Surah Ar-Rum

ভূমিকা: আয়াত ১৯
“তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন আর মৃত ভূমিকে জীবিত করেন। এভাবেই তোমাদেরকে বের করা হবে। “অজৈব জড়বস্তু থেকে জীবন সৃষ্টি। জীবনের বিবর্তনীয় বিকাশের একটি পর্যায়ে পৃথিবীতে মানুষের উপস্থিতি এবং এ জীবনকে আবার প্রাণহীন জড়বস্তুতে রূপান্তরিত করা হবে। আল্লাহই জানেন জীবন-মৃত্যুর এ পালাবদলের শেষ কোথায়!

(১) আয়াত ২০
“তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে,
১) তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন
২) তারপর যখন তোমরা বাশার (দেহ মানব) ছড়িয়ে পড়লে।” আয়াতের প্রথম অংশে, একা আদমকে মাটি থেকে বানানো হয় নি বরং বর্তমান নৃ-গোষ্ঠির পূর্ব পুরুষের উৎপত্তির কথা বলা হচ্ছে এখানে। তাদেরকেও মাটি থেকে বানানো হয়েছে। আয়াতের দ্বিতীয় অংশে, এই আদিম মানুষ বা বাশার জান্নাত থেকে জমিনে নেমে পড়লো এবং পৃথিবীর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর মাঝখানের সবুজ-সুজলা ভূমি যাকে মানবজাতির দোলনা বলা হয় এই অংশটাই হলো কোরানে বর্ণিত আদমের জান্নাত। যেখান থেকে বাশার পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার যাত্রা শুরু করে। আর এই যাত্রাই হলো আদমের জান্নাত থেকে নেমে যাওয়ার অন্তর্নিহিত অর্থ।

নোহা হারারির মতে পৃথিবীতে যখন হোমো সেপিয়েন্সরা ছড়িয়ে পড়া শুরু করে তখন মানুষের আরো দুইটি স্পেসিস ছিলো একটি হলো হোমো নিয়ান্ডারথাল আরেকটি হলো হোমো ইরেক্টাস। কোরানে যে ফেরেস্তারা আদমের রক্তপাতের আশঙ্কার কথা বলছে, তার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায় এই দুই নৃ-গোষ্ঠীর সাথে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বনী আদমের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার মধ্যে। আমার মতে, কোরানে বনী আদম বলতে হোমো সেপিয়েন্সকে বোঝায়। আর মানব জাতি বলতে হোমো সেপিয়েন্স ছাড়াও বেঁচে যাওয়া অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠী ও তাদের মধ্যকার সঙ্কর আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে বোঝায়। সুরা মরিয়মের ৫৮ নং আয়াত অনুধাবন করলে এমন আইডিয়া পাওয়া যায়।

(২) আয়াত ২১
“তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে,
১) তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের সঙ্গীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও।
৩) তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়াও সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এর মধ্যে চিন্তাশীল লোকদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।”

আয়াতের প্রথম অংশে, জাউজা মানে শুধু স্ত্রী না। সঙ্গী, জোড়া, বন্ধু, অ্যালাই ইত্যাদি বোঝায়। যদি স্ত্রী ধরি তাহলে পরিবার গঠন, যদি সমমনা বন্ধু ধরি তাহলে বিভিন্ন ছোট ছোট ট্রাইব আর যদি অ্যালাই ধরি তাহলে অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠির সাথে ক্ষমতা ব্যালেন্স করা বা শান্তি চুক্তি করা অর্থে বুঝতে হবে। পরিবার, গোষ্ঠী গঠন এবং অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর সাথে শান্তি চুক্তি এই জন্যই করা, যাতে তারা একে অপরের নিকট থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা আর পারস্পারিক সাহায্য পেতে পারে। আয়াতের দ্বিতীয় অংশে, নিজেদের মধ্যে রক্তপাত কমিয়ে শান্তি, নিরাপত্তা ও সম্প্রীতির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে। এ পর্যায়ে সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য চিন্তা করা শুরু করে। আয়াতে চিন্তাশীলদের চিন্তা করতে বলা মানে পাঠক ও উক্ত মানবগোষ্ঠী উভয়েরই চিন্তা করার খোরাক আছে ও ছিলো ঐ সমাজ-বাস্তবতার ভেতরে। চিন্তার প্রকাশ ভাষাতে বা চিন্তার করার ফলে ভাষা ডেভেলপ করে। যা বাস্তবে নাই তা ভাষায় উপস্থাপন করা যায়। বাস্তবতার বাইরে গিয়ে কল্পনার যোগ্যতা অর্জন এই সময়েই। পরের আয়াতে বা স্টেজে এ কারণে ভাষার ভিন্নতার কথা বলা হচ্ছে।

(৩) আয়াত ২২
“তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে,
১) আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং
২) তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতা। এর মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।”

আয়াতের প্রথম অংশে, নৃগোষ্ঠী ও জাতিগোষ্ঠী নিজেদের আকাশ ও জমিনের বাউন্ডারি সৃষ্টি করলো, এবং মানুষের মধ্যে চিন্তা ডেভেলপ করায় আকাশ তথা মানুষের মন ও জমিন তথা দেহের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখে। দেহের চেয়ে মনের গুরুত্ব দিতে শুরু করে এ সময়ে। আয়াতের দ্বিতীয় অংশে, ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। যারা জ্ঞানে গভীর তারা এ ভিন্নতাকে মেনে নেয়। ভাষা ও নৃ-গোষ্ঠী ভিত্তিক জাতিগত ভিন্নতাকে বৈষম্যমূলক হিসেবে না দেখে বৈচিত্র্যতার সৌন্দর্য হিসেবে দেখে।

(৪) আয়াত ২৩
“তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে,
১) রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা
৩) তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ।
এর মধ্যে শ্রবণশক্তিসম্পন্ন মানুষের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।”

আয়াতের প্রথম অংশে, মানুষ বিশ্রামের সুযোগ পেলো। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মানুষের জীবন যাপনকে স্থিতিশীল করে। যুদ্ধ-হানাহানি কমতে থাকে ফলে মানব সভ্যতায় এক বিরাট অবসাদের সময় আসলো। কিছু মানুষ অধিকাংশ মানুষকে খাটিয়ে নিজেদের অফুরন্ত কর্মহীন সময় বেঁচে নিলো। এই অবসর সময়েই মানুষ সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে শুরু করলো। তাদের চিন্তার প্রভাব মানুষের কর্মবিস্তৃতি খাদ্য সংগ্রহ ও উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। কীভাবে জীবনকে আরো উন্নত করা যায় সেই চিন্তাতে আত্ম নিয়োগ করল ।

আয়াতের দ্বিতীয় অংশে, প্রথম পর্যায়ের স্থিতিশীলতা কংক্রিট সভ্যতা বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কংক্রিট সভ্যতার জন্য দরকার আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে সম্পদ ও খাদ্য অনুসন্ধানের এবং সংরক্ষণের। ফলে, নগর সভ্যতার উন্মেষ ঘটলো। মানব রচিত আইন-কানুন প্রথা-রীতির উন্নতি ঘটলো। মানুষকে এগুলো মেনে চলতে হতো। এ কারণে আয়াতের শেষের অংশে শোনা কথা জুড়ে দেয়া হয়েছে। কোরানে শ্রবণ করা বলতে আদেশ-নিষেধ শোনা বোঝায়। কিন্তু যারা আক্বল কাজে লাগায় তারা মানুষের তৈরি প্রথা-নীতি-রীতিকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। যারা বুদ্ধিমান বা আক্বলমান তারা এ সমাজে কী কাজ করে বা কেমন মানসিক অবস্থা তৈরি তা পরের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

(৫) আয়াত ২৪
“তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে,
১) তিনি তোমাদেরকে বিদ্যুতের ঝলক দেখান ভয় ও আশার বস্তু হিসেবে
২) এবং আসমান থেকে পানি বর্ষণ করে তার সাহায্যে মৃত ভূমিকে জীবিত করেন। এর মধ্যে বুদ্ধিমান মানুষের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।”

আয়াতের প্রথম অংশে, সভ্যতা নির্মান ও সৃজনশীল চিন্তার পর্যায়ের পর মানুষের জগত ও জীবনের হিসাব বুঝতে স্পিরিচুশাল কোয়েস্টে অনুসন্ধানী হলো। এবং সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস ও প্রথার বিরুদ্ধে নিজের অস্তিত্বের গভীরে সন্দেহ ও বিশ্বাস দানা বাঁধতে থাকলো। বিদ্যুতের ঝলক হচ্ছে সেই সন্দেহ বা কনফিউশনের দোলাচালে ফেলে দেয়। এরই মধ্যে আদমের খিলাফত অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখনকার যে পর্যায়ের আমি কথা বলছি তা ইদ্রিস, নুহু (আ) এর সামন্য পূর্ববর্তী সময় বা অবস্থার পর্যায়। ইব্রাহীম (আ) এই কোয়েস্টের শেষ পর্যায়। যিনি প্রচলিত প্রথা ও বিশ্বাসের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেছিলেন।

আয়াতের দ্বিতীয় অংশে, মানবজমিন বিশ্বাসের অভাবে শুষ্ক ও প্রাণহীন ছিলো বৃষ্টির রূপকে ওহী দানের মাধ্যমে মৃতমানবজমিনকে জীবিত করলেন। যাদের আক্বল আছে তারা এই ওহী নাযিলের মানব মনস্তত্ব বোঝেন। এই জন্য এ “আয়াতে বুদ্ধিমান মানুষের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে” বলা হচ্ছে।
এ স্তরে বা এ আয়াতে ইব্রাহীমের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হলো। এবং পরের আয়াতে কেয়ামতের আলোচনা শুরু হলো। ব্যাপারটা এমন, যেন ইব্রাহীমের ধর্মচিন্তা কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে।

(৬) আয়াত ২৫
“তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে,
১) আসমান ও জমিন তাঁর হুকুমে দাঁড়িয়ে আছে।
২) অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে ডাকার মত ডাক দিবেন/একবার ডাক দেবেন, জমিন থেকে অমনি তোমরা বেরিয়ে আসবে।”

আয়াতের প্রথম অংশে, আসমানকে ইস্পিরিচুয়ালিজম অর্থে গ্রহণ করা যেতে পারে। আসমান এখানে প্লুরাল শব্দ যার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ অভিমুখিতার মত ও পথের ভিন্নতা। আর্দ অর্থ বস্তু। সুতরাং বস্তুবাদিতা হিসেবে আর্দকে বুঝতে পারেন। শব্দটি সিঙ্গুলার। অর্থাৎ বস্তুবাদিতার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। মত ও পথের কোন ভিন্নতা নেই।
আসমান ও আর্দকে স্পেস-টাইম-ম্যাটার হিসেবেও বুঝতে পারেন।
আক্ষরিক অর্থে আকাশ ও পৃথিবীকেও বুঝতে পারেন।
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে আসমানকে মানসিক বিভিন্ন স্তর ও ফ্যাকাল্টি এবং জমিনকে দেহ হিসেবে ধরতে পারেন।

আয়াতের দ্বিতীয় অংশে, আল্লাহর ডাককে মৃত্যু অর্থে বা কবর থেকে উত্থান অর্থে গ্রহণ করতে পারেন।
বস্তুবাদী, ভোগবাদী ও পুঁজিবাদী অবস্থা ও ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ অভিমুখী অর্থে নিতে পারেন।
মানুষ (আর্দ) ও তার অন্তরের (আসমান) মাঝে আল্লাহর ডাক অর্থেও নিতে পারেন।

মানব ইতিহাসের এই স্টেজ বা অবস্থায় মাল্টিপল ডিসিপ্লিনারি ওয়েতে জগত ও জীবন নিয়ে চিন্তা করা সম্ভব হবে। ধর্ম, শিল্প, বিজ্ঞান, ব্যবসা ইত্যাদি আপাতত একে অপরের বিরোধী হলেও সেগুলোকে আল্লাহ টিকিয়ে রাখবেন। কারণ আয়াতের প্রথম অংশে আসমান ও জমিন টিকিয়ে রাখার অর্থ এভাবে করতে হবে। সবগুলো টিকে থাকবে যাতে এগুলোর মধ্য দিয়েই মানুষকে ডাকা যায়। এই ছয়টি আয়াতে ছয়টি নিদর্শনের আলোচনা করা হয়েছে। এই ছয়টি আয়াত যেন মানব সভ্যতা বিকাশের ছয়টি স্তর।

উপসংহার: আয়াত ২৭
“তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তিনি পুনরায় সৃষ্টি করবেন। এটা তাঁর জন্য অধিকতর সহজ। আসমান ও জমিনে সর্বোচ্চ বর্ণনা তাঁরই জন্য। আর তিনিই পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।”

লেখক পরিচিতি:
মোহাম্মদ রোকনুউজ্জামান
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *