Political Philosophy of Allama Iqbal
বাংলা ভাষায় ইকবাল-চর্চার সেকাল ও একাল:
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের আগে থেকেই আল্লামা ইকবালের সাহিত্য বাংলা ভাষায় অনূদিত এবং আলোচিত হয়ে আসছিল। যারা ইকবালের রচনার অনুবাদ অথবা পর্যালোচনা করেছেন তাদের মধ্যে যাদেরকে আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে তারা হলেন গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), আবদুল হক ফরিদী (১৯০৩-১৯৯৬), সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪), হুমায়ুন কবীর (১৯০৬-১৯৬৯), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), মনিরউদ্দীন ইউসুফ (১৯১৯-১৯৮৭), শঙ্খ ঘোষ (জন্ম ১৯৩২) এবং সৈয়দ আবদুল মান্নান (?)।
এছাড়া যারা বাংলা ভাষায় ইকবাল চর্চা করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯), আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), তালিম হোসেন (১৯১৮-১৯৯৯), আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২), মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) ও আরো অনেকে।
চলমান ধারাবাহিক নিবন্ধের এই পর্বটি লেখার সূত্রে, বাংলা ভাষায় আল্লামা ইকবালের যেসব রচনা অথবা তার উপরে রচিত পর্যালোচনা আমাকে বিবেচনায় নিতে হয়েছে, সেগুলি হল:
১. কবি গোলাম মোস্তফা অনূদিত ‘শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া’ (১৯৬০) ২. তিরিশী পঞ্চকবির অন্যতম অমিয় চক্রবর্তীর লেখা দুটি প্রবন্ধ ‘যুগসংকটের কবি ইকবাল’ এবং ‘ইকবাল কাব্যের নতুন প্রসঙ্গ’ (‘সাম্প্রতিক’ বই থেকে, ১৯৬৪; ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’, সম্পাদনা: ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ১৯৯৮) ৩. সৈয়দ আবদুল মান্নান অনূদিত ‘আসরারে খুদী’ (১৯৪৫) ৪.আবদুল হক ফরিদী অনূদিত ‘রমূ্য-ই-বেখূদী’ (১৯৫৫) ৫.দুই বাংলার খ্যাতিমান রম্যলেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ইকবালকে সমালোচনা করে লেখা নিবন্ধ ‘উভয় বাঙলা – নীলমণি’ (সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকা, ১৯৭২; সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, অষ্টম খন্ড, ১৯৭৭) ৬. প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও লেখক হুমায়ুন কবীরের ইকবাল দর্শনের ব্যাখ্যামূলক নিবন্ধ ‘ইকবাল ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য’ (‘কবি ইকবাল’, সম্পাদক: মোহাম্মদ হবীবুল্লাহ, প্রকাশকাল দেয়া নেই) ৭. মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ অনূদিত ‘ইকবালের নির্বাচিত কবিতা’ (১৯৫২ সালে প্রথম প্রকাশিত সৈয়দ আলী আহসান সম্পাদিত ‘ইকবালের কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত) ৮.কবি ও অনুবাদক মনিরউদ্দীন ইউসুফ কৃত ইকবাল কাব্যের অনুবাদ-সংকলন ‘ইকবালের কাব্য-সঞ্চয়ন’ (১৯৬০) ৯.কবি শঙ্খ ঘোষের ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ (১৯৮৯) গ্রন্থের দুটি নিবন্ধ ‘ইকবাল: প্রতিভার অপচয়?’ এবং ‘কেন ইকবাল’ ১০. এছাড়া আল্লামা ইকবালের যে গদ্য রচনাটি তার দার্শনিক ও ধর্মীয় চিন্তার মূল আধার হিশেবে বিশ্ববিখ্যাত সেই ইংরেজী ভাষায় লেখা ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ (1934)-এর একটি বাংলা অনুবাদ অধ্যয়ন ও অনুধাবনের চেষ্টা করেছি ‘ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ শিরোনামে (অনুবাদ সম্পাদক: অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ, ভূমিকা: দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ১৯৫৭)।
এইসব অনুবাদ ও পর্যালোচনার প্রকাশকাল লক্ষ করলেই এটা পরিস্কার হয়ে যাবে যে ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যবর্তী সময়কালেই সর্বাধিক ইকবাল-চর্চা হয়েছে। আবার যদি প্রকাশস্থান খেয়াল করি তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসা সহজ হয়ে যায় যে তৎকালীন পূর্ব বাংলাতেই বাংলা ভাষায় সর্বাধিক ইকবাল-চর্চা হয়েছে। এর কারণ অত্যন্ত সহজ; যেহেতু আল্লামা ইকবালের মিল্লাত ধারণা ও উম্মাহচেতনার একটি রূপরেখা হিশেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যূদয় হয়েছিল সেহেতু তৎকালীন পূর্ব বাংলা, যা “পূর্ব পাকিস্তান” অভিধা পেয়েছিল, সেখানে ইকবাল চর্চা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দ্রুত বিকাশ লাভ করেছিল।
আবার ১৯৭১ সালে যখন বিউপনিবেশিত হতে ব্যর্থ কামালবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্রটি স্বায়ত্ত্বশাসন ও স্বাধিকারের প্রশ্নে পূর্ব বাংলার উপরে একটি রক্তক্ষয়ী গণহত্যা ও নারী ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়ে পড়ে তখন একটি বাঙালি জাতিবাদী প্রতিহিংসা ও ঘৃণাবাদী প্রতিক্রিয়া ও আবেগের পরিবেশ তৈরি হয়। এই জিঘাংসা ও প্রতিশোধের আবেগ ও আবেশে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল পরিমন্ডলও প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে যে কলোনিয়াল সিভিল ও সামরিক আমলাতন্ত্র ও এলিটের অপকর্মের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়েছিল তার দায় আল্লামা ইকবালের উপরেও বর্তানো হয়েছে। কাজেই পূর্ব বাংলায় যে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির রক্তাক্ত অভ্যূদয় হল সেই রাষ্ট্রটি আল্লামা ইকবালের প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য প্রত্যাহার করে নিল। এরই ফলে বাংলাদেশে একাত্তর-পরবর্তী কালে ইকবাল-চর্চা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। স্কুলের পাঠ্যবই, বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির বলয়ে তথা জনপরিসরে ইকবাল অনুপস্থিত, অপাংক্তেয় এবং অস্পৃশ্য অপর।
একাত্তর-পূর্ব ও একাত্তর-পরবর্তী ইকবাল-চর্চার এই বৈপরীত্যকে খোলাসা করার জন্য এখানে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি:
প্রথম উদ্ধৃতিটি হল তিরিশী আধুনিক কবি অমিয় চক্রবর্তীর লেখা ‘যুগসংকটের কবি ইকবাল’ প্রবন্ধ থেকে। এখানে তিনি গভীর শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতার সঙ্গে ১৯৩৭ সালে লাহোরে আল্লামা ইকবালের সঙ্গে তার সাক্ষাতের একটি চমৎকার বর্ণনা দিচ্ছেন:
“কবি ইকবালের বাড়ির দরজাটা খুলে মনে হ’ল মধ্য-এসিয়ার বিস্তৃত অঙ্গনে এসে পৌঁচেছি যেদিকে লাহোরের কাবুলি দরোয়াজা খোলা। উত্তর-ভারতের মুক্ত হাওয়া ইকবালের কথাবার্তায়, তাঁর দরাজ ব্যবহারে, ঘরের পঞ্জাবি-আফগানি সরঞ্জামে। তাঁর শরীর অসুস্থ ছিল। [১] কৌচে ঈষৎ হেলান দিয়ে উঠে বসলেন, হাতে গড়গড়ার নল। পরনে তাঁর ধবধবে পিরান, ফুলো পাজামা। তাঁর সৌজন্য সুন্দর বললে সব বলা হয় না, যেন ব্যবহারের একটি শিল্পকাজ; এইরকম আভিজাত্য পুরনো পশ্মিনার উপরে কাশ্মীরী ফুলের মতো, দুর্লভ সামগ্রী। অথচ প্রখর যুগসচেতন মন, হাস্যোজ্জ্বল। একেবারে ভারতীয় এবং আধুনিক পারসিক তাঁর চিন্তার সৌকর্য। জানতাম এই কবি দামাসকুস, কাইরো থেকে পঞ্জাব পর্যন্ত পারসিক উর্দু ভাষায় লোকের মন নাড়িয়েছেন; ভারতবর্ষব্যাপী তাঁর ‘হিন্দোস্তান হমারা’ গানের চল; কেম্ব্রিজের ইনি মেধাবী পন্ডিত; এর মত চোস্ত ইংরেজী কম-ভারতীয় লিখেছেন। অথচ কত হালকা তাঁর জ্ঞানের ভার, সহজ দিলদরিয়া ভাব। বুঝলাম একেই আমরা কস্মোপলিটান মন বলি, যা স্বদেশী অথচ প্রসারী, যেখানে লেনদেন চলছে বড় চত্বরে, নানাদেশীয় আধুনিকে-প্রাচীনে সমন্বয়।” [২]
এবারে উদ্ধৃত করছি প্রখ্যাত বাঙালি মুসলমান শিক্ষাবিদ, কবি ও সম্পাদক যিনি ভারতের প্রশাসনে উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন সেই অক্সফোর্ডের মেধাবী শিক্ষার্থী হুমায়ুন কবীরের একটি নিবন্ধ থেকে:
“ইকবালের কাব্যপ্রতিভা অবিসম্বাদী, কিন্তু চিন্তানায়ক হিসাবেও তাঁর আসন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মধ্যে। কবি ইকবাল এবং দার্শনিক ইকবালের মধ্যে কে বড় সে বিষয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু সেই বিতর্কই প্রমাণ করে যে ইকবালের জীবনদর্শন ভারতের ইতিহাসে স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। শিক্ষা এবং সংস্কার, সমাজ ও ব্যক্তির সম্বন্ধ এ সমস্ত প্রশ্নই চিত্তকে আকর্ষণ করেছিল এবং কখনো কাব্যে কখনো গদ্য রচনায় তাঁর চিন্তার ধারা তিনি অমর করে রেখেছেন।” [৩]
কবি ফররুখ আহমদ আল্লামা ইকবালের কবিতার বাংলা অনুবাদে এনেছিলেন এক শিল্পসৌকর্য ও উৎকর্ষ যা আজ অবধি আর কেউ পেরেছেন কিনা সন্দেহ। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত তার এই ইকবাল কাব্যের অনুবাদ সম্পর্কে বিশিষ্ট সমালোচক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর এই উদ্ধৃতিটি প্রণিধানযোগ্য:
“… [ইকবালের কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে] ফররুখ আহমদ মূল থেকে তেমন দূরে সরে যাননি, বরং মূল ভাববস্তু এবং শিল্পসম্পদের ওপর ভিত্তি রেখেই, তাঁর সৃজনক্ষমতার স্পর্শে এই অনুবাদ কবিতাটিকেও নতুন মহিমা দিয়েছেন, এবং তাতে প্রাণ সঞ্চার করেছেন। আর এক্ষেত্রে তাঁর সহায়ক হয়েছে ভাষা ও ছন্দের ওপর অবাধ অধিকার এবং কল্পনা-প্রতিভা। তিনি যখন উচ্চারণ করেন:
ওঠো – দুনিয়ার গরীব ভুখারে জাগিয়ে দাও। ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও করো ঈমানের আগুনে তপ্ত গোলামী খুন বাজের সমুখে চটকের ভয় ভাঙিয়ে দাও ঐ দেখ আসে দুর্গত দীন-দুখীর রাজ; পাপের চিহ্ন মুছে দাও, ধরা রাঙিয়ে দাও। কিষাণ-মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল সে মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও। স্রষ্টা ও তার সৃষ্টির মাঝে কেন আড়াল? মধ্যবর্তী মোল্লাকে আজ হাঁকিয়ে দাও… … …
তখন এই রচনা আদৌ অনুবাদ বলে মনেই হয় না, এটি ইকবাল কিংবা অন্য কারো কবিতা কিনা, সে-প্রশ্নও মনে জাগে না, বরং একটি মৌলিক কবিতারূপেই পাঠকের চেতনায় আঘাত হানে, মনে অনুরণন জাগায়। অনুবাদের ক্ষেত্রে এরচেয়ে বড় সার্থকতা আর কি হতে পারে?” [৪]
এভাবে আল্লামা ইকবালের কাব্য ও দর্শন যখন বাংলা অনুবাদের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় ক্রমাগত প্রচার ও প্রসার লাভ করছিল তখন ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক সংকট এই ধারায় ছেদ ঘটায়। জাতিবাদী হিংসা ও ঘৃণার সার্বিক প্লাবনে পরিবেশ বিষিয়ে ওঠে। এই পরিবেশের গর্ভ থেকে যে বাংলাদেশের অভ্যূদয় হয় তা আরো কামালবাদী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রতিহিংসায় আরো উগ্র সেক্যুলার, জাতিবাদী, বাঙালিত্ববাদী এবং পাঞ্জাবি-বিহারী জাতিসত্তা ও উর্দু ভাষা বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। অসাম্প্রদায়িকতার ছদ্মবেশে এই ধর্মবিদ্বেষী সংকীর্ণ ও কূপমন্ডুক পরিবেশে জ্বলন্ত আগুনে তপ্ত হাওয়া দিতে এগিয়ে আসেন সৈয়দ মুজতবা আলী; তিনি লেখেন:
“….ভূরি ভূরি গর্দভ গর্দভী জর্মনী থেকে – জর্মনী কেন, সর্বদেশেই – নিত্যি নিত্যি ডক্টরেট পেয়েছে ও পাবে। অতএব ইকবাল-‘ভক্ত’ মদোৎকট পচঞ্চনদবাসী কবি ইকবালের ডক্টরেট নিয়ে যতই ধানাই পানাই করুক, ডক্কা-ডিন্ডিম-নাদ ছাড়ুক, তদ্বারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। বিশেষত আমরা যখন বিলক্ষণ অবগত আছি, উচ্চাঙ্গের কাব্য রচনার জন্য দর্শন-শাস্ত্রের প্রয়োজন নেই, এবং ঐ উদ্দেশ্যে ম্যুনিক পানে ধাবমান হওয়াও বন্ধ্যাগমন। বস্তুত কবি ইকবালের ডক্কাবাদক পঞ্চনদ সম্প্রদায় তাঁর যে-সব “দার্শনিক কবিতা”র প্রশস্তিতে পঞ্চমুখ সেগুলি না দর্শন না কবিতা।” [৫]
“… … ইকবাল যখন গাইলেন, “চীন ও আরব আমাদের হিন্দুস্থান আমাদের” তখন এই “আমাদের”-এর আমরা খুব সম্ভব একমাত্র মুসলমানগণ, কারণ চীন ও আরবে হিন্দু আছেন বলে শুনিনি। পক্ষান্তরে তিনি যখন বলেন, “হিন্দুস্থান সর্ববিশ্বে শ্রেষ্ঠতম” তখন নিশ্চয়ই তিনি আপন মাতৃভূমিকে (সে যুগে ভারত) ইসলামের জন্মভূমি আরবের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আসন দিচ্ছেন। অতএব তিনি প্রথম মুসলিম তারপর ভারতীয়, না প্রথম ভারতীয় তারপর মুসলিম এ-সমস্যা থেকেই যায় – অন্তত আমার কাছে। সর্বশেষ প্রশ্ন, দেশ, ধর্ম, ভগবান ইত্যাদির প্রতি রচিত কবিতা আজ পর্যন্ত বিশ্বকাব্যে কতখানি সফল হয়েছে, কোন পর্যায়ে উঠতে পেরেছে, সেটাও পাঠক বিবেচনা করে দেখবেন।” [৬]
“….স্বধর্মাভিমান যখন অন্য ধর্মকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে এমনকি বৈরীভাবে দেখতে আরম্ভ করে — বিশেষ করে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর – তখন প্রতিবেশী ভারতীয় হিন্দুর প্রতি পাঞ্জাবীদের রাজনৈতিক আচরণও যে বৈরীভাবাপন্ন হবে সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক।” [৭]
“দেশ বিভাগের পর পাঞ্জাবীদের ভিতর দেখা দিল দুই প্রকারের আত্মম্ভরিতা। পাকিস্তান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র অতএব পাকিস্তানীরা বিশ্ব মুসলিমের প্রতিভূ, এবং যেহেতু তাঁরা প্রতিভূ, অতএব তাঁরা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান; বলা বাহুল্য সেই সর্বশ্রেষ্ঠদের মুকুটমণি স্বভাবতই, অতি অবশ্যই পাঞ্জাবী মুসলমান। সূত্রটি সত্য কিন্তু তার থেকে যে দু’তিনটি সিদ্ধান্ত হল সেগুলো যুক্তি ও ইতিহাসসম্মত নয়।” [৮]
“… … …পাঞ্জাবী মুসলমানরা পাক-ভারতে শ্রেষ্ঠ — সর্বশ্রেষ্ঠ না – যোদ্ধা হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন। পঞ্চাশাধিক বৎসর ধরে আমি সিভিল মিলিটারি উভয় শ্রেণীর পাঞ্জাবীকে চিনি এবং কস্মিনকালেও এই খ্যাতিতে বিশ্বাস করিনি।” [৯]
“… … …ইয়াহিয়ার একাধিক সেপাই দ্বারা পর পর ধর্ষিতা অগণিত নারী সঙ্গে সঙ্গে প্রাণত্যাগ করেছে। অফিসারদের জন্য প্রতি কেন্টুনমেন্টে নির্মিত হয়েছিল ব্রথেল – অনেক মেয়েকেই লুট করে আনা হয়েছিল মেয়ে-বোর্ডিং থেকে। ঢাকাস্থ সাধারণ পাঞ্জাবী সেপাই ঢাকার সামান্য বাইরে মুক্তি ফৌজের ভয়ে…মুক্ত পাজামা হয়ে গিয়েছিল। ….এবং পরাজয় অনিবার্য জানামাত্রই অফিসার গোষ্ঠী প্রাইভেটদের না জানিয়ে প্লেন, হেলিকপ্টার, লঞ্চ চুরি করে পালায়… …এদের আমি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বলি কি করে?” [১০]
সৈয়দ মুজতবা আলী এভাবে ইকবালের উচ্চশিক্ষার জার্মান ডিগ্রীকে লক্ষ করে একধরনের নোংরা ব্যক্তি আক্রমণ দিয়ে শুরু করেছেন। এরপরে তিনি ইকবালের বৈশ্বিক মিল্লাত ও উম্মাহচেতনাকে ঠিকমত না বুঝে একে সাম্প্রদায়িক, জাত্যাভিমানী, ধর্মাভিমানী ইত্যাদি বলেছেন। মুসলমানদের ধর্মভিত্তিক জাতিবোধ এবং দেশচেতনার পার্থক্য না বুঝে এগুলিকে পরিচয় সংকট সৃষ্টিকারী ও বিভ্রান্তিকর বলেছেন। ধর্মচেতনা দিয়ে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির কোন নজির নেই বলেছেন। অথচ ল্যাটিন মহাকবি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ কিংবা ইংরেজ মহাকবি মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ তো ধর্মচেতনা দ্বারা প্রারম্ভিক আধুনিক কালের মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির নমুনা; এছাড়া বিশ শতকীয় আধুনিক ইংরেজী কাব্যে রয়েছে কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের আইরিশ লোকজ ইতিহাস ও খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি বিপুল উল্লেখে ভরপুর কাব্যের নমুনা। এছাড়া মার্কিন-ব্রিটিশ আধুনিক কবি টি এস এলিয়টের রয়েছে ক্যাথলিক চৈতন্যকে ধারণ করে অসামান্য কবিতা লেখার উৎকর্ষ ও সাফল্য। কাজেই সৈয়দ সাহেবের এসব অভিযোগ ও আপত্তি ধোপে টেকে না।
আর সর্বশেষে তিনি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধকালীন পাঞ্জাবী মুসলিম সৈনিক ও অফিসারদের বিচ্ছিন্ন কিছু অপকর্মের অতিরঞ্জিত বয়ানের উপরে নির্ভর করে যেভাবে পাঞ্জাবী মুসলিমদের সম্পর্কে সাধারণীকরণ করেছেন এবং স্টেরিওটাইপ আকারে চিত্রিত করেছেন তা অনেকটাই বর্ণবাদী এবং জাতিবিদ্বেষী রূপ পরিগ্রহ করেছে। সৈয়দ সাহেব এই কাজটি খুব সচেতনভাবে করেছিলেন ইকবালের পাঞ্জাবী জাতিসত্তাগত পরিচয়কে হেয় করার হীন উদ্দেশ্যে। যদিও ইকবাল পাঞ্জাবের অধিবাসী হলেও কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত ছিলেন।
মোদ্দা কথা হল সৈয়দ মুজতবা আলী একজন প্রকাশ্য মদ্যপায়ী, সম্ভোগবাদী, নন-প্রাকটিসিং মুসলিম। তিনি একজন প্রান্তিক সেক্যুলার, আধুনিক ও অতি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, পাশ্চাত্যমনা মানুষ। তার এই পক্ষপাতদুষ্ট চশমা পরা চোখে ইকবালের কুর’আন- নির্ভর জাতি ও ধর্মবোধ এবং জীবনদর্শন ও শিল্পচৈতন্য যে অপ্রিয় এবং বিভ্রান্ত বলে মনে হবে সেটাই স্বাভাবিক।
সৈয়দ মুজতবা আলীর এই তীব্র নেতিবাচক ইকবাল সমালোচনার এক দশকেরও বেশি পরে শঙ্খ ঘোষ নিয়ে এলেন তার ‘জাভিদনামা’র বাংলা অনুবাদ। সেখানে তিনি কম বেশি ইকবালকে একজন ‘মানবতাবাদী’ কবি হিশেবে দেখিয়েছেন; যেখানে ইকবাল তার নির্দিষ্ট সম্প্রদায়চেতনারও উর্ধ্বে। শঙ্খ ঘোষ এটা ভালই বলেছেন। আসলে এই কথিত ‘মানবতাবাদী’ বায়বীয় দৃষ্টিভঙ্গীটি ইকবাল সম্পর্কে ভারতের যে অফিসিয়াল পলিসি রয়েছে তার সঙ্গেই অনেকটা সাযুজ্যপূর্ণ।
তবে শঙ্খ ঘোষ ইকবালের সঙ্গে এক নারীর ব্যাক্তিগত প্রেমের সম্পর্কের আলাপও তুলেছেন। এই সম্পর্ক পারিবারিক ও সামাজিক বাধা পেরিয়ে বিবাহে পরিণত হতে না পারায় ইকবাল দারুণভাবে হতাশাগ্রস্ত ও অসুখী ছিলেন বলে তিনি মনে করেন। ঐ নারী লিখিত একটি ছোট্ট পুস্তিকার বরাতে তিনি আরো বলতে চেয়েছেন যে ইকবাল-জীবনের এই ব্যক্তিগত ট্রাজেডির কারণে ইকবালের আরো বড় ও মহৎ হবার সম্ভাবনা নাকি পূরণ হয়নি। এভাবে একটি তীর্যক দৃষ্টিপাত যোগ করে শঙ্খ ঘোষ বলতে চেয়েছেন যে ইকবাল এরপর যা করেছেন তাকে কী তার প্রতিভার অপচয় বলা যেতে পারে কিনা? [১১]
এই অবান্তর প্রশ্নের জবাবে আমরা বলব যে আমরা ইকবালের মতো কোনো ইতিমধ্যে মহৎ ও সফল ব্যক্তির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে এই ধরনের ব্যক্তিগত একটি ঘটনা দিয়ে অনুমানমূলক কল্পনাবিলাসে নিযুক্ত হওয়াকে অবাঞ্ছিত ও অশোভন বলে মনে করি।
ইকবাল একজন অত্যন্ত গভীর বিশ্বাসী, ভারসাম্যপূর্ণ এবং আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ ছিলেন। সেকারণেই তিনি তার সমকালে ও উত্তরকালে বিশ্বের বিপুল মানুষের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন ও থাকবেন।
রেফারেন্স:
[১] ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে ইকবালের সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর প্রথম পরিচয় হয়েছিল।
[২] অমিয় চক্রবর্তী, যুগসংকটের কবি ইকবাল, (‘সাম্প্রতিক’ (১৯৬৩) বই থেকে), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, সম্পাদনা: ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১২২
[৩] হুমায়ুন কবীর, ইকবাল ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ‘কবি ইকবাল’, সম্পাদক: মোহাম্মদ হবীবুল্লাহ, ঢাকা, প্রকাশকাল দেয়া নেই, পৃষ্ঠা ৩৬
[৪] মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্, ভূমিকা, ফররুখ আহমদ অনূদিত ‘ইকবালের নির্বাচিত কবিতা’, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রাজশাহী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮০, (১৯৫২ সালে প্রথম প্রকাশিত সৈয়দ আলী আহসান সম্পাদিত ‘ইকবালের কবিতা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত), পৃষ্ঠা ১৫-১৬
[৫] সৈয়দ মুজতবা আলী, ‘উভয় বাঙলা – নীলমণি’ (পঞ্চতন্ত্র, সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকা, ১৯৭২), সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও অন্যান্য সম্পাদিত, অষ্টম খন্ড, উভয় বাঙলা, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ৩২৩
[৬] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২৪
[৭] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২৪-৩২৫
[৮] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২৫
[৯] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২৫
[১০] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২৬
[১১] শঙ্খ ঘোষ, ইকবাল: প্রতিভার অপচয়? ঐতিহ্যের বিস্তার, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৭৪ – ৮৬
আল্লামা ইকবালের বিশ্বজনীন ইসলামের চেতনা, রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’, কাজী নজরুলের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধনা এবং আগামী বাংলাদেশের নবগঠন:
আল্লামা ইকবালের কাব্যে ও দর্শনে ইসলামের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনা ও রূপ বিধৃত হয়েছে। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান প্রকল্পে আল্লামা ইকবালের এই বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, একথা ঠিক। কিন্তু একথাও অনস্বীকার্য যে ১৯৪০ সালে ঘোষিত লাহোর প্রস্তাবের পরিবর্তিত সংস্করণের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে যে ঐকিক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আল্লামা ইকবালের এই বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছিল। অর্থাৎ যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ১৯৪৭ সালে গঠিত হয়েছিল সেটিকে আদতে তৎকালীন উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম সমস্যার প্রেক্ষিতে একটি স্থানীয় ধর্ম-সম্প্রদায়ভিত্তিক জাতিবাদী প্রতিক্রিয়া হিশেবেই দেখা দরকার।
এই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে ইসলামের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনার কিছু চিহ্ন ও প্রতীক স্থান পেয়েছিল, একথা ঠিক। কিন্তু বস্তুতঃ এই পাকিস্তান রূপকল্পে উপমহাদেশের উর্দুভাষায় দক্ষ উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের আশরাফ মুসলিমদের সম্প্রদায়ভিত্তিক জাতিবাদী আকাঙ্খা ও নেতৃত্ব কায়েম হয়েছিল। [১] পূর্ব বাংলার বিশাল আতরাফ মুসলিম জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল তাদের কৃষক চেতনার আলোকে। এই বাঙালি মুসলিম কৃষক ও প্রজা শ্রেণির উপরে হিন্দু জমিদার শ্রেণি দীর্ঘদিন ধরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত্তিতে শোষণ ও জুলুম চালিয়ে আসছিল। তাই এরা জমিদারি প্রথা অবসানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পাকিস্তান প্রকল্পের মধ্যে নিজেদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। [২] মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৯), শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) প্রমুখ বাঙালি মুসলিম ব্যক্তিত্ব এই কৃষক চেতনার কমবেশি ধারক ও বাহক হিশেবেই এদের নেতৃত্ব অর্জন করেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে সবচাইতে অর্গ্যানিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল হাশিম (১৯০৫-১৯৭৪) ও শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)। [৩] শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব যিনি একাধারে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রশিক্ষিত করেছেন [৪] এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিণত হয়েছেন। এজন্য তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়েছিলেন।
কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তান কায়েমের লড়াইয়ে একাধারে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও কংগ্রেস নেতৃত্বের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। এই ত্রিমুখী লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে তিনি উপমহাদেশের মুসলিমদের আঞ্চলিক ও শ্রেণিগত বিভেদকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রচ্ছন্ন করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে পূর্ব বাংলায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করা প্রশ্নে যে বিরোধ দেখা দেয় তার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান প্রকল্পের বোঝাপড়ায় উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ও পূর্ব বাংলার মুসলিমদের ভিন্নতা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এই বিরোধটি কেবলমাত্র জাতিগত বিরোধ ছিল না। এটি সেইসঙ্গে ছিল আশরাফ ও আতরাফ মুসলিমদের মধ্যকার একটি শ্রেণিগত বিরোধ।
এই বিরোধ যারা প্রকাশ করেছিলেন তারা মূলত বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হলেও এদের উৎসস্থল ছিল পূর্ব বাংলার বৃহত্তর কৃষক সমাজের গভীরে নিহিত। [৫] মনে রাখতে হবে এই কৃষক শ্রেণি পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিল জমিদারী প্রথার অবসানের মধ্য দিয়ে তাদের সার্বিক মুক্তির আকাঙ্খায়। কাজেই তারা এমন এক পাকিস্তান চেয়েছিল যেখানে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হবে এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা দীক্ষা অর্জন করে সমাজ ও রাষ্ট্রে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এজন্যে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়াটা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল।
আর এখানেই তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা সবচাইতে ভুল কাজটি করে বসলেন। আল্লামা ইকবালের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন ইসলামের চেতনা থেকে বিচ্যুতি আরেক কদম অগ্রসর হল। আশরাফ শ্রেণির আঞ্চলিক কৃষ্টি ও দৃষ্টির আলোকে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা বাঙালি মুসলিম কৃষক শ্রেণি থেকে উঠতি নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত কয়েক বছরের মধ্যেই এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য করল। এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া কোন সাময়িক এবং ঐকিক বিষয় ছিল না। এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিহিত ছিল তাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক সম্প্রদায়নিরপেক্ষ জাতিবাদী চেতনা ও আকাঙ্খা — যা পরবর্তী দুই দশক ধরে ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে। [৬]
এই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক সম্প্রদায়নিরপেক্ষ জাতিবাদী চেতনার জাগরণের প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রমাগত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে থাকলেন। তার সাহিত্য ও সঙ্গীত উঠতি শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে অনুসরণীয় ও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল।
ইসলামের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু বস্তুতঃ পাকিস্তান রাষ্ট্র এর উপনিবেশিক কাঠামো অব্যাহত রেখে অগ্রসর হতে থাকে; সেইসাথে জমিদারী প্রথা উঠে গেলেও সামন্ত প্রভুদের আধিপত্য নিঃশেষ হয়ে যায়নি; সিভিল প্রশাসন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও বহির্দেশীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল উপনিবেশিক আইন-কানুন ও পদ্ধতির আওতাধীন। এ কারণে পূর্ব বাংলায় উদ্ভূত এই ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সমস্যার কোন ইনসাফ বা আদল ভিত্তিক সমাধান করা হয়নি; উপরন্তু এই সমস্যার সঙ্গে পরবর্তী দুই দশকে যুক্ত হয় আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনার একটি ক্রমবর্ধিষ্ণু বয়ান।
এই সবকিছু মিলিয়ে পূর্ব বাংলায় দেখা দেয় একটি স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধিকার ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী ও আন্দোলন। এই আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার যোগান দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন এর প্রবক্তাদের কাছে প্রধান প্রণোদক আইকন বা প্রতিভূ। [৭] উর্দু ভাষায় দক্ষ পাঞ্জাবি ও ভারতের উত্তর অঞ্চল থেকে হিজরত করা উর্দুভাষী মোহাজের বিহারী মুসলিম — বাস্তব পাকিস্তানে আধিপত্য বিস্তারকারী এই দুই জাতিসত্তার বিরুদ্ধে বাংলাভাষী পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের এই সংগ্রাম পরিণত হয় একটি বাঙালি জাতিবাদী আন্দোলনে। আর এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সঙ্গীত এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। [৮]
পাকিস্তানের আশরাফ মুসলিম নেতৃত্ব যতই এই বাঙালি জাতিবাদী আন্দোলনকে ভারতের ষড়যন্ত্র ও হিন্দুদের প্রভাবপুষ্ট বলে প্রচার করতে চেয়েছে ততই এই আন্দোলন আরো বেশি জোরদার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এই কথা সত্য; যখন রবীন্দ্রনাথের হিন্দু ও ভারতীয় পরিচয় তুলে ধরে তার প্রভাব ও জনপ্রিয়তাকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করা হয়েছে তখনই তিনি এই বাঙালি জাতিবাদী আন্দোলনকারীদের কাছে আরো বেশি বরণীয় ও স্মরণীয় হয়ে উঠেছেন। এই প্রেক্ষিতেই ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে বেসরকারীভাবে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়েছিল। [৯]
কিন্তু এই ধারা ১৯৭১-পূর্ব কালে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও ১৯৭১-পরবর্তীকালে রবীন্দ্র অনুরাগীদের মধ্যে এক ধরণের উগ্র বাঙালি জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ঘটিয়েছে বলে লক্ষ করা যায়। এর প্রভাবে উর্দু ভাষা, উর্দুভাষী বিহারী ও সামগ্রিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী জাতিসত্তাগুলি, বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের প্রতি, একধরণের বিদ্বেষ ও ঘৃণার উদ্রেক হতে দেখা যায়। এই বিদ্বেষ ও ঘৃণা এতই সঞ্চারী যে এর প্রভাবে এরা এমনকি এদেশের নাগরিকদের মুসলমানত্ব ও অনেক ইসলামিকেট চিহ্ন ও প্রতীকের প্রতিও অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও প্রতিহিংসা প্রদর্শন করে।
এরই প্রভাবে আল্লামা ইকবালের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন ইসলাম-ভাষ্য থেকে পূর্ব বাংলার বাংলাভাষীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ ও বাউল চেতনা আশ্রয়ী যে বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন “মানুষের ধর্ম” বা সম্প্রদায় ও জাতিনিরপেক্ষ মহামানব চেতনা, তা যতটা না এই বাঙালি জাতিবাদীরা আত্মস্থ করতে পেরেছে, তার চাইতে তারা রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানী চেতনার একটি প্রতিচেতনা হিশেবে বেশি চর্চা করেছে।
একইভাবে এই উগ্র বাঙালি জাতিবাদী ও সাম্প্রদায়িকেরা কাজী নজরুল ইসলামের হিন্দু-মুসলিম যৌথ ঐতিহ্য ও ঐক্য সাধনাকে যতটা না অনুশীলন করেছে, তার চাইতে বেশি অনুশীলন করেছে নজরুলকে সামনে রেখে পাকিস্তানবাদ বর্জনের নামে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি হিন্দু রচিত সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অতিভক্তি; এবং উর্দু ও ফারসি ভাষা ও এসব ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি একধরনের বিদ্বেষ ও ঘৃণা।
এভাবে পূর্ব বাংলার বাঙালি একাধারে উপমহাদেশের তিন তিনজন মহাপুরুষের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনা ও আদর্শের প্রতি ইনসাফ ও আদল করতে ব্যর্থ হয়েছে; এবং তাদের উচ্চতর আদর্শ ও চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়ে একধরনের অদ্ভূত, স্থূল, সংকীর্ণ, কূপমন্ডুক, আত্মকেন্দ্রিক, একভাষী ও উর্ধ্বে মাঝারিমানের প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। এই কারণে এদের মধ্যে বিশ্বমানের বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৃহত্তর ও উচ্চতর উৎকর্ষ ও অর্জনের কোন নজির অত্যন্ত দুর্লভ।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আগামী বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পুনর্গঠিত ও নবগঠিত করা এখন সময়ের দাবী ও প্রয়োজন।
রেফারেন্স:
[১] Willem Van Schendel, A History of Bangladesh, Cambridge University Press, Cambridge, 2009
[২] Taj ul-Islam Hashmi, Pakistan As A Peasant Utopia: The Communalization Of Class Politics In East Bengal, 1920-1947, Westview Press, 1st edition, 1992, Routledge, New York, 2019
[৩] Joya Chatterji, Bengal Divided, Cambridge University Press, Cambridge, 1994
[৪] শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১২
[৫] বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, প্রথম প্রকাশ, ১৯৭০, সুবর্ণ সংস্করণ, ২০১২
[৬] Willem Van Schendel, A History of Bangladesh, Cambridge University Press, Cambridge, 2009
[৭] Anisuzzaman, Claiming and Disclaiming a Cultural Icon: Tagore in East Pakistan and Bangladesh, Rabindranath Tagore: Reclaiming a Cultural Icon, Eds. Kathleen M. O’Connell and Joseph T. O’Connell, Visva-Bharati, Kolkata, 2009, 377-389
[৮] সৈয়দ আবুল মকসুদ, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৭
[৯] Anisuzzaman, Claiming and Disclaiming a Cultural Icon: Tagore in East Pakistan and Bangladesh, Rabindranath Tagore: Reclaiming a Cultural Icon, Eds. Kathleen M. O’Connell and Joseph T. O’Connell, Visva-Bharati, Kolkata, 2009, 377-389
আল্লামা ইকবাল এবং আবুল মনসুর আহমদ:
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে উপমহাদেশে মুসলিমরা সাধারণভাবে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ১৭০৭ সালে মৃত্যু থেকেই উপমহাদেশে মুসলিম অবনতির সূত্রপাত হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ দমনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে মুসলিম পতনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়
উপমহাদেশের মুসলিমদের এই অবনতি ও পতনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। প্রথমেই যে প্রতিক্রিয়াটির কথা উল্লেখ করতে চাই সেটি ছিল ঐতিহ্যবাদী উলামাদের অরাজনৈতিক মাদরাসা-ভিত্তিক ইসলামী শিক্ষা সংরক্ষণের উদ্যোগ। এই উদ্যোগের ফল ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতের দেওবন্দে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম মাদরাসা। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর নেতৃত্বে জিহাদী আন্দোলনের অসফল পরিসমাপ্তি ও পরবর্তীকালে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের নির্মম ও নিষ্ঠুর দমনের প্রেক্ষাপটে এই ঐতিহ্যবাদী উলামারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারা প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন এবং জনগণের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে মাদরাসায় ইসলাম-শিক্ষার স্বাধীনতা সংরক্ষণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবেন। পূর্ব বাংলার ঐতিহ্যবাদী উলামারাও এই অরাজনৈতিক ও রাষ্ট্র-বহির্ভূত মাদরাসা শিক্ষাকেন্দ্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। মুফতী ফয়জুল্লাহ (১৮৯২-১৯৭৬), মওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (১৮৯৫-১৯৮৭), মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (১৮৯৬-১৯৬৯) এবং আল্লামা শাহ আহমদ শফী (জন্ম ১৯১৬) প্রমুখ এই কওমী শিক্ষা আন্দোলনেরই ফসল ও নেতৃত্ব।
১৮৫৭-উত্তর উপমহাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে মুসলিমদের দ্বিতীয় যে শিক্ষাগত প্রতিক্রিয়াটি আলোচনার দাবী রাখে সেটি হল স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) কর্তৃক ১৮৭৫ সালে প্রবর্তিত আলীগড় আন্দোলন। এই শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য ইংরেজী ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে পশ্চিমা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করা এবং উপনিবেশিক ভারতের প্রশাসন ও সমাজের নেতৃত্বে আসীন হওয়া। এক্ষেত্রে অধিকতর অগ্রসর উপমহাদেশীয় হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নিজেদের অধিকার ও সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেয়াটাও এই লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
আল্লামা ইকবাল বিশ শতকের সূচনা থেকে তার কাব্য ও দর্শনে ইসলামের যে চিত্রটি অঙ্কন করেছিলেন তা মূলত উপমহাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে মুসলমানদের জন্য একটি নবজাগরণের বার্তা বহন করেছিল। এক্ষেত্রে তিনিও পর্যালোচনা সাপেক্ষে পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার পক্ষপাতী ছিলেন। সুতরাং আল্লামা ইকবাল এদিক থেকে এক অর্থে স্যার সৈয়দের উত্তরাধিকারী ছিলেন বলা যায়। কিন্তু তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের মোকাবেলায় স্যার সৈয়দের মত অনুতপ্ত ভাষ্যকার বা এপলোজেটিক ছিলেন না। তিনি বরঞ্চ ইসলামের সক্রিয়বাদী ভাষ্যের পাটাতনে দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার পর্যালোচনা ও সমালোচনায় অসামান্য দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। এছাড়া তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ সূচিত হিন্দু-মুসলিম স্বাতন্ত্র্যের ধারণাকে আরো বিকশিত করে ১৯৩০ সালে এলাহাবাদ ভাষনে একটি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম মিল্লাত বা বিশ্বমুসলিম চেতনায় পৌঁছেছিলেন। [১] কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে ঘোষিত লাহোর প্রস্তাবে এই চেতনাকে দ্বিজাতিতত্ত্বে রূপান্তরিত করে।
বাঙালি মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার নকিব আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) আল্লামা ইকবালের দ্বারা এক্ষেত্রে স্পষ্টতই প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে অন্যান্যদের সঙ্গে মিলে যে ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’তে অংশগ্রহণ করেছিলেন তা ছিল এই চেতনার আলোকে গড়ে ওঠা একটি সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন। তার সঙ্গে পূর্ব বাংলার সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তি ও কৃষ্টিকে এই মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনায় জারিত করতে আরো যারা যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৯), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮), হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী (১৯০৬-১৯৬৬), আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪) প্রমুখ। ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (১৯২০-১৯৯৫) এবং সৈয়দ আলী আহসান-ও (১৯২২-২০০২) এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।
এবারে দেখা যাক আবুল মনসুর আহমদ পূর্ব বাংলার স্বতন্ত্র মুসলিম জাতি, রাষ্ট্র, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে কি ভেবেছিলেন। তার নিজস্ব লেখার পাঠ পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা তার এই বোঝাপড়াকে বুঝতে চাই। তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামীয়া কলেজে অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’র সম্মিলনীতে দেয়া মূল-সভাপতির ভাষনে বলেন:
“…রাজনীতিকের বিচারে ‘পাকিস্তানের’ অর্থ যাই হোক না কেন, সাহিত্যের কাছে তার অর্থ তমদ্দুনি আজাদি, সাংস্কৃতিক স্বরাজ, কালচার্যাসল অটনমি। … … …তমদ্দুনি আজাদি ছাড়া কোন সাহিত্য বাঁচতে পারা তো পরের কথা, জন্মাতেই পারে না। … … …জাতিতে-জাতিতে সংস্কৃতিগত পার্থক্য কত সুস্পষ্ট। হরেক জাতির রাজনৈতিক আজাদি নিশ্চয়ই হবে অদূরাগত ভবিষ্যতের যুগবাণী। কিন্তু সে রাজনৈতিক স্বরাজের সার্থকতা হবে জাতির স্বকীয় নিরংকুশ বিকাশে। এই বিকাশের মর্মবাণী হচ্ছে তমদ্দুনি আজাদি বা কালচার্যাসল অটনমি। এরই নাম পাকিস্তান। কৃষ্টিগত পরসহিষ্ণুতা পাকিস্তানের বুনিয়াদ।
… … …হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতিকে নিজ নিজ স্বকীয়তায় বাড়তে দিতে হবে। যারা অতীতে হিন্দু-মুসলিম-সংস্কৃতিকে ভেঙ্গেচুড়ে এক করতে চেয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যের সাধুতায় শ্রদ্ধা জানিয়েও আমরা বলতে বাধ্য, তাঁরা ঠিক কাজ করেন নি।
… … …অনেক বন্ধুর ধারণা, পাকিস্তান আন্দোলনটা প্রগতি-বিরোধী। কারণ এতে জোর দেওয়া হচ্ছে ধর্মোন্মাদনার দিকে এবং তাতে করে উপেক্ষা করা হচ্ছে বিজ্ঞান, প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধিকে। বন্ধুদের এ কথাটা যে শুধু স্থূলদর্শী ও অজ্ঞতা-প্রসূত তাই নয়, কথাটা অবৈজ্ঞানিকও বটে অনৈতিহাসিকও বটে। কারণ কোনো জাতি বা মানব গোষ্ঠীই নিজের সংস্কৃতিকে এড়িয়ে বা ডিঙিয়ে প্রগতির পথে এগুতে পারে না। যারা সে চেষ্টা করে, তারা অনুকরণ করে মাত্র, সৃষ্টি করে না। দুনিয়ার প্রগতিতে কোনো দান করতে তারা পারে না। অতএব সংস্কৃতিই হচ্ছে সকল জাতির জীবন সাধনার বুনিয়াদ। আর এই সংস্কৃতি হচ্ছে ধর্ম-বীজেরই ফুলে-ফুলে-মঞ্জরিত জীবন্ত গাছ।” [২]
এভাবে আবুল মনসুর আহমদ ‘পাকিস্তান’ ও ‘পূর্ব পাকিস্তান’ প্রসঙ্গে তার যে বয়ানটি এই ভাষনে উপস্থাপন করেছেন সেখানে দেখা যাচ্ছে তার মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধের বুনিয়াদ নিহিত রয়েছে ধর্ম ও সংস্কৃতির এক মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যে। এরপরে এই বয়ানে বৈশ্বিক মাত্রা সংযোজন করে তিনি বলেছেন:
“…পাকিস্তান রাষ্ট্র-দর্শনের কথা নয়; এটা জীবন-দর্শনের কথা। পাকিস্তান শুধু মুসলমানের জীবন-বাণী নয়; শুধু ভারতের হিন্দু-মুসলিমেরও বাণী নয়। পাকিস্তান সারা দুনিয়ার অদূরাগত ভবিষ্যতের বাণী।” [৩]
এভাবে পাকিস্তান ধারণাকে একটি বিশ্বজনীন এবং সর্বজনীন ইসলামিকতার উপরে স্থাপন করবার পরে তিনি আবার ফিরে আসছেন একেবারে তার স্থানীয় ও মূর্ত প্রেক্ষিতে অর্থাৎ তার পূর্ব বাংলায় যাকে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আখ্যা দিতে পছন্দ করেছেন; তিনি বলছেন:
“এইবার আসুন পূর্ব-পাকিস্তানে। ভারতের হিন্দু ও মুসলমানরা একজাতি নয়। তাদের সংস্কৃতিও এক নয়। … … …কিন্তু হিন্দুরা বা মুসলমানরাই কি নিজেরা এক-একটা আস্ত জাতি ?অথবা তাদের সংস্কৃতি এক-একটা আস্ত কৃষ্টি? তা’ নয় । আরবি, তুর্কী, আফগানরা একই মুসলমান হয়েও এক জাতি নয়। … … …এদের ধর্ম এক হলেও তমদ্দুন এক নয়। গাছ ও বীজের মধ্যে যা সম্পর্ক, ধর্ম সংস্কৃতির সম্পর্ক তাই। ধর্ম থেকেই সংস্কৃতির জন্ম। বীজ থেকেই গাছের জন্ম। আবার গাছের মধ্যেও বীজ রয়েছে। সংস্কৃতির মধ্যেও ধর্ম লুকিয়ে আছে। তবু গাছ ও বীজ এক নয়। ধর্ম ও সংস্কৃতি এক জিনিস নয়। ধর্ম ভূগোলের সীমা ছাপিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তমদ্দুন ভূগোলের সীমা এড়াতে পারে না। বরঞ্চ সে সীমাকে আশ্রয় করেই সংস্কৃতির পয়দায়েশ ও সমৃদ্ধি।
এইখানেই পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের সরহদ্দ। এইখানেই পূর্ব-পাকিস্তান একটা ভৌগোলিক সত্তা। এই জন্যই পূর্ব-পাকিস্তানের বাশিন্দারা ভারতের অন্যান্য জাত থেকে এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের ধর্মীয় ভ্রাতাদের থেকে একটা স্বতন্ত্র আলাহিদা জাত। …. …. …
পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি তাই পূর্ব-পাকিস্তানেরই রেনেসাঁ আনতে চায়।” [৪]
এরপরে তিনি রেনেসাঁ বলতে কি বোঝেন সেটা স্পষ্ট করে বলেন:
“… … …আমরা শুধু রাষ্ট্র-বিপ্লবে সন্তুষ্ট হতে পারি না। আমরা চাই জাতির সর্বাঙ্গীন বিপ্লব। আর সে বিপ্লব হবে জনগণের কল্যাণে রূপায়িত। শুধু রাষ্ট্র-রূপের পরিবর্তনে বা রাষ্ট্র-নেতার হাতফেরিতে পর্যবসিত হবে না সে বিপ্লব। রিভলিউশনে যে রাষ্ট্র রূপায়ণ হবে, তাতে গণকল্যাণ হতেও পারে, নাও হতে পারে। তাতে বিপ্লবীর জয় হতে পারে, আবার প্রতি-বিপ্লবীরও জয় হতে পারে। কিন্তু রেনেসাঁর পথে যে সর্বাঙ্গীন জয়লাভ হবে, তাতে এ ডিক্টেটর বা ও ডিক্টেটরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না; প্রতিষ্ঠিত হবে এক আল্লাহর রাজত্ব। সে রাষ্ট্রে তখন এ-শাসক ও-শাসিত বলে কেউ থাকবে না; সবাই হবে স্বরাট; সকলে হবে সমান। সে রাজ্যে এ-ধনিক আর ও-শ্রমিক বলে কেউ থাকবে না, সব ধনের মালিক হবেন আল্লাহ। আর আল্লার ধনের সমান ভোগী হবে তার সকল বান্দা। এজন্য রেনেসাঁ সোসাইটি রিভলিউশনের চেয়ে রেনেসাঁয় বেশি বিশ্বাসী।” [৫]
এরপরে আবুল মনসুর আহমদ ব্যাখ্যা করেছেন যে কেন তিনি রেনেসাঁ চান কিন্তু রিফরমেশন এবং রিভাইভাল চান না:
“তারপর রিফরমেশন নয় কেন ? রিফরমেশন ধর্মীয় সংস্কারের কথা। আমরা মুসলমান। ইসলাম আমাদের ধর্ম। ধর্ম আমাদের দ্বীনে-মোকাম্মে। কোন রিফরমেশনের এতে দরকার নেই; কোন সংস্কারের এতে গুঞ্জায়েশ নেই। ইউরোপে রিফরমেশনের দরকার পড়েছিল। কারণ খৃষ্ট-ধর্ম সেখানে স্বরূপ হারিয়ে গোঁড়া কুসংস্কারে পরিণত হয়েছিল। আমাদের ইসলামে তা হয়নি, এর চারপাশে অনেক আগাছা-আবর্জনা জন্ম নিয়েছে সত্য, কিন্তু কালের বিবর্তন ভূগোলের পরিবর্তন রাজার রাজদন্ড কিছুই ইসলামকে তার স্বকীয়তা থেকে হটাতে পারে নি। কাজেই আমাদের ধর্ম-সংস্কার বা রিফরমেশনের দরকার নেই।
তারপর ধরুন, রিভাইভ্যালিযমের কথা। রিভাইভ্যালিযম হচ্ছে ‘ফিরে চলার ডাক, ‘গোয়িং ব্যাকের’ আবাহন। আমরা কোথায় ফিরে যাব? দিল্লি-আগ্রার তখতে-তাউসেও ফিরে যেতে পারবো না, বাগদাদ-দামেশকের খেলাফতেও ফিরে যাওয়া চলবে না। সে আশা হবে বাতুলতা, আর সে চেষ্টা হবে আত্মঘাতী। আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ফাঁকি দিতে পারবো না। প্রগতিকে এড়িয়ে যেতে পারবো না। সেটা হবে আত্মহত্যারই শামিল।
বিগত গৌরবের যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কর্তারূপে মুসলমান ছিল দুনিয়ার শিক্ষক। শিল্প-বাণিজ্যে ছিল তারা বিশ্বের নেতা। প্রগতির ছিল তারা অগ্রপথিক। এ যুগে আমাদের সে গৌরবের পথে ফিরে যেতে হলে, সে নেতৃত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের চলতে হবে যুগের আগে-আগে। প্রগতি থেকে মুখ ফিরিয়ে পিছন দিকে রওয়ানা হলে চলবে না। কাজেই রিভাইভ্যালিযম বা ‘ফিরে চলোর’ ডাক আমাদের আদর্শ হতে পারে না।
পূর্ব-পাকিস্তানের জাগরণের জন্য তাই রেনেসাঁ অপরিহার্য। এটা আমরা বুঝতে পারি ইউরোপের রেনেসাঁর বিচার করলে। ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রাক্কালে তথাকার খৃষ্টান জাতিসমূহের যে দুরবস্থা হয়েছিল, পূর্ব-পাকিস্তানের বাশিন্দাদেরও আজ সেই দুরবস্থা।” [৬]
তাহলে দেখা যাচ্ছে আবুল মনসুর আহমদ তার পূর্ব-পাকিস্তানের তত্কালীন সংকটময় অবস্থার তুলনা করছেন ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি সুনির্দিষ্ট পর্ব অর্থাৎ রেনেসাঁ -পূর্ব সময়ের সঙ্গে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে সমাধানটি তিনি উপস্থাপন করছেন তাও তিনি আহরণ করছেন ইউরোপীয় ইতিহাসের থেকে। লক্ষণীয় তিনি কিন্তু সমস্যা ও সমাধানের পূর্ব-নজির মুসলিম বা ইসলামিকতার পরিমন্ডল থেকে আহরণ করছেন না। কাজেই ইউরোপীয় রেনেসাঁর একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য করণীয় নির্ধারণ করে বলছেন:
“… … …রেনেসাঁ … … জাতীয় জীবনের একটা গুরুতর নৈতিক সাধনার বস্তু। একটা সর্বজনীন কর্মোন্মাদনার ব্যাপার। জাতীয় নওজোয়ানির পাহাড় ভাঙা পর্বত ডিঙানো দৃঢ় সংকল্পের রূপায়ন। … … …চিন্তার রাজ্যে জাতির কালেকটিভ মনে বিপ্লব না এলে কর্মে বিপ্লব আসতে পারে না। চিন্তায় বিপ্লব আনবার দায়িত্ব কবি-সাহিত্যিকের। ফরাসী বিপ্লব প্রভৃতি সত্যিকার বিপ্লবের দিকে নজর দিলেই আমরা এটা দেখতে পাই।” [৭]
এবারে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্য কেমন হওয়া উচিত সেটা বলতে গিয়ে উনিশ শতকের উপনিবেশিক কলকাতায় উদ্ভূত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি চুলচেরা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন; তিনি বলেন:
“পূর্ব-পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুবই উন্নত সাহিত্য। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গেছেন।
তবু এ সাহিত্য পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। কারণ এটা বাঙলার মুসলমানের সাহিত্য নয়। এ-সাহিত্যে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোনো দান নেই শুধু তা নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ-সাহিত্যের কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ-সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ কোনো প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে এ-সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়; এর বিষয়-বস্তুও মুসলমান নয়। এর স্পিরিটও মুসলমান নয়; এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়।
… … …এ-সাহিত্য হিন্দু-মনীষীর সৃষ্টি। সুতরাং হিন্দু সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করেই তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই করেছেন তাঁরা। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না। হিন্দু ধর্মেরই সন্তান। হিন্দু ধর্ম ত্যাগ বৈরাগ্য ও মুনী ঋষির ধর্ম। হিন্দু সংস্কৃতিও তাই ত্যাগ প্রেম ও ভক্তিবাদের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির বুনিয়াদ প্রতীক-পূজা। কাজেই হিন্দুর শিল্পী মন সুন্দরের পূজারী। এতে করে এই বাঙলা সাহিত্যের প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্যম শিবম সুন্দরমের সাধনা। … … …[এই] বাঙলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে নারী-প্রেমকে কেন্দ্র করে। নারী এখানে সৌন্দর্যের প্রতীক। … … … … … … এইসব আদর্শকে বুনিয়াদ করে নারী-প্রেমকে কেন্দ্র করে হিন্দু শিল্প-মনীষা যে সাহিত্য রচনা করেছে, সে সবই হয়েছে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য এবং তা পড়ে অপর সকলের মতই মুসলমান রস-পিপাসীরাও পিপাসা নিবারণ করে থাকে। কিন্তু সত্য কথা এই যে, ঐ সাহিত্যকে মুসলমানরা তাদের জাতীয় সাহিত্য মনে করতে পারে না। কারণ ত্যাগ, বৈরাগ্য-ভক্তি-প্রেম যতই উঁচুদরের আদর্শ হোক, মুসলমানের জীবনাদর্শ তা নয়। হিন্দুর ধর্ম যেমন ত্যাগ বৈরাগ্য ও মুনী ঋষির ধর্ম মুসলমানের ধর্ম তেমনি হক-ইনসাফ ও জেহাদ-শহীদের ধর্ম। প্রতীকবাদী সুন্দর-পূজারী আর্টবাদী হিন্দু সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তি-কেন্দ্রিক, মুসলিম সংস্কৃতি তেমন ব্যক্তি-কেন্দ্রিক নয়। হক-ইনসাফবাদী কল্যাণমুখী মুসলিম সংস্কৃতি তাই সমাজ-কেন্দ্রিক।
… … …মুসলমান মূলত কর্মবাদী, ভক্তিবাদী নয়। … … … নারী মুসলমানের নজরে দেবী নয়। … … …সে মানবী। … … …বাঙলার মুসলমান অনর্জিত বিত্তশালী অবসর-প্রচুর শ্রমকুণ্ঠ অভিজাত শ্রেণী নয়। কাজেই… … …নারীমন তাদের কাছে রহস্যপুরীও নয়। এই জন্যই বর্তমান বাঙলা সাহিত্য মুসলিম সমাজ মনে কোনো প্রেরণার স্পন্দন জাগাতে পারেনি। তাই রাধা কৃষ্ণের প্রেমে প্রতিবেশী হিন্দু ভাইকে আনন্দে নৃত্য করতে দেখেও মুসলিম সমাজ-মনের একটা তারও ঝনাৎ করে উঠেনি।” [৮]
এই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরে আবুল মনসুর আহমদ যখন কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিকে মুসলিম চেতনার রূপায়ন হিশেবে ব্যাখ্যা করেন তখন পরিস্কার হয়ে যায় এই কবিতাটি কেন বাঙালি মুসলিমদের এতটা নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল; তিনি বলেন:
“… … …যেদিন এক অচেনা অজানা বালক হঠাৎ জিকির দিয়ে উঠলো: ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’, সেদিন রিক্ত ক্লান্ত ঘুমন্ত ও জীবন্মৃত মুসলমান ধচ্মচ্ করে জেগে উঠে চোখ রগড়াতে-রগড়াতে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো: ‘উন্নত মম শির’। কারণ এ যে তারই অন্তরের ঘুমন্ত শিশুর চীৎকার। এ যে তারই জীবনের কথা। তাই নজরুল ইসলামের আকস্মিক আবির্ভাব মুসলিম সমাজ-মনকে এমন করে আলোড়িত করতে পেরেছে। … … …নজরুল ইসলাম এই জীবনকে কেন্দ্র করেই সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। শুধু এই কারণেই নজরুল ইসলাম পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় কবি।” [৯]
এরপরে আবুল মনসুর আহমদ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙলা সাহিত্যের বিষয়বস্তু নিয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করেন:
“… … …সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা যদি আমরা না হলাম, সাহিত্যের পটভূমি যদি আমার কর্মভূমি না হলো, সাহিত্যের বাণী যদি আমার মর্মবাণী না হলো, তবে সে সাহিত্য আমার সাহিত্য হয় কিরূপে?আমার ঐতিহ্য, আমার ইতিহাস, আমার কিম্বদন্তী এবং আমার উপকথা যে সাহিত্যের উৎস নয়, সে সাহিত্য আমার জীবন-উৎস হবে কেমন করে? … … …
… … … বাঙলার মুসলমানকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে জাগ্রত ও জীবন্ত করে তুলতে হলে, তার জীবনে রেনেসাঁ আনতে হলে তার সাহিত্য সাধনাকে অনুকরণ-অনুসরণ থেকে বাঁচাতে হবে। তাকে নিজস্ব সাহিত্য দিতে হবে। হিন্দুর সৃষ্ট বাঙলা সাহিত্য খুবই বড়। খুবই উচ্চাঙ্গের। কিন্তু তার নকল করে মুসলমান অমন বড় অমন জীবন্ত সাহিত্য রচনা করতে পারবে না; হোমার মিল্টন শেকসপিয়ারকে নকল করে রবীন্দ্রনাথ অতবড় সাহিত্য রচনা করতে পারতেন না। তিনি তাঁর সাহিত্য সাধনাকে নিজস্ব কৃষ্টির উপর দাঁড় করাতে পেরেছেন বলেই তিনি আজ বিশ্ব-কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙলার মুসলমানও তেমনি রবীন্দ্রনাথের নকল করে বড় হতে পারবে না। তাকে বড় হতে হবে তার স্বকীয়ত্বের উপর দাঁড়িয়ে, নিজের কৃষ্টিকে বুনিয়াদ করে। বিশ্ব-কবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব-ভারতীয় আকাশে কতবার শরতের চন্দ্রোদয় হয়েছে, তাতে শারদীয়া পূজায় ‘আনন্দময়ী মা’ কতবার এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ-মোহররমের চাঁদ উঠেনি। সে চাঁদ উঠাবার ভার ছিল নজরুল ইসলামের ওপর। এতে দুঃখ করবার কিছু নেই। কারণ এটা স্বাভাবিক। কাজেই কঠোর সত্য।” [১০]
এরপরে তার ভাষন শেষ করবার আগে তিনি বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য ঐতিহ্য কি সে সম্পর্কে তার মত প্রকাশ করেন এভাবে:
“… … …বাংলার বর্তমান সাহিত্যে মুসলমানের কোনো দান নেই বলে বাঙালি মুসলমানের কোনো সাহিত্যই নেই, এ কথা ঠিক নয়। … … …বস্তুত বাংলার মুসলমানের যেমন একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তেমনি তাদের একটা নিজস্ব সাহিত্যও আছে। সে সাহিত্যের নাম মুসলমানী বাংলা সাহিত্য বা পুঁথি সাহিত্য। মকতবে-মাদ্রাসায় শিক্ষিত লক্ষ লক্ষ মুসলমান পাঠক ঐ পুঁথি সাহিত্য থেকেই জীবনের প্রেরণা পাচ্ছে।
… … …পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্যিক রেনেসাঁ আসবে এই পুঁথি সাহিত্যের বুনিয়াদে। … … …বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যের প্রাণ হবে মুসলমানের প্রাণ এবং সে সাহিত্যের ভাষাও হবে মুসলমানেরই মুখের ভাষা। এই দুই দিকেই আমরা পুঁথি সাহিত্য থেকে প্রচুর প্রেরণা ও উপাদান পাব। … … …পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্য রচিত হবে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীর মুখের ভাষায়। সে ভাষা সংস্কৃত ব্যাকরণের বা তথাকথিত বাংলা ব্যাকরণের কোনো তোয়াক্কা রাখবে না। পূর্ব-পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় সে ভাষায় নিজস্ব সত্যকার বাংলা ব্যাকরণ রচনা করবে।” [১১]
এরপরে আবুল মনসুর আহমদ বাংলা ভাষার হরফ সংস্কারের একটি পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন; এবং পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্য ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল ভবিষ্যত আশা করে তার এই ঐতিহাসিক ভাষনের সমাপ্তি টানেন।
রেফারেন্স:
[১] Muhammad Iqbal, Presidential Address, 25th Annual Session of All-India Muslim League, Allahabad, December 29, 1930
[২] আবুল মনসুর আহমদ, পাক-বাংলার রেনেসাঁ, (কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’র সম্মিলনীতে প্রদত্ত মূল-সভাপতির ভাষন, ৫ মে ১৯৪৪), বাংলাদেশের কালচার, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ১৯৬৬, প্রথম সংস্করণ, সপ্তম মুদ্রণ, ২০১১, পৃষ্ঠা ৯৪-৯৫
[৩] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৬
[৪] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৬
[৫] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৭
[৬] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮
[৭] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৯-১০০
[৮] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০০-১০১
[৯] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০২
[১০] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০২-১০৩
[১১] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪
লেখক পরিচিতি:
মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত
লেখক
কবি
গবেষক