Shah Waliullah Dehlawi: One of the pioneers of Muslim awakening in Bengal

সামাজিক- সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক পটভূমি:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ছিলেন যুগস্রষ্টা মহাপুরুষ। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল ফাইয়্যাদ কুত্বউদ্দীন। পিতা শাহ আবদুর রহীম ও দাদা শাহ ওয়াজিহুদ্দীন ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গযীবের সময়কার খ্যাতিমান আলিম। শাহ ওয়ালিউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন শায়খ আহমদ সরহিন্দ মুজাদ্দিদ-ই আলফিসানীর (১৫৬৩-১৬২৪) ইনতিকালের প্রায় আশি বছর পরে, দিল্লীর শহরতলীতে, ১৭০৩ খ্রীস্টাব্দের ২১ ফেব্র“য়ারী মুতাবিক ১১১৪ হিজরী সনে। তিনি ছিলেন জাজিরাতুল আরবের যুগ প্রবর্তক এীষী শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব নযদীর (১৭০৩-১৭৯২) সমসাময়িক।

দশ সম্রাটের শাসনকাল:

শাহ ওয়ালিউল্লাহর জন্ম হয় মুগল সম্রাট আওরঙ্গযীব আলমগীরের মৃত্যুর চার বছর আগে এবং ইনতিকাল করেন দিল্লীর অন্ধ সম্রাট শাহ আলমের আমলে। ফলে তিনি দিল্লীর দশজন সম্রাটের শাসনকাল প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। তিনি ক্ষয়িষ্ণু মুগল সাম্রাজ্যের অনেক বিপর্যয় ও বিশৃংখলার দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করেন। সে সাথে তাঁর চোখের সামনেই ক্রুসেডের উত্তরাধিকারী পাশ্চাত্য ফিরিঙ্গি শক্তির অভ্যুদয় ঘটে। এমনি এক পরিস্থিতিতে জাতিকে কুরআনের আলোকে পথ দেখানোর কঠিন দায়িত্ব পালন করেন যামানার মুজাদ্দিদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ ।

জনবিচ্ছিন্ন ও নীতিহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি:

মুগল সম্রাট আওরঙ্গজীব আলমগীরের মৃত্যুর পর তাঁর অযোগ্য উত্তরাধিকারীগণ শৌর্য-বীর্য হারিয়ে ভীরুতা ও কাপুরুষতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। নাদির শাহের হামলায় তাঁদের শেষ শক্তিটুকুও তখন নি:শেষপ্রায়। মুগল সম্রাটগণ মারাঠাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। তৈমুরের এককালের বংশধরগণ আত্মরক্ষার যে শক্তিশালী দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন, অযোগ্য উত্তরাধিকারীদের হাতে পড়ে সেসব দুর্গ স্বার্থ-শিকারী আর ভাগ্যান্বেষীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিলো। দিল্লীর সিংহাসনের ওপর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে লোভী স্বার্থ-শিকারীদের একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছিলো।

দিল্লীর নামমাত্র সম্রাট তখন কার্যত উযীর, উমরাহ ও পারিষদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিলেন। সেই আমীর-উমরাহগণও পরস্পর আত্মকলহ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িত ছিলেন। দিল্লীর লাল কেল্লার বাইরে প্রত্যেক প্রদেশের সুবাহদার তখন তাঁর নিজ স্বাধীনতা ঘোষণার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। কেন্দ্র ও সুবাহর মধ্যে চলছিলো এক হতাশাজনক ও পীড়াদায়ক রাজনৈতিক দাবা খেলা। দিল্লীর সম্রাট কখনো কোন আমীরের প্রতিপত্তির কাছে নতি স্বীকার করছিলেন, আবার কখনো কারো তোষামোদে গলে গিয়ে তাকে সুবাহদারী মনযূর করছিলেন।

বিশাল মুগল সাম্রাজ্য তখন কার্যত খন্ড-বিখন্ড। কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন শাসকগণ আত্মকলহে লিপ্ত। এক কথায় সাম্রাজ্যের রাজনীতি এ সময় হয়ে পড়েছিলো পুরোপুরি গণ-বিচ্ছিন্ন এবং নীতি বিবর্জিত।

শাসক সমাজ ও আমীর-উমরাহ এবং রাজানুকূল্য লাভকারী মুসলিম ধনিকশ্রেণীর মধ্যে চরম বিলাসিতা, নিষ্ক্রিয়তা ও নির্বীর্যতা বাসা বেঁধেছিলো। মদপান, সংস্কৃতির নামে বাইজীচর্চাসহ নানা চারিত্রিক স্খলন ও অবক্ষয় সমাজের উচ্চশ্রেণীকে নৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলেছিলো। আঠারো শতকের মুসলিম সমাজে–দিল্লী থেকে মুরশিদাবাদ, ঢাকা, সোনারগাঁও কিংবা চট্টগ্রাম, সর্বত্র–একই অবস্থা বিরাজ করছিলো।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষয় :

সমকালীন সাধারণ মুসলিম সমাজের নৈতিক, তামুুদ্দুনিক ও সামাজিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো। আকীদা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ, নৈতিক বৃত্তি ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সৃষ্টি হয়েছিলো সার্বিক বিপর্যয়। আঠারো শতকের মুসলিম সমাজে কুরআন-সুন্নাহর আদর্শের পরিবর্তে শিরক, বিদআত, হিন্দু-মিথ-প্রভাবিত সূফীতত্ত্ব, দীন ও শরীয়তের পরিপন্থী ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রাধান্য লাভ করেছিলো। ইসলাম যে পর্ণাঙ্গ বৈপ্লবিক আদর্শ এবং শান্তি ও স্বাধীনতার রক্ষাকবচ এবং এটিই যে সভ্যতা নির্মাণ ও হিফাযতের মৌল উপাদান, সে ধারণা সমাজ থেকে প্রায় লোপ পেয়েছিলো।

আলিমগণ কুরআন-হাদীসের চর্চা বাদ দিয়ে ফিক্হর খুঁটি-নাটি বিষয় নিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত ছিলেন। মুসলমানগণ তাদের জীবন থেকে সংগ্রামকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ইসলামী আদর্শের প্রেরণা অনুপস্থিত ছিলো। জিহাদের প্রেরণা ভুলে তারা হয়ে পড়েছিলো নিছক ভাড়াটিয়া বা চাকুরে।

এ পরিস্থিতি মুকাবিলায় মুসলিম জাতির শিক্ষা এবং দীনী ও নৈতিক উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা বা ফুরসত কোনটাই আলমগীর-এর উত্তরাধিকারী সম্রাট এবং তৎকালীন সুবাহদারদের ছিলো না। বংশীয় শাসন ও গদি রক্ষার কাজেই তাঁদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিয়োজিত ছিলো।

বিদেশী বণিক ও মিশনারী প্রতিপত্তি:

মুসলিম শাসকদের দুর্বলতা ও অসচেতনতার সুযোগে সে সময় বাংলায় ইউরোপীয় খ্রীস্টানদের মিশনারী তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তারা এখানে খ্রীস্টধর্মের ব্যাপক প্রচার শুরু করে। হুগলী, ঢাকা, শ্রীপুর ও পিপলীতে কেন্দ্র স্থাপন করে তারা হাজার হাজার মুসলমান ও হিন্দুকে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে। স্থানীয় মুগল শাসকগণ এতে বাধা দেননি। আলিম ও পীরদের দুর্বল প্রতিরোধের মুখে শাসকরা মিশনারীদেরকেই সাহায্য করেছেন।

এমনি পরিস্থিতিতে বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের উপকূল এলাকায় ইংরেজদের বাণিজ্যিক কুঠিগুলো অস্ত্রাগার ও কেল্লায় পরিণত হচ্ছিলো। ইংরেজ ও ফরাসী বণিকদের সাথে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ বণিকদের দীর্ঘ দিন ধরে সংঘাত চলে। পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিতাড়িত করার পর ইংরেজরা রাজনৈতিক ক্ষমতার দিকে নযর ফেরায়। দেশের ভেতরকার অনৈক্যের সুযোগ তারা পুরোপুরি কাজে লাগায়। হিন্দুস্তানের কোন প্রদেশে ক্ষমতার দুই দাবিদারের মধ্যে লড়াই বাঁধলে সাহায্যের জন্য এক দাবিদার হাত পাততেন ইংরেজদের কাছে, অপরজন ধরনা দিতেন ফরাসীদের কাছে।

বাংলার বিপদ দিল্লীর ব্যর্থতা:

শাসকদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতা, রাজনৈতিক অংগনে বিরাজমান বিভেদ ও বিশৃংখলা এবং অন্যদিকে মারাঠা ও শিখদের উত্থানের পাশাপাশি ক্ষাত্র-শক্তিহীন, অপেক্ষাকৃত নিরীহ অথচ ষড়যন্ত্র-পটু, জাগরণকামী বর্ণ-হিন্দু বেনিয়া ও শেঠদের মুসলিম বিদ্বেষ, লোভ ও ষড়যন্ত্র ইংরেজদেরকে তাদের লক্ষ্য হাসিলে উৎসাহী, সাহসী ও বেপরোয়া করে তোলে। তারা বাণিজ্যের পেশাদারী থেকে সাম্রাজ্য গড়ার রাজনীতির দিকে অগ্রসর হয়। তার প্রথম শিকার হয় সুবেহ বাংলা বা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আঠারো শতকের শেষার্ধে এ এলাকার কর্তৃত্ব গ্রাস করে।
বাংলার মুসলিম শাসনের সাথে দিল্লীর সালতানাত দীর্ঘদিন গভীরভাবে জড়িত ছিলো। বাংলায় মুসলিম শাসন অবসানের পরও আরো নব্বই বছর দিল্লীতে মুসলিম শাসন চালু ছিলো। কিন্তু বাংলার বিপদে দিল্লীর দুর্বল শাসকরা কার্যকর কোন ভূমিকাই পালন করতে পারেন নি।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর মানস গঠন:

উপমহাদেশের মুসলমানদের সার্বিক বিপর্যয়ের এমনি এক পটভূমিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী। মুজাদ্দিদে আলফিসানীর বিশিষ্ট খলীফা শাহ আদম বিন্নৌরীসহ বহু বিশিষ্ট ধর্মবেত্তার কাছে শাহ ওয়ালিউল্ল¬াহ শিক্ষা লাভ করেন। তিনি আরবী ও ফারসী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তাফসীর, হাদীস, ফিক্হ, উসল, মানতিক, কালাম, তাসাউফ, চিকিৎসা, দর্শন, জ্যামিতি ইত্যাদি বিদ্যায়ও তিনি পান্ডিত্য অর্জন করেন।

এরপর তিনি দিল্লীতে তাঁর পিতার স্থাপিত মাদ্রাসা-ই-রহীমিয়ায় দীর্ঘ বারো বছর অধ্যাপনা করেন।

তিনি হাদীসের ইতিহাস, হাদীসের যথার্থতা যাচাই পদ্ধতি ও ব্যাখ্যা এবং কুরআনের সাথে হাদীসের সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে ১৭৩০ সালে হিজাজ গএ করেন। মক্কায় হজ্জ সমাপনের পর তিনি এক বছর মুসলিম জাহানের নেতৃস্থানীয় আলিম ও চিন্তানায়কদের সাথে মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন সমস্যা বিষয়ে আলোচনা করে অতিবাহিত করেন। হিজাজে তিনি শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে শায়খ আব তাহের মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কুরদী মাদানী ও শায়খ সুলায়মান মালিকের কাছে হাদীস বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। এছাড়া তিনি শায়খ তাজউদ্দীন হানাফী, মুফতী-ই-মক্কা শায়খ আলাবী প্রমুখ বিশিষ্ট আলিমের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন।

এভাবে তিন বছর হেজাজে শিক্ষা সফর শেষে ১৭৩৩ সালে দ্বিতীয়বার হজ্জ সম্পন্ন করে দেশে রওনা হন এবং ছয় মাস পর দিল্লী পৌঁছেন। এরপর শাহ ওয়ালিউল¬াহ মুসলিম উম্মাহর চিন্তা ও কর্মের ত্র“টি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার ব্যাপারে তাঁর সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুনর্গঠন পরিকল্পনা:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন সমকালীনতার প্রভাবমুক্ত একজন যুগোত্তীর্ণ চিন্তানায়ক। এ এীষী সমসাময়িক মতবাদসমূহের বিভ্রান্তির ঊর্ধে থেকে নিজের মুক্ত চিন্তা ও বিচার-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে উম্মাহ্র প্রধান দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করেন। সমালোচনার মাধ্যমে শত শত বছরের বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করে উম্মাহর বুদ্ধি ও চিন্তা-চেতনার জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন এবং চিন্তা ও গবেষণার নতুন মহাসড়ক নির্মাণ করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ সমালোচনার মাধ্যমে উম্মাহর মৌলিক গলদগুলোকে স্পষ্ট করে তোলেন এবং জাতির চিন্তার পুনর্গঠনে তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেন।

মূলে ফেরার তাকীদ:

এ এীষী উপলব্ধি করেন যে, ইসলামের মূল সত্য থেকে বিচ্যুতিই মুসলমানদের পতনের কারণ। তিনি ইসলামী আদর্শ, ভাবধারা ও জীবন বিধানের ভিত্তিতে মুসলিম সমাজ পনুর্গঠনের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পূর্ণ ইসলামী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তিনি প্রথম পর্যায়ে মুসলমানদের চিন্তার সংশোধন ও পরিশুদ্ধির কাজে হাত দেন। মুসলিম শাসক, আমীর-ওমরাহ, সৈনিক, আলিম, সূফী, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী তথা সকল স্তর ও পেশার মানুষকে তিনি ইসলামের সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবান জানান। তাদের আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, শিক্ষা-চরিত্র, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে সকল প্রকার অনিসলামী প্রভাবের ঊর্ধ্বে কুরআন-হাদীসের আলোকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যএে বিপর্যয় রোধ সম্ভব বলে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন।

মধ্যযুগ শেষ আধুনিক যুগে কলম হবে হাতিয়ার:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর গভীর অন্তরর্দৃষ্টি, অনুধ্যান এবং সাধনায় এতটা দূরদর্শী হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁর সময়েই যুগের একটি বিভাজন ঘটছে–এটা তিনি উপলব্ধি করেন। তিনিই প্রথম উল্লেখ করেন যে, মধ্যযুগের অবসান হয়েছে এবং আধুনিক যুগের শুরু হতে যাচ্ছে। এখন শুধু তলোয়ারের মাধ্যমে নয়, কলমের সাহায্যে মুকাবিলার কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। তাঁর এ দূরদৃষ্টিই তাঁকে আধুনিক যুগের প্রবক্তা একজন সাচ্চা কলম-সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তার পুনর্গঠন ইজতিহাদের পথ নির্দেশ:

দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তার পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। তিনি মুসলমানদের মাযহাবী বিরোধ দূর করার পথ নির্দেশ করেন। ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন। ইজতিহাদকে তিনি সকল যুগের জন্য ফরযে কিফায়া বলে উল্লেখ করেন। ইজতিহাদের নিয়ম-বিধান ও শর্তাবলী রচনা করে এ ক্ষেত্রে তিনি একটি শৃংখলার পথ-নির্দেশ দান করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে কুরআনের জীবন ব্যবস্থা ও ইসলামী জীবন দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেন। ইসলামের নৈতিক, তামুদ্দুনিক ও আইনগত ব্যবস্থাকে তিনি লিখিত আকারে পেশ করার উদ্যোগ নেন।

আল-কুরআনের তরজমা:

‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’, ‘ইযালাতুল খিফা’ প্রভৃতি পান্ডিত্যপূর্ণ রচনা ছাড়াও কুরআন-হাদীসের জ্ঞানের সাথে জনগণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য তিনি তখনকার সামাজিক ও সরকারী ভাষা ফারসীতে আল-কুরআন তরজমা করেন। পবিত্র কুরআন মজীদের এ তরজমা ছিল এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। কেননা, সমকালীন আলিমগণ ভিন্ন ভাষায় কুরআনের তরজমা করা যাবে না মর্মে যে প্রচলিত বিশ্বাসে অবস্থান করছিলেন, সে বিভ্রান্তির দেয়াল ভেঙে আল কুরআনের তরজমার মাধ্যমে ওহীর জ্ঞানকে মানুষের বোধের সীমায় আনয়নের ব্যবস্থা করেন।

কুরআন তরজমার সুদূর প্রসারী ফল:

এ তরজমা কর্মের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ফার্সী ভাষায় কুরআন অধ্যয়নের সুযোগেই ভারতে ব্রাহ্মধর্ম নামে একেশ্বরবাদী একটি ধর্মের বিকাশ ঘটে। এ ধর্মের অনুসারী তদানিন্তন ঢাকা জেলার ভাই গিরিশচন্দ্রসহ অনেকে শাহ ওয়ালিউল্লাহর পথ ধরেই ফারসী ভাষা থেকে আল কুরআনকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। এভাবেই আমাদের দেশে আল কুরআন তরজমার ধারা বিকশিত হয়।

শুধু তাই নয়, তিনি হাদীসের প্রথম সংকলিত গ্রন্থ ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’-এর তরজমা করেন এবং তাতে টীকা সংযোজন করেন। এভাবে কুরআন-হাদীসের শিক্ষা-পদ্ধতিতে তিনি ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর সুযোগ্য পুত্রগণের চেষ্টায় এ দেশে কুরআন ও হাদীস চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়।

জাহিলী রাষ্ট্র উৎখাতে বিপ্লব সমর্থনযোগ্য:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ পারিবারিক জীবন সংগঠন, সামাজিক রীতি-নীতি, রাজনীতি, বিচার-ব্যবস্থা, কর-ব্যবস্থা, দেশ-শাসন, সামরিক সংগঠন প্রভৃতি দিক নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। সমাজ-সভ্যতার বিপর্যয় ও বিকৃতির কারণসমূহের ওপর তিনি গভীরভাবে আলোকপাত করেন। তিনি ইসলাম ও জাহিলিয়াতের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের একটা ধারণাও পেশ করতে সক্ষম হন। তিনি খিলাফত ও রাজতন্ত্রের পার্থক্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। জাহিলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের পার্থক্যকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরে তিনি যুক্তি দেন যে, জাহিলী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবসান করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত কোন ঈমানদারের পক্ষেই নিশ্চেষ্ট বসে থাকা সম্ভব নয়।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইসলামকে নিছক একটি ধর্ম নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ ও মলানুগভাবে বিপ্লবী আদর্শরূপেই পেশ করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোন বিপ্লব দেখা দিলে তা সমর্থনযোগ্য। বিশ্ব মানবের কল্যাণে ইসলামের বাণী প্রচারের পথে যে কোন বাধার বিরুদ্ধে সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ সঙ্গত বলে তিনি মনে করতেন। কারণ বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ক্ষুদ্রতর ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করা ন্যায়সঙ্গত।

ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সংগঠনের ধারণা :

ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর মতে একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ আদর্শ সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হওয়া উচিত। মক্কা শরীফই এ কেন্দ্রের উপযুক্ত স্থান। এভাবেই তিনি প্যান ইসলামী ধারণার বীজও বপন করেন।

পরবর্তীতে এ পথে জামাল উদ্দীন আফগানী, মওলানা মুহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা আবুল আ’লা মওদূদী-প্রমুখ তাঁর এ ধারার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

পথের নির্দেশ:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে সমাজ-সভ্যতার বিপর্যয়ের কারণগুলো চিহ্নিত করে লিখেছেন : ‘কোন মানব-গোষ্ঠীর মধ্যে সভ্যতার বিকাশধারা অব্যাহত থাকলে তাদের শিল্পকলা পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। তারপর শাসকগোষ্ঠী ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েস ও ঐশ্বর্যের মোহে আচ্ছন্ন জীবনকে বেছে নিলে সেই আয়েস ী জীবনের বোঝা তারা শ্রমিকশ্রেণীর ওপর চাপায়। ফলে সমাজের অধিকাংশ লোক মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হয়। গোটা সমাজ-জীবনের নৈতিক কাঠামো তখনই বিপর্যস্ত হয়, যখন তাকে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে জীবন-যাপনে বাধ্য করা হয়। মানুষ তখন রুযী-রুটির জন্য পশুর মতো কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়। এ চরম নির্যাতন ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগের অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পথের নির্দেশ এসে থাকে। অর্থাৎ স্রষ্টা নিজেই বিপ্লবের আয়োজন করেন। জনগণের বুকের উপর থেকে বে-আইনী শাসক-চক্রের জগদ্দল পাথর অপসারণের ব্যবস্থাও তিনি করেন। রোমান ও পারসিক শাসকগোষ্ঠী সে যুলুমবাজির পথেই এগিয়েছিলো। তাদের ঐশ্বর্য ও বিলাসিতার যোগান দিতে গিয়ে জনসাধারণকে পশুর স্তরে নেমে যেতে হয়েছিলো। এ যুলুমশাহীর প্রতিকারের জন্যই আরবের জনগণের মধ্যে হযরত রসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অবতীর্ণ করা হয়েছিলো। মিসরে ফিরাউন বা ফারাওদের ধ্বংস এবং রোম ও পারস্য সম্রাটের পতন এ নীতি অনুসারে নবুওয়াতির আনুষঙ্গিক কর্তব্যরূপে তামিল হয়েছে।’

শাহ ওয়ালিউল্লাহ উপলব্ধি করেন যে, দিল্লীর সম্রাট ও আমীর-ওমরাহ এবং হিন্দুস্তানের অন্যান্য শাসকের নৈতিক দেউলিয়াত্ব পারস্য ও রোম সম্রাটদের কাছাকাছি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিলো।

শাসকদের প্রতি শাহ ওয়ালিউল্লাহ:

আঠারো শতকের মুসলিম সমাজের মূল ত্র“টিগুলোকে চিহ্নিত করে শাহ ওয়ালিউল্লাহ সমকালীন শাসক ও আমীর-ওমরাহগণকে সম্বোধন করে তাঁর ‘তাফহীমাতে ইলাহিয়া’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন : ‘তোমাদের কি আল্লাহর ভয় নেই? ক্ষণস্থায়ী আরাম-আয়েসের সন্ধানে লিপ্ত হয়ে সাধারণ মানুষকে তোমরা পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত করে দিয়েছো। প্রকাশ্যে শরাব পান করা হচ্ছে, অথচ তোমরা বাধা দিচ্ছো না! প্রকাশ্যে যিনা, জুয়া ও শরাব পানের আড্ডা চালু রয়েছে; অথচ তোমরা এর প্রতিরোধে অগ্রসর হচ্ছো না … তোমরা নানা রকম খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করছো, স্ত্রীদের মান-অভিমান ভঞ্জন আর প্রাসাদ ও পোশাকের বিলাসিতার মধ্যে তোমরা ডুবে রয়েছো!’

অন্যান্যের প্রতি:

একইভাবে তিনি আলিম-উলামা, ওয়ায়েয, বংশানুক্রমিক পীর, খানকার দরবেশ, পেশাদার সৈনিক, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষকে আলাদা ও সম্মিলিতভাবে সম্বোধন করে তাদের জীবন থেকে সকল বিচ্যুতি ও বিকৃতি দূর করে ইসলামের রঙে নিজেদেরকে পূর্ণরূপে পুনর্গঠনের আহবান জানান।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর মৌলিক অবদান:

শাহ ওয়ালিউল্লাহর বহুমুখী অবদানের কয়েকটি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হলো :

‘ইসলামের ইতিহাস’ ও ‘মুসলমানদের ইতিহাস’ এক নয় :

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইসলামের ইতিহাস ও মুসলমানদের ইতিহাসের সূক্ষ্ম প্রভেদরেখাটি উম্মাহ্র সামনে স্পষ্ট করে তোলেন। তিনিই প্রথম এটা দেখান যে, মুসলিম ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাস মূলত এক নয়।

খিলাফত ও ‘রাজতন্ত্র’ দুই জিনিস:

খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যকার নীতিগত ও পারিভাষিক পার্থক্যকে তিনি হাদীসের আলোকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি সমকালীন রাজতান্ত্রিক সরকারকে অগ্নি-উপাসকদের সরকারের সাথে তুলনা করে বলেন, এ দুই সরকারের মধ্যে পার্থক্য হলো মুসলিম রাজতন্ত্রী সরকারের লোকেরা নামায পড়ে, মুখে কালেমা উচ্চারণ করে।

জাহিলী বনাম ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা:

তিনি জাহিলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। জাহিলী রাষ্ট্র খতম করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য দায়িত্ব সম্পর্কেও তিনি উম্মাহকে সতর্ক ও সচেতন করার চেষ্টা করেন।

মাযহাব প্রশ্নে অনৈক্য মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রধান মৌলিক ত্রুটি:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মাযহাব প্রশ্নে অনৈক্যকে সমকালীন মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৌলিক ত্র“টি হিসাবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, সিরীয় (উমাইয়া) শাসকদের পতনকাল পর্যন্ত কেউ নিজেকে হানাফী বা শাফিয়ী বলে দাবি করতেন না। বরং তাঁরা সবাই নিজ নিজ ইমাম ও শিক্ষকদের দেখানো পদ্ধতিতে শরীয়তের প্রমাণ গ্রহণ করতেন।

কিন্তু ইরাকী (আব্বাসীয়) শাসকদের সময় থেকে প্রত্যেকেই নিজের জন্য একটি মাযহাবী পরিচয় নির্দিষ্ট করে নেয়। তারা নিজ মাযহাবের বড় বড় নেতাদের অনুমোদন ছাড়া কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত নিতেও রাযী হতো না।
তুর্কী (উসমানীয়) শাসনামলে লোকেরা বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা নিজ নিজ ফিক্হভিত্তিক মাযহাব থেকে যা কিছু স্মরণ করতে পারে, সেটাকেই দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করে। আগে যে সব বিষয় কুরআন ও হাদীসের উৎস থেকে উদ্ভত মাযহাব ছিল, এখন তা-ই স্থায়ী সুন্নতে পরিণত হয়।

ইজতিহাদ ফরযে কিফায়া নাকের দড়ি খুলতে হবে:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইজতিহাদের গুরুত্বের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের যামানার নির্বোধ ব্যক্তিরা ইজতিহাদের নামে ক্ষেপে ওঠেন। এদের নাকে উটের মতো দড়ি বাঁধা আছে। এরা জানে না কোন দিকে যাচ্ছে। শাহ সাহেব ইজতিহাদকে সকল যুগের জন্য ফরযে কিফায়া হিসাবে উল্লেখ করেন এবং তিনি ইজতিহাদের নিয়ম-নীতি, সংবিধান ও শর্তাবলী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন।

ইসলামী সমাজ দর্শনের ইমারত নির্মাণ:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইসলামের সমগ্র চিন্তা, নৈতিক ব্যবস্থা, তামুদ্দুনিক ব্যবস্থা ও শরীয়ত লিপিবদ্ধ আকারে পেশ করার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহের মাধ্যমে ইসলামী দর্শন লিপিবদ্ধ করার ভিত্তি স্থাপন করেন। নৈতিক দর্শনের ওপর তিনি একটি সমাজ দর্শনের ইমারত নির্মাণ করেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর শক্তি ও সীমাবদ্ধতা গণ-বিপ্লবের কর্মসূচী:

সমালোচনা ও চিন্তার পুনর্গঠন–এ দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাজেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন। সংশোধনের বাস্তব কার্যক্রম পরিচালনা বা সঠিক ইসলামী চিন্তা ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কোন সক্রিয় সংগঠন গড়ে তোলা এবং আন্দোলন পরিচালনার সুযোগ তাঁর ঘটেনি। তবে সে প্রয়োজন সম্পর্কে তিনি পূর্ণ সচেতন ছিলেন। ভারতের তদানীন্তন সরকারের পরিবর্তে নতুন একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে উপমহাদেশের ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় সামগ্রিক একটি ইসলামী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় দীর্ঘ-মেয়াদী গণ-বিপ্লবের কর্মসূচী পেশ করেছেন। আল কুরআনের ফারসী তরজমা ‘ফতহুর রহমান’-এর টীকায় তাঁর এ কর্মসূচী অধিকতর স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ সম্পর্কে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী লিখেছেন:

‘একদিকে তাঁর যমানা ও পরিবেশ এবং অন্যদিকে তাঁর কার্যাবলীকে সামনে রাখলে মানুষ হতবাক হয়ে যায় যে, সে যুগে এএ গভীর দৃষ্টি, চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের জন্ম কেএ করে সম্ভব হলো! …সে অন্ধকার যুগে শিক্ষা লাভ করে এএ একজন মুক্ত বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তানায়ক ও ভাষ্যকার জনসমক্ষে আবির্ভূত হলেন, যিনি যমানা ও পরিবেশের সকল বন্ধন মুক্ত হয়ে চিন্তা করেন, আচ্ছন্ন ও স্থবির জ্ঞান ও শতাব্দীর জমাট বাঁধা বিদ্বেষের বন্ধন ছিন্ন করে প্রতিটি জীবন-সমস্যার ওপর গভীর অনুসন্ধানী ও মুজতাহিদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং এএ সাহিত্য সৃষ্টি করে যান-, যার ভাষা, বর্ণনাভঙ্গি, চিন্তা, আদর্শ, গবেষণালব্ধ বিষয় ও সিদ্ধান্তসমূহের ওপর সমকালীন পরিবেশের কোন ছাপ পড়েনি। এএকি তাঁর রচনা পাঠ করার সময় মনে এতটুকু সন্দেহেরও উদয় হয় না যে, এগুলো এএ এক স্থানে বসে রচনা করা হয়েছে যার চারদিকে বিলাসিতা, ইন্দ্রিয়পূজা, হত্যা, লুটতরাজ, জুলুম, নির্যাতন, অশান্তি ও বিশৃংখলার অবাধ রাজত্ব চলছিলো।’ (ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন, শতদল প্রকাশনী লিমিটেড, ১৯৮৮, পৃ-৬২)।

মারাঠা ও শিখ হামলার মুকাবিলা:

উপমহাদেশের বিশেষত দিল্লীর সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনা-প্রবাহের ব্যাপারে সচেতন ও সক্রিয় থেকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুসলিম জনপদে মারাঠা ও শিখ হামলার মুকাবিলায় আহমদ শাহ আবদালীকে আমন্ত্রণ জানান। দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসক বা স্থানীয় উমরাহদের অনৈক্য ও দুর্বলতার মুখে শাহ ওয়ালিউল্লাহর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আহমদ শাহ আবদালী ১৭৪৭ থেকে ১৭৬১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ১৪ বছরে দশটি অভিযান চালিয়ে মারাঠাদের দএ করেন। তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের পর্যদুস্ত করতে না পারলে ভারতে মুসলিম পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা ঐ সময়েই শেষ হয়ে যেতো।

ঠিক এ সময়েই ইংরেজরা বাংলাদেশে প্রভুত্ব বিস্তার করছিলো। এলাহাবাদ পর্যন্ত তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এ শক্তিটির ব্যাপারে শাহ সাহেব কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেননি। সম্ভবত এ সময় দিল্লীর হিফাযতের ব্যাপারেই তাঁর দৃষ্টি বেশী নিবদ্ধ ছিলো।

উনিশ শতকের মুক্তি-সংগ্রামে শাহ ওয়ালিউল্লাহর প্রভাব :

শাহ ওয়ালিউল্লাহ উপমহাদেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত জনগণকে তাৎক্ষণিক বিপর্যয় ও ধ্বংসের সয়লাব থেকে পুরোপুরি রক্ষা করতে না পারলেও তাঁর আন্দোলন ভবিষ্যৎ প্রতিরোধের এক দুর্জয় শক্তি গড়ে তুলেছিলো। উপমহাদেশের মুসলমানদের চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে তিনি আঠারো শতকের বন্ধ্যা সময়ে বিপ্লব ও বিদ্রোহের এএ এক শক্তি জাগ্রত করেন যা পরবর্তীকালে একাধিক আপোসহীন মুক্তি-সংগ্রামের জন্ম দেয়। পরবর্তী যুগের প্রায় সকল আপোসহীন মুক্তি-সংগ্রামে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন বিপুল প্রেরণা ও শক্তির উৎস।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সৎ ও চিন্তাসম্পন্ন একটি বিরাট দলের সৃষ্টি করেন। তাঁর চিন্তার অনুসারীগণ নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও উন্নত চরিত্রের কারণে সাধারণ লোকদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন।

হিন্দুস্তানকে দারুল হারব ঘোষণা :

শাহ ওয়ালিউল্লাহর ইনতিকালের পর তাঁর চার ছেলে শাহ আবদুল আযীয (১৭৪৬-১৮৪৩), শাহ রফিউদ্দীন, শাহ আবদুল কাদীর ও শাহ আবদুল গনী বিপুলভাবে এ দলের কলেবর বৃদ্ধি করেন। শাহ আবদুল আযীয শাহ ওয়ালিউল্লাহর বাণী সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে ব্যাপকতর জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এভাবেই ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শাহ সাহেবের শিক্ষার অনুসারী হাজার হাজার লোক তৈরী হন। শাহ ওয়ালিউল্লাহর সন্তানগণের চেষ্টায় ভারতবর্ষে ইসলামী আন্দোলনের একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

এ পটভূমিতেই শাহ আবদুল আযীয ১৮০৩ সালে ইংরেজ কবলিত হিন্দুস্তানকে ‘দারুল হারব’ বা ‘যুদ্ধ কবলিত রাষ্ট্র’ বলে ঘোষণা করেন ।

উপমহাদেশীয় মুসলিম গণবাহিনী ও জিহাদ আন্দোলন:

শাহ আবদুল আযীয খুলাফায়ে-ই-রাশেদার আদর্শে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সংগঠন কায়েম করেন। এ সংগঠনে প্রর্বীণদের মধ্যে তাঁর তিন ভাই শাহ রফিউদ্দীন, শাহ আবদুল কাদীর ও শাহ আবদুল গনী এবং তরুণদের মধ্যে শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল, শাহ মুহাম্মদ ইসহাক ও সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী (১৭৮৬-১৮৩১) শামিল ছিলেন।
শাহ আবদুল আযীয শেষোক্ত তিনজন তরুণ আলিমকে সামনে রেখেই উপমহাদেশীয় মুসলিম গণবাহিনী গঠন করেন। সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর নেতৃত্বে ১৮১৮ সালে দিল্লী থেকে জিহাদ আন্দোলনের সূচনা হয়।

ফরায়েজী আন্দোলন:

এ একই সময় ১৮১৮ সালে বাংলাদেশে হাজী শরীয়তউল্লাহ (১৭৬৪-১৮৪০) ফরায়েজী আন্দোলনের সূচনা করেন। জিহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের উৎসভূমি, সংগঠন কাঠামো ও কর্মসূচীতে পার্থক্য ছিল। কিন্তু মুসলমানদের ঈমান-আকীদা, আচার-আচরণ, নীতি-প্রথা ইসলামের আলোকে পুনর্গঠন এবং তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে বিজাতীয় কুসংস্কার, কুপ্রথা ও বিদআত থেকে মুক্ত করার অভিন্ন লক্ষ্যে এ উভয় আন্দোলনই কাজ করেছে।

ইসলামের আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে দেশ থেকে ইংরেজদের উৎখাত করার ব্যাপারেও তাদের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। জিহাদপন্থীদের অনুরূপ ফরায়েজীগণও ইংরেজ-কবলিত হিন্দুস্তানকে ‘দারুল হারব’ বা যুদ্ধ কবলিত বিবেচনা করতেন।

জিহাদ আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা:

শাহ ওয়ালিউল্ল¬াহর চিন্তার ভিত্তিতে পরিচালিত সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর নেতৃত্বাধীন জিহাদ আন্দোলনের সাথে বাংলার জনগণ গোড়া থেকেই যুক্ত ছিলেন। ১৮২১ সালে হজ্জ সফর উপলক্ষে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী কলকাতায় আসেন। বাংলার উলামায়ে কেরাম ও সচেতন জনগণের একটি বিরাট অংশ সে সময় সরাসরি তাঁর সান্নিধ্যে এসে জিহাদ আন্দোলনের বাইআত বা শপথ গ্রহণ করেন। মওলানা সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

১৮২৫ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের অংশীদার পাঁচ-ছয় হাজার মুজাহিদের মধ্যে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ যোগ দিয়েছিলেন বাংলা থেকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত চল্লিশ জন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সীমান্ত প্রদেশে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সরকারের মজলিসে শরা ও মন্ত্রীসভার প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন পূর্ব বাংলার বিপ্লবী মুজাহিদ নেতা ইমামউদ্দীন বাঙালী। ১৮২৮ সালে জিহাদ আন্দোলনের কঠিন সংকটকালে জনশক্তি ও আর্থিক সাহায্য বাংলাদেশ থেকেই প্রথম গিয়ে পৌঁছেছিল।

জিহাদ আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকার স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের ঘরে ঘরে মুষ্টি চাল রাখার ব্যবস্থা চালু ছিল। অনেক সময় মা-বোনেরা তাদের অলংকার এবং অনেকে তাদের গরু-বাছুর বা জমি বিক্রি করে জিহাদের জন্য সাহায্য পাঠিয়েছেন।

১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের প্রান্তরে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী ও মওলানা শাহ ইসমাইলের সাথে দুই শতাধিক মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় অন্তত নয়জন বাঙালী মুসলমানের নাম জানা গেছে। ইমাম উদ্দীন বাঙালীসহ বাংলার প্রায় চল্লিশ জন মুজাহিদ বালাকোটের লড়াইয়ে আহত হন। বালাকোটের ময়দান থেকে ফিরে এসে তাঁরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জিহাদ আন্দোলন সংগঠিত করেন। এ সময় বাংলার জিহাদ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকার বংশালে। পাটনায় ছিল মূল কেন্দ্র।

তিতুমীরের জিহাদ আন্দোলন:

মাওলানা সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) ছিলেন জিহাদ আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১৮২১ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর সাথে মক্কা, মদীনা, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ সফর করে সাইয়েদ সাহেবের একজন খলীফা বা প্রতিনিধি হিসাবে বাংলার জিহাদ আন্দোলনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন।

তিনি ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারদের মুকাবিলায় জনগণকে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। ইসলামী অনুশাসনের পূর্ণ অনুসরণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের আদর্শে তিনি সকলকে উজ্জীবিত করেন। মুসলমানী নাম রাখা, ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পরা, এক আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করা, কুরআন-হাদীসের খেলাফ কাজ বন্ধ করা–এসব ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুনর্গঠনে তাঁর কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত।

তিতুমীরের আন্দোলনের ফলে এক বিরাট ইসলামী জামাত গড়ে ওঠে। তাঁরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে থাকেন নানা জায়গায়। নারকেলবেড়িয়ার এক বিরান মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের দুর্গ। গড়ে উঠে বাঁশের কেল্লা। তিতুমীরের বাহিনী নদিয়া ও চব্বিশ পরগনা জেলার অধিকাংশ ভূখন্ড মুক্ত করেন।

এভাবে তিতুমীরের ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে আযাদ ভূখন্ড গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যায়। বিভিন্ন খন্ডযুদ্ধে জমিদার ও ইংরেজদের পরাজয় হয়। কিন্তু ১৮৩১ সালের ১৯ নবেম্বর এক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে ইংরেজদের কামানের গোলার আঘাতে তিতুমীর, তাঁর পুত্র জওহর আলী, জিহাদ আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ময়েজউদ্দীন বিশ্বাসসহ বহু যোদ্ধা বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন। তিতুমীরের দুই পুত্র মীর তোরাব আলী ও মীর গওহর আলী এবং প্রধান সেনাপতি ভাগ্নে গোলাম মাসুমসহ বন্দী হন সাড়ে তিন শ’ মুক্তিযোদ্ধা। গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেয়া হয়।

সিপাহী বিপ্লবে শাহ ওয়ালিউল্লাহর বিপ্লবী ভাবধারার প্রভাব:

১৮৩১ সালে বালাকোটে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী এবং একই বছর নারকেল বেড়িয়ায় তিতুমীরের শাহাদাতের ঘটনার পর জিহাদের বিপ্লবী ভাবধারায় উজ্জীবিত নেতৃবৃন্দ উপমহাদেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর অনুসারী হাফিয কাসিম। জিহাদী নেতৃবৃন্দের মধ্যে জেনারেল বখত খান, মওলানা আহমদ উল্লাহ শাহ ও মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী দিল্লী কেন্দ্রে, হাজী ইমদাদ উল্লাহ ও তার অনুসারীগণ শামেলী, সাহারানপুর ও থানাভবনে সক্রিয় ছিলেন।

হাফিয কাসিমের অনুসারী মুজাহিদদের মধ্যে দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা কাসিম নানুতুভী, মওলানা রশীদ আহমদ গাংগোহী, মওলানা মুহাম্মদ মুনীর প্রমুখ বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্বে উত্তর প্রদেশ, দিল্লী ও কানপুরসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবের কেন্দ্র গড়ে ওঠে।

এভাবেই দিল্লী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র স্বাধীনতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান ছড়িয়ে দেয়া হয়। দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরও এ সময় জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়কদের সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানান।

১৮৫৭ সালে সারা ভারতে বিপ্লব ও বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহের সূচনা হয় ইংরেজ শাসনের রাজধানী কলকাতার ব্যারাকপুরে। বাংলায় সে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, যশোর প্রভৃতি স্থানে। দেশের স্বাধীনতার জন্য ১৮৫৭ সালে ঢাকার লালবাগের যে স্থানটিতে সেদিন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রক্ত ঝরেছিল, সে স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ইংরেজরা সেখানে কারাগার নির্মাণ করে, যা এখনো বিদ্যমান। ইংরেজদের হাতে বন্দী বিপ্লবী মুসলমান সৈন্যদের কয়েকজনকে নামকাওয়াস্তে বিচারের প্রহসন করে ঢাকার সদরঘাটের অদূরে আন্টাঘর ময়দানে গাছের শাখায় ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। সেই আন্টাঘর ময়দানই এখন ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’ নামে পরিচিত।

বস্তুত শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তা-চেতনার উত্তরাধিকারীরাই ছিলেন সিপাহী বিপ্লবের মূলনায়ক। এ বিদ্রোহের শাস্তিস্বরূপ কত জনের ফাঁসি হলো, কত লোকের হলো কারাবাস, সে হিসাব পাওয়াও এখন আর সম্ভব নয়। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরবাসে দন্ডিতদের সংখ্যাই ছিল দশ হাজারের বেশী। জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক আন্দামান বন্দী ফজলে হক খয়রাবাদী লিখেছেন,
‘‘স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তবেই কোন হিন্দুকে আটক করা হতো, কিন্তু পালাতে পারেনি এএ একজন মুসলমানও সেদিন বাঁচেনি।’’

দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা:

সিপাহী বিপ্লবের পর ১৮৫৮ সালে জিহাদ আন্দোলনের নেতা মওলানা ইনায়েত আলী এবং ১৮৬২ সালে ফরায়েজী আন্দোলনের নায়ক দুদু মিয়া ইনতিকাল করেন। সিপাহী বিপ্লবোত্তর ব্যাপক মুসলিম নির্যাতনের পটভূমিতে এবং আন্দোলনের দুই প্রধান কান্ডারীর ইনতিকালের পর এ দু’টি আন্দোলনের ধারা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে ।

১৮৬৭ সালে জিহাদী বিপ্লবীগণের উদ্যোগে আন্দোলনের প্রধান ঘাঁটিরূপে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে জিহাদ আন্দোলনের বিভিন্ন কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৮৬৪ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত তথাকথিত ওয়াহাবী মামলাগুলো থেকে জানা যায় যে, সে সময় পর্যন্ত বাংলায় জিহাদ ও ফরায়েজী আন্দোলনের ধারা চালু ছিল ।

চেতনার বাতিঘর :

এদেশের মুসলমানদের জাগরণমূলক প্রায় সকল আন্দোলনে শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শাহ ওয়ালিউল্লাহর ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ আলিমগণই উপমহাদেশের মুসলমানদের মুক্তি-সংগ্রামে নেতৃত্ব দানের উদ্দেশ্যে ১৯১৯ সালে ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরাই ইংরেজ কবলিত হিন্দুস্তানকে স্বাধীন করার ঘোষণা প্রথম প্রচার করেন। মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী আলিমগণ ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর আদর্শেরই উত্তরপুরুষ। আজো বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনকে শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা পথ প্রদর্শন করছে। সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী, মওলানা আতাহার আলীর জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নিজামে ইসলাম পার্টি, মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী ও আবদুল্লাহিল বাকীর আহলে হাদীস আন্দোলন কিংবা পরবর্তী সময়ে হাফেজ্জী হুজুরের খিলাফত আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলন এবং বিভিন্নমুখী ইসলামী জাগরণমূলক কার্যক্রম শাহ ওয়ালিউল্লাহর সংগ্রামী ভাবধারার দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত। ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলনে শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার প্রভাব অনস্বীকার্য।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী আজো চেতনার বাতিঘররূপে আমাদের বোধ-বিশ্বাস ও এীষাকে আলোকিত করে চলেছেন।

তথ্যসূত্র:
১. ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
২. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, হুজ্হাতুল্লাহিল বালিগা।
৩. সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন, শতদল প্রকাশনী লিমিটেড, ১৯৮৮।
৪. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা, দারুস সালাম প্রকাশন, ১৯৯৮।

লেখক পরিচিতি:

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
লেখক
গবেষক
চিন্তাবিদ
ইতিহাসবিদ

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *