Ishqer Dohone Rumi- M. Moniruzzaman
জালালুদ্দীন মােহাম্মদ রূমী সুবিদিত একটা নাম। বাংলাদেশ বা উপমহাদেশসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশে তিনি অধিক পরিচিত মাওলানা রূমী (র:) নামে । সুফী জগতে কিংবদন্তীতুল্য এই মহাপুরুষ বিগত প্রায় সাতশত পঞ্চাশ বছর যাবৎ দেশে দেশে মানুষের স্মৃতিতে জাগরূক রয়েছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে।
মূলত: দু’টো কারণে মাওলানা রূমী ইতিহাসে অম্লান: প্রথমত- একজন আধ্যাত্মিক সুফী-সাধক হিসেবে, আর দ্বিতীয়ত, একজন জগদ্ধিখ্যাত সুফী মহাকবি হিসেবে । মুসলিম জাহানে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলােতে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাওলানা তরিকা ইরান, তুর্কী, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান ও তাজিকিস্তানে বিপুলভাবে সমাদৃত। তবে এসব দেশে তাঁকে মূলত: একজন সুফী মুরশিদ হিসেবে বেশি মান্য করা হয়। অবশ্য শিক্ষিত মহলে তাঁর দ্বিতীয় পরিচয়টাও সমানভাবে সমাদৃত।
পারস্য সাহিত্যের সীমানা ছাড়িয়েও বিশ্ব সাহিত্যে তাঁর যে অবদান তা সমানভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্যভুবন অকপটে স্বীকার করে। তাঁর অনেকগুলাে রচনার মধ্যে ‘মসনবী’ সর্বাপেক্ষা পরিচিত ও জনপ্রিয়। এটার সাহিত্যমান পারসী ভাষায় অদ্বিতীয় এবং বিশ্বসাহিত্যেও সর্বোচ্চ শিখরের একটা । ভাব, ভাষা, ছন্দ, মৌলিকতা, প্রকাশভঙ্গী, অর্থ, সর্বদিক দিয়ে এটা যেমন অতুলনীয়, তেমনি সর্বোচ্চমানের হলাে এর বিষয়বস্তুর অবিনশ্বরতা । তাহলাে প্রেম । মসনবীর মূল বিষয়বস্তু হলাে প্রেম, আধ্যাত্মিক প্রেম । সুফীবাদী প্রেম অনন্তকালের ও খােদার সত্ত্বার সাথে প্রেম, তাতে বিলীন হওয়ার প্রেম । রূমী নিজেই বলেছেন ‘মসনবী’ কুরআনের রূহ। তবে এতে প্রেম এত বেশি মাত্রায় রূপক যে, এটাকে মানবীয় প্রেমেও ব্যাখ্যা করা যায় ।
কীভাবে রূমীর এই সুফিবাদের বা আধ্যাত্মিকতাবাদের জন্ম হলাে? কীভাবে জন্ম হলাে মসনবীর মতাে মহাকাব্যের? সেটা এক অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার । “ইশকের দহনে রূমী’ সেটারই আভাস প্রদান করে। এটা মূলত; একটা উপন্যাসমূলক জীবনালেখ্য যাতে চিত্রিত করা হয়েছে কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে মাওলানা রূমী একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞ আলেম থেকে সুফীবাদী জীবন গ্রহণ করেন, সেই জীবনের রূপ কেমন এবং কে তাকে এই নতুন জীবনে কীভাবে দীক্ষা দেন । তাছাড়া বেশি গুরত্বপূর্ণ যেটা তাহলাে কীভাবে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে মসনবীর মতাে মহাকাব্য রচনা শুরু হলাে।
অবশ্য এই বইতে কথােপকথনে উদ্ধৃত বাক্যগুলাে নেয়া হয়েছে রূমী এবং অন্যদের রচিত মূল বই Divan-i Shams-i Tabrizi, Masnavi-yi Ma'navi, Fihi mafihi,Maqalat-i Shams-i Tabrizi, Valadnamah Manaqib al-arifin
থেকে ।
মূলত: ছয়টা প্রধান চরিত্রকে কেন্দ্র করে এই বই ‘ইশকের দহনে রূমী’ রচিত । তারা হলেন— শামছ-ই-তাবরিজ, রূমী, হুসাম ও সালাহ নামের রূমীর দু’জন সাগরেদ এবং রূমীর দু’ছেলে ।
শামছ-ই-তাববিজ নামের এক অপরিচিত- ভবঘুরে দরবেশের আগমন ঘটে রূমীর জীবনে হঠাৎ করেই । তিনিই দীক্ষা দেন রূমীকে সুফীবাদে । অথচ তিনি থাকেন দূর্বোধ্য, মরিচিকার মতো । মাত্র দু’বছরের মতাে সময়ের সংশ্রবে রূমীর মানসজগতে ও অন্তরজগতে তিনি ঘটান মহা বিপ্লব – দু’জনের মধ্যে তৈরি হয় ইশক-প্রেম। সে প্রেম এতই গাঢ় ও গভীর যে তাদের প্রেম মানবিক গুণের নাকি খােদায়ী প্রেম- তা পার্থক্য করা দূরুহ হয়ে পড়ে । পরিশেষে এটা বিভ্রান্তিকর হয়ে প্রকাশিত হয় যে- শামছ-ই-তাবরিজ কি মানুষ ছিলেন নাকি খােদা ছিলেন ।
তাদের প্রেম এক সময় রূমীর পক্ষ থেকে উদাসীনতায় গড়িয়ে অন্য খাতে প্রবাহিত হয়- যা ডেকে আনে চিরন্তন বিচ্ছেদ। ফলশ্রুতিতে রূমীর জীবন থেকে শামছ-এর উধাও হয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে উদগত বিরহের ক্রন্দন থেকেই জন্ম নেয় প্রেমের মহাকাব্য ‘মসনবী’ । তবে সেই প্রেমের উপজীব্য হয় রূপক । এক অনন্ত মহাজাগতিক অস্তিত্ব বা খােদার সাথে । দু’জনের প্রেম-সম্পর্কের ঘাতপ্রতিঘাতের মাধ্যমে কীভাবে এই মহাকাব্যের সূচনা হয়, সেটাই এই বইয়ের তৃতীয় চরিত্র হুসাম নামের রূমীর একান্ত শিষ্য নিজের চোখে দেখার ভাষায় চিত্রিত করেছেন। এখানেই এই গ্রন্থের বিশেষত্ব। রূমীর অন্যান্য জীবনীগ্রন্থ থেকে এটা আলাদা । মূল উপজীব্য বিষয়কে ঠিক রেখে কল্পনার আশ্রয় নিয়ে এখানে তৈরি করা হয়েছে সেই পরিপ্রেক্ষিত যেখানে জন্ম নিয়েছে মসনবী । তবে তা দেখানাে হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের প্রাত্যহিক কাজকর্মের মধ্য দিয়ে।
এই বইয়ের আরেকটা যে বৈশিষ্ট্য তা হলাে- এখানে উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চিত্রও। তখন চলছিল সারা মুসলিম দুনিয়া বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য তথা ইরান, ইরাক, তুর্কী, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান এলাকায় দুধর্ষ মােঙ্গল বাহিনীর পৈশাচিক নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞের বিভীষিকাময় নৈরাজ্য। মুসলিম সমাজ কীভাবে তটস্থ থাকতো, রাজনৈতিক গােলযােগের ডামাডােলে জনজীবন কীভাবে প্রভাবিত হতো,রূমীর সাথে সেখানকার রাজপরিবারের কী ধরনের সম্পর্ক ছিল, রূমী ও শামছ-এর কেরামতি সমাজের সর্বস্তরে কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল এবং একই সাথে শামছ ও রূমীর কারণে সমাজে কি ধরণের দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল- তার জীবন্ত বর্ণনা এতে উপস্থাপন করা হয়েছে। অবশ্য এখানে রূমীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে লোমখাড়া করা বিতর্কিত তথ্যও পাওয়া যাবে ।
Rumi: The Fire of Love
এটা একটা অনুবাদকর্ম। মূল লেখাগ্রন্থ "Rumi: The Fire of Love"
উপন্যাসের ধাঁচে কথপােকথন ও বর্ণনার মাধ্যমে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছে মূল বক্তব্য ও সংশ্লিষ্ট ঘটনা প্রবাহ। গ্রন্থকার নাহাল তাজাদুদ একজন ইরানি বংশােদ্ভুত এবং বাল্যকাল থেকে সুফীবাদে দীক্ষাপ্রাপ্ত । অনুবাদকর্ম সাধারণত: কঠিন। ভাব-ভাষা-অর্থ ঠিক রেখে অনুবাদ করা প্রায়ই দূরহ ব্যাপার । তারপরও এগুলােকে ঠিক রেখেই যথাসম্ভব আক্ষরিক অনুবাদ করা হয়েছে- সাহিত্যিক মান অক্ষুন্ন রেখেই। অর্থ এবং বর্ণনার সাবলীলতাকে বত্যয় না ঘটতে দেয়াতে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।
আমি নিজেও বহু আগে মসনবী কিছুটা পড়েছি বাংলা অনুবাদে। কিন্তু এর ভাব-ভাষা বােঝার মতাে জ্ঞান আমার ছিল না । তাছাড়া মসনবী এত উচ্চমানের যে এর রচনা সম্পর্কিত ইতিহাস না জানলে এটা হৃদয়াঙ্গম করা অসম্ভব। “Rumi: The Fire of Love” বইটা পড়তে পড়তে এবং এর অনুবাদ করার সময় আমার এ অনুধাবন আরাে প্রগাঢ় হয়েছে । সেদিক দিয়ে বর্তমান বইটার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই, এটা যদি মসনবী অনুধাবনে পাঠকদের উপকারে আসে, তবে আমার শ্রম সার্থক হবে বলে আশা করি । ভাষান্তরগত সীমাবদ্ধতা থাকলে তা অনস্বীকার্য এবং তা অনুবাদক হিসেবে একান্তই আমার । আমার স্ত্রী ফারজানার নিকট হতে উপহার হিসেবে পাওয়া বইটার অনুবাদ করেছি। তাই তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এই বই প্রকাশে অনার্য প্রকাশনীর সফিক -এর আন্তরিকতা আমাকে খুবই মুগ্ধ ও বাধিত করেছে ।
লেখক পরিচিতি:
মু. মনিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া ।