The Reconstruction of Religious Thought in Islam- Muhammad Iqbal
স্কলাস্টিক বা পন্ডিতি দর্শনে আল্লাহর অস্তিত্বের সমর্থনে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে তিনটি। এই যুক্তি তিনটি বিশ্ববাদী যুক্তি, উদ্শ্যেবাদী যুক্তি ও তত্ত্ববাদী যুক্তি নামে পরিচিত। এগুলো পরম সত্তার সন্ধানে চিন্তাশক্তির এক সত্যিকার অভিযানের ফল। তবে আমার আশঙ্কা-এসব যুক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর রকমের সমালোচন হতে পারে। তা ছাড়া এগুলো অভিজ্ঞতার এক অগভীর বিশ্লেষণের পরিচয় দেয়।
বিশ্ববাদী যুক্তি জগৎকে দেখে একটা সসীম কার্যফলরূপে। কার্য-কারণরূপে সম্পৃক্ত, পরস্পর-র্ভিরশীল ঘটনপরম্পরার ধারা অতিক্রমণের পর এই যুক্তির দৌড় গিয়ে থামে এক স্বয়ংসিদ্ধ আদি কারণে। এই আদি কারনের ওপারে আমাদের চিন্তা আর অগ্রসর হতে পারে না। তবে এটা স্বতই প্রতীয়মান যে একটা সসীম কার্য থেকে শুধু একটা সসীম কারণ অথবা এরূপ সসীম কারণেরই এক অসীম ধারার সন্ধান মিলতে পারে। কোনো এক বিশেষ স্থানে এই কারণ-ধারা শেষ করা, আর এই কারণ-ধারার কোনো এক কারণকে স্বয়ংসিদ্ধ এক আদি কারণের মর্যাদায় উন্নীত করার অর্থ হচ্ছে, যে কার্য-কারণের সম্বন্ধের নিয়মকে ভিত্তি করে এই যুক্তির অবতারণা, তাকেই উড়িয়ে দেওয়া। তা ছাড়া যুক্তিলব্ধ এই আদি কারণের সঙ্গে তার কার্যের কোনো সম্বন্ধই থাকে না।
এ কথার অর্থ হচ্ছে, কার্য তার নিজের কারণের সীমারূপে দাঁড়িয়ে সেই কারণকেই অবনমিত করে একটা সসীম কিছুতে। আবার যুক্তিলব্ধ এই কারণকে একটা অপরিহার্য সত্তা বলে ও মনে করা চলে না। এর স্পষ্ট কারণ হচ্ছে, কার্য ও কারণের মধ্যে যে সম্পর্ক তার ফলে এরা পরস্পর-নির্ভরশীল, এদের কারো পরিপূর্ণ স্বাধীন সত্তা নেই। বিশ্ববাদী যুক্তির বিরুদ্ধে আরও বলা চলে যে কারণের বাস্তব অস্তিত্বের প্রয়োজন আর তার যুক্তিকল্পিত প্রয়োজন এক নয়। আসলে এই যুক্তি শুধু সসীমকে অস্বীকার করে অসীমে পৌঁছার চেষ্টা করে। কিন্তু সসীমকে অস্বীকার করে পাওয়া যে অসীম, তা মিথ্যা অসীম। তেমন অসীম নিজেকেও ব্যাখ্যা করে না, সসীমকেও না। বরং এত সসীমকে দাঁড় করানো হয় অসীমের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে।
সত্যিকারের যে অসীম তা সসীমকে বর্জন করে না। সসীমের সসীমত্বের বিলোপ না ঘটিয়েই অসীম সসীমকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে। এরূপে অসীম তার অস্তিত্বের প্রমাণ দেয় ও কারণ দর্শায়। কাজেই যুক্তিশাস্ত্রের দিক দিয়ে বলতে গেলে বিশ্ববাদী যুক্তিতে সসীম থেকে অসীমে পৌঁছার যে পথ, তা একান্তই অবৈধ এবং গোটা যুক্তিটাই অসার।
উদ্দেশ্যবাদী যুক্তিরও জোর এর চেয়ে বেশি নয়। উদ্দেশ্যবাদি যুক্তি কার্যত বিশ্লেষণের দ্বারা তার কারণের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা করে।
প্রকৃতিতে দূরদৃষ্টি, উদ্দেশ্য ও অবস্থার সঙ্গে ব্যবস্থার যে নিদর্শন মেলে, তার থেকেই এই যুক্তিতে অনুমান করা হয় যে অসীম বুদ্ধি ও ক্ষমতার অধিকারী এক আত্মসচেতন সত্তা আছে। এই যুক্তিতে বড়জোর পাওয়া যায় বাইরের এক নিপুণ ব্যবস্থাপকের সন্ধান; পূর্ব থেকেই বর্তমান রয়েছে এমন অচেতন ও অনমনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তার কারবার। এই পদার্থের উপাদানগুলো তাদের নিজস্ব প্রকৃতি বলে শৃঙ্খলামতো সংগঠিত ও সংযোজিত হতে পারে না। এই যুক্তিতে আমরা কোনো সৃষ্টিকর্তাকে পাই না, পাই শুধু একজন ব্যবস্থাকুশলীকে। আর যদি আমরা এ ব্যবস্থাকুশলীকে তার উপকরণের স্রষ্টা বলে মনে করি,তাহলে কথা দাঁড়ায় এই রকম:প্রথমে ব্যবস্থাকুশলী অনমনীয় উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, তারপর সেই অবাধ্য উপকরণকে বশে আনার জন্য তিনি উক্ত উপকরণের স্বভাববিরোধী উপায় অবলম্বন করেছেন। এমন হলে তো আর বুদ্ধির তারিফ করা যায় না। এই ব্যবস্থাকুশলীকে যদি তাঁর উপকরণের বাইরে বলে মনে করি, তবে তাঁকে অবধারিত রকমে তাঁর নিজ উপকরণ দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকতে হবে ও সসীমের সীমায় নেমে আসতে হবে। আসল কথা হচ্ছে, যে উপমার ওপর ভিত্তি করে উদ্দেশ্যবাদী যুক্তি অগ্রসর, তা একান্তই অসার। মানব কারিগরের কাজ আর প্রকৃতির কাজের মধ্যে মূলত কোনো সাদৃশ্য নেই।মানব কারিগর প্রকৃতির বুক থেকে তার উপকরণসামগ্রী সংগ্রহ করে সেগুলোকে ভেঙে নতুন করে সাজিয়ে তার ইমারত তৈরি করে। প্রকৃতি তার উপদানসমূহকে অখন্ড রেখেই নিজ স্বভাবলে তাদের বিবর্তন সাধন করে। স্থাপত্যশিল্পীর কাজ নির্ভর করে তার উপকরণগুলোর ক্রমশ স্বতন্ত্রীকরণ ও সমন্বয় বিধানের ওপর; প্রকৃতির অখন্ড বস্তুনিচয়ের যে বিবর্তন, তার সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য এর নেই।
বাকি রইল তত্ত্ববাদী যুক্তি। তত্ত্ববিলাসী মনের কাছে বরাবরই এই যুক্তির আবেদন সবচেয়ে বেশি। যুক্তিটা বিভিন্ন চিন্তানায়ক বিভিন্ন আকারে পরিবেশন করেছেন। দেকার্তে এ যুক্তির যে রূপ দিয়েছেন, তা হচ্ছে এই:
একটি বস্তুর প্রকৃতিতে কিংবা তৎসম্বন্ধীয় ধারণায় একটি গুণ নিহিত আছে বলা আর সেই বস্তুর বেলায় সেই গুণ সত্য এবং তাতে সেই গুণ বিদ্যমান বলে স্বীকার করা একই কথা। কিন্তু অপরিহার্য অস্তিত্ব আল্লাহর সত্তায় বা আল্লাহর ধারণায় নিহিত আছে। কাজেই এ কথা সত্যই সমর্থন করা চলে যে আল্লাহর বেলায় অস্তিত্ব অপরিহার্য অথবা আল্লাহ আছেন।
এরই পরিপূরক হিসেবে দেকার্তে আরও একটি যুক্তি দিয়েছেন। আমাদের মনে এক পূর্ণ সত্তার ধারণা রয়েছে। এই ধারণার উৎস কী? প্রাকৃতিক জগৎ থেকে নিরঙ্কুশ সত্তার ধারণায় আসা যায় না। কেননা প্রাকৃতিক জগৎ সতত পরিবর্তনশীল। বস্তুত প্রাকৃতিক জগতের পক্ষে নিরঙ্কুশ সত্তার ধারণা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের মনোগত ধারণার সঙ্গে মেলে এমন একটি বাস্তব প্রতিরূপ অবশ্যই আছে, তার থেকেই আমাদের মনে গড়ে উঠেছে এই পরম সত্তার ধারণা। এই যুক্তির স্বরূপ কতকটা সেই বিশ্ববাদী যুক্তির মতো, যার সমালোচনা আমি আগে করেছি। তত্ত্ববাদী যুক্তির রূপ যা-ই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে অস্তিত্বের ধারণা বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ নয়।
যেমন কান্ট এই যুক্তির সমালোচন প্রসঙ্গে বলেছেন, আমার মনের তিন শ ডলারের আইডিয়া বা ধারণা এ কথা প্রমাণ করে না যে আমার পকেটেও তিন শ ডলার আছে। এই যুক্তি যেটুকু প্রমাণ করে তা হচ্ছে এই যে নিরঙ্কুশ সত্তার ধারণায় তার অস্তিত্বের ধারণাও বিদ্যমান। কিন্তু আমার মনের নিরঙ্কুশ সত্তার ধারণা আর সেই সত্তার বাস্তব অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে একটা ব্যবধান; এই ব্যবধান চিন্তা ও যুক্তি মারফত অতিক্রম করা সম্ভব নয়। যে ভাবে এই যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে তাতে এটা একটা ‘পিটিশিও প্রিন্সিপি’ বা সাধসম প্রতিজ্ঞামাত্র। কারণ যে বিষয়টি প্রমাণের লক্ষ্য, অর্থাৎ কল্পনা থেকে বাস্তবে আগমন, তাকেই এই যুক্তিতে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
আশা করি, আপনাদের কাছে এ কথাটা পরিষ্কার করে তুলেছি যে সাধারণত যেভাবে তত্ত্ববাদী ও উদ্দেশ্যবাদী যুক্তির অবতারণা করা হয়ে থাকে, তাতে এদের সাহায্যে আমর কোনো সিদ্বান্তেই উপনীত হতে পারি না। আর এই যুক্তি দুটোর ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে- এরা চিন্তাকে দেখে এমন একটা কর্তারূপে, যা বস্তুর ওপর ক্রিয়অ করে বাইরে থেকে। চিন্তার সম্বন্ধে এই যে ধারণা তাতে আমরা এক ক্ষেত্রে পাই এক নিছক যন্ত্রশিল্পীর সন্ধান, আর এক ক্ষেত্রে পাই কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে সৃষ্ট এক অনতিক্রম্য ব্যবধান। তবে এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে চিন্তা এমন কোনো নীতি নয়, যা বাইরে থেকে তার উপকরণের ব্যবস্থা ও ঐক্যবিধান করে, বরং চিন্তা এমন একটা শক্তি যা তার উপকরণকে সৃষ্টি করে নিতে পারে। চিন্তা ও ধারণাকে যখন এভাবে গ্রহণ করা হয়, তখন তা বাস্তবসমূহের মূল স্বভাবের বিরোধী নয়, বরং এটাই হচ্ছে যাবতীয় বস্তুর চরম ভিত্তি এবং তাদের সত্তার প্রণবস্তু তাদের যাত্রার সূচনা থেকেই তাদের মধ্যে নিহিত থাকে এবং এক স্বতঃনির্ধারিত লক্ষের পথে তাদের অগ্রগতিকে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু আমাদের জ্ঞানের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা ও সত্তার দ্বৈত ভাব অপরিহার্য। মানুষের জ্ঞানের প্রত্যেকটি কাজ সত্তাকে দুই অংশে ভাগ করে: তার এক অংশ হচ্ছে জ্ঞান আর তার অন্য বিরোধী অংশ হচ্ছে জ্ঞাত বস্তু।
অথচ উপযুক্ত অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে ঐক্যের সূত্র মিলে যায়। এই জন্য আমরা ধরে নিতে বাধ্য হই যে সত্তার মোকাবিলায় আমরা যে বস্তুকে দেখতে পাই সে বস্তুর অস্তিত্বের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অধিকার আছে, ব্যক্তিসত্তার ওপর তা নির্ভরশীল নয়, আর ব্যক্তিসত্তা বস্তুকে জানলে বস্তুর কোনো পরিবর্তন হয় না। আমরা যদি দেখাতে পারি যে বর্তমান মানবীয় পরিস্থিতি চূড়ান্ত নয় এবং চিন্তা ও সত্তা পরিণামে একই, তবেই তত্ত্ববাদী ও উদ্দেশ্যবাদী যুক্তির সত্যিকার তৎপর্য পরিস্ফুট হবে। শুধু যদি কোরআন- প্রদত্ত সূত্র অনুসারে আমরা অভিজ্ঞতার পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করি, তাহলেই এটা সম্ভব। কারণ কোরআন বাইরের ও ভেতরের অভিজ্ঞতাকে মনে করে একই সত্তার প্রতীকরূপে। এই সত্তাকে কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে আদি ও অন্ত, দৃশ্য ও অদৃশ্য বলে। বর্তমান বক্তৃতায় আমি কোরআনের ওই পন্থাই আলোচনা করব।
কালের মধ্যে ক্রমে অভিজ্ঞতা বিকাশ লাভ করছে। এই অভিজ্ঞতার এখন তিনটি প্রধান স্তর লক্ষিত হয়- বস্তুর স্তর, জীবনের স্তর ও আত্মচেতনার স্তর। এগুলো যথাক্রমে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।
প্রথমে বস্তু নিয়ে আলোচনা করা যাক। আধনিক পদার্থবিজ্ঞানের স্বরূপ নির্ধারণ করতে হলে বস্তু বলতে আমরা কী বুঝি, তা স্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম করা প্রয়োজন। ফলিত বিজ্ঞান হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানের কারবার হচ্ছে অভিজ্ঞতা, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার তথ্য নিয়ে। বস্তুত পদার্থবিজ্ঞানীর যে গবেষণা, তার আরম্ভ ও ইতি উভয়ই ইন্দ্রিয়গোচর প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলোকে ভিত্তি করে। এগুলোকে বাদ দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীর পক্ষে তাঁর মতবাদের যথার্থ্য নির্ণয় অসম্ভব। ইন্দ্রিয়ের অগোচর বা অনুভবের অতীত যেসব সত্তা, যেমন পরমাণুরাশি- পদার্থবিজ্ঞানী তা বিনা প্রমাণে স্বীকার কবে নিতে পারেন। তবে তাঁর পক্ষে এরূপ করার কারণ হচ্ছে, অন্য কোনো উপায়ে তিনি তাঁর ইন্দ্রিয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা করতে অপারগ। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বস্তুজগৎ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয় প্রকটিত জগৎই হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানীর বিচার্য বিষয়। বস্তুজগতের বিচারে যে মানসিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন, তা পদার্তবিজ্ঞানের এলাকায় পড়ে না। অনুরূপভাবে ধর্ম ও সৌন্দর্যগত অভিজ্ঞতাও পদার্থবিজ্ঞানের এখতিয়ারে আসে না, যদিও তা গোটা অভিজ্ঞতারই অংশ। এর স্পষ্ট কারণ হচ্ছে, পদার্থবিজ্ঞানের অনুসন্ধান শুধু বস্তুজগতে সীমাবদ্ধ। এই বস্তুজগৎ বলতে আমরা সেসব বস্তুর জগৎকে বুঝি, যা আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমি যদি আপনাদের জিজ্ঞেস করি যে বস্তজগতে আপনারা কী কী জিনিস অনুভব করেন, তাহলে আপনারা অবশ্য আপনাদের চারদিকের পরিচিত জিনিসগুলোর কথাই উল্লেখ করবেন, যথা:পৃথিবী,আকাশ,পাহাড়-পর্বত,চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি।
এরপর যদি আরও জিজ্ঞেস করি- এসব জিনিসে আপনারা ঠিক কী অনুভব করেন? তার জবাবে আপনারা বলবেন যে আপনারা এদের গুণাবলি অনুভব করেন।প্রকৃতপক্ষে আমাদের ইন্দ্রিয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতারই বিশ্লেষণ করছি। আর এ বিশ্লেষণের লক্ষ্য হচ্ছে বস্তু ও তার গুণাবলির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ। প্রকৃত প্রস্তাবে এটাই হচ্ছে জড়বাদ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুর প্রকৃতি, অনুভকারী মনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং তাদের চরম কারণ সম্বন্ধীয় মতবাদ। এই মতবাদের সারাংশ হচ্ছে এই :
ইন্দিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহ ( যথা বর্ণ, শব্দ ইত্যাদি ) মনেরই কতকগুলো অবস্থা। কাজেই বস্তুর আসল রূপ এসব নয়; এগুলো কেবল বাইরের জিনিস। এই জন্য কোনো সংগত কারণেই ওগুলো প্রাকৃতিক বস্তুর গুণাাবলি হতে পারে না। আমি যখন বলি, আকাশটা নীল; তখন তার অর্থ শুধু এই হতে পারে যে আকাশটা আমার মনে নীল অনুভূতি সৃষ্টি করে; নীল বর্ণটা আকাশের নিজস্ব গুণ নয়। মানসিক অবস্থা হিসেবে এসব আমাদের মনেরই কতকগুলো ধারণা, অর্থাৎ আমাদের মনের ওপর বাইরের জগতের প্রতিক্রিয়ার ফল। বস্তুজগৎ আমাদের ইন্দ্রিয়, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের মারফত কাজ করে মনের ওপর এই ফল উৎপাদন করে। বস্তুজগতের এই ক্রিয়া সম্পাদিত হয় সংযোগ কিংবা সংঘর্ষের মাধ্যমে। কাজেই আকৃতি, আকার, ঘনত্ব ও শক্তি-এসব গুণ বস্তুর থাকতেই হবে।
‘বস্তুই হচ্ছে আমাদের অনুভূতিসমূহের অজ্ঞাত কারণ’- এই মতবাদ খন্ডন করতে যিনি প্রথম এগিয়ে এলেন, তিনি হচ্ছেন দার্শনিক বার্কলে। আমাদের কালের বিশিষ্ট গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক অধ্যাপক হোয়াইটহেড চূড়ান্তভাবেই দেখিয়েছেন যে জড়বাদের যে প্রচলিত নীতি, তা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা স্পষ্ট যে এই নীতি অনুসারে বর্ণ, শব্দ ইত্যাদি মানসিক অবস্থারই নামান্তর, প্রকৃতির কোনো অংশ তারা নয়। আমাদের চোখে-কানে যা প্রবেশ করে, তা বর্ণও নয় শব্দও নয়, বরং তারা রাশি রাশি ইথারতরঙ্গ এবং শ্রুতির অগোচর বায়ুতরঙ্গ। প্রকৃতিকে আমরা যা বলে জানি, ঠিক তা সে নয়।
আমাদের অনুভূতিগুলো মায়ামাত্র, প্রকৃতির যথার্থ অভিব্যক্তি বলে এদের মনে করা চলে না। জড়বাদের নীতি অনুসারে প্রকৃতি দুই ভাগে বিভক্ত: এক ভাগে সব মানসিক ছাপ, আরেক ভাগে এসব মানসিক ছাপের উৎপাদক এমন সব সত্তা যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়, অনুভব করাও সম্ভব নয়। পদার্থবিজ্ঞান যদি প্রকৃতই প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত বস্তুনিচয়ের সুসমঞ্জস্য ও যথার্থ জ্ঞান হয়, তাহলে বস্তুসম্বন্ধীয় প্রচলিত মতবাদকে বর্জন করতে হয়; কেননা, আমাদের ইন্দ্রিয়াদির যে সাক্ষের ওপর পদার্থবিজ্ঞানীর একমাত্র নির্ভর, এ মতবাদ সেই সাক্ষ্যকেই মনে করে মনের কতকগুলো নিছক ছাপ বলে । বস্তুত এই মতবাদ প্রকৃতি ও প্রকৃতির পর্যবেক্ষকের মধ্যে এমন একটা ব্যবধানের সৃষ্টি করে, যা দূর করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানীকে বাধা হয়ে একটা অনিশ্চিত অনুমানের আশ্রয় নিতে হয়। সে অনুমান হচ্ছে এই যে একটা অননুভবনীয় কিছু অনন্ত দেশে ব্যাপ্ত হয়ে আছে এবং কোনো পাত্রে অবস্থিত একটা বস্তুর মতোই এই অননুভবনীয় একটা কিছু কোনো উপায় সংঘর্ষ দ্বারা অনুভূতির সৃষ্টি করছে। অধ্যাপক হোয়াইটহেডের কথা বলতে গেলে এই মতবাদ প্রকৃতির অর্ধেকটাকে স্বপ্নে পরিণত করে, বাকি অর্ধেকটাকে জল্পনায় ।
পদার্থবিজ্ঞান যখন দেখল তার ভিত্তিটারই সমালোচনা প্রয়োজন, তখন সে নিজের গড়া আদর্শটাকেই শেষ পর্যন্ত ভেঙে ফেলা সংগত মনে করল। যে প্রত্যক্ষবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে মনে হয়েছিল বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের অবশ্যম্ভাবী উৎস, পরিণামে তা-ই দেখা দিল বস্তুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহরূপে । তাহলে বস্তুর সূক্ষ্ম জড়ের দ্বারা কৃত কোনো মানসিক অবস্থা নয়, তা যথার্থই প্রকৃতিতেই বিদ্যমান এবং তা-ই প্রকৃতির সারবস্তু । এই বস্তু প্রকৃতিতে যেমনটি রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবেই আমরা তার পরিচয় পেয়ে থাকি। কিন্তু বস্তুর ধারণা সবচেয়ে বড় মার খেয়েছে আরেকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর হাতে। তিনি হচ্ছেন আইনস্টাইন।মানুষের গোটা চিন্তাজগতে তার আবিষ্কারগুলো করেছে। এক সুদূরপ্রসারী বিপ্লবের ভিত্তি রচনা।
মি. রাসেল বলেন, “আপেক্ষিকতাবাদ কালকে স্থান-কালের মধ্যে বিলীন করে বস্তুসত্তা সম্বন্ধীয় প্রচলিত ধারণার যতখানি ক্ষতি করেছে, দার্শনিকদের যাবতীয় যুক্তিতর্ক তা করতে পারেনি । সাধারণ ধারণায় পদার্থ এমন এক বস্তু, যার অবস্থান কালের বুকে এবং চলাচল স্থানের মধ্যে। কিন্তু আধুনিক আপেক্ষিকতাবাদী পদার্থবিজ্ঞানের মতে, এ ধারণাও আর সমর্থনীয় নয়। এক খণ্ড বস্তু এখন আর পরিবর্তনশীল অবস্থাসম্পন্ন কোনো স্থায়ী জিনিস বলে প্রতীয়মান না হয়ে পরস্পর সংশ্লিষ্ট ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়। সেই সঙ্গে বস্তুর বিভিন্ন লক্ষণের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। আগে জড়বাদীরা বস্তুর লক্ষণগুলো দেখেই মনে করতেন চলমান চিন্তার চেয়ে বস্তু বেশি বাস্তব।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, অধ্যাপক হোয়াইটহেডের মতে, প্রকৃতি একটা শূন্যে অবস্থিত নিশ্চল বস্তু নয়। প্রকৃতি হচ্ছে ঘটনাসমূহের এমন একটা বিন্যাস,যাতে এক নিরবচ্ছিন্ন সৃজনী-প্রবাহের লক্ষণ বর্তমান । মানুষের চিন্তা এই প্রবাহকে বিভক্ত করেছে পৃথক অনড় বস্তুরূপে । এই বস্তুনিচয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে স্থান ও কালসম্বন্ধীয় ধারণার উৎপত্তি । ফলত আজ আমরা দেখছি কীভাবে আধুনিক বিজ্ঞান বার্কলের সমালোচনার সঙ্গে তার মতৈক্য ঘোষণা করছে। অথচ একসময় আধুনিক বিজ্ঞান মনে করত বার্কলের সমালোচনা তার ভিত্তিমূলের ওপরই একটা আক্রমণ । প্রকৃতিটা নিছক বস্তুসৰ্বস্ব, বিজ্ঞানের এই যে অভিমত, তা স্থান সম্পর্কে নিউটনীয় ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট । নিউটনের মতে, স্থান হচ্ছে একটা নিরঙ্কুশ ‘শূন্য’, সকল বস্তু তারই ভেতর অবস্থিত। বিজ্ঞানের এই দৃষ্টিভঙ্গি তার উন্নতিকে ত্বরান্বিত করেছে সন্দেহ নেই।
কিন্তু গোটা অভিজ্ঞতাকে মন ও বস্তু এই দুটি বিপরীত এলাকায় বিভক্ত করার ফলে বিজ্ঞানের নিজের ঘরেই দেখা দিয়েছে অসুবিধা । তাই বিজ্ঞান এখন সেসব সমস্যা সম্বন্ধে বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছে, যা সে তার যাত্রার শুরুতে করেছিল সম্পূর্ণ উপেক্ষা। গাণিতিক বিজ্ঞানের ভিত্তিগুলো নিয়ে যেসব আলোচনা হয়েছে, তাতে পূর্ণরূপেই প্রকাশ পেয়েছে যে নিছক জড়বাদ নিয়ে আর কারবার চলে না। স্থান কি তাহলে একটা নিরপেক্ষ ‘শূন্য’ যাতে বস্তুনিচয় অবস্থিত? আর, সব বস্তু সরিয়ে নিলেও কি সে ‘শূন্য’ থাকবে অবিকল?
গ্রিক দার্শনিক জেনোস্থান-সংক্রান্ত সমস্যাটির মোকাবিলা করেছেন স্থানভিত্তিক গতি-সম্পর্কিত প্রশ্ন মারফত । গতির অবাস্তবতার পক্ষে তাঁর যেসব যুক্তি, তা দর্শনের ছাত্রদের কাছে সুপরিচিত। তাঁর সময় থেকেই চিন্তার ইতিহাসে এই সমস্যাটি বারবার চলে এসেছে এবং পরবর্তীকালে সব চিন্তানায়কেরই গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জেনোর দুটি যুক্তি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। স্থানকে তিনি অসংখ্য ভাগে বিভাজ্য মনে করতেন। তাঁর একটি যুক্তি হলো যে স্থানের মধ্যে গতি অসম্ভব। গন্তব্যবিন্দুতে পৌঁছার আগে চলমান বস্তুকে তার যাত্রাবিন্দু ও গন্তব্যবিন্দুর মধ্যবর্তী অর্ধস্থান অতিক্রম করতেই হবে এবং সেই অর্ধস্থান অতিক্রম করার আগে সেই অর্ধের অর্ধেকের ভেতর দিয়ে যেতে হবে এবং এভাবে তার যাত্রা হবে অসীম অনন্যের দিকে। আমরা স্থানের এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে যেতে পারি না, যতক্ষণ সেই বিন্দুর মধ্যবর্তী স্থানের অসংখ্য বিন্দু অতিক্রম না করি। কিন্তু সসীমকালে এই অনন্ত বিন্দুরাশি অতিক্রম করা অসম্ভব।
তিনি আরও বলেন যে উড়ন্ত যে তির তা চলে না, কারণ ওড়াকালীন যেকোনো সময় সেই তির স্থানের কোনোনা কোনো বিন্দুতে স্থির হয়ে থাকে। কাজেই জেনোর মতে, গতি একটা ভ্রান্ত শ্রুতিমাত্র আর সত্তা অখণ্ড ও অপরিবর্তনীয় । গতির অবাস্তবতা দ্বারা এক অন্য-নিরপেক্ষ স্থানের অবাস্তবতাই বোঝায়। আশয়ারি মতবাদ অনুসারে মুসলিম চিন্তানায়কগণ স্থান ও কালের অন্তহীন বিভাজ্যতায় বিশ্বাস করেননি। তাদের মতে বিন্দু ও মুহূর্ত দ্বারাই স্থান, কাল ও গতি গঠিত। এই বিন্দু ও মুহুর্তকে আর ভাগ করা চলে না। অতি সূক্ষ্ম ও অবিভাজ্য বিন্দু ও মুহূর্তের অস্তিত্ব রয়েছে, এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই তারা গতির সম্ভাবনা প্রমাণ করেছেন। কারণ স্থান ও কালের বিভাজ্যতার যদি শেষ থাকে, তাহলে সসীমকালের স্থানের এক বিন্দ পর্যন্ত চলাচল সম্ভব না হবে কেন? ইবনে হাজম কিন্তু আশয়ারিদের অবিভাজ্য সূক্ষ্ম বিন্দু-মুহর্তের ধারণা নাকচ করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আধুনিক গাণিতিকগণও তাঁর মতবাদ সমর্থন করেছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আশয়ারিদের যুক্তিও জেনোর আপাত-স্ববিরোধী যুক্তিকে খণ্ডন করতে পারেনি। আধুনিক চিন্তানায়কদের মধ্যে ফরাসি দার্শনিক বার্গস এবং ব্রিটিশ গাণিতিক বার্ট্রান্ড রাসেল নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে জেনোর যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন । বার্গসের মতে, সত্যিকার পরিবর্তন হিসেবে গতিই হচ্ছে মৌলিক সত্তা । স্থান ও কালের ভ্রান্ত ধারণা থেকেই জেনোর আপাতবিরোধী যুক্তির উৎপত্তি।
বার্গস মনে করেন, স্থান ও কাল গতির বুদ্ধিগত ধারণামাত্র । জীবনের এক দার্শনিক তত্ত্বের ওপর বার্গস তাঁর যুক্তিকে দাঁড় করিয়েছেন। এই তত্ত্বের বিশদ আলোচনা ছাড়া আমাদের পক্ষে বার্গসের যুক্তি হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। বার্ট্রান্ড রাসেলের যুক্তি অগ্রসর হয়েছে ক্যান্টরের গাণিতিক ধারাবাহিকতার মতবাদকে অবলম্বন করে। তাঁর মতে, গাণিত্যিক ধারাবাহিকতা আধুনিক গণিতশাস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
স্থান ও কাল অনন্তসংখ্যক বিন্দু ও মুহর্তের সমষ্টি—স্পষ্টত এই অনুমানের ওপর জেনোর যুক্তি প্রতিষ্ঠিত। এই অনুমান অনুসারে সহজেই তর্ক চলতে পারে যে চলমান বস্তু যখন দুই বিন্দুর মধ্যে অবস্থানহীন হয়ে পড়ে, তখন তার গতি কী করে সম্ভব? কেননা, দুই বিন্দুর মধ্যস্থলে এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে গতি সংঘটিত হতে পারে। ক্যান্টরের আবিষ্কার দেখিয়েছে যে স্থান ও কাল বিরামহীন । স্থানের যেকোনো দুটি বিন্দুর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য বিন্দু; আর এই অনন্ত বিন্দুধারার কোনো দুটি বিন্দুই পরপর অবস্থিত নয় । স্থান ও কালের অন্তহীন বিভাজ্যতার মানে হচ্ছে এই যে শ্রেণি-বিন্দুগুলোর মধ্যে ঘনত্ব আছে। এর অর্থ হলো তাদের প্রত্যেকের মধ্যে ফাঁক রাখার জন্য বিন্দুগুলোপরস্পর পৃথকভাবে অবস্থান করছে। কাজেই রাসেল জেনোর মতবাদের জবাব দিলেন এভাবে :
জেনো প্রশ্ন করেছেন, এক মুহূর্তে এক স্থানে অন্য মুহর্তে অন্য স্থানে যেতে চাইলে যাওয়ার পথে মাঝখানে কালহীন ও স্থানহীন কোথাও অবস্থান না করে কী করে আপনি যেতে পারেন? এর উত্তর হচ্ছে কোনো স্থানেরই পরবর্তী স্থান নেই; কোনো মুহূর্তেরই পরবর্তী মুহর্ত নেই; কারণ যেকোনো দুটি স্থান ও মুহূর্তের মধ্যে সব সময়ই আর একটা স্থান বা মুহর্ত রয়েছে। আর যদি অবিভাজ্য সূক্ষ্ম বিন্দু মুহূর্ত থাকত, তাহলে গতি সম্ভব হতো না, কিন্তু অবিভাজ্য সূক্ষ্ম বিন্দু-মুহূর্ত বলে কিছু নেই। কাজেই জেনোর এ কথা ঠিক যে তির ছো টার সময়ে প্রত্যেক মুহতেই স্থির হয়ে থাকে। কিন্তু সে কারনেই তিরের গতি নেই, এ অনুমান তাঁর ভুল । কারণ যেকোনো গতিতে স্থানের অসীম ধারা ও মুহূর্তের অসীম ধারার মধ্যে এক-এক পর্যায়ে সাযুজ্য রয়েছে। কাজেই এই মতবাদ অনুসারে স্থান, কাল ও গতির বাস্তবতা স্বীকার করা এবং সেই সঙ্গে জেনোর যুক্তির স্ববিরোধিতা এড়ানো সম্ভব । এভাবে বাট্রান্ড রাসেল ক্যান্টরের ধারাবাহিকতার মতবাদকে ভিত্তি করে গতির বাস্তবতা প্রমাণ করেছেন। গতির বাস্তবতা বলতে বোঝায় যে স্থানের স্বাধীন সত্তা। আছে এবং প্রকৃতিও কেবল কল্পনা নয়, তারও একটা বাস্তব সত্তা আছে। কিন্তু স্থানের ধারাবাহিকতা ও তার অন্তহীন বিভাজ্যতা—এই দুইকে অভেদ মনে করলেও সমস্যার সমাধান হয় না।
এক সসীম ‘শূন্য’ অসীম-সংখ্যক মুহূর্ত এবং স্থানের এক সসীম অংশে অসীম-সংখ্যক বিন্দুর মধ্যে একাত্মক অনুরূপতা স্বীকার করে নিলেও বিভাজ্যতাজনিত অসুবিধাটা পূর্ববৎই থেকে যায় । অনন্তক্রম হিসেবে ধারাবাহিকতার যে গাণিতিক ধারণা, তার প্রয়োগ একটা ঘটনা হিসেবে বিবেচিত গতির বেলায় হয় না, এ ধারণার প্রয়োগ হয় বরং বাইরে থেকে দেখা গতির ছবি সম্বন্ধে । গতির যে বাস্তব ক্রিয়া, তাকে ভাগ করা চলে না। স্থানের ভেতর দিয়ে তিরের যে গতি আমরা দেখি, সে গতিকে ভাগ করা চলে, কিন্তু তিরের গতিকে একটি ক্রিয়া বলে বিবেচনা করলে তা অখণ্ডরূপেই প্রতিভাত হয়। তখন এ গতিকে খণ্ড খণ্ড অংশে ভাগ করা যায় না । গতিকে ভাগ করলে তা আর গতি থাকে না। আইনস্টাইনের মতে, স্থান বাস্তব, কিন্তু পর্যবেক্ষকের বেলায় তা আপেক্ষিক । নিউটন বলেন যে স্থান অন্য-নিরপেক্ষ। আইনস্টাইন এ মত প্রত্যাখ্যান করেন। আমরা যে জিনিস দেখি তা পরিবর্তনশীল, দ্রষ্টার কাছে তা আপেক্ষিক। দ্রষ্টার গতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্ট বস্তুর পরিমাণ ও আকারের পরিবর্তন ঘটে। গতি এবং স্থিতিও দ্রষ্টার সম্পর্কে আপেক্ষিক। কাজেই দেখা যাচ্ছে প্রাচীন পদার্থবিজ্ঞান যাকে স্বয়ংজীবী বস্তু বলত, বাস্তবে তেমন কোনো জিনিস নেই।
তবে এখানে একটা ভুল ধারণার সম্ভাবনা আছে, সে সম্পর্কে আমাদের পূর্বাহ্নেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ‘দ্রষ্টা’ শব্দের ব্যবহারই এই সম্ভাব্য ভুল ধারণার উৎস। উইলডন কার তো সত্যিই ভুল করেছিলেন। তার ধারণায় আপেক্ষিকতাবাদের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে নিরবয়বমূলক ভাববাদ। সত্য বটে, আপেক্ষিকতাবাদ অনুসারে দৃষ্টিগোচর প্রাকৃতিক বস্তুর আকৃতি, আকার ও অবস্থান অন্য-নিরপেক্ষ নয়। কিন্তু অধ্যাপক নান দেখিয়েছেন যে স্থান-কালের যে কাঠামোতা দ্রষ্টার মনের ওপর নির্ভর করে না; বরং বস্তুজগতের যে বিন্দুটির সঙ্গে দ্রষ্টার দেহ সংশ্লিষ্ট, তারই ওপর এই কাঠামোর নির্ভর। বস্তুত দ্রষ্টার বদলে সহজেই একটা রেকর্ড-যন্ত্র বসানো যেতে পারে। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি তো মনে করি, সত্তার চরম স্বরূপ হচ্ছে আধ্যাত্মিক। কিন্তু একটা ভ্রান্ত ধারণা যাতে প্রসার লাভ করতে না পারে, তার জন্য এখানে দেখিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে আইনস্টাইনের যে মতবাদ তার কারবার হচ্ছে বস্তুনিচয়ের কেবল গঠন নিয়ে। সুতরাং যেসব বস্তুর এই গঠন তাদের অন্তিম প্রকৃতির ওপর এ মতবাদ কোনো আলোকপাত করে না। এই মতবাদের দার্শনিক মূল্য দুই রকমের।
প্রথমত, এই মতবাদ প্রকৃতির বস্তত্বকে নষ্ট করে না, নষ্ট করে সেই মতবাদকে যে মতবাদ অনুসারে পদার্থ হচ্ছে স্থানের ভেতরে অবস্থিতি মাত্র এবং যে মতবাদ থেকে প্রাচীন দর্শন-বিজ্ঞানে হয়েছিল বস্তুবাদের উদ্ভব। আধুনিক আপেক্ষিকতাভিত্তিক পদার্থবিজ্ঞানের মতে, সার পদার্থ পরিবর্তনশীল, অবস্থাবিশিষ্ট কোনো স্থায়ী জিনিস নয়; পদার্থটা হচ্ছে পরস্পরসম্পৃক্ত ঘটনাবলির একটা বিন্যাস। হোয়াইটহেড যেভাবে এই মতবাদ পরিবেশন করেছেন, তাতে পদার্থের ধারণা সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে, তার স্থলে দেখা দিয়েছে জৈবিক ধারণা। দ্বিতীয়ত, এই মতবাদে স্থান হয়ে পড়ে বস্তুর ওপর নির্ভরশীল । আইনস্টাইনের মতে, পৃথিবী অনন্ত শূন্যে অবস্থিত একটা দ্বীপের মতো নয়; পৃথিবীটা সসীম কিন্তু সীমাহীন—এর বাইরে কোনো শূন্য স্থান নেই । পদার্থ না থাকলে বিশ্ব ছোট হয়ে একটা বিন্দুতে পরিণত হতো। যে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে আমি বক্তৃতাগুলো করছি, সেদিক থেকে এই মতবাদের বিচার করলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ আমাদের সামনে মস্ত একটা অসুবিধা, অর্থাৎ কালের অসারত্ব বা অবাস্তবতা তুলে ধরে। যে মতবাদ কালকে স্থানের একটু চতুর্থ মাত্রা বলে মনে করে, মনে হয় তা অবশ্যই ভবিষ্যৎকেও মনে করে এমন একটা জিনিসরূপে, যা পূর্ব থেকেই অতীতের মতো নিঃসন্দেহ রকমে দেওয়া আছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এ মতবাদ অনুসারে অবাধ সৃজনশীল গতি হিসেবে কালের কোনো অর্থ নেই। কাল এখানে অতিবাহিত হয় না; ঘটনাও সংঘটিত হয় না—আমরা তাদের সাক্ষাৎ পাই মাত্র।
ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন
মুহাম্মদ ইকবাল
তর্জমা: মোহাম্মদ মোকসেদ আলী এম এ