Revolutionary changes in the social system

সমাজ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর দুইভাবে করা যায়:

১. বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে সমাজিক রূপান্তর।
২. সমাজ ও ঐতিহ্যকে বর্জন করে নতুনভাবে সবকিছু করার মধ্য দিয়ে সামাজিক রূপান্তর।তবে এটার সাথে জড়িত সহিহ মুসলিম প্রকল্প ।
প্রথমটা বাস্তবসম্মত, সহজসাধ্য ও কার্যকরী। অপরদিকে দ্বিতীয়টা কঠিন, অলিক ও অকার্যকর পন্থা। দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলমানরা দ্বিতীয় পন্থাকেই সামাজিক রূপান্তরের পথ হিসাবে বেছে নিয়েছে বলে তাদের কর্মকান্ডে লক্ষনীয়।

আসুন বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবি ও কিছুটা ব্যাখ্যা করি।
মুসলমানদের মধ্যে একটা পিউরিটান প্রবণতা হলো তাদের নিজেদের কল্পিত “সহিহ মুসলমান” না হলে এবং কারো চিন্তার সাথে নিজের চিন্তা সম্পূর্ণ না মিললে তাকে বর্জন করা। তার কাছ থেকে কিছু নেয়া যাবেনা, তার বই পড়া যাবেনা, তার অবদান স্বীকারও করা যাবেনা। এই হলো মোটের উপর মনস্তত্ত্ব।
ফলে মুসলমানরা ধ্রুপদী যুগের বাঘা বাঘা চিন্তকদের বর্জন করেছে এবং গ্রহণ করেছে তাদের যাদের চিন্তা সংকীর্ণ ও এক্সক্লুসিভ। যারা সবাইকে ধারণ করতে পারে না।

তবে যারা ইনক্লুসিভ বা সবাইকে নিয়ে চিন্তা করেছে, জগত জয়ের স্বপ্ন দেখেছে, যাদের চিন্তায় দল, মত, ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে সকল মানুষ স্থান পেয়েছে, তাদেরকে বর্জন করা হয়েছে কিংবা করা হয়েছে কোনঠাসা। ফতোয়া দিয়ে তাদেরকে মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নও করা হয়েছে।
ফলতঃ মুসলমানদের সামগ্রিক চিন্তা হয়েছে সংকীর্ণ ও দলাদলিতে বিভক্ত।
ঐতিহ্যকে বর্জন করার ফলে তারা হয়েছে শেকড় বিচ্ছিন্ন। ফলে তাদেরকে সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে হচ্ছে ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংগীত চর্চায় মুসলমানদের সমৃদ্ধ অতীত রয়েছে। মুসলমান সংগীতে নতুন জনরা, এমনকি, নতুন বাদ্যযন্ত্রও তৈরী করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মুসলিম সমাজে সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায় না।
বাংলা গানের কথায় ধরুন, বাঙলার বাউল, জারি, সারি, ভাটিয়ারী, কাওয়ালী অর্থাৎ লোক সংগীতে ইসলামী উপাদান ও তাদের ধর্মসাধনা সাধারণ জনগণের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে যুগের পর যুগ।
কিন্তু একদল এসে বলল, বাদ্যহীন গানই শরিয়ত সম্মত গান। ফলে তারা প্রচার করতে লাগল বাদ্যসহ গান হারাম। যারা গানবাজনা করে তারা জাহান্নামী।
তারা বর্জন করলো লালন, নজরুল, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম কিংবা আব্বাসউদ্দীনের ঐতিহ্যবাহী গানের ধারাকে।
আর নিজেরা তৈরী করল সমাজবিচ্ছিন্ন পিউরিটান ধারা। জুব্বা পাঞ্জাবী পরে বাদ্যবিহীন হামদ, নাত এবং জেহাদী চেতনার গানে তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ করে তুললো ।

যারা বাদ্যসহ গান করেন তাদেরকে অপর করে দিয়ে নিজেরা মানসিক আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে লাগলো যা সংগীতে মুসলমাদেরদের কয়েক যুগ পিছিয়ে দিল।
সিনেমা ও নাটকের বেলায়ও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। নাটক সিনেমা অভিনয় যারা করেন তাদের বিরুদ্ধে চলতে থাকল ফতোয়ার স্ট্রিমরোলার। তাদেরকে বলা হলো জাহান্নামী। ফলে তারাও ভাবল, যেহেতু আমরা জাহান্নামী, সুতারাং যা ইচ্ছা তাই করবো। তারা বানাতে শুরু করলো অশ্লীল সিনেমা এবং সিনেমায় ব্যবহার করলো সমাজবর্জিত কৃষ্টি। ফলতঃ সময়ের ব্যবধানে তাদের সিনেমাও মুখ থুবড়ে পড়লো। ক্ষতিটা হলো দেশের।

আর এদিকে সহীহ মুসলমানরা নাটক সিনেমার নামে রচনা করে চলল কুপমন্ডুকতা। নারীদের ছাড়াই বানানোর চেষ্টা করল নাটক-সিনেমা। যেন মধ্যযুগের ইউরোপ যেখানে নারীদের অভিনয় পুরুষরা করতো। ফলে সেটাও গোড়াতেই ব্যর্থ হলো।
তারা একবারো চেষ্টা করল না বিদ্যমান নাটক-সিনেমা কিংবা সংগীত শিল্পীদের সাথে নিয়ে ইতিবাঁচক ও বৈপ্লবিক কিছু করার। কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা করলেও সেটা সফল হলোনা।
বিদ্যমান শিল্পীদের কাজে লাগিয়ে তারাও পারতো “দিরিলিস অার্তুগ্রুলের” মতো বাংলার মুসলমানদের ঐতিহ্যের উপর সিনেমা কিংবা ড্রামা সিরিজ বানাতে।
কিন্তু তা না করে তারা অভিনেতা অভিনেত্রীদের জাহান্নামে পাঠালো।
তারা যে সিনেমা নির্মাতা কিংবা অভিনয় শিল্পীদের জাহান্নামে পাঠিয়েছে, তারা কি তাদের সাথে একান্তে দেখা করে কখনো কথা বলেছে। তাদেরকে অশ্লীলতা বর্জন করে সুন্দর, পারিবারিক ও প্রাত্যতিক এবং ঐতিহ্যগত ইসলামের উপাদান নিয়ে সিনেমা বানাতে কখনো বলেছে কি!

পতিতালয়ের বিরুদ্ধে হাজারো ফতোয়া দিয়েছে মৌলবীরা, কিন্তু তারা কি কখনো পতিতাদের পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ নিয়েছে ? কিরকম পরিস্থিতিতে একটা মেয়ে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে যায় এবং সেখানকার ভয়ংকর দুষ্টচক্র কেমন তারা কি তা জেনেছেন? জানলে তাদের পুনর্বাসনের কি কোন উদ্যোগ নিয়েছেন?
নেননি।

যে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটি ইসলাম বিদ্বেষের সঙ্গে জড়িত, যার মুসলমানদের কথা শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়, নিশ্চয় সেই ছেলেটির মনেও রয়েছে চরম ক্ষোভ, নিশ্চয়ই সে মুসলমানদের দ্বারাই কোনসময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কিংবা অবিচারের শিকার হয়েছে। কখনো কি মুসলমানরা সেই ছেলেটির অভিযোগগুলো শুনেছে, তাকে ভালোবেসেছে, একাকীত্বে তার সঙ্গী হয়েছে !
যেসব বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, কবি, চিত্রশিল্পী মুসলমানদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন, মুসলমানরা কি কখনো গিয়ে তাদের সাথে দেখা করেছেন ? নামায, কলমা পড়ার উপদেশ বাদে সমাজ সংস্কৃতি সভ্যতা নিয়ে তারা কি কোন আলাপ করেছেন ? তাদের সাথে কি চিন্তার বিনিময় করেছেন ! তাদের ভালো কাজের প্রশংসা করেছেন! মুসলমানদের জাগরণে তাদের ভূমিকার কথা বলেছেন!

এই যে শত শত ইসলামী দল, কেউ কাউকে পছন্দ করেন না, সবাই সবাইকে পথভ্রষ্ট বলেন। তারা কি সকলে কখনো একসাথে মিলিত হয়েছেন, তাদের চিন্তার দ্বিমত নিয়ে কখনো কি কথা বলেছেন? বলেননি বা করেননি।
বিএনপি আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সাথে কি কখনো নামায রোজার উপদেশ দেয়া ছাড়া ইসলামের সভ্যতাগত প্রকল্প নিয়ে কেউ কথা বলেছেন ? তাদের সাথে কি চিন্তার মতবিনিময় করেছেন কিভাবে মুসলিম জাতির উন্নতি করা যায় এবং মুসলমানদের সভ্যতাগত প্রকল্পে তাদের করণীয় সম্পর্কে ? তাদেরকে কি কখনো আপনার দলীয় বই পড়ার বদলে কোরান কিংবা মুসলিম চিন্তকদের ভালো কোন বই উপহার দিয়েছেন?

যোগ্য লোক সব জায়গায় সম্মানীত, আজ যে আপনি ইসলাম বিদ্বেষীদের কাছে সম্মানিত, ইসলামের পক্ষে কাজ করলে সে মুসলমানদের কাছেও সম্মানিত হবে। এটাই স্বাভাবিক।
মুসলমাদের এতো লাখো লাখো মাওলানা-মুফতি-হযরত, কিন্তু দুই-একশ কবি নাই কেনো, সাহিত্যিক উপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যনির্মাতা, কিংবা সিনেমা নির্মাতা নাই কেন? কারণ কি ওয়াজ করলে ধর্মবিক্রি করে কোটিপতি হওয়া যায়?
মুসলমাদের সামগ্রিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ নাই কেন? আপনি ইসলামের কথা বলে ধার্মিক মেয়েদের ঘরে আটকিয়ে রেখেছেন কিন্তু অন্যরা তো ঠিকই সব কাজ করছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে কারা ?

গান কবিতা সাহিত্য, রাজনীতি, কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য সব জায়গায় নারীদের জয়জয়কার। আপনি ফেতনার কথা বলে আপনার ধার্মিক মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াননি কিংবা রাজনীতি করতে দেননি। ফলে হয়তো কোন ইসলাম বিদ্বেষীর মেয়ে সাহিত্যিক হচ্ছে কিংবা এম্পি মন্ত্রী হচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হলো কে ! একসময় আপনিই ওই নারী সাহিত্যিকের বই পড়ে ফতোয়া দিবেন কিংবা ওই মন্ত্রীর বিরোধীতা করবেন।
যারা বর্তমানে এসব করছে তাদের বলেননা টেবিলটা উল্টিয়ে দিতে। তাদের হৃদয়েও একটা স্বপ্ন তৈরী করুন। তাদের হৃদয়েও প্রবেশ করুন। তবে আপনার সংকীর্ণ কুয়োর বাঙের চিন্তা দিয়ে তা হবে না। সবাইকে ধারণ করতে পারলে তবেই হবে।
আর এই পারাটা হতে হবে চিন্তা ধারার পরিবর্তন করে । তবেই সমাজ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে ।

লেখক পরিচিতি

আবু প্রান্তর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রিয় উক্তি – Shine like the whole universe is yours

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *