Interview with Musa Al-Hafeez

ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও কালামদর্শন -এর ওপর শায়খ মুসা আল হাফিজ (দা. বা.) একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ।কাজী একরাম এই অতিব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন । এতে দর্শন ও ইলমে কালাম নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে। সময় ও বাস্তবতার দাবিতে এতে যে জ্ঞানগত ও চিন্তাগত দিকনির্দেশনা উঠে এসেছে, তা কেবল বাংলাদেশের বাস্তবতায় গুরুত্বপূর্ণ, তা নয়। বরং মুসলিম বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটে এর রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব ।

কাজী একরামঃ আপনি ইলমে কালামের চর্চার কথা বলেন। আসলে কি দর্শন চর্চার কথা বলেন?

মুসা আল হাফিজঃ ইলমে কালাম মেটাফিজিক্স বা পরপদার্থ বিদ্যার এলাকার বিষয়; যা দর্শনের এরিয়ার মধ্যে আছে। কিন্তু দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি, এটি ঠিক তা নয়, ইলমে কালামকে স্কলাস্টিক থিয়োলোজি বলা যেতে পারে। আর পশ্চিমা দর্শনের সাথে এর ব্যবধান সুস্পষ্ট। ইলমে কালামের কেন্দ্র অবতীর্ণ ওহী; তার বুনিয়াদে আছে খোদাতত্ত্ব তথা ইলমুত তাওহিদ ওয়াসসিফাত। আর পশ্চিমা দর্শনের মূলে আছে মানুষের দূরকল্পন। মানুষের অর্জিত জ্ঞান ও চিন্তাধারাকে ওহীভিত্তিক জ্ঞানের আলোকে যাচাই পর্যালোচনা করে ইলমে কালাম। এ ক্ষেত্রে ইস্তেদলাল (আরোহপদ্ধতি) ও ইস্তেকরা (অবরোহপদ্ধতি) সহ বিভিন্ন পদ্ধতিকে কাজে লাগায় এবং নিজস্ব পথে অগ্রসর হয়। অপরদিকে গড়পড়তা দার্শনিকরা ধর্ম, ওহীসহ জীবন ও জগতের মৌলিক প্রশ্নসমূহের সমাধানে নিজেদের অনুভাব ও চিন্তা-গবেষণাকে ব্যবহার করেছেন। বৈজ্ঞানিক নানা প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন। প্রধানত অবরোহ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। বুদ্ধি, যুক্তি, সংশয়-অনুসন্ধান, অভিজ্ঞতাসহ নানা উপাদানকে কাজে লাগিয়েছেন। ইউরোপ ইলমে কালামকে এক সময় কাজে লাগাতো নিজেদের প্রয়োজনে। পশ্চিমা দর্শন বিকাশে ইলমে কালামের বড় রকমের প্রভাব রয়েছে।

কাজী একরামঃ এটা তো বিস্ময়কর শুনাচ্ছে !

মুসা আল হাফিজঃ কেন বিস্ময়কর মনে হবে? ইলমে কালামের প্রভাবে তো ইহুদীদের ইলমে কালাম জন্ম নেয়, খ্রিস্টানদের মধ্যেও ইলমে কালাম জন্ম নেয়। ওলন্দাজ দার্শনিক বারুখ স্পিনোজা যখন ইউরোপে নতুন দার্শনিক পদ্ধতি নিয়ে এলেন, তখন ইহুদী ও খ্রিস্ট্রিয় কালাম দর্শনের অগ্রগতি থেমে যায়। তিনি বলতেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব শুধুই দর্শনতাত্ত্বিক। তার দার্শনিক পদ্ধতি ছিলো জটিল, দুর্বোধ্য। এমনকি গ্যেটের মতো মহাপণ্ডিতও সেটা বুঝতেন না, বলে স্বীকার করেন। কিন্তু এর প্রভাব ছিলো খুব বেশি। দর্শনের দুনিয়াটাই বদলে দেন স্পিনোজা। ১৬৭৭ সালে তার মৃত্যু হয়। তিনি নিজের দার্শনিক ভিত্তি গড়েন ইহুদি কালামবিদদের মাধ্যমে। যাদের অন্যতম হলেন মাইমোনাইড্‌স, এবিসেব্রন প্রমুখ। এরা আরবীয় দর্শন পড়তেন, পড়াতেন। এসবের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করতেন। এসব থেকেই স্পিনোজার দার্শনিক ভিত্তিমূল তৈরী হয়। বিজ্ঞানী ব্রুনোর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তিনি। ইহুদী ও খ্রিস্টান কালাম দর্শনের উদর থেকে তিনি বের করে আনেন দর্শনের নতুন বয়ান। যেখানে গণিত ও বিজ্ঞান প্রবলভাবে হাজির থাকে। স্পিনোজার পরের ইউরোপীয় দর্শনে নাস্তিকতা সবলে কথা বলতে থাকে। মুসলিমরা তখন কম প্রয়োজনীয় ইলমে কালামে বেশি মনোযোগী।

কাজী একরামঃ কম প্রয়োজনীয় ইলমে কালাম কোনটা?

মুসা আল হাফিজঃ ইলমে কালামের ধারাবাহিক ইতিহাস যদি মন্থন করেন, দেখবেন, ইলমে কালামের দুইটি প্রবাহ। একটির জন্ম হয়েছে, মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ফলে। এটি নিয়ে মুসলিম দুনিয়ায় সবচে বেশি হাঙ্গামা, রক্তারক্তি হয়েছে। অসংখ্য মেধা জীবন বিনিয়োগ করেছে এ ধারায়। এটির চর্চা প্রয়োজনীয় মাত্রায় হলেই যথেষ্ট । কিন্তু এর প্রতি মনোযোগ এতো বেশি দেখানো হয়েছে যে, কোথায় থামা উচিত, সেটাও এক সময় ভুলে বসে নানা গোষ্ঠী। পতনকালে সেটা আমাদের সভ্যতাকে ভেতর থেকে অনেক বেশি ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। কিংবা পতনকালের পেছনে এর ভূমিকাটা কম ছিলো না। কারণ এটি কালাম চর্চা তথা যুক্তি ও প্রমাণের লড়াইয়ের মধ্যে আটকে থাকেনি, বরং বিভক্তির এক পর্যায়ে যুদ্ধের ময়দান তৈরী করেছে মুসলিম মনে, সমাজে, ঘরে ঘরে।

ইলমে কালামের আরেকটি ধারা জন্ম নেয় দর্শনের সাথে লড়াই করতে গিয়ে। এটিকে বলা হতো ইলমে কালাম জাদিদ বা নবীন ইলমে কালাম। আগেরটা প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিলো নুসূস বা কুরআন-সুন্নাহ এর মধ্যে। যাকে বলা হতো কালামে কুদামা বা প্রাচীনদের কালাম। তাফতাজানী উভয়টির পার্থক্য নিয়ে আলোকপাত করেছেন তার বিখ্যাত শারহুল আকায়িদিন নাসাফিয়্যাহ গ্রন্থে। তিনি দেখিয়েছেন, প্রাচীনদের কালামে দর্শন ছিলো না। পরবর্তীদের কালামে কুরআন-হাদীসের প্রমাণাদির পাশাপাশি দর্শন ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপস্থিতি এতো বেশি ছিলো যে, এতে যদি কুরআন-হাদীস না থাকতো, তাহলে সেই কালাম ও দর্শনের মধ্যে কোনোই পার্থক্য থাকতো না। কিন্তু কেন এ ব্যবধান আসলো? তাফতাজানি দেখিয়েছেন, যেহেতু তখন ইসলামী আকিদা ও জ্ঞানকলা এমন সব মতবাদীদের হামলার কবলে পড়েছিলো, যাদের হাতিয়ার ছিলো দর্শন। ফলত তাদের মোকাবেলা করতে ইলমে কালাম তাদেরই হাতিয়ারকে অবলম্বন বানায়। এটি ইলমে কালামের দ্বিতীয় ধরণ। এর লড়াই ইসলাম বিরোধী দর্শনের সাথে।

একটি বিষয় মনে রাখা দরকার। ইলমে কালাম যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে, তা হচ্ছে আসলী বা মৌলিক এবং এ’তেকাদী বা বিশ্বাসগত। ফলত ফরয়ী বা শাখাগত এবং আমলী বা কর্মগত বিষয় তার অন্বিষ্ট নয়। এগুলো মূলত আহকামাতের এলাকা; ফিকহের ময়দান।

ইলমুল কালামের অন্বেষা প্রধানত আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী। এ জায়গায় আসল লড়াইটা খোদার প্রতি অস্বীকৃতিবাদীদের সাথে। তারপর তাদের সাথে, যারা খোদার সাথে শরীক করে এবং খোদার সাথে এমন বিষয়াবলী আরোপ করে, যা থেকে তিনি উর্ধ্বে।

কাজী একরামঃ তাহলে ইলমে কালামের এতো সমালোচনা কেন করা হলো ?

মুসা আল হাফিজঃ নতুন যে ইলমে কালাম, সেটা সমালোচনার মধ্যে পড়লো। ফকীহগণ নিন্দা করলেন, মুহাদ্দিসগণ করলেন। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এর একটি উক্তি তো প্রায় প্রবাধের মতো বিখ্যাত হয় যে, ইলমে কালামে বিখ্যাত হবার মানেই হলো, তাকে যিন্দিক বলা হবে। খেজুরের ঢাল ও জুতো দিয়ে কালামবিদদের পেটাতে বলেছিলেন তিনি। হানাফী ফকিহদের ফতোয়া উল্লেখ করেছিলেন ইমাম সদরুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আলী রহ: । ফতোয়াটি হলো, দেশের আলিমদের জন্য কেউ যদি ওসিয়ত করে, তাহলে এতে কালামবিদরা পড়বে না। কারণ তারা আলেম নয়। ইলমে কালামও দ্বীনী ইলমের মধ্যে পড়বে না। হানাফি ফকীহ ইবনে নুজাইম এর আল-আশাবাহ ওয়াল-নাজাঈর, মালেকি ফকীহ আদ দারদির আল-শারহুল-কাবির কিংবা ইমাম দাসুকী তাঁর হাশিয়াহ এর দ্বিতীয় খণ্ডে, শাফেয়ী ফকীহ ইমাম যাকারিয়া আনসারী তাঁর আসনা আল-মাতালিবের চার নম্বর খণ্ডে, হাম্বলি ফকীহ আল বাহুতি তার কাশশাফ এর তিন নম্বর খণ্ডে সমালোচনা করেছেন দর্শন ও কালামের।

সালাফী ধারার অনেকেই এখনও কালামের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। তারা দর্শনের সমালোচনা করেন প্রবলভাবে। মানি ‘হা্ম্মাদ আল জুহানীর মতো দায়িত্বশীল মানুষ দাবি করেন, যে, দর্শনে সুন্নাহের নৈতিক নির্দেশনা অনুসরণ করা হয় না, “দার্শনিকরা যুক্তিবিজ্ঞানের ভিত্তিতে যা সংজ্ঞায়িত করেছেন তা বিশ্বাস ও ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক মিথ্যাচার এবং সবচেয়ে জঘন্যতম যুক্তি, ব্যাখ্যা এবং রূপক । যা ধর্মীয় গ্রন্থকে বিকৃত করে। তার নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করা খুবই সহজ।ʼʼ রবি মাদখালি দাবি করেন, ইলমে কালাম সর্ববাদীসম্মত হারাম; এ দাবি ভুল। তিনি বলেছেন, সঠিক মানুষের এর দরকার নেই। আর ভুল মানুষ এ থেকে ফায়দা পাবে না। রবির এ সমালোচনা ইবনে তাইমিয়াররই পুনরুল্লেখ। তিনি বা এরকম সালাফীরা সেসব বক্তব্যই শুনিয়ে যান। ইবনে তাইমিয়া বলেছিলেন, “বুদ্ধিহীন ব্যক্তি এর মাধ্যমে উপকৃত হয় না, বুদ্ধিমান ব্যক্তির এর প্রয়োজন নেই।” বুদ্ধিমান ব্যক্তির এর প্রয়োজন নেই; কারণ সে সত্তাগত, ফিতরতি ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে বিচক্ষণ। আর একজন বুদ্ধিহীন ব্যক্তি এর থেকে উপকৃত হয় না। সে যদি ইলমুল কালামের সব কিতাবও পড়ে, তবুও এর থেকে উপকৃত হবে না।

এধারায় অসংখ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহের নাম আসবে। সবকালেই তারা আছেন। যারা সমালোচনা করেছিলেন, তাদের অনেকেই কালামের আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন ইবনে তাইমিয়া। এমনকি যে ইমাম গাযালি দর্শনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন, তিনিও তা করেছিলেন দার্শনিক পন্থায়, তিনি নিজে ছিলেন এক অগ্রগণ্য দার্শনিক। ইমাম আবু হানিফার কিতাব তো আছে ইলমুততাওহিদ নিয়ে, আল ফিকহুল আকবার। আহমদ ইবনে হাম্বলের কিতাব আছে, আসসুন্নাহ, মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া আল মাদিনীর কিতাব আছে, আল ঈমান। ইমাম আশয়ারী গ্রিক ফালসাফার সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তিনি নিজেই যুক্তি ও কার্যকারণ বা causality -এর কথা বলতেন, অস্বীকারের জন্যই বলতেন। কিন্তু এ অস্বীকার প্রক্রিয়াও দর্শনের-ই একটি বিষয়। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস ও যুক্তি নিয়ে প্রচুর আলোচনা করা হয়। প্রত্যেক ইসলামী চিন্তাবিদ-ই যুক্তি ও বুদ্ধি নিয়ে কথা বলেছেন। এগুলো তো ইলমে কালাম ও দর্শনের মৌলিক উপাদান।

তাহলে তারা কীসের সমালোচনা করলেন? এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, সমালোচনাটা সাধারণভাবে ইলমে কালামের ছিলো না, ছিলো নতুন ইলমে কালামের।

কিন্তু নতুন ইলমে কালাম মানেই কি সমালোচনাযোগ্য? ইমাম তাহাবীকে যদি না ধরি, ফকীহ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির ইমাম আবু হাফস নাসাফী কিংবা ইমাম সাদুদ্দীন তাফতাজানী রহ. নতুন ধারার কালামবিদ ছিলেন, তা তো মানতে হবে। তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন এই সমালোচনা? জবাবের জন্য আমাদের নজর দিতে হবে একটু গভীরে।

আমরা মানুষকে দেখি। কিন্তু জীবনকে দেখি না। আমরা দেখি জীবনের লক্ষণ। অন্তরালের সেই জীবনকে তলিয়ে দেখার প্রজ্ঞাপ্রসুত চেষ্টা করে দর্শন। ঢালাওভাবে সে ভালো কিংবা খারাপ নয়। খারাপ রাজনীতি আমরা দেখে বলতে পারি না রাজনীতি মাত্রই খারাপ। রাজনীতিকে তাড়াতে হবে। যারা রাজনীতি করে, তারা খারাপ। রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্র হয় না, সমাজ হয় না। দর্শন ছাড়াও মানবসমাজ হয় না, রাষ্ট্র হয় না। যেখানে জীবন আছে, সেখানে দর্শন আছেই। সত্য কী? জ্ঞান কী? ভালো-মন্দ কী? ইত্যাদি জিজ্ঞাসা সব সমাজেই থাকে, যেখানে এসব জিজ্ঞাসা আছে, সেখানে দর্শন আছেই। প্রাকৃতিক জ্ঞান ও মানবিক জ্ঞানকে অবজ্ঞা করার সুযোগ আছে আমাদের? যদিও ইমাম গাযালী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কিছু দিককে ইসলামের জায়গা থেকে রিজেক্ট করেছেন। এর ফলাফল মুসলিম সভ্যতার ক্ষতি করেছে। এটা মনে করার কারণ নেই যে, গাযালি ভুল করতে পারেন না। আবার তাঁকে মুসলিম জ্ঞানের অধ:পতনের জন্য দায়ী করার প্রবণতার সাথেও আমি একমত নই কোনোভাবেই। কিন্তু তার কিছু বিচার ছিলো পরিস্থিতির সন্তান। সেগুলোকে পরবর্তী চিন্তাহীনতা আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করেছে। অন্ধঅনুকরণ করেছে। প্রয়োজন ছিলো সেগুলোর পুনর্পঠন ও পুনরোৎপাদন। সেটা আর হয়নি সেভাবে। ইমাম গাযালিকে অতএব ইবনে রুশদের সাথে মিলিয়ে পাঠ করা চাই। কিন্তু এখানে বিপদ হলো দর্শনের মোহ। এই মোহের ক্ষমতা ভয়াবহ। এর চোখ দিয়ে সবকিছু বিচারের প্রবণতা আত্মঘাতী। এর হাতে নিজেকে সমর্পণ করলে চলবে না।

বলতে চাইছি, দর্শন আছে সবখানে। ধরেন ইতিহাস। এই যে ইবনে খালদুন বললেন, ইতিহাস হলো দর্শনের জিনিশ । ঠিকই বলেছেন। তার ব্যাখ্যা হলো, ইতিহাসের ভেতরের মানে হচ্ছে সত্যে উপনীত হওয়া। ঘটনাগুলো কেন ঘটলো, কীভাবে ঘটলো, এ বিষয়ে গভীরভাবে জানা। এর মানে হলো, ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, সেখানে ছড়িয়ে আছে দর্শন। কিন্তু আপনি ইতিহাসকে গুরুত্ব দিচ্ছেন আর দর্শনকে রিজেক্ট করছেন, এর মানে কী? এর মানে হলো আপনি ইতিহাসকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

কাজী একরামঃ তাহলে এর এতো সমালোচনা কেন হলো?

মুসা আল হাফিজঃ ফকিহ ও মুহাদ্দিসদের অনেকেই কালামবিদদের যে সমালোচনা করেছেন, সেটা এককথায় যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, এককথায় প্রত্যাখ্যানযোগ্যও নয়।

ইলমে কালামের বিষয়বস্তুর প্রতি আমরা লক্ষ্য করতে পারি। এ শাস্ত্র বলতে গেলে দু’টি বিষয়। একটি হচ্ছে ইসলামী আকিদা-বিশ্বাসের জ্ঞানগত প্রতিষ্ঠা। আরেকটি হলো নাস্তিক্যের প্রতিরোধ এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের সাথে প্রামাণ্য লড়াই। ইলমে কালামকে যেহেতু গ্রিক দর্শনের সাথে প্রবল লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়েছিলো, তাই তার মধ্যে দর্শন বিরোধী কাড়া নাকাড়ার আওয়াজ ছিলো খুব। শুরুতে তো গ্রিক দর্শনের মন্দ দিকগুলোর সাথে এর লড়াই শুরু হয়। পরে যখন জ্ঞান এ চিন্তার দুনিয়ায় গ্রিক আধিপত্য ব্যাপক হতে থাকলো, তখন অনেকেই দর্শনের, গ্রিক দর্শনের মূলত কাঠামোর বিরুদ্ধে গোলা বর্ষণ করেছেন। সেটা তারা করলেন ইসলামের সুরক্ষার লক্ষ্যে। কিন্তু সেই কালামবিদদেরই ইসলাম বিরোধী বলে আক্রান্ত হতে হলো!

কুরআন-সুন্নাহে এমন বহু বিষয় আছে, যেগুলোর পরস্পরবিরোধী অর্থ করা যায়। এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ফকীহগণকেও মতবিরোধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ফলে দার্শনিকদের বিচারভঙ্গী আর তাদের বিচারভঙ্গীর মধ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো, একদিক থেকে বিচারভঙ্গীর ভিন্নতা মাত্রা ছাড়িয়ে আকিদার সীমানা অতিক্রম করে, আরেকদিক থেকে কেবল বিচারভঙ্গীর ভিন্নতার কারণেই কাউকে দ্বীন থেকে খারিজ বলে দেয়া।

এটি একটি গুরুতর প্রশ্ন যে, ঐশীবাণীর সাথে যুক্তিবাদের সম্পর্ক কতটা? কিছু মানুষ সব ক্ষেত্রেই যুক্তি চায়, যুক্তি ছাড়া কিছুই বুঝে না। আবার কিছু লোক সব ক্ষেত্রেই শ্রদ্ধাভাজনের অনুসরণ করতে চায়।

অনেকেই আবার মধ্যমপন্থী। যুক্তিশীলতা ও বর্ণনার সামঞ্জস্য বিধান করেন তারা।

সাহাবীদের মধ্যে কি যুক্তি ও রেওয়ায়েত বিচার নিয়ে ভিন্ন অবস্থান আমরা দেখি নাই? হযরত আবু হুরাইরা রা. হাদীস বর্ণনা করলেন যে, জীবিতের বিলাপে মৃতের শাস্তি হয়।

আয়শা রা. এ শুনে বললেন, না, মৃতরা শুনে না। ‘ইন্নাকা লা তুসমি’উল মাওতা।’ এতে কি আম্মাজান আয়িশা রা. হাদীস অস্বীকার করলেন? আসলে তা করেননি। তিনি দলিলের সাথে এর সামঞ্জস্য ও যুক্তিশীলতা দিয়ে হাদীসকে বিচার করতে চেয়েছেন। আবু হুরাইরা রা. -এর অনেক হাদীসে এভাবে ত্রুটি ধরেছেন। সুয়ুতি রহ. সেগুলোর একটি সঙ্কলন করেছেন।

মুতাকাল্লিমদের অনেক সমালোচনা এমন আছে, যা মূলত ভুল বুঝাবুঝির ফসল। সামাজিক ক্ষেত্রে ফকীহ ও মুহাদ্দিসদের ভেদনীতি একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার। তারা সাধারণত স্বধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্যদের সাথে তেমন একটা মেলামেশা করতেন না। ভিন্ন ধারা ও বিচিত্র মতবাদীদের সাথে সম্পর্ককে তারা খুব একটা ভালো নজরে দেখতেন না। তারা নিজেদের কাজের মগ্নতায় এই অবকাশও পেতেন না আসলে। তাদের চারপাশে থাকতেন শাগরেদরা। মানার জায়গা থেকে তারা প্রশ্ন করতেন। বিশ্বাসের জায়গা থেকে প্রশ্ন করতেন। তারা জবাব দিতেন এবং বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়া শ্রোতারা ছিলেন চারধারে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক ও মুতাকাল্লিমরা সব শ্রেণির সাথে মিশতেন। তাদের প্রশ্ন ও আপত্তি কী, শুনতেন ও জানতেন। তারা সাধারণত না মানা ও অবিশ্বাসের জায়গা থেকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতেন। প্রত্যাখানকারীদের আপত্তি ও বয়ানের জবাবে তারা কথা বলতেন। ফলে উভয় শ্রেণির ভাষা, উপস্থাপন, প্রমাণপদ্ধতি ইত্যাদি আলাদা হতে বাধ্য ছিলো।

একজন মুহাদ্দিস ভক্তকে যখন বলছেন আল্লাহ কেমন, তা আমরা জানি না এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদয়াত, তখন ভক্ত থেমে যাচ্ছেন।

কিন্তু মুতাকাল্লিম যে শ্রেণির সাথে কথা বলেন, তারা এমনটি শুনে থেমে যাবেন না। বরং আরো একগুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

ফলে তাকে নানা মাত্রায় আলোচনা করতে হচ্ছে। এমনকি রিওয়ায়েত দিয়েও আলোচনা করলে চলছে না। কারণ, তার শ্রোতা রেওয়ায়েতকেই মানতেছে না হয়তো।

ফলত তার আলোচনা প্রথাগত আলেমদের থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং প্রায়ই ভুল বুঝার সম্মুখিন হয়।

ইমাম শাহরাস্তানি দেখিয়েছেন, চারটি মৌলিক কারণ আছে, যা বিভিন্ন চিন্তাঘরাণা তৈরী করেছে। এগুলো হচ্ছে, আল্লাহর গুণাবলী আছে কি না? থাকলে আল্লাহর সত্তার সাথে এর সম্পর্ক কী? জবর ও কদর তথা মানুষ সক্ষম না অক্ষম? ঈমান ও আমলের মাঝে সম্পর্ক কী ও কেমন? যুক্তি ও ঐশীবাণীর সম্পর্ক কী ও কেমন?

এই সব বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বয়ান এসেছে এবং ফেরকা তৈরী হয়েছে মূলত। মুজাসসামিয়্যা, মুশাব্বিহা, মুতাজিলা, জাবরিয়া, কাদরিয়া, খারেজি, মুরজিয়া ইত্যাদি নানা ফেরকা এইসব প্রশ্নে জন্ম নিয়েছে। এরা মূলত ছিলো ভ্রান্ত এবং এদের বেশির ভাগের বাণীভাষ্য নির্মাতা ছিলো যুক্তিবাদী ও মুতাকাল্লিম নানা গোষ্ঠী। ফলে মুহাদ্দিস এবং ফুকাহা সাধারণ অর্থে মুতাকাল্লিমদের সমালোচনা করলে এই জাতীয় নানা শ্রেণির লোকেরাই হতো তাদের লক্ষ্যকেন্দ্র। বিশেষত মুতাজিলাদের কথা তো বলতেই হবে।

আরেকটা শ্রেণি আছেন। যারা কালাম ও দর্শনকে রাখে সবকিছুর কেন্দ্রে। তারা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন।

মনে রাখতে হবে, কালাম ও দর্শনকে লক্ষ্য বানানো ইসলামের জায়গা থেকে বিপজ্জনক। এ এক হাতিয়ার। এ এক অবলম্বন। উপায়। যেমন কুরআন-হাদীস বুঝার জন্য আরবী ভাষাতত্ত্ব একটি উপায়। শব্দ ও বাক্যতত্ত্ব একটি উপায়। খাবারের জন্য চাল পাকাতে হয়। ভাত বানাবেন। গ্যাসের চুলায় আগুন জ্বালানো একটি উপায়।

যারা একে মাকসাদ বানিয়ে ফেলেন, জীবনকে এর পেছনে উজাড় করে দেন, তাদের দৃষ্ঠান্ত সেই লোকের সাথে, যে পুরো জীবন কাটিয়ে দিলো হাতিয়ার মেরামতে। কিন্তু যে জন্য হাতিয়ার বানানো হলো, সে কাজটি করলো না। এ ইলিম জীবনের আসল মাকসাদ নয়। একে আসল মাকসাদ বানালে ইসলামের জ্ঞানদৃষ্টি এর সমালোচনা করবেই। এ হচ্ছে মাকসাদ হাসিলের সহযোগী। ফলত দীনিয়্যাতের তুলনায় যখন এর চর্চা বেশি হতে থাকে, তখন তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কাজী একরামঃ তাহলো ইলমে কালামের একদিকে নিন্দা, আরেক দিকে এর চর্চাও হয়েছে। উভয়টার সমন্বয় কোথায়?

মুসা আল হাফিজঃ দেখুন, ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টিভঙ্গির। একে আপনি কীভাবে নিচ্ছেন, এর উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। আমি অনেককেই দর্শনে উদ্বুদ্ধ করেছি। বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে যে, এক পর্যায়ে সে দর্শনের এটা সেটা দিয়ে দ্বীনকে বিচার করতে থাকে। যে পোকা তার মাথায় ঢুকে, সেটাই সারাক্ষণ ভনভন আওয়াজ করতে থাকে। দর্শনের পরিভাষা ও আদলে বলতে না পারা কিংবা না বলাকে সে মনে করে অজ্ঞতা। দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তার মনে বসবাস করে। ওরাই তার চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ। এ এক মন্দ ও আত্মঘাতী দিক। এমন সব প্রশ্ন সে করে, মনে হয় দ্বীন থেকে তাহলে কী শিখলো? মনে হয় দ্বীনী ইলম সে ভুলে গেছে একদম।

দেখলাম, গভীর ও ভারসাম্যপূর্ণ দ্বীনী জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে দর্শনের দ্বারা যে কেউ প্রতারিত হতে পারে। এমনকি সে প্রথাগত আলিম হলেও। প্রাচীন ফালসাফায় এমন বিভ্রান্তির উপাদান কম বলা যায়, আধুনিক ফালসাফার তুলনায়। আধুনিক ফালসাফা এ পথে খুবই ধ্বংসাত্মক। কিন্তু প্রাচীন ফালসাফা কীভাবে বিভ্রান্ত করতো, এর একটা নজির লক্ষ্য করা যেতে পারে। একবার গাঙ্গুহী রহ. এর কাছে এসেছে এক ছাত্র। ফালসাফায় বেশ পারদর্শী ছিলো। একদিন সবকে আসলো এক হাদীস। “লা-ইয়াকবালুল্লাহু সালাতান বিগাইরি তুহুরিন”। পবিত্রতা ছাড়া আল্লাহর কাছে নামাজ হয় না। গাঙ্গুহী বললেন, এই হাদীস প্রমাণ করে, ওযু ছাড়া নামাজ হয় না। ছাত্রটি বললো, এখানে ইয়াকবালুল্লাহু বলা হয়েছে। এর মানে তো এটাই যে, আল্লাহর কাছে নামাজ কবুল হবে না। কবুল হওয়া আর আদায় হওয়া দুই জিনিশ। আমাদের নামাজ আদায় হয়, কিন্তু আল্লাহর কাছে কবুল হতে পারে, নাও হতে পারে। ফলত ওযু ছাড়া তার নামাজ আদায় হবে, কিন্তু আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। ফলে কেউ যদি ওযু ছাড়া নামাজ পড়ে নেয়, পরে ওযু করে নেয়, আশা করা যায় নামাজ কবুলও হয়ে যাবে! তার কথা শুনে সকলেই হাসলো।

এটা তখনই হয়, যখন ফালসাফায় আসক্তি ভারসাম্য হারায়। এমনটি হয়েছিলো দেওবন্দে। একবার দারুল উলূম দেওবন্দে মান্তিক-ফালসাফার কিতাবকে নেসাব থেকে খারিজ করে দিলেন হযরত গাঙ্গুহী রহ.। এক ছাত্র ইয়াকুব নানুতুবী রহ. এর কাছে গেলো। তার অভিযোগ, মানতেক-ফালসাফাকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা হলো? তিনি বললেন, নিষিদ্ধ তো গাঙ্গোহী সাহেব করেননি, করেছো তোমরা। তোমাদের আসক্তির ভারসাম্যহীনতা একে নিষিদ্ধ করেছে। তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বক্র হয়ে যাচ্ছে, বোধশক্তি পথ হারাচ্ছে। ফলে এ নিষিদ্ধকরণ।

এ যদি না হতো, তাহলে আমরা বোখারি পড়িয়ে যে সওয়াব আশা করি, ফালসাফা পড়িয়েও সেই সওয়াব আশা করি।

আকিদা ও ইলমে কালামের অন্যতম ইমাম আবুল হাসান আল-আশআরী রহ. এর আচার ভারসাম্যের এক দৃষ্টান্ত হতে পারে। রাজদরবারে একদা সবশ্রেণির আলেম ছিলেন। ফকীহ, মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক, কালামবীদ, ভাষাতাত্ত্বিক, মুতাজেলা, নাস্তিক, অমুসলিম পণ্ডিত … সব। আশআরী রহ. মজলিসে গেলেন। উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন শুরু করলো আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলী নিয়ে বিতর্ক। আলেমরা অংশ নিলেন। প্রমাণাদি পেশ করলেন। মু’তাজেলিরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের অনুসারিদের উপর নানা আপত্তি উত্থাপন করে চললো। মুহাদ্দিস-ফুকাহা-মুতাকাল্লিমরা করে চলছিলেন খণ্ডন। বাদ-প্রতিবাদ চলছিলো অব্যাহতভাবে। আশ’আরী তো চুপচাপ বসে আছেন। সকলের আলোচনা যখন শেষ হলো, তিনি দাঁড়ালেন। মু‘তাজেলাদের অভিযোগ সমূহ এক এক করে খণ্ডন করলেন। ফালাসিফার ভুল সমূহ ধরিয়ে দিলেন। জবাব সমূহ এমনভাবে দিলেন, কারোরই আর বলার থাকলো না কিছুই।

একজন মজলিস শেষে প্রশ্ন করলেন, আগেই যদি আপনি এসব জবাব দিয়ে দিতেন, এতো বিবাদ-বিসম্বাদ হতো না। ভিন্নমতীরা এতো বড় বড় কথা বলার সুযোগ পেতো না।

জবাবে আশ’আরী যা বললেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বললেন, এসব ব্যাপারে নিজের তরফে আলোচনা আনা বিদ’আত। এ জন্যই মজলিসের শুরুতে এ বিষয়ে আলোচনা বৈধ মনে করিনি। পরে যখন দেখলাম, বিভ্রান্তির ভাষ্যকাররা দার্শনিক বয়ানের মাধ্যমে একের পর এক ভ্রান্ত দাবি হাজির করছে ও আক্রমণ করছে, তখন এগুলো খণ্ডন করা আমার উপর ফরজ হয়ে গেলো। তখন সেই দার্শনিক ব্যাপারাদি এনে বাধ্য হয়ে আলোচনা করতে হলো।

লেখক পরিচিতিঃ
লেখক
কবি
ইসলামী চিন্তাবিদ
দার্শনিক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *