Muhammad Asad: World-Muslim personality and mind

যখন থেকে মুহাম্মাদ আসাদ ইসলাম, মুসলিম বিশ্ব, সমাজ ও মানস সম্পর্কে জানতে, বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছিলেন তা ছিল এখন থেকে ঠিক একশ বছর আগে ১৯২০ এর দশকের প্রথমে । সেই সময়টা ছিল মুসলিম বিশ্বের একটা ক্রান্তিলগ্ন, একটা যুগান্তকারী আবার নবযুগের সূচনালগ্ন। মুসলিম বিশ্বে তখন মুটামুটি চারটা ধারার ঘাত-প্রতিঘাত চলছিল। প্রথমতঃ কয়েশ বছরের ইউরোপীয় উপনিবেশের শৃঙ্খল থেকে মুসলিম বিশ্বের বের হব হব ভাব; দ্বিতীয়তঃ মুসলিম-বিশ্বের সর্বশেষ সাম্রাজ্য ওসমানীয় খেলাফতের তখন পতনোন্মুখ পর্যায়; তৃতীয়তঃ মুসলিম-বিশ্ব জুড়ে ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের প্রচন্ড শক্তিশালী ঢেউয়ের প্রবাহ; এবং চতুর্থতঃ মুসলিম আত্ম-পরিচয়ের জিজ্ঞাসার প্রশ্ন। এ সকল ধারাগুলো ঠিক সমান্তরালে সমসাময়িকতার আবহে আবদ্ধ ছিল। আর এর প্রতিটার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিল ইসলাম একটা সর্বোপরি পরিচয়ের মোড়ক হিসেবে। মোটাদাগে বলা যায় ইসলাম, মুসলিম-বিশ্ব, মুসলিম সমাজ একটা চরম যুগ-সন্ধিক্ষণের মুখোমুখী ছিল।
এমন একটা সময়ে মুসলিম-বিশ্বের চিন্তার জগতে উন্মেষ ঘটে মুহাম্মাদ আসাদের । তবে ব্যাপারটা এমন নয় যে ওই সময়ে মুসলিম-বিশ্বে ইসলামী চিন্তাবিদের নিতান্তই ঘাটতি ছিল। মুসলিম-বিশ্বে ইউরোপীয় অমানিশার যখন শেষ প্রহর তখন ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব নিয়ে গ্রান্ড চেতনার উন্মেষ ঘটেছে জামালুদ্দীন আফগানী ও মুহাম্মাদ ইকবালের চিন্তাধারায়। ইসলাম ও মুসলিম-বিশ্বকে বৈশ্বিক দৃস্টিকোণ থেকে এঁদের থেকে বেশী আর কেউ তখন দেখেনি। এঁদের চিন্তা ও মানসের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে অসেন সাইয়েদ আবুল- আলা মওদুদী, হাসান আল্-বান্না ও সায়্যেদ কুতুব শহীদ । তবে এই প্রজন্মের ইসলামী চিন্তাবিদরা তখনো মাত্র প্রকাশমান; পুরোপুরি প্রকাশিত নন। মুসলিম-বিশ্বে ও ইসলামী চিন্তাজগতে মুহাম্মাদ আসাদের প্রবেশের যুগ ওই সকল চিন্তাবিদগনের সমসাময়ীক, তবে তাঁদের হাত ধরেও না বা তাঁদের দ্বারা উৎসাহিত হয়েও না। একটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী প্রেক্ষিত ও ধারার প্রবাহে মুহাম্মাদ আসাদের আগমন, বিচরণ ও অবদান। এটাই মুহাম্মাদ আসাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যার বিষয় ।

মুহাম্মাদ আসাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্মেষ:

জীবনী পর্যালোচনান্তে এটা পরিষ্কার যে পূর্ব ইউরোপের অভিজাত ইহূদী পরিবারে জন্ম হলেও মুহাম্মাদ অসাদ এর ব্যাক্তি-মানস ছিল বাল্যকাল থেকেই প্রথাবিরোধী ও বিদ্রোহী ধাঁচের। আপন মনোলোকের মুক্তাকাশে মুহাম্মাদ আসাদের দৃষ্টিসীমা ছোটকাল থেকেই অবারিত প্রান্তরের বাইরে ঘুরে বেড়াতো। এই ধারাবাহিকতায় মুহাম্মাদ আসাদের স্কুল পালিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া কিংবা পিতাকে অগ্রাহ্য করে প্রায় শূন্যহাতে চিরদিনের জন্য গৃহত্যাগ অজানা পৃথিবীর পথে- এসবই তাঁর ভবিষ্যৎ বিশ্ব-মানসের প্রেক্ষাপট।
গৃহত্যাগী মুহাম্মাদ আসাদ বৃহত্তর জার্মান সমাজের যে অবর্তে যেয়ে পড়লেন বা যে গণ্ডিতে পদচারনা করতেন সেখান থেকেই ব্যক্তি আসাদের মনোজগতের উন্মেষ। আত্ম-শক্তি, মনোবল, দূরদর্শিতার বলিষ্ঠ উপাদান- নিয়ে তখন থেকেই আত্মানুসন্ধানের একটা অদম্য উৎসাহ তাঁকে উদ্বেলিত রাখতো। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্ঘবলয়ে বিভিন্ন বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা-পর্যালোচনার আসর আসাদের আত্মানুসন্ধানের তেষ্টা মেটাতে সক্ষম হতো না। তাঁর অতৃপ্তির মাত্রা ক্রমাগত চরম নিরাশার দিকে ঠেলে দিত। উনবিংশ শতাব্দির শেষ তিন ও বিংশ শতাব্দির প্রথম তিন দশকে ফরাসী ও জার্মান সমাজে একঝাঁক দুর্ধর্ষ উত্তোরাধুনিক দার্শনিকের আবির্ভাব হয় যাঁদের চিন্তা-চেতনা ইউরোপীয় সমাজ ও মানস কে চরম ভাবে নাড়া দিয়েছিলো। এঁরা তৎকালীন ফরাসী-জার্মান বুদ্ধিবৃত্তিক মানস ও সমাজ গঠনে প্রচন্ডভাবে প্রভাব ফেলেছিলো। ইউরোপের মহাদেশীয় দর্শন রেনেসাঁ যুগ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ধারায় ভর করে এত বেশী পরিমাণ সেক্যুলার হয়ে গেল যে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে খোদাকে একদম মৃত ঘোষণা করলো। জার্মান-ফরাশী উত্তোরাধুনিক দর্শনে খোদার বিকল্পে মানুষ নিজেই হলো সর্বেসর্বা। কিন্তু তখন এই দর্শন নতুন একটা অভ্যন্তরীণ প্রশ্নের সন্মুখীন হলো- খোদা মৃত, মানুষ সর্বেসর্বা; কিন্তু এরপর কি? এ প্রশ্নের উত্তরে নৈরশ্যবাদের মত একটা নতুন ধারণার জন্ম দিলো বটে কিন্তু তারপরও সমাধান হলো না। নতুন করে প্রশ্ন উঠলো- মানুষের মৃত্যু অপরিহার্য্য, অবশ্যম্ভাবী; পরজীবন অলীক, তাহলে এই জীবনকালে জীবনের গূঢ়তত্বকে বা অর্থকে কিভাবে বুঝা যাবে বা সংজ্ঞায়িত করা যাবে ?

এটাই ছিলো ওই সময়ের ফরাসী-জার্মান দর্শনের মূল উপজীব্য বিষয় । এ প্রশ্নের উত্তর উপস্থাপন করার প্রচেষ্টায় তৎকালীন উত্তোরাধুনিক দর্শন চরম ও দূর্বোধ্য ভাব বিতর্কে নিমজ্জিত হলো। তবে মোটামুটিভাবে যে একটা সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো সেটা হচ্ছে- আত্মোপোলব্ধি পারিপার্শিক উপাদানের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ ব্যাক্তি-নির্ভর । মৃত্যু যেহেতু অবধারিত তাই এই জীবনকে নিজের স্বাধীনতা মত ভোগ করাই হলো জীবনের অর্থ । নিরেট বস্তুবাদিতা আর লাগামহীন ভোগবাদিতাই হলো জীবনের অর্থ। আক্ষরিক অর্থেই তৎকালীন জীবনে এটার প্রতিফলনও ছিলো। মাদক, নেশাগ্রস্থতা, যৌণ-স্বেচ্ছাচারিতা, ধর্মহীনতা ও বামরাজনৈতিক মতাদর্শ- এসবই ছিলো তাঁদের দার্শনিক ও বাস্তব জীবনের সংমিশ্রণ । ক্রমান্বয়ে ধর্মহীনতা, শিল্প-বিপ্লবজাত ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্য্যতা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যতা ইউরোপীয় সমাজকেও সেরকম উদ্দেশ্যহীন ও চরম ভোগবাদী করে তুলেছিলো।
ব্যক্তি আসাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙির বৈপ্যরিত্য ছিলো ঠিক এখানেই। সমকালীন ফরাসী-জার্মান দর্শন ও চরম ভোগবাদিতার অর্থ ও সমাজনীতি আসাদকে জীবনের কোন অর্থ জোগান দিতে পারেনি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি জীবনের সে অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন ইউরোপীয় বৃত্তের বাইরে এসে- আরব মরুর ধুসর প্রান্তরে, নির্মল দৃপ্ত অবারিত মরুর আকাশে, প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা সহজ সরল বেদুইনের তাঁবুতে, তাঁদের সহজ-সরল জীবনধারা অথচ বিশ্বাসে ভরা অসীম অকাশ ও আদিগন্ত প্রান্তরের মত বিশাল হৃদয় ও স্বচ্ছ চোখের গভীর দৃষ্টিতে।

মজার ব্যাপার হলো, মুহাম্মাদ আসাদ আরব বিশ্বে এসেছিলেন ইসলামের টানে তো নয়ই, যেহেতু তিনি ইসলাম জানতেন না, এবং ইসলামকে জানতেও না। একান্ত দৈবিক কারণে জেরুজালেমে তাঁর চাচার আমন্ত্রনে আগমনটা ইউরোপের বাইরে একটা নতুন বিশ্বের সাথে পরিচয় যেখানে জীবনের স্পন্দন আছে। সেই জীবন আর সৌন্দর্যতাকে সাংবাদিকতার মাধ্যমে জার্মান সমাজে পরিবেশন করতে যেয়ে আসাদ নিজেকে আবিস্কার করেছিলেন ইউরোপীয় বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও নৈরাশ্যবাদের বিপরীতে এক নতুন স্বত্বা হিসেবে। সময়ের বিবর্তনে এবং আরব মরু ও মুসলিম বিশ্ব পরিক্রমায় কখন তিনি নিজেকে মনের অজান্তে ইসলামে সপর্দ করে এক ভিন্ন পরিচয়ের সন্ধান পেয়েছিলেন সেটা বুঝেছিলেন আরো পরে সেই ইউরোপের মাটিতে ফিরে যেয়েই। এখানে এই প্রেক্ষাপটের অবতারনা ব্যক্তি আসাদের মনোজগতের ক্রমবিকাশের পরিচয় তুলে ধরার জন্য। কারণ আগেই বলা হয়েছে যে তৎকালীন ইউরোপীয় উত্তোরাধুনিক দর্শন যুবসমাজ, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ তথা তরুণ আসাদকে নির্ভরযোগ্য কোনো জীবন-দর্শন বাতলাতে ব্যর্থ হয়েছিলো।

মুহাম্মাদ আসাদের ইসলামী চিন্তাধারার ধরণ:

মুহাম্মাদ আসাদ জীবন, সমাজ, ও ধর্মকে দেখ্তেন বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে । এ কারণে তিনি ক্ষুদ্রক্ষুদ্র বিষয়ে বিশ্লেষণে যেতেন না। তিনি ইসলামকে দেখতেন সভ্যতার আলোকে। তাঁর মূল্যায়নে পাশ্চাত্য সভ্যতা ছিলো চাকচিক্যময় মোড়কে সমৃদ্ধ, এর ভেতরটা নিতান্তই ফাঁপা, আত্মাহীন। কিন্তু তা সত্বেও পাশ্চাত্য বেশ সৃজনশীল; যদিও এই সৃজনশীলতা আধ্যাত্মিকতাকে পোষণ ও লালন না করে বরং হত্যাই করেছে। তবে এই সৃজনশীলতার কারণে এ সভ্যতা দুনিয়াব্যাপী আধিপত্য করতে সক্ষম হয়েছে। আর তাঁর মতে এ আধিপত্যের একটা মৌলিক উপকরণ হলো একমুখী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ।

দৃশ্যতঃ প্রাথমিক পর্যায়ে মুহাম্মাদ আসাদ বেদুইন আরবদের সামাজিক, ধর্মীয় ও মানবিক সরলতাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তঃস্বারশূণ্যতার বিপরীতে প্রচণ্ড রকমের পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক বিকল্প হিসেবে বুঝেছিলেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে একজন মুসলিম হিসেবে যখন বিশ্লেষণে গেলেন তখন বুঝলেন যে, ইসলামের ভেতর যে চিরসত্যের চিরঞ্জীব প্রাণ আছে সেটা মুসলিম বিশ্ব-সমাজে প্রতিফলিত নেই। তাঁর মতে দুনিয়াতে ইসলামের উপস্থিত থাকা উচিৎ একটা সভ্যতার শক্তি হিসেবে, যে সভ্যতা হবে ক্রমাগত সৃজনশীল । অতীতে ইসলামী ও মুসলিম সভ্যতার এ দুটো গুণাগুণ খুবই শক্তিশালী ছিলো। তাই ইসলামকে ফিরে যেতে হবে সেই সভ্যতার দিকে। তাঁর মতে সেখানে ফিরে যেতে হলে মুসলিম সমাজকে ফিরতে হবে কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক শিক্ষা ও খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন্ত ও প্রায়োগিক মডেলে। কিন্তু মুহাম্মাদ আসাদ যথেষ্ঠ মুক্তমনা। ইউরোপীয় ধারায় গড়ে ওঠা তাঁর মুক্তপ্রবৃত্তির দৃষ্টিভঙ্গি এখানে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। মুহাম্মাদ আসাদ যখন বলেন যে ,মুসলিম সমাজকে কুরআন-সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের বা অতীত ঐতিহাসিক সভ্যতার দিকে ফিরতে হবে তখন তিনি এটা নির্দেশ করেন না যে সেই মধ্যযুগের সমাজ-ব্যবস্থার অবিকল নকলের প্রবর্তন করতে হবে। বরং তিনি যেটা বুঝাতে চান সেটা হলো ওই অতীত যুগের বিশ্বাস, আত্মশক্তি আর সৃজনশীলতার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে। তার অর্থ হলো কেবল মাত্র কুরআন ও সুন্নাহ-ই আজকের ইসলামী সভ্যতার ও এর সৃজনশীলতার মূলভিত্তি। কারণ আজকের সময় ও সমাজ কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক এমন একটা কাঠামো দাবী করে যেটা ইসলামের অতীত ইতিহাসে নাও পাওয়া যেতে পারে।

লক্ষ্যণীয় যে, মুহাম্মাদ আসাদ ইসলামকে চিন্তা করছেন পাশ্চাত্য সভ্যতার বিকল্প একটা সভ্যতা হিসেবে। আর এ কারণেই তিনি সৃজনশীলতার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আর ইসলামী সভ্যতাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপরীতে পরিপূর্ণ, শক্তিশালী ও যুক্তিযুক্ত এ কারণেই বলেছেন যে, ইসলামে জীবন ও জগতের একটা সুস্পস্ট লক্ষ্য আছে। সেটা হলো, এই জাগতিক জীবনকে জাগতিকতার মধ্য দিয়েই আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ দ্বারা মহান আল্লাহর প্রতি নিবেদিত করা, আর পরকালীন জীবনে পরমাত্মার সাথে সন্তষ্টচিত্তে মিলিত হওয়া। এখানে মুহাম্মাদ আসাদ ইউরোপীয় উত্তোরাধুনিক দর্শনকে ছাড়িয়ে মৃত্যুকে জয় করে ইহজীবন ও পরজীবনের মধ্যে সেতু-বন্ধন রচনা করেছেন। এভাবেই তিনি জীবনকে পূর্ণরূপে সংগায়িত করেছেন । এভাবেই তিনি ইসলামের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে, ইসলামী সভ্যতার পুনরুজ্জীবনের পক্ষে, এবং ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তা-চেতনার পুনরুজ্জীবনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলেন।
অতএব এটা হয়তো বলা যুক্তিযুক্ত হবে যে, মুহাম্মাদ আসাদ যখন এহেন মতধারা গড়ে তুলছেন ততদিনে তিনি স্পষ্টভাবে বুঝেছেন যে বিগত দশকে আরব মরুতে বেদুইনের তাঁবুতে যে ইসলাম তিনি দেখেছিলেন সেটা সভ্যতার শক্তি হিসেবে তো নয়ই বরং রাষ্ট্রশক্তি হিসেবেও খুবই দুর্বল। তাঁর চোখের সামনেই ওসমানীয় খেলাফত ভেঙে যে রাষ্ট্রের জন্ম নিলো আধুনিক তুরস্কে চরম উগ্রবাদী সেক্যুলারিজমের উপর ভিত্তি করে তাতে মুহাম্মাদ আসাদের মনে ইসলামী পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তা আরো বদ্ধমূল হয়েছে ।

মুহাম্মাদ আসাদ ইসলামী সভ্যতার পুনরুজ্জীবনকে তিনটা মৌলিক কাজের সমাহার বলে ভেবেছিলেন। প্রথমতঃ কুরআন ও সুন্নাহ-এর মৌলিক শিক্ষার দিকে ফিরে যাওয়া; দ্বিতীয়তঃ মুসলিম বিশ্বে শিক্ষা সংস্কার; এবং তৃতীয়তঃ ইসলামী জ্ঞানের বা চিন্তার পুনর্গঠন । কুরআন ও সুন্নাহ্ -এর ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হলো এ দুটো উৎস থেকেই মৌলিক ও চিরন্তন মূলনীতিকে বের করে আনতে হবে, যেটার উপর দাঁড় করানো হবে পুরো ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি। মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা সংস্কারটা তিনি সৃজনশীলতার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন এইভাবে যে, পাশ্চাত্য থেকে বিজ্ঞান-ভিত্তিক আধুনিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে কিন্তু তাদের জীবনধারাকে গ্রহণ করা যাবে না। মুসলিমদেরকে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক নিজস্ব স্বকীয়তা ধরে রাখতে হবে। আরো বৃহদার্থে বললে, পশ্চিমের ভোগবাদী ও ধর্মহীন আবর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যাবে না। সবশেষে, ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠনের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হলো আধুনিক বা সমকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক নতুনতর শারিয়াহ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

এদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বলা যায় মুহাম্মাদ আসাদ আসলে নতুন কিছু বলেননি। উপরে যে তিনটা মৌলিক ব্যাপারে বলা হলো সেসব ব্যাপারে মুসলিমবিশ্বে ততদিনে অনেকেই একই ধারণা পেশ করেছেন । ইতোপূর্বে জামালুদ্দিন আফগানী, মুহাম্মাদ আব্দুহ এমন পুনর্গঠনমূলক ধ্যানধারণা নিয়ে আন্দোলন করেছেন; তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে মুহাম্মাদ আসাদের অগেই পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনমূলক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন মুহাম্মাদ ইকবাল, আবুল `আলা মওদূদী ও কাজী নজরুল ইসলাম । তবে আসাদ ও মওদূদীর ভেতর মিল হলো তাঁরা দু’জনেই বাস্তবিকভাবে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনে সরাসরি প্রচেষ্টা করেছেন । উপমহাদেশে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ভবিষ্যৎ পাকিস্তান ইসলামী রাস্ট্র আধুনিকতার আলোকে কেমন হওয়া উচিত তার রূপরেখা তাঁরা দু’জনেই পেশ করেছেন। আধুনিক বিশ্বে তৎকালীন সময়ে আধুনিক ইসলামী রাস্ট্রের কাঠামো নিয়ে এত বিস্তারিত এঁদের দু’জন ছাড়া আর কেউ পেশ করতে পারেনি । যদিও তাঁদের পেশকৃত কাঠামো ছিলো খুবই মৌলিক এবং অসম্পূর্ণ। উদহরণস্বরূপ বলা যায়, তাঁরা মূলতঃ সার্বভৌমত্ব, নির্বাহী, আইন প্রণয়ন ও বিচার-ব্যবস্থা সম্পর্কেই বলেছেন। মুহাম্মাদ আসাদ নাগরিকত্বের ব্যাপারটা পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়েছেন যার কারণে অমুসলিমদের ব্যাপারে তাঁর মতামত অব্যক্ত থেকেছে, অথচ এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। আবার মওদূদীর পর্যালোচনায় অমুসলিম নাগরিকদের ব্যাপারে নতুন কিছু নেই। তবে তাঁরা দু’জনেই ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠনে ও কুরআন-সুন্নাহর প্রতিরক্ষায় ধারালোভাবে কলম চালিয়েছেন। মওদূদী উপমহাদেশীয় গণ্ডিতে আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জকে সাহসিকতার সাথে ক্ষুরধার যুক্তির মাধ্যমে মোকাবিলা করেছেন, আর মুহাম্মাদ আসাদ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে করেছেন সেই একই কাজ।

তবে মুহাম্মাদ আসাদের একটা অলাদা বিশেষত্ব আছে যেটা মুসলিম বিশ্বের অন্য কোন চিন্তাবিদের ছিলো না। সেটা হলো মুহাম্মাদ আসাদের জন্মগতভাবে ইউরোপীয় হোয়াইটম্যান হওয়া, পশ্চিমা জগতে তাঁর সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ হিসেবে জনপ্রিয়তা, ও উচ্চমানের ইংরেজীতে লেখনী সরাসরিভাবে পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে প্রবেশ করতে পারা। যেহেতু তিনি পশ্চিমা জগতের নিজস্ব ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন তাই সরাসরিভাবেই তাঁর চিন্তা-চেতনাকে বিশ্বদরবারে পেশ করতে পেরেছেন নির্বিঘ্নে। অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের পন্ডিতেরা নিজেদেরকে পেশ করেছেন নিজেদের ভাষায়। আসাদের সমসাময়িক মুসলিম মনিষীরা যেমন হাসান- আল্-বান্না, সায়্যেদ কুতুব শহীদ লিখেছেন আরবী ভাষায়; ইকবাল ও মওদূদী লিখেছেন ফার্সি ও উর্দুতে; কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন বাংলাতে। নিজস্ব ভাষায় প্রত্যেকের কর্ম অতি উচ্চমানের হলেও মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য এলাকায় তাঁদের সেসব কর্ম অপরিচিত ও অজানাই থেকে যায়; আর পশ্চিমা বিশ্বের জন্য় সেসব থেকে যায় অপ্রাসংগিক ও অবান্তর। ইংরেজী অনুবাদের মাধ্যমে যেটুকু বা পশ্চিমাবিশ্বে পৌঁছুতে পেরেছে সেটাও অপেশাদারীত্ব ও অপশ্চিমী লেখক-অনুবাদকের নামের কারণে পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক মহলের মনযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রথমতঃ পশ্চিমা পণ্ডিতেরা মুসলিম লেখকদের লেখনীতে আকৃষ্ট হন না; দ্বিতীয়তঃ এসব চিন্তাবিদদের লেখনী পশ্চিমী ভাষায় অনূদিত হলেও যদি যথেষ্ঠ যুক্তিপূর্ণ ও বিশ্লেষণধর্মী না হয় তাহলে পশ্চিমারা কেও এসব ঘেঁটে দেখতেও রুচিবোধ করবেন না। সায়্যেদ কুতুব বা মওদূদীর বিশ্লেষণ বিশ্বমানের হলেও তাঁদের সাহিত্যকর্মের ইংরেজী অনুবাদ নিতান্তই অপেশাদার ও ভাষাগতভাবে উচ্চমার্গের নয়। শুধুমাত্র ইকবাল গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন তাঁর নিজস্ব পান্ডিত্য, পশ্চিমী ভাষাতেই তাঁর দখল ও নিজস্ব কিছু লেখনী এবং পশ্চিমাদের দ্বারাই তাঁর সৃষ্টির অনুবাদ কর্মের কারণে। মুহাম্মাদ আসাদের এই সীমাব্ধতা একেবারে তো নেই-ই, বরং তাঁর পরিবেশনা অনেক পশ্চিমী পন্ডিতকেও ছাড়িয়ে যায়। তবে এটা বলা একদম অত্যুক্তি হবে না যে, মুহাম্মাদ আসাদই এযাবত কালের পশ্চিমে জন্মানো একমাত্র হোয়াইট মুসলিম যিনি সাবলীলতার সাথেই পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক ও পন্ডিত সমাজে প্রবেশ করতে পেরেছেন। ইসলামকে জেনে বুঝে গ্রহণ করে এটাকে চরম বৈরী পশ্চিমা সমাজ ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে উপস্থাপন করতে তাঁর সমকক্ষ আর কেও নেই। এই কারণেই আরেক জার্মান হোয়াইট মুসলিম মুরাদ হফ্ম্যান মুহাম্মাদ আসাদকে বলেছেন ইসলামের প্রতি ইউরোপের সর্ব্বোৎকৃষ্ট উপহার। মুরাদ হফ্ম্যান আসলেই অত্যুক্তি করেননি মোটেও।

মুসলিম বিশ্বে মুহাম্মাদ আসাদের এ্যডভেঞারের একশ বছর পর আজকের মুসলিম বিশ্বে ও সমাজে মুহাম্মাদ আসাদ ও তাঁর ইসলামী চিন্তা-চেতনা কি প্রাসাংগিকতা হারিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, প্রাসাংগিকতা তো হারাইনি বরং আরো বেড়েছে। বিগত একশ বছরে মুসলিম বিশ্ব জাতীয়তাবাদের দাপটে ছিন্নভিন্ন হয়েছে; অধিকাংশ মুসলিম জাতীরাষ্ট্রে উগ্র বা অনুগ্র সেক্যুলারিজম শিকড় গেড়েছে; পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আধুনিক পশ্চিমা জীবন যাপন ও ভোগবাদী আচার জনপ্রিয়তা পেয়েছে; এবং সর্বোপরি ইসলামী ও মুসলিম পরিচয় ও সৃজনশীলতা লোপ পেয়েছে আরো প্রকটভাবে। এসবই সেই সব মৌলিক বিষয় যেগুলো মুহাম্মাদ আসাদ ১৯৩০ এর দশক থেকেই সংস্কারের পক্ষে কাজ করেছেন। আশার কথা হলো যে প্রায় প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রেই ইসলামপন্থী ও সংস্কারপন্থীদের উপস্থিতিও এখন দৃশ্যমান যাঁদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মুহাম্মাদ আসাদের চিন্তা-চেতনার সাথে সমার্থক। সুতারাং ইসলামী রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতার পুনরুজ্জীবনে মুহাম্মাদ আসাদের প্রস্তাবিত চিন্তা-কাঠামো শুধু প্রাসংগিক তাই না বরং পথ প্রদর্শকও। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, চিন্তার পুনর্গঠনে মুহাম্মাদ আসাদ যেখানে থেমেছেন সেখান থেকে সামনে আরো বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই বর্তমান ইসলামী প্রজন্মের দায়ীত্ব। আর এটাকেই মুহাম্মাদ আসাদ বলেছেন ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও শরীয়তের চিরন্তন গতিশীলতা।


গ্রন্থ সহায়ক:

  1. Muhammad Asad. Islam at the Crossroads, Gibraltar: Dar al-Andalus, 1982.
  2. Muhammad Asad. The Principles of State and Government in Islam, Kuala Lumur: Islamic Book Trust, 2007 (reprint).
  3. Muhammad Asad. The Road to Mecca, New York: Simon and Schuster, 1954.
  4. Murad Hoffman. Muhammad Asad: Europe’s Gift to Islam, Islamic Studies, Vol. 39, No. 2 (Summer 2000), pp. 233-247.

লেখক পরিচিতি:
ড. মু. মনিরুজ্জামান
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালেশিয়া

তথ্য সূত্র- মুহাম্মদ আসাদ :বাংলাদেশের অভিবাদন
সম্পাদনা: ফাহমিদ-উর-রহমান(প্রকাশিতব্য)

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *