Forty-seven to seventy-one
ইসলাম মানে মৌলবাদ আর মুসলমান,জিহাদ(চেষ্টা প্রচেষ্টা) ও কুরবানী এই প্রসঙ্গ এলেই তখন সে মৌলবাদী, এই চরমপন্থী চিন্তার বিষ ভারত থেকেই চালান হয় । তারপর এদেশে অবস্থানরত ভারতীয় দালাল শ্রেণীর কিছু বুদ্ধিজীবী যারা এই গুজব লালন করে প্রচার করতে থাকে । এই দেশের ভারাটে বাহিনী দুই ভাবে লাভবান হয়:
এক.
অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জন করে ।
দুই.
ইসলাম ও মুহাম্মদ স. এর প্রতি বিদ্বেষ ও তীব্র ঘৃণা প্রচার করে আত্ম তৃপ্তি পায় ।
সরাসরি এই বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে না বলেই যারা ইসলাম ও মুহাম্মদ স. এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তাদের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বন্ধুত্ব আনুগত্য ও সর্বোপরি সহায়তা করে এই দালাল শ্রেণী ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের নগ্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে থাকে । অন্য দিকে যারা ইসলাম প্রচার করে এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামী মতাদর্শ ধারণ করে তাদের উপর চলে জুলুম নির্যাতন ও ফেরাউনি নিপীড়ন ।
মুসলমান, কুরআন এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কখনোই ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঊর্ধে নয় ।
প্রতিবেশী হিসেবে ভারতীয় রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা যেতে পারে কিন্তু দেশের মানুষ ও রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতিকূলে অবস্থান করে দেশপ্রেমিকের অভিনয় করা অজ্ঞতা, দাসত্ব ও নিষ্ঠুরতার শামিল। হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় হিন্দুদের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক আম আর দুধ মাখা আঠালো ভাতের মতো নয় । কতটা অবহেলা, অত্যাচার, জুলুম, অগ্নিসংযোগ- দাঙ্গা ও গণহত্যা ঘটিয়ে হিন্দুরা মুসলমানদের সাথে সম্প্রীতির বন্ধন আটুট রেখেছে সে কথা হাজার বছরের ইতিহাসে ক্ষোদিত রয়েছে।
আজ থেকে হাজার বছর অথবা শত বছর পূর্বে ভারতের আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যেভাবে অত্যাচার, জুলুম ও হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে উল্লাস করেছে ঠিক আজও ভারত তার সেই মূর্খতা ও নিষ্ঠুরতার অবস্থানে অনড় রয়েছে । শাস্ত্রের বিধিনিষেধ ,কুসংস্কার, বর্ণবৈষম্য ও আধুনিকতার নামে অবাধে সেক্স চালু করে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আজ বর্বরতা ও নির্লজ্জতায় নামিয়ে এনেছে । ধর্মবিশ্বাস জোর জবরদস্তি করে মানুষের মগজ থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না ঠিক । কিন্তু আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের উন্নয়নের সাথে সাথে ধর্মীয় কুসংস্কার, চিন্তা -চেতনা ও সামাজিক রীতি- নীতির পরিবর্তন ঘটে । কিন্তু তার পরিবর্তে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ ধর্মকে শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আধুনিক ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্র শাসন করছে । শত শত বছর ধরে ভারতীয় মুসলমানরা একদিকে যেমন সহ্য করেছে রাজা বাদশাদের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা তেমনি সহ্য করেছে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ।
একটা কথা কি জানেন?
হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দৃষ্টিতে বাংলা ভাষা ছিল ম্লেচ্ছ জাতের ভাষা । শিক্ষা ধর্ম ও রাজদরবারের একমাত্র ভাষা ছিল সংস্কৃতি । বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষ ছিল অবহেলিত ও সোজা ভাষায় ঘৃণিত। তের শতকে এদেশে মুসলিম অভিযান এবং পরবর্তীতে সুলতানদের সহযোগিতায় পুরাণ ও রামায়ণ বাংলা ভাষায় অনুবাদ হওয়ার পর এই বিদ্বেষ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় রূপান্তরিত হয়। ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার The Influence Urdu Hindi on Bengali Language and Literature গ্রন্থে বলতে দেখিয়েছেন,
“যে মানব অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ণ ম্লেচ্ছ ভাষায় শোনে,
তার ঠাই হবে রৌরব নরকে ।”[১]
তাহলে চিন্তা করেন ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের অবহেলা ও লাঞ্ছনা কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল । কেবল মাত্র বেঁচে থাকার জন্য নিম্নবিত্তের হিন্দুরা মুসলমান হওয়ার তীব্র আকুতি জানায় । সেদিন ব্রাহ্মণ্যবাদের অমানবিক আচরণ, সামাজিক ভাবে অবহেলিত লাঞ্ছিত ও ঘৃণা বিদ্বেষ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কেবল নূন্যতম মানুষের মর্যাদা পাওয়ার জন্য ইসলামে যোগ দিয়েছিল ! কতটা নিষ্ঠুর আচরণে মানুষ নিজের ধর্ম ছেড়ে কেবল বেঁচে থাকার জন্য অন্য ধর্মে পাড়ি জমান ভাবতে পারেন? আমার দৃষ্টিতে ভারত বর্ষে ইসলামের আগমন ঘটেছিল স্বয়ং ঈশ্বর হয়ে । কারণ সাধারণ মানুষ মুসলিম পোষাক ও পদবী গ্রহণ করে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা টুকু করেছিলেন । মুসলিম শাসনামল সম্পর্কে বিনয় ঘোষ বলেছেন
“শাস্ত্রের বিধিনিষেধ কুসংস্কার বর্ণবিদ্বেষ অনাচার আর ব্যভিচারের খানা ডোবা জলা জঙ্গলে তার (হিন্দু সভ্যতার) গতি রুদ্ধ হয়ে গেল ,জাতি ও সভ্যতার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল,এই সময় ইসলাম তার নবীন উদ্যম নবীন আদর্শ ও বিজয়ী ধর্মের প্রেরণা নিয়ে এ দেশে এলো ।”[২]
নিম্নবর্ণের ম্লেচ্ছ জাতির সাধারণ মানুষেরা গৃহ পালিত জন্তু জানোয়ারের মতো জীবন যাপন করতো । ইসলামের আগমনে এই তথাকথিত নিম্মশ্রেণীর মানুষ গুলো ইসলাম গ্রহণ করে সামাজিকভাবে এই প্রথম মানুষের মর্যাদা পেলো
১৮৫৩ সালের ১০ জুন কার্ল মার্কসের ভারতের ব্রিটিশ শাসন ও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল প্রবন্ধের দিকে চোখ বুলালে ভারতীয় ধর্ম ,সংস্কৃতি ও দর্শন খুঁজে পাওয়া যায় । তিনি ভারতীয় মহাদেশে চলতে থাকা ধর্ম ও সংস্কৃতির নামে বর্বরতার নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছেন । মার্কসের ভাষায়
“প্রকৃতি আর গতানুগতিকতার প্রতি আত্মসমর্পণের হীনম্মন্যতা থেকে সেকালের ভারত ও বাঙলার মানুষ সূর্যকে সূর্যদেব, সাপকে নাগদেব, বানরকে হনুমানদেব ও গরুকে শবলাদেবী রূপে পূজা দিয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বকে এবং ন্যূনতম মানবিক চেতনাকে পদদলিত করেছিল”।[৩]
ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে অন্য যায়গায় বলেছেন,
“এ ধর্ম যুগপৎ ইন্দ্রীয়াতিশয্য ও আত্মনিগ্রহী কৃচ্ছসাধনের ধর্ম লিঙ্গম আর জগন্নাথদের ধর্ম, সন্ন্যাসী ও বায়াদের( দেবদেসীর ) ধর্ম ।”[৪]
একজন সমাজ বিপ্লবী যার কলমে কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি ও ধর্মের নামে অজ্ঞতা ও বর্বরতার চিত্র দেখলে বোঝা যায় সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল ।
মার্কস মানসিক দাসত্ব নিয়ে আরেক যায়গায় বলেছেন
“চিরায়ত নিয়মের ক্রীতদাস হয়ে হারিয়ে ফেলেছিল মানব জীবনের সমস্ত কিছু মহিমা ও ঐতিহাসিক কর্মদ্যোতনা “।[৫]
মানুষ তার কর্মপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেছিল । ব্রাহ্মণ্যবাদী পীড়নে তার ব্যক্তি সত্ত্বার অপঘাত ঘটেছিল । কেবল মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার শেষ আকুতি তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল ।সেদিন ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে সমাজের অবহেলিত মানুষ গুলো বেঁচে থাকার শেষ ভরসা হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল ।
ভারতীয় মুসলমানের মনে ইসলাম কতটুকু বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে আজ সে কথার দিকে যাব না । হাজার বছর ধরে ভারতীয় মুসলমানরা ব্রাহ্মণ্যবাদ ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছে এমনকি আজও হচ্ছে সে কথার কারণ বলেই শেষ করব ।১৭৫৭ সালে মির জাফরেরা যে বিশ্বাস ঘাতকতার পথ তৈরি করেছিল আজও সেই পথ ধরে নব্য বিশ্বাসঘাতকেরা দালাল আর ভারাটের ভূমিকায় দেশ বিক্রির পায়তারা করছে । আর বাঙালি মুসলমান চেয়ে চেয়ে দেখছে । তারপর নতুন কোন ইতিহাসবিদ ড: শহীদুল্লাহ ও দার্শনিক কার্ল মার্কসের ন্যায় এই ষড়যন্ত্র বিশ্বাসঘাতকতা ও কাপুরুষতার ইতিহাস লিখবে ।।
তথ্য নির্দেশ:
[১] ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ -The Influence Urdu Hindi on Bengali Language and Literature
[২] বিনয় ঘোষ -বাংলার নবজাগৃতি
[৩] মার্কস এঙ্গেলস চার খণ্ডের প্রথম খণ্ড (দ্বিতীয় অংশ)
[৪] প্রাগুক্ত
[৫] প্রাগুক্ত
লেখক পরিচিতি: আবদুল কাদের জিলানী
সম্পাদক