আল্লামা ইকবালের যরবে কলীম
কবিতা জীবন, কবিতা মৃত্যু । আর মুত্যু অনন্ত জীবনের প্রবেশ পথ । তাই কবিতা জীবন থেকে অন্তহীন জীবনের পথে একজন সুসজ্জিত যাত্রী। জিব্রীল যে অনন্ত জীবনের পয়গাম আনেন, নবী যে পয়গামের আলােকে মানুষের জীবনকে আলােকিত করে তােলেন কবিতায় তারই সুর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত । মহাপ্রলয়ের যে বিউগল হাতে নিয়ে ইসরাফীল দীর্ঘকাল থেকে প্রতীক্ষারত আছেন, জীবন শেষের যে কান্নায় হেসে ওঠে জীবন সূচনা, কবিতা তারই মুখবন্ধ । ইকবালের কবিতার এ-ই হলাে সারৎসার ।
বিশ শতকের একেবারে গোড়াতেই এমন এক সময়ে কবির আবির্ভাব যখন পশ্চিমী দুনিয়ায় চিন্তার কাষেতে চলছে নতুন ভাঙাগড়ার আয়ােজন । মেশিনের ধোঁয়ায় ইউরােপের নগর-বন্দরের আকাশ বাতাস আচ্ছন্ন । কলকারখানায় শ্রমরত মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত । অথচ পুঁজিপতির সম্পদের ভাণ্ডার প্রতিদিন স্ফীত হয়ে চলেছে । গৃহের চৌহদ্দী পেরিয়ে মেয়েরা পুরুষদের সাথে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়েছে । ইউরােপে সংসার জীবনে ভাঙন দেখা দিয়েছে । পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ এশিয়া ও আফ্রিকার কোটি কোটি মানুষকে গােলামে পরিণত করেছে । উপনিবেশবাদী শাসন ও শােষণে এসব এলাকায় অর্থনৈতিক দারিদ্র, সামাজিক দুর্নীতি ও রাজনৈতিক বিশৃংখলার বিস্তৃতি ঘটে চলেছে । ইউরোপে ধর্ম গীর্জার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে গেছে। ব্যক্তি ও গােষ্ঠী স্বার্থই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দর্শনে পরিণত হয়েছে । পশ্চিমের বস্তুবাদী সভ্যতা সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছে ।
আর প্রাচ্যের অবস্থা তখন কেমন ? প্রাচ্যের দিনগুলাে তখন রাতের মতােই আঁধার। পশ্চিমের সূর্যই এখানকার আকাশে কিরণ দিচ্ছে । জ্ঞান, সভ্যতা, শিক্ষা, দর্শন সবকিছুই আসছে ইউরােপ থেকে। শুধু রাজনৈতিক দাসত্ব নয়, ইউরােপের মানসিক ও সাংস্কৃতিক দাসত্বের তখন যৌবনকাল। প্রাচ্যের প্রধান পুরুষ মুসলিমের দুরবস্থা সবার চেয়ে বেশী। উসমানী খিলাফত ‘রুগ্ন পুরুষ’ রূপে পরিচিতি লাভ করেছে। হাজার বছর ধরে সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দান করার পর আরব-অনারব মুসলিম মানসে এক প্রকার নির্জীবতা বাসা বেঁধেছে । পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবার যােগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে তারা। শত শত বছরের অবিমৃশ্যকারিতার ফলে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান, ভাবধারা ও আদর্শ থেকে তাদের বিচ্যুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে । তাই ইউরােপ হয়েছে নতুন সভ্যতার বাহক এবং মুসলিম তার গ্রাহক।
ইকবাল নিজে পাশ্চাত্য শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত । পাশ্চাত্য দর্শন ও চিন্তাধারার তিনি একজন বড় পাঠক, পর্যবেক্ষক ও সমালােচক । এই সাথে প্রাচ্য জীবনধারা ও জীবন দর্শনের সাথেও তিনি পরিচিত । ইসলামী চিন্তা, ভাবধারা ও জীবন দর্শনে তিনি গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী । পাশ্চাত্য ও ইসলামী ভাবধারা ও জীবন দর্শনের তুলনামূলক অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ তাঁর বৈশিষ্ট । এ দৃষ্টিতে তিনি বিশ শতকের বিশ্ব মানবতার সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন । এই ব্যাপক ও গভীর অধ্যয়নের ফলাফলই তাঁর কবিতা।
ইকবাল সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন, মানুষ অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী ও গভীর চিন্তাশীল । তবুও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিছক বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করে প্রতি যুগেই মানুষ বড় বড় ভুল করে এসেছে । এক্ষেত্রে আল্লাহর অহী সমস্ত ভুলের উর্ধে। আল্লাহ মানুষের এবং বিশ্ব প্রকৃতি ও পরিবেশের স্রষ্টা । মানুষের প্রকৃতি তিনিই নির্ধারণ করেছেন। তিনি জানেন, মানুষের দুর্বলতা ও শক্তিমত্তা । কাজেই মানুষের জন্য কোন্টা ভালাে, কোন্টা মন্দ এবং কোন্টা কল্যাণকর ও কোনটা অকল্যাণকর তা তিনি মানুষের চেয়ে অনেক বেশী করে নির্ভুলভাবে জানেন । তাই আল্লাহর অহী মানুষের জন্য একমাত্র সঠিক পথ নির্দেশক। এ দৃষ্টিতে ইকবাল বিশ্ব মানবতাকে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও পাশ্চাত্য চিন্তাধারার আপাত চাকচিক্যে মুগ্ধ না হয়ে গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার শুধুমাত্র কল্যাণকর বিষয়টুকু গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন । পাশ্চাত্যকে তার গলদগুলো তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন । সূদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থাকে তিনি বলেছেন গরীবকে শোষণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার । পুঁজিবাদী ব্যাংকিং সম্পর্কে বলেছেন, “যাহির মেঁ তিজারত বাতিন মেঁ জুয়া হ্যায় “- বাহির থেকে দেখতে তেজারতি প্রতিষ্ঠান কিন্তু আসলে ভেতরে জুয়ার আড্ডাখানা । পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেছেন :সেখানে মানুষের মাথা গণনা করা হয় কিন্তু মানবতাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না । ফলে গণতন্ত্র অদ্ভুত প্রহসনে পরিণত হয় । মার্কস ও এঙ্গেলসের চিন্তাধারা এবং বলশেভিক রাশিয়ায় কম্যুনিজমের বিস্তারও তিনি গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন । একে পুঁজিবাদী শােষণের প্রতিক্রিয়ামূলক একটি বিভ্রান্ত ও নিষ্ফল পদক্ষেপ রূপেই চিহ্নিত করেছেন ।
আধুনিক বিশ্বে মানুষের জন্য সঠিক ও কল্যাণমূলক জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কবি মর্দে মুমিন ও মর্দে মুসলিমকে আহ্বান জানিয়েছেন । ইকবালের মর্দে মুমিন ও মর্দে মুসলিম কোনো গতানুগতিক বা নিছক বংশানুক্রমিক মুসলমান নয় । তথাকথিত সংকীর্ণ ও গোষ্ঠীগত মুসলিম জাতীয়তার ধারক তিনি নন । আল্লাহ বিশ্বাসী আল্লাহর অনুগত ও আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের অনুসারী ব্যক্তিবর্গই তাঁর লক্ষ্য । ইকবাল নিছক কিছু চিন্তার উন্মেষ সাধন করেই ক্ষান্ত হননি বরং সংগে সংগে এর ভিত্তিতে মানুষের জন্য সুন্দর পথ রচনাও করেছেন । এভাবে তাঁর দর্শন চিন্তা ও চিন্তার প্রয়ােগ উভয় ক্ষেত্রে সমানভাবে অংশ গ্রহণ করেছে ।
ইকবাল উর্দূ ও ফারসী উভয় ভাষায় কবিতা রচনা করেন । ‘বাঙ্গে দারা’, ‘বালে জিব্রীল’ ও ‘যরবে কলীম’ তিনটি বই লিখেছেন উর্দূতে । ‘আরমগানে হিজায’-এর কিছু কবিতা উর্দূতে লিখেছেন। বাকি এর অধিকাংশ কবিতা ফারসীতে লেখা । এছাড়া তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ফারসীতে লেখা। সেগুলাে ‘আসরার খুদী’ রুমুজে বেখুদী’, ‘পায়ামে মাশরিক’, ‘যাবূরে আজম’, ‘জাবীদ নামা’, ‘পাস চে বায়াদ কারদ আয় আকওয়ামে গারব’।
ইকবালের কবিতা গভীর দার্শনিক তত্ত্বে পরিপূর্ণ হলেও নিছক বা নিরস দর্শন যাকে বলে তা-এর কোথাও নেই । এর ফলে এর শৈল্পিক মানও কোথাও ক্ষুন্ন হয়নি । মানুষের জন্য তিনি কবিতা লিখেছেন, নিছক দর্শন চর্চা করার জন্য নয় । তাছাড়া তাঁর কবিতায় ইতিহাস সচেতনতাও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ইকবালের জীবদ্দশায়ই তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হবার কাজ শুরু হয়। তাঁর শিক্ষক কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ নিকলসনই ১৯২০ সালে তাঁর বিখ্যাত ফারসী কাব্যগ্রন্থ ‘আসরারে খুদী’ ইংরেজীতে অনুবাদ করেন । এর ফলে সমগ্র পাশ্চাত্যে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ইকবাল কোনাে অপরিচিত কবি নন । চল্লিশের দশক থেকেই তাঁর কবিতা বাংলায় অনূদিত হতে থেকেছে। তাঁর কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্বমানবতাকে ধ্বংসের গভীর আবর্ত থেকে উদ্ধার করার যে আর্তি তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে তার অন্তরঙ্গ সুর বাংলার মানসকে আচ্ছন করেছে । বিশেষ করে বাংলার মুসলিম মানস তাঁর কবিতার মধ্যে আত্ম আবিষ্কারের সকল আয়ােজনই প্রত্যক্ষ করেছে। সমগ্র উপমহাদেশের মতাে বাংলারও তিনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি ।
১৮৭৭ সালে পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে ইকবালের জন্ম। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল।
“যরবে কলীম” ১৯৩৬ সালের মে মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। এর দুবছর পরে কবির ইন্তিকাল হয়। যরবে কলীম তাঁর পরিণত বয়সের লেখা । এ জন্য তাঁর চিন্তাধারা এখানে এতই সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ যে, পাঠক মাত্রই তার প্রভাব গ্রহণ না করে পারেন না।
‘যরবে কলীম’-এর অর্থ কলীমের আঘাত। কলীম হচ্ছেন হযরত মূসা কলীমুল্লাহ। অর্থাৎ হযরত মূসা যেমন তাঁর লাঠির আঘাতে পাথরের বুক বিদীর্ণ করে ঝরণা ধারা প্রবাহিত করেছিলেন ইকবাল ঠিক তেমনি এ কবিতাগুলোর মাধ্যমে জাতির স্পন্দনহীন দেহে আবার নতুন প্রাণ প্রবাহ সৃষ্টি করতে এবং ঘুমন্ত মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে চান। বইয়ের নামকরণে কবি নিজেই একথা প্রকাশ করেছেন । মুসলমান জেগে উঠুক, আত্ম-বিশ্লেষণ করুক এবং আত্মশক্তি উপলব্ধি করে বর্তমান যুগের অমানবিক জুলুম, নিপীড়ন, শােষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করুক- এটিই কবির একান্ত কামনা । কবি বিশ্বাস করেন, একমাত্র আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাসী একটি সত্যাশ্রয়ী মানবগােষ্ঠীই বিশ্ব মানবতাকে জুলুম-শােষণ মুক্ত করতে পারে।
বর্তমান যুগ বলতে তিনি বিশেষ কোনাে সময় বা কাল মনে করেন না। বরং বর্তমান যুগে পাশ্চাত্য চিন্তাধারা যে ধৰ্মবৈরিতার আমদানি করেছে এবং এর ফলে চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে যে বিশৃংখলা, নৈরাজ্য ও প্রবৃত্তির অন্ধ অনুসৃতির ধারা প্রবাহিত হয়েছে সেদিকেই তিনি অংগুলি নির্দেশ করেছেন । ‘আরমগানে হিজায’ কাব্যগ্রন্থে কবি বলেছেনঃ
“নিষ্কৃতি চাই এ যুগের ধ্বংসকারিতা থেকে,
কেননা রাষ্ট্র শাসনের নামে সে চালিয়েছে শয়তানী রীতি। “
পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মনগড়া মতবাদের বিভ্রান্তিকে ইকবাল কল্পিত মিথ্যা খােদার সাথে তুলনা করেছেন । এ কাব্যগ্রন্থে তিনি বিভিন্নভাবে এ মতবাদগুলাে বিশ্লেষণ করেছেন এবং এগুলাের বিভ্রান্তির তিলিসমাতি থেকে সফলতার সাথে বের হয়ে আসার পথও নির্দেশ করেছেন। তিনি মুসলমানকে খুদীর সমুদ্রে ডুব দেবার পরামর্শ দিয়েছেন। খুদীর সমুদ্রে ডুব দেবার মানে হচ্ছে, আপন সত্তাকে পূর্ণরূপে জানা ও চিনে নেয়া । এ জন্য প্রথমে নিজেকে অধ্যয়ন করতে হবে। নিজের অন্তরকে অধ্যয়ন করতে হবে । নিজের সত্তা ও নফস সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে হবে। তারপর নিজেকে গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের নফস বা খুদীর প্রচ্ছন্ন শক্তির পরিমাপ করে নির্ভুল পথে তাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
‘যরূবে কলীম’-এ মূলত ইকবাল মুসলিম জাতির পতনের কারণ এবং জাতি হিসেবে পুনরায় তার দুনিয়ায় কর্তৃত্বশালী হবার পদ্ধতি নিরূপণ করেছেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসার পূর্বে মুসলমানদের চিন্তায় জড়তা দেখা দেয় । তাদের মৌলিক চিন্তার স্রোত প্রায় শুকিয়ে যায় । সমগ্র জাতিই ‘তাকলীদ’ তথা অন্ধ অনুসৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । এ অবস্থায় পাশ্চাত্য সভ্যতা তার আপাত মনােমুগ্ধকর মতবাদ নিয়ে হাজির হয় । এই সংগে মুসলিম এলাকাগুলােতে পাশ্চাত্য তার রাজনৈতিক আধিপত্যও বিস্তার করে । রাজনৈতিক দাসত্বের ফলে পাশ্চাত্যের মানসিক দাসত্বও মুসলমানদের জন্য স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানদণ্ডকে মুসলমানরা গ্রহণ করে নেয় । অথচ এ মানদণ্ড ছিল ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনবােধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী । কবি কেমন চমৎকারভাবে বলেছেনঃ
“একদা যা মন্দ ছিল ধীরে ধীরে তা-ই হলাে ভালাে
কেননা গােলামীতে পরিবর্তিত হয় জাতির বিবেক।”
তাই পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে কবি জিহাদ ঘােষণা করেছেন । কবির ভাষায় মুসলমান হলাে ‘মর্দে হুর’ -স্বাধীন পুরুষ । তার আত্মাকে কেউ বন্দী করতে পারে না। মানুষের মনগড়া মতবাদের কাছে সে নতি স্বীকার করতে পারে না। সে মাথানত করে একমাত্র আল্লাহর কাছে । কুরআনের আলােকে রসূলের নির্দেশিত পথে সে অগ্রসর হয় । মুসলমান হচ্ছে ‘মর্দে মুমিন’ ও ‘মর্দে মুজাহিদ । আল্লাহর প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস তার হৃদয়ে শক্তি যােগায়, তার আবেগকে স্বতস্ফূর্ত করে। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। কে তার সংগে এলাে আর কে এলাে না, এর কোনাে পরােয়াই সে করে না। তার জিহাদী মনােবৃত্তি অনুভব করে শয়তানের সমগ্র সত্তা কেঁপে ওঠে এক অজানা আশংকায় । মুজাদ্দিদে আলফি সানির ন্যায় একজন মর্দে মুমিন, মর্দে মুজাহিদ ও দুর্বল ফকীর একাকী দাঁড়িয়ে যান মহাপরাক্রমশালী শাহানশাহ জালালুদ্দীন আকবরের ইসলাম বিরোধী চিন্তাধারা ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য । ভয় করেননি তিনি বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রক্ত চক্ষুকে । একাকী মোগল শক্তির মোকাবিলা করেন ।
মুজাদ্দিদে আলফি সানির ঈমান ও জিহাদী প্রেরণা ইকবাল মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করতে চান ।ইকবালের মতে , মুসলমানরা যখন পাশ্চাত্য ভাবধারা বিসর্জন দিয়ে ইসলামকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি ও গ্রহণ করতে সক্ষম হবে তখনই তাদের মধ্যে মুজাদ্দিদে আলফি সানির ঈমান ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রেরণা সৃষ্টি হবে । আর একমাত্র তখনই মুসলমানরা দুনিয়ার জীবনে সাফল্য লাভ করতে এবং বিশ্বে কর্তৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে ।
ইকবালের কাব্যগ্রন্থগুলাের মধ্যে ‘যরবে কলীম’ সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। উপমহাদেশের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশে মুসলিম মিল্লাতের বুকে ইকবাল চিন্তা যে নতুন প্রাণের জোয়ার এনেছে তা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছি আমরা । এমন কি ইকবালের কবিতা আরবীতে অনূদিত হয়ে আজ সমগ্র আরবী সাহিত্য অংগনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং আরবী ভাষাভাষী এলাকার মুসলিম মিল্লাত ইকবাল সাহিত্যে তাদের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে । ইউরােপের বিভিন্ন ভাষায় ইকবাল কাব্য অনূদিত হয়ে ইউরােপবাসীদের জন্য নতুন চিন্তার দ্বার উন্মােচন করছে । আজ আমাদের সাহিত্য অংগনে যে জড়তা ,বিভ্রান্তি, দিকভ্রষ্টতা ও হতাশা বিরাজ করছে তা দূর করার একমাত্র পথ ইকবাল সাহিত্য চর্চা ।
এসব দিক বিবেচনা করে ১৯৬২ সালে আমি ‘যরবে কলীম’ অনুবাদ করি । কিন্তু গত তিরিশ বছরের মধ্যে এটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি । এক সময় এর সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিই হারিয়ে যায় । তারপর আবার পনের বিশ বছর পরে আল্লাহর মেহেরবানীতে পাণ্ডুলিপি হাতে আসে । তখন থেকে এটি নতুন করে পরিমার্জনা করার কাজে হাত দেই । বর্তমানে বলতে গেলে মূলত ঢাকাস্থ আল্লামা ইকবাল সংসদের সম্পাদক অামাদের একান্ত স্নেহভাজন মওলানা আবদুল ওয়াহিদের বারবার তাগাদা ও অত্যধিক আগ্রহের ফলেই ‘যরবে কলীম’ বাংলা ভাষাভাষী পাঠকবৃন্দের হাতে তুলে দেবার সুযােগ পাচ্ছি। এখন অনুবাদ কতটুকু হৃদয়গ্রাহী এবং সাহিত্য মান ও কাব্যগুণ সমৃদ্ধ হয়েছে তা মননশীল পাঠকই বলতে পারবেন। তবে ইকবালের চিন্তা বাংলায় পরিবেশন করার চেষ্টা করেছি এতটুকুতেই আমি পরিতৃপ্ত ।
শুধু এ কাব্যগ্রন্থেই নয়, ইকবালের কবিতার বৈশিষ্টই হচ্ছে, বিশাল চিন্তা ও বক্তব্যকে গুটিকয় ছত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা । তাই আমি পাঠকবর্গকে কবির চিন্তার সাথে পরিচিত করার উদ্দেশ্যে এবং তাঁর বক্তব্যকে সৃষ্টি করে তুলে ধরার জন্য কয়েক জায়গায় কিছু ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি। আশা করি। কবির বক্তব্য বােঝার ক্ষেত্রে এগুলাে পাঠকবর্গকে সাহায্য করবে ।
লেখক পরিচিতি:
আব্দুল মান্নান তালিব ১৮০ শান্তিবাগ, ঢাকা।
১৭ জুলাই ১৯৯৩
তথ্য সূত্র: যরবে কলীম -মুহাম্মদ ইকবাল
তর্জমা: আবদুল মান্নান তালিব