মিথের মাহাত্ম্য

শিশু জন্ম নেয়ার পর ধীরে ধীরে চিনে নেয় বাবা-মাকে। সত্যিই কি চিনে নেয়? নাকি চিনিয়ে দেয়া হয়? একটা বিশ্বাস আটকে দেয়া হয় সরল মস্তিষ্কে। একটা মিথ। শিশু বাড়ে, বাড়ে মিথ। রূপে আর পরিমাণে। তারপর…
OPAE নামের মেয়েটা গর্ভবতী হলো। অথচ তাঁর কোনো স্বামী নেই। যায় নি কোনো পুরুষের মোলাকাতেও। যেহেতু সমাজ একথা বুঝতে নারাজ, সেহেতু ইজ্জতের ভয়ে অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটা। গোপনে জঙ্গলে ফেলে আসলো সন্তানকে। একটা পাখি কিন্তু ঠিকই দেখে ফেললো ঘটনা। তারপর কোত্থেকে যেনো বাকল আর পাতা এনে ঢেকে দিলো পরিত্যক্ত শিশুকে। সময়ের ব্যবধানে শিশুটি একটা গাছে পরিণত হলো। এটাই পৃথিবীর প্রথম ট্যারু গাছ, ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবন যাপনের অন্যতম অবলম্বন। গল্পটা নিউ গিনির হলেও এরকম অজস্র গল্প আছে অন্যান্য সংস্কৃতিতেও। টিকে আছে অনেকটা শ্রদ্ধা পেয়েই। বিশেষ এই গল্পগুলোর বিশেষত্ব কেবল সংশ্লিষ্ট উপাদানে না, বর্ণনার প্যাটার্নেও। মিথের মাহাত্ম্য এখানেই।
গ্রীক শব্দ ‘Mythologia’ থেকে লাতিন এবং ফরাসি ভাষা ঘুরে ইংরেজিতে Mythology শব্দটি এসেছে। গ্রীক Muthos এর মানে গল্প, বয়ান কিংবা পৌরাণিক আখ্যান হলেও তাৎপর্যগতভাবে Mythology এর বিস্তৃতি বিশাল। এতোটাই বিশাল ও বৈচিত্র্যময় যে, অর্থের ফ্রেমে বাঁধতে চাওয়াটা নেহাত বোকামি। ইঁদুরের গর্তে নীলতিমি ঢোকাতে চাওয়ার মতোন।
মিথ আর মিথোলজির মধ্যে যেহেতু কিঞ্চিৎ ফারাক আছে, তাই মিথ থেকেই শুরু করা যাক। এককথায় মিথ হচ্ছে সমাজ বা সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত পবিত্র ধারণাগুলোর শাব্দিক উপস্থাপন। কখনো কখনো মিথ এমন একটি গল্প, যা ব্যাখ্যা করে কোনো কিছু কেনো অস্তিত্বশীল। উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ আমেরিকার জমজ সন্তানের মিথ আনা যেতে পারে। অথবা মিথ ব্যাখ্যা করবে কোনো ধর্মীয় আচার কেনো পালিত হয়। বাইবেলের অনুসরণে আব্রাহামিক ধর্মের খৎনার কথা এক্ষেত্রে যুতসই। অথবা মিথ হচ্ছে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর ব্যাক্তিরূপে উপস্থাপন। যেমন- গ্রীক মিথে ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি, বজ্রের দেবতা জিউস এবং এরকম সবাই।

এতোকিছুর পরেও কিছু কথা থেকে যায়। যীশু খ্রিষ্ট নবি ছিলেন নাকি আল্লাহর পুত্র- সত্যতা নির্ণয়ে বাহাস হতে পারে। পক্ষে বা বিপক্ষে কিংবা দুইয়ের মাঝামাঝি সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। সেই খতিয়ান অন্যদিকের। যে কোনো একটা সিদ্ধান্তই যীশুর একটা কাল্ট দাঁড় করায়। সেই কাল্টকে ঘিরে একটা সমাজ গড়ে উঠারও নজির কম নেই। এই সমাজ রক্তসম্পর্কীয় সমাজের বন্ধন থেকে কম দৃঢ় না। তাঁর অন্যতম কারণ- এখানে ঐশী ধারণার সাথে যোগাযোগ আছে। যাই হোক, এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমরা শুধু একটা কথা সামনে আনতে চাচ্ছি। তা হলো- শুধু দেবতাদের আখ্যান মিথ না। সত্য, মিথ্যা কিংবা উভয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা এমন প্রচারণাকে আমরা মিথ বলতে পারি; যার সাথে স্বর্গীয় সংজ্ঞায়ন যুক্ত। যীশুর প্রভাব কোনো অংশেই জিউসের চেয়ে কম না। পাকিস্তানের ইতিহাসে জিন্নাহ্ প্রমিথিউসের চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ। সমকালীন কিংবা পরবর্তী সমাজ ও সংস্কৃতির উপর ক্রিয়াশীল নিয়ামক দেখে মিথ সনাক্ত করা যায়। একটা শিশু জন্ম নেবার সাথে সাথে তাঁর সামনে উপস্থাপিত হয় সমাজ, দেশ এবং ধর্ম। হাজির করা হয় কোনটা পবিত্র আর কোনটা অপবিত্র- সেই জ্ঞান। যুক্তি আর বুদ্ধি অদ্ভুতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় অন্যকিছুর দ্বারা। যারা এই কর্তৃত্ব করে; প্রায়শ তারাই মিথ।
মিথ আর ফোকলোর কি এক? অবশ্যই না। নিতান্ত সাধারণ পাঠকও মিথকে অন্যান্য গল্প থেকে আলাদা করতে পারে। কীভাবে? কারণ সকল মিথের ভেতর একটা বিশেষ অনুরণন আছে। আর তা হলো- মিথ এমন ব্যাখ্যা এনে সামনে হাজির করে, যার ভিন্ন ব্যাখ্যা পাঠকের মস্তিষ্কে আগে থেকেই আছে। পাঠকের মস্তিষ্কে বিশ্বাসযোগ্য অবস্থায় ক্রিয়াশীল সেই ব্যাখ্যাকে আমরা ‘ফ্যাকচুয়াল মিথ’ (Fcactual Myth) হিশেবে নামকরণ করবো।

জরাথুস্ট্রবাদ অনুসারে, পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে আহুর মাজদা এবং আঙরা মাইনু বা আহরিমানের ধারণাকে সজোরে মিথ বলে আখ্যা দেবে সেমেটিক ট্রাডিশনের ধর্মগুলো। এর কারণ, তাঁর মস্তিষ্কে ফ্যাকচুয়াল মিথ হিসেবে পৃথিবী সৃষ্টির অন্য ধারণা ক্রিয়ারত। অনুরূপভাবে সেমেটিক সৃষ্টিবাদ একজন জরাথুস্ট্রবাদীর কাছেও মিথ মাত্র। একে আমরা ‘নমিনাল মিথ’(Nominal Myth) হিশেবে নামকরণ করবো। অর্থাৎ পাঠক যে মিথ সম্পর্কে রায় দিচ্ছে, তা নমিনাল মিথ। আর যে মিথের মধ্যে বসবাস করছে, তা ফ্যাকচুয়াল মিথ। বাঙালি সংস্কৃতিতে বাস করে একজন কট্টর বাঙালির চর্চিত বিশ্বাস ফ্যাকচুয়াল আর পাশাপাশি আরব, তুর্কি, ইরানী কিংবা অন্য যেকোনো সংস্কৃতির বিশ্বাস তখন নমিনাল। নবি মুহম্মদ সা. এর সবচেয়ে বড় সফলতা ছিলো এইখানে। তিনি গোত্রীয় বহু বিভাজিত মিথকে কা’বাকেন্দ্রিক একটি মিথ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছেন। প্রত্যেকটা মহাপুরুষ মূলত এইকাজটাই করেন। আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞান তাঁর নিজস্ব মিথ দিয়ে সেই কাজগুলোই করছে, মধ্যযুগে যা ধর্ম করতো।
যাইহোক, ফ্যাকচুয়াল এবং নমিনাল উভয় মিথকে সামনে দাঁড় করালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়-

  1. ঘটনার চরিত্র অন্যান্য গল্প থেকে আলাদা। প্রায়শ মিথগুলোতে কোনো দেবতা, উপদেবতা কিংবা অপদেবতা জড়িত থাকে। একে বরং আরেকটু আধুনিক করে বলা যেতে পারে। মিথে সংশ্লিষ্ট চরিত্রের দেবতাকরণ করার প্রয়াস থাকবে। পীর-ফকির কিংবা জাতীয়তাবাদী নেতার কাল্ট আমরা অনায়াসে সামনে আনতে পারি উদাহরণ হিশেবে।
  2. একটা সংস্কৃতিতে লালিত বিশ্বাস এবং পবিত্র কিছুর ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয় মিথে। এখানে পবিত্র মন্ত্র বা শব্দ, পবিত্র কাজ বা ইবাদত এবং পবিত্র স্থান- এই তিনটির যেকোনো একটি থাকবে। নবজাতক শিশুর পিতা যখন ধর্ম কিংবা রাষ্ট্র যখন সংবিধান হাজির করে, তা পবিত্র আর আজীবন মান্য হিশেবেই আসে। সত্যযুগে ভারতের কোন অঞ্চলে কোন ইবাদতের চর্চা হতো, তা পরের বিষয়। প্রায়োর হলো- বর্তমানে কি চর্চিত হচ্ছে। মিথ দুটোই।
  3. সাধারণ গল্পগুলো আমাদের একটা নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ে যায়। অনেকটা Once upon a time দিয়ে শুরু হবার মতো। কিন্তু মিথ নিয়ে যাবে সময়ের শুরুতে। যেমন বাইবেলের জেনেসিস বলছে- “In the beginning, God created the heavens and the earth.”
  4. মিথ তর্ক করবে না। শুধু উপস্থাপন করবে। অর্থাৎ যুক্তি প্রমাণের তোয়াক্কা নেই। কেউ গ্রহণ করতে চাইলে একে মেনেই গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ মিসরীয় খেপরি পুরাণের উক্তি তুলে ধরা যায়- I spat out what was shu, and I sputtered out what was tenfut.
  5. সময়ের আগ্রাসী স্রোত, পরিস্থিতির টানাপোড়েন- তবু যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা মিথগুলো মূলত সাক্ষ্য দেয় তাদের Extraordinary authority -এর। ব্যাখ্যাগুলো কেউ তৈরি করে নি। স্বর্গীয়ভাবে মানব সমাজে প্রোথিত। এটা মিথের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।

মিথোলজি হচ্ছে কোনো একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি বা সভ্যতায় চর্চিত মিথগুলোর সামগ্রিক রূপ। সে হিশেবে ইণ্ডিয়ান মিথোলজি বলতে বুঝায় ভারতীয় সভ্যতায় বিরাজিত সমগ্র মিথ। রামের সীতা উদ্ধারের আখ্যান এবং পাণ্ডবদের কৌরববধের আখ্যান দুটি আলাদা মিথ। কিন্তু দুটোই ইণ্ডিয়ান মিথোলজির অন্তর্ভুক্ত। মিথোলজির অপর সংজ্ঞা- মিথকে পাঠ করবার বিদ্যা। প্রাচীন গ্রীস থেকে আধুনিক যামানা পর্যন্ত নানা রঙে নানাভাবে মিথের তর্জমা-তাফসির হচ্ছে। প্লেটো বা তাঁর আগে থেকে লেভি স্ত্রাউস, ইয়াং, মির্চা এলিয়াদ এবং যোসেফ ক্যাম্পবেল হয়ে আজ পর্যন্ত মিথ পাঠ করার যে কাঠামো তৈরি হয়েছে, তাঁর পরিধি কম না। অজস্র পণ্ডিতের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বগলে করে গড়ে উঠা এই শাস্ত্রই মিথোলজি। এর মানে এই নয় যে- মিথের পাঠ আমাদের পৌরাণিক সময়ের সাঁকো দিয়ে হাঁটাবে। অবশ্যই মিথোলজির পাঠ কল্পনার জগত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা দেয়। মিথোলজির অধ্যয়নের জন্য সিম্বল নিয়েও ঘাটাঘাটি তাই জরুরি। কিন্তু তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো- মিথের পাঠ আমাদের সক্ষম করে তোলে বর্তমানে প্রচলিত মিথকে সনাক্ত করতে। আবারো স্মরণ করাতে চাই, মিথ বলতে আমরা সত্য বা মিথ্যা বলছি না। মিথ সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা।

লেখক পরিচিতি :
আহমেদ দীন রুমি
লেখক,
চিন্তাবিদ
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *