড়ে উঠার ইতিহাস অন্য অর্থে ঈশ্বরের বেড়ে উঠার ইতিহাস। জিউস কিংবা মহাদেবের মর্ত্যে নেমে আসা, দেবীতে দেবীতে মনোমালিন্য, দেবতা-দেবতায় যুদ্ধ- অন্য জগতের কিছুর না, মানুষের ভেতরের যৌনতা, ক্রোধ এবং প্রতিহিংসার প্রকাশ। মানুষ তাঁর ভেতরের ভয়, লোভ এবং অভিপ্রায়কে বিশ্বাসের বলয় দিয়ে সামনে এনেছে। মিথ পাঠের এই তত্ত্ব মানুষের আচার, সমাজচিন্তা, মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া সংজ্ঞায়নে তাৎপর্যপূর্ণ ।

ক্লাসিক্যাল যুগে মিথ পাঠের তৃতীয় ধারণার নাম ইউহেমারিজম। একে অন্য কথায় মিথের ঐতিহাসিক পাঠ বলা যেতে পারে। ইউহেমারাস নামক গ্রীক পণ্ডিত প্রথম দাবী করেন- যাদেরকে দেবতা জ্ঞানে টঙে তুলে রাখা হয়েছে তারা মূলত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। দেবতা জিউস ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ক্রিটের একজন শক্তিশালী শাসক আর তাঁর সম্পর্কে গড়ে উঠা মিথ প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসের অতিরঞ্জন। এভাবে পার্সিয়াস, হারকিউলিস কিংবা প্রমিথিউসকেও ব্যাখ্যার আলোয় আনা যায়। ভারতীয় মিথ নিয়ে যে ঐতিহাসিক পাঠের দাবী নেই, তা না। রামের লঙ্কা অভিযান, রাবণবধ, কৌরব-পাণ্ডব টানাপোড়ন এবং কুরুক্ষেত্রের রক্তপাত- ঘটনাগুলোকে ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস উল্লেখযোগ্য। গঙ্গার অস্তিত্বশীলতা, জগন্নাথের মন্দির, কাশী- প্রভৃতি ধারণাতে ইতিহাস আর মিথ একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।

ক্লাসিক্যল যুগের পরে আসে ক্যাথলিক যুগ। ক্রিশ্চিয়ান ধর্মের প্রচারকেরা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিলো ইউহেমারিজমের ধারণা। তাঁদের প্রথম আর প্রধান শত্রু প্যাগানদের বিরোধিতা করতে প্যাগান দেবতাদের অযোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ এরচেয়ে ভালো কী? ক্লিমেণ্ট অব আলেক্সান্দ্রিয়ার মতো অনেকেই টিপ্পনি কাটতে থাকে-
“Those to whom you bow were once men like yourselves”.
এই প্রচারণার অভূতপূর্ব শক্তিও সেই কারণগুলোর একটি, যার প্রভাবে প্যাগানিজমের বুকের উপর স্থাপিত হয় খ্রিষ্টীয় ঝাণ্ডা।

অষ্টাদশ শতক থেকে মিথ সম্পর্কে ধারণা অনেকটা বদলাতে থাকে। সামঞ্জস্য পাওয়া যেতে থাকে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন মিথের সাথে গ্রীস এবং রোমান মিথের। পণ্ডিতমহলে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। মিথকে গণ্য করা হয় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক শিশু অবস্থার স্বাক্ষর হিসেবে। রোমান্টিক যুগে ভাষাবিজ্ঞানের আলো ফেলা শুরু হয়। শুরু হয় আর্ট, কৃষ্টি এবং আচারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংস্কৃতির মিথের তুলনামূলক অধ্যয়ন । বই লেখা হতে থাকে “Mythology” এবং “Symbolism” এর উপর।

উনবিংশ শতকে বিবর্তনবাদের স্রোত এইদিকেও আঘাত হানতে ভুল করেনি। ডারউইনের জীববিবর্তন, মার্কসের সমাজ বিবর্তন এবং ফ্রয়েডের মনোবিবর্তন- হাত বিস্তার করে মিথের ব্যাখ্যা দেবার জন্যও। এরমধ্যে যুক্ত হয় প্রচুর তত্ত্ব-উপাত্ত। বৈদিক পণ্ডিত ম্যাক্স মুলার, নৃবিজ্ঞানী জেমস জর্জ ফ্রেইজার এবং এডওয়ার্ড বার্নেট টেইলর অভাবনীয় সংযোগ ঘটান । বিভিন্ন অঞ্চলের মিথকে সংগ্রহ এবং তা থেকে অর্থ বের করবার বিদ্যা হিসেবে ব্যাপক ক্ষেত্র তৈরি হয়।

বিশ শতক ছিল মিথ পাঠের স্বর্ণসময়। কার্ল জাঙ মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। মিথের পেছনে তিনি কিছু নির্দিষ্ট সুপ্ত অবচেতন মনস্তাত্ত্বিক শক্তির খোঁজ করেছেন। যার নাম দিয়েছেন আর্কিওটাইপ। পৃথক সংস্কৃতির মিথের মধ্যে সাদৃশ্য মূলত এই আর্কিওটাইপের উপর নির্ভর করে। লেভি স্ট্রাউস মানব মনের সহজাত প্যাটার্নের ধারণা বলেই উপস্থাপন করেন মিথকে। ইডিপাসের মিথ সহ অন্যান্য মিথ দিয়ে এই গঠনবাদী পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন জোড় বিপরীত ধারণার সাথে। যেমন- আলো বনাম অন্ধকার, রুক্ষতা বনাম দয়ার্দ্রতা, সুন্দর বনাম কুৎসিত- ইত্যাদি।

জোসেফ ক্যাম্পবেল মিথকে মানুষের আধ্যাত্মিক সম্ভাবনার মেটাফোর উপস্থাপন হিসেবে দেখতে চান। মির্চা ইলিয়াদ দেখেন মানুষের পবিত্রতার জ্ঞান। যাইহোক, পাঠ করবার ধরণে ভিন্নতা কিংবা অর্থপ্রাপ্তিতে পৃথক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেও মিথের আবেদন এবং মূল্যায়ন বোদ্ধামহলে বাড়ছে বই কমছে না। একবিংশ শতকের এই সময়ে মিথ নিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রাম এমনকি বিগ বাজেটের মুভির নাম দেখলেই তা স্পষ্ট হয়। সাথে সাথে পার্টিকুলার এবং কম্পারেটিভ মিথোলজি নিয়ে প্রকাশিত এবং প্রকাশিতব্য বইগুলো তো আছেই। যদিও মিথ বলতে এখন পর্যন্ত ‘নমিনাল মিথ’ কেই পাঠ করা হচ্ছে। ব্যক্তি নিজে যে মিথের সাগরে ডুবে আছে, সে বিষয়টা থেকে গেছে অজ্ঞাতেই। অথবা বলা যেতে পারে- হয়তো অস্তিত্বের সংকট নয়তো ক্ষমতার হিসাবনিকাশ থেকেই বারবার চেপে যাওয়া হয়েছে একটা অংশ- ফ্যাকচুয়াল মিথ। যার বুকের উপর দিব্যি হেসে-খেলে রাত পোহাচ্ছে কৌশলী আধিপত্যবাদী। হয়তো সচেতনে অথবা অবচেতনে।

মিথকে সরাসরি সত্য কিংবা মিথ্যা বলা নির্বুদ্ধিতা। বরং মিথ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সত্য-মিথ্যার বাইরেও আলাদা স্থান আছে দাঁড়ানোর। আধুনিক ধর্ম কিংবা আধুনিক বিজ্ঞানের চশমা দিয়ে দেখে অনেকেরই মিথকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবার প্রবণতা আছে। সেই প্রসঙ্গ পরে হবে। বরং সরাসরি কিছু মিথের মুখোমুখি হওয়া যাক। মানুষের চিন্তার ইতিহাসে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা দুটি বিষয়- সৃষ্টি আর মৃত্যু। বিভিন্ন সভ্যতা বিভিন্নভাবে আরো স্পষ্টভাবে বললে কৌতূহলোদ্দীপক করে বর্ণনা করেছে জগতের সৃষ্টি আর মৃত্যুকে।

জগতের সৃষ্টি নিয়ে গড়ে উঠা মিথগুলোকে মোটা দাগে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। তারমধ্যে সবার প্রথমে আসে শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টির ধারণা। সেমেটিক ঐতিহ্যের একত্ববাদী ধর্মগুলো এইরকম নির্দেশ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জেনেসিস এর উক্তি-
“And God said, let there be light and there was light.” (1: 3)

অনুরূপ ইসলামের “কুন ফায়াকুন”। এই চোখে জগতের সৃষ্টি একটি বিস্ময়, যার পেছনে আছে অপার শক্তিমান কোনো সত্তা। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় সৃষ্টির পেছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে।

দ্বিতীয় কিসিমের মিথ বলে, সৃষ্টির শুরুটা বিশৃঙ্খলা থেকে। সেই বিশৃঙ্খলা পানি হতে পারে। নিস্তব্ধতা কিংবা রুক্ষতা হতে পারে। অন্ধকার কিংবা অপদেবতাও হতে পারে। আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ান এবং নিকট প্রাচ্যে বিশৃঙ্খলার স্থানে সাপসদৃশ অপদেবতা দেখা যায়।

পরবর্তী ধরণে বাইবেল অনুসারে ইবলিশ কিংবা জরাথুস্ট্রবাদ অনুসারে আহরিমান সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সংক্ষেপে তাঁরা ‘আর্থ ডাইভার’ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। এই ধরণের মিথে সৃষ্টিকর্তা এবং আর্থ ডাইভারের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয় প্রথমে। পরবর্তীতে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া অনেকটা এর পরিণাম। সবচেয়ে জনপ্রিয় বাইবেলের আদম-ইভের স্বর্গচ্যুত হবার গল্প এবং ইবলিশের ভূমিকার কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

জগৎ সৃষ্টির পেছনে মিথগুলোর আরো অনেক ধরণ আছে। মহাজাগতিক ডিম থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি, বৈশ্বিক পিতামাতা থেকে সৃষ্টি, আবির্ভাব সংক্রান্ত মিথ, আদিম দেবতার বমি থেকে সৃষ্টি- প্রভৃতি।

অপর একটি আলোচিত বিষয়- মৃত্যু। এক্ষেত্রে প্রথম দিকেই থাকবে ঈশ্বরের অভিপ্রায়। সুমেরীয় মিথ এবং পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্যের কথা উল্লেখ করা যায়। গিলগামেশ ছিল উরের শাসক। সমান শক্তিসম্পন্ন আরেক ব্যক্তি এনকেদুর সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এনকেদুর অপমৃত্যু ঘটে। দুঃখিত গিলগামেশ মৃত বন্ধুকে জীবিত করার বাসনায় বের হন এবং লম্বা যাত্রার পর পৌছান উতনা পিশতিমের কাছে। খালি হাতে না ফিরলেও অচিরেই তাঁর বুঝতে দেরি হয়না- মৃতকে বাঁচানো যাবে না। অনুরূপ কঙ্গোর প্রচলিত মিথ এবং মিশরীয় মিথে মৃত্যুকে দেবতার অভিপ্রায় হিসেবে দেখানো হয়েছে।

পূর্ব আফ্রিকায় একটা মজার মিথ প্রচলিত আছে। ঈশ্বর একটা গিরগিটি পাঠালেন মানুষকে অমরত্বের সংবাদ জানাতে। যাত্রার ধীরতায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেল। এরমধ্যে মন্ত্র বেহাত হয়ে গেলো সাপের কাছে। সেই থেকে মানুষের মৃত্যু। এরকম মিথ ব্রিটেনের আদি Purgo দের মধ্যেও দেখা যায়। এই শ্রেণির মিথে মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতারণার শিকার।

“Sulawesi” তে একধরণের মিথ দেখা যায়। একবার ঈশ্বর আকাশ থেকে পাথর ফেলার নির্দেশ দিলেন মানুষের জন্য উপহারস্বরূপ। পাথরটা যখন আঙিনায় এসে পড়লো, তখন মানুষ বিস্ময় নিয়ে দেখলো বটে। কিন্তু কেউ গ্রহণ করলো না। অতঃপর ঈশ্বরের নির্দেশে কলা ফেলা হলো। এবার মানুষ কিন্তু ফেলে দিলো না। তুলে নিয়ে গেলো ঘরে। সেই থেকে মানুষ কলার মতো ক্ষণজীবী অর্থাৎ মৃত্যুশীল। যদিও তাঁর পাথরের মতোন দীর্ঘজীবী হবার সুযোগ ছিলো। এই ধরণের মিথগুলোতে মানুষের মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে মানুষেরই ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল।

পরবর্তী প্রকার মৃত্যু মিথের মধ্যে আছে- মানুষের গলদ। জিউস প্যাণ্ডোরাকে একটা বাক্স উপহার দেন। নারীজাতির সহজাত কৌতূহলতার জন্য নিষেধ সত্ত্বেও বাক্স খুলে ফেলেন প্যাণ্ডোরা। সেই ভুলটাই কাল হলো। আরো একটি জনপ্রিয় মিথ হচ্ছে বাইবেল অনুযায়ী আদম-ইভের স্বর্গচ্যুত হবার গল্প। এমতে তাঁরা নিষিদ্ধ ফল খাবার আগ পর্যন্ত সকল প্রকার দুঃখ, ব্যথা, মৃত্যু থেকে মুক্ত ছিলো। এই শ্রেণির মিথ মৃত্যুর কারণ হিসেবে মানুষেরই কোনো একটা অতীত পাপকে দায়ী করে।

মানুষ জন্মের পর থেকেই হাজার রকমের দুঃখে ভোগে। আছে অনাহার, মহামারি কিংবা প্লেগের মতো উপদ্রব। এরমধ্যে নানা কিসিমের রোগ-বালাই তো আছেই। সুতরাং মৃত্যুকে মানুষ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে এইসব কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্য। অথবা দেবতা নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে মানুষের কপালে মৃত্যুকে লিখে দিয়েছেন। যাতে করে মানুষ উৎকট সব ব্যাধিতে কষ্ট পেয়ে আর্তনাদ করে বাতাস ভারী না করে। এই ধরণের মিথও কম নেই। এছাড়া মানুষ কর্তৃক ভুল সিদ্ধান্ত, ঐশী মৃত্য কিংবা ঐশী সংঘাত প্রভৃতি নানা কিসিমের মিথ গড়ে উঠেছে মৃত্যুকে ব্যাখ্যা দেবার জন্য। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞান নিজেও মিথ সৃষ্টির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

শুধু সৃষ্টি কিংবা মৃত্যু নয়। মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে কোনো না কোনোভাবে মিথ গড়ে উঠেছে। কখনো সচেতনভাবে কখনোবা অবচেতনে গড়ে উঠা এইসব মিথ যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে রেখেছে মানুষকে। আদিম সমাজে অর্থাৎ শিকার আমলে যুদ্ধ-দেবতাদের উপযোগিতা ছিলো সবথেকে বেশি। ধীরে ধীরে কৃষির যুগে প্রবেশ করার অন্যতম ফলাফল হলো উর্বরতার দেবীদের সামনে আসা। তবে দেবতা না হয়ে বেশির ভাগ সংস্কৃতিতে দেবী হলো কেনো- এইটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। হয়তো নারীত্ব মানেই উর্বরতা, যে জন্ম দিতে পারে। তারপর মানুষের চিন্তা আরেকটু সামনে এলে উঁকি দিয়েছে একত্ববাদী ধর্মগুলো। শিকার কিংবা কৃষিযুগের দেবতা দর্শন আর বিজ্ঞানের শিরীষ কাগজে নিজেকে আরেক দফা ঘষেমেজে নিলো। এখানেই কিন্তু থেমে যায়নি। একবিংশ শতকে দাঁড়ানো যে কোনো ধার্মিকের ধর্মগ্রন্থ আগের চেয়ে অনেক বেশি এবস্ট্রাক্ট অর্থ বহন করে। ভবিষ্যতে নতুন ধর্ম না এলেও বিশ্বাস বিবর্তিত হবে সময়ের সাথে। যেভাবে হয়ে এসেছে আগে।

সাম্প্রতিক মিথ:

সাম্প্রতিক মিথ বলতে আমরা সেইসব বিষয়গুকে সামনে আনতে পারি- যেগুলো পবিত্রজ্ঞানে চর্চিত হচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ‘মানবতাবাদ’ এমন একটি ধারণা, যার অর্থ এবং সংজ্ঞায়ন অনেকাংশে ক্ষমতা আর রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত। অথবা মানবতাবাদ যদি পুরোদস্তুর মানুষকে নিয়ে গঠিত মানবতাবাদই হয়, তবুও এটি একটি মিথ। এমন মিথ, যার ভিত্তিতে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর আচার নির্ধারিত হয়। ঠিক-ভুলের প্রশ্ন না, মানবতাবাদের প্রোপাগাণ্ডা কতোটা প্রভাবিত করতে পেরেছে, প্রশ্নটা সেইখানে। আগেই বলা হয়েছে, পাঠক যেহেতু কেবল নমিনাল মিথকে সনাক্ত করে, সেই জন্য পপুলার ফ্যাকচুয়াল মিথ হিসেবে মানবতাবাদ কর্তৃত্ব করছে আধুনিক মানুষের মনে। রেনেসাঁর পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদের উত্থান ইতিহাসে অন্যতম লক্ষ্যণীয় বিষয়। অস্পষ্ট নয়, জাতীয়তাবাদের ধারণা ইউরোপ পার হয়ে এশিয়াকেও ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অবশ্যই এর লাভ আছে। প্রতিপক্ষ দেশকে খণ্ডিত করে দেবার জন্য এখন পর্যন্ত এরচেয়ে বড় অস্ত্র আর কী!

ক্যাপিটালিজম কিংবা এর বিপরীতে কমুনিজমও মিথের বাইরে পড়ে না। মার্ক্স বা লেলিনের যে ফিগার হাল আমলের সমাজতন্ত্রীদের মাঝে গড়ে উঠেছে তা গ্রিসের এপোলোর ধারণা থেকে খুব কি কম? বরং বেশিই হবে।

একটা মিথের জন্ম কখন কীভাবে, তা ঐতিহাসিক কিংবা তাত্ত্বিকদের প্রশ্ন। তবে মিথ যে উপর তলার দ্বারা নিচতলাকে রিপ্রেস করার জন্য সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়, এটা সত্য। ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য রক্ষার জন্য কিংবা অনার্যদের অবদমন করে রাখার জন্য বর্ণপ্রথার সৃষ্টি বললে খুব বেশি মিথ্যা কথা বলা হয় না। আজকাল ফেমিনিজম কিংবা লিবারেলিজমের যে জিগির সামনে পেছনে হামেশাই শোনা যায়, তাকেও ওই স্কেলেই মাপা যায়। নবি মুহম্মদের স. কাছে জিবরাইল আসতো, এটা সত্যাসত্য নির্ণয় করবে ধর্মতাত্ত্বিকেরা। কিন্তু তাঁর এই ডিভাইনিটির প্রোপাগাণ্ডা যে কুল্লে আরবকে একত্রিত করে ফেলেছিলো, এটা তুখোর ইসলামবিদ্বেষীও স্বীকার করবে। ভুল হবে, যদি ভাবা হয় বর্তমানে ওইসব নেই। বরং সামান্য রঙ বদলিয়ে একটু ভিন্ন স্বাদে এখনো বর্তমান।

ভুলে গেলে চলবে না, মানুষ অন্যান্য প্রানীর থেকে আলাদা হতে পেরেছে এই মিথ তৈরির ক্ষমতার কারণে। যদি মানুষের ইতিহাস শাসক আর শাসিতের ইতিহাস হয়, তবে মিথ সবসময় নির্ধারণ করেছে ইতিহাসের গতিপথ। মিথের মৃত্যু নেই। একসময় মহাকাব্য ও পাঁচালি দারুণ জনপ্রিয় হলেও বর্তমানে তাদের আবেদন নগণ্য। এরমানে এই নয় যে,তাঁরা হারিয়ে গেছে। বরং রূপান্তরিত হয়েছে অন্যকিছুতে। উদাহরণস্বরূপ গান, শর্টফিল্ম, টিভি সিরিজের নাম আনা যায়। একইভাবে যে মিথগুলোকে আমরা হারিয়ে গেছে বলে সিদ্ধান্ত দিচ্ছি, সেগুলো খানেক বিবর্তিত হয়ে টিকে আছে আমাদের বিশ্বাসের ভেতরেই। বৈজ্ঞানিক সত্য বলে তিনবেলা যা কিছু আমাদের আঁকড়ে রেখেছে, তা কি মিথ নয়? স্টিফেন হকিং এর সাথে হোমার কিংবা বাল্মীকির পার্থক্য আকাশ-পাতাল না। হয়তো নতুন খোলসে আধুনিকায়নের পথে আরেকধাপ যাত্রা। মিথের আধুনিকায়নের অন্যতম সংযোজন মিডিয়া প্রোপাগাণ্ডা। ব্ল্যাক সম্পর্কে হোয়াইট, হোয়াইট সম্পর্কে ব্ল্যাক, ইসলাম সম্পর্কে ইউরোপ কিংবা ইউরোপ সম্পর্কে ইসলাম- নানাভাবে নানারকম মিথ দ্বারা প্রভাবিত। জনপ্রিয়তার জন্য যে কোনো মিডিয়া এই ইস্যু লুফে নিতে পারে।

মিথের আধিপত্যবাদ:

ডোনাল্ড এ ম্যাকেঞ্জি তাঁর ‘ইণ্ডিয়ান মিথস্ এণ্ড লিজেণ্ড’ বইতে দেবরাজ ইন্দ্রকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ‘ইণ্ডিয়ান হ্যামার গড’ হিসেবে। মজাটা ভাষার এই খেলায়। ‘থর’ যদি হ্যামার গড হয়, তাহলে ইন্দ্র ভারতীয় হ্যামার গড। একজন ইউরোপীয় বক্তা যদি একজন ইউরোপীয় শ্রোতার কাছে এইভাবে ইন্দ্রকে পরিচয় করিয়ে দেয়, তবে কিছু আসে যায় না। আসে যায় তখনি, যখন বক্তা সর্বজন সম্মুখে এই ঘোষণা দেন। কেননা তাতে একটা সংস্কৃতির মিথকে অন্য সংস্কৃতির মানদণ্ডে বিচার করা হয়। আরেকটু খোলাসা করে বলা উচিৎ। তৈমুর লঙকে এশিয়ার আলেক্সাণ্ডার বলা হয়। ইরানীয় শিল্পী কামাল উদ্দিন বিহযাদকে বলা হয় প্রাচ্যের রাফায়েল। এছাড়া আরো অজস্র অভিধা আছে উল্লেখ করার মতো। কিন্তু লক্ষণীয় হচ্ছে- ইউরোপের কাউকে অনুরূপভাবে পরিচিত করানো হয়না। অথচ প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, রুমি ,বুদ্ধ কিংবা কৌটিল্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে ইউরোপ। তারপরেও কৌটিল্যকে ভারতের ম্যাকেয়াভেলি বলা হবে। ম্যাকিয়াভেলিকে কখনো ইউরোপের কৌটিল্য বলা হবে না। এর কারণ আধিপত্য। কী দিয়ে কাকে মাপা হবে, এটা জ্ঞানের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত হয় না। নির্ধারণ করে ক্ষমতা। ক্ষমতাশালীর সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে অন্য সবকিছুর ব্যাপারে। অর্থাৎ ক্ষমতাধরের মিথ মূলধারার মিথ, বাদ বাকি মিথ ইন্ডিজেনাস।

দর্শনের ইতিহাস পাঠের সময়ও অনুরূপ বিষয় চোখে পড়ে। এক বয়ান অনুসারে, মুসলিম আর ভারতীয় দর্শনকে দর্শনের বাইরে রাখা হয়। অভিযোগ অতিমাত্রায় ধর্ম সম্পৃক্ততা। প্রশ্ন আসে- ইউরোপীয় সংজ্ঞার ফ্রেমে ভারত, চাইনিজ কিংবা মুসলিম দর্শনকে পরিমাপ করতে যাওয়া কতোটুকু যৌক্তিক? এইখানে আবার মিথ নিয়ে সেই কথাতে ফেরত আসতে পারি আমরা। ক্ষমতাধারীর লালিত বিশ্বাস সংজ্ঞায়ন করবে বাকি কিছুর। মিথের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটে এবং ঘটছে। এই আধিপত্যবাদের কারণেই ভারতীয় মিথের চেয়ে গ্রীক বা রোমান মিথ স্বয়ং ভারতীয়দের কাছেই বেশি পরিচিত। সাবিত্রী-সত্যবানের গল্পের চেয়ে হেলেন-প্যারিসের আখ্যান অনেক বেশি কদর পায়।

কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা- এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য না। আলোচনার উদ্দেশ্য ছিলো মিথ আমাদের কতোটা আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে। প্রায় প্রত্যেকটা সম্পর্ক মিথের উপর ভর দিয়েই টিকে থাকে। জন্মের পর মা যেদিন বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, সেইদিন থেকে মৃত্যুপূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত একরকম মিথের ভেতরেই আটকে থাকে বেশিরভাগ মানুষ। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় শৃঙ্খল ভাঙতে পারেনা বলে হয়তো বের হতে পারেনা মিথ থেকেও। মিথ বেঁচে ছিলো, বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে। কারণ দিনশেষে আমাদের আশ্রয় নিতে হয় বিশ্বাসের দুয়ারেই। আর এজন্যেই “Homo sapiens” এর অন্যনাম আমরা” Homo muthos” বলতে পারি অসংকোচে।

লেখক পরিচিতি :
আহমেদ দীন রুমি
লেখক,
চিন্তাবিদ,
ইসলামী স্টাডিস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *