The Reconstruction of Religious Thought in Islam- Muhammad Iqbal(আল হিকমা)

তবে এ কথা ভুললে চলবে না যে আমরা উপলব্ধি করে থাকি-কালের এমন কতকগুলো গুণকে এই মতবাদ উপেক্ষা করে। প্রকৃতির যেসব রূপ গাণিতিকতভাবে বিচার করা চলে, শুধু সেসব রূপের ধারাবাহিক বিবরণ দানের জন্য আপেক্ষিকতাবাদ কালের কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে বটে, কিন্তু তাতে এ কথা বলা সম্ভব নয় যে সেসব বৈশিষ্ট্যের অতিরিক্ত আর কোনো বৈশিষ্ট্য কালের নেই। তা ছাড়া আইনস্টাইন বর্ণিত কালের প্রকৃত স্বরূপ যে কী, তা আমাদের মত অবিশেষজ্ঞের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে আইনস্টাইনের কাল বার্গসের নিছক অবস্থানের মেয়াদমাত্র নয়। আমরা এ কালকে ক্রমিক বা ধারাবাহিক সময় বলেও গণ্য করতে পারি না। কান্ট কার্যকারণ সম্বন্ধের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তাতে ক্রমিক কালই হচ্ছে কার্য-কারণ সম্বন্ধের মূল বস্তু কারণ এবং কার্যের পারস্পরিক সম্পর্কটা এমন যে কালানুসারে কারণটা তার কার্যের পূর্বে থাকবে এবং সেহেতু কারণ না থাকলে তার কার্য ও সম্ভব হবে না। গাণিতিক কালকে যদি ধারাবাহিক সময় বলে ধরা হয়, তাহলে এই মতবাদের ভিত্তিতেই কার্যকে তার কারণের পূর্বগামী বলে প্রমাণ করা সম্ভব। এর জন্য শুধু প্রয়োজন দ্রষ্টার গতিবেগ আর যে পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট কতকগুলো ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, তার বেগ—এই দুই বেগের সতর্ক নির্বাচন। আমার মনে হয়, কালকে স্থানের মত মাত্রা বলে গণ্য করলে তা সত্যিই আর কাল থাকে না। আধুনিক রুশ লেখক আউসপেনস্কি তার টারশিয়াম অর্গানাসনামক গ্রন্থে স্থানের চতুর্থ মাত্রা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, একটা ত্রিমাত্রিক চিত্রের যে দিকটা তার নিজের মধ্যে নেই, সেদিকে তার যে গতি, সেটাই হচ্ছে চতুর্থ মাত্রা। বিন্দু, রেখা এবং তলের যে দিকটা তাদের নিজেদের মধ্যে নেই, সেই দিকে তাদের গতির দ্বারা যেমন আমরা সাধারণ তিনটি মাত্রার ধারণা পেয়ে থাকি, ঠিক তেমনি ত্রিমাত্রিক চিত্রের যে দিকটা নিজের মধ্যে নিহিত নেই, সেই দিকে তার চলাচল দেখে কার্যের আমরা স্থানের চতুর্থ মাত্রার ধারণা অবশ্যই পাব।

আর যেহেতু কালটা হচ্ছে সেই দূরত্ব, যা ঘটনাসমূহকে পর্যায়ক্রমিকভাবে পৃথক করে এবং বিভিন্ন স্বতন্ত্র সত্তারূপে তাদের গেঁথে রাখছে, সেহেতু স্পষ্টত কাল এমন একটা দূরত্ব, যা ত্রিমাত্রিক স্থানের মধ্যে নেই এমন একটা দিকে অবস্থিত। নতুন মাত্রা হিসেবে, পর্যায়ক্রমিকভাবে ঘটনাসমূহকে পৃথককারী এই দূরত্ব ত্রিমাত্রিক স্থানের মাত্রাগুলোর সঙ্গে খাপ খায় না, যেমন, একটি বছর খাপ খায় না সেন্ট পিটার্সবার্গের সঙ্গে। ত্রিমাত্রিক স্থানের সব কটি দিকের বেলায়ই কাল লম্বস্বরূপ আর তাদের কোনোটার সঙ্গে কাল সমান্তরাল নয়। আউসপেন্স্কি এই একই গ্রন্থের অন্যত্র আমাদের কাল-জ্ঞানকে বর্ণনা করেছেন একটা অস্পষ্ট স্থান-জ্ঞান বলে। আর আমাদের মানসিক গঠনের ওপর ভিত্তি করে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, এক, দুই বা তিন মাত্রাবিশিষ্ট সত্তাসমূহের কাছে উচ্চতর মাত্রাটা সব সময় কালভত্তিক পর্যায় বলে প্রতিভাত হবেই। তাহলে স্পষ্টতই এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে ত্রিমাত্রিক জীব হিসেবে আমাদের কাছে যা কাল বলে প্রতিভাত হয়, আসলে তা অসম্পূর্ণরূপে উপলব্ধ একটা স্থানঘটিত মাত্রা মাত্র; নিজস্ব স্বভাবের দিক দিয়ে এই স্থানঘটিত মাত্রা পূর্ণরূপে উপলব্ধ ইউক্লিডীয় স্থানের মাত্রাগুলো থেকে স্বতন্ত্র নয়। অন্য কথায়, কাল কোনো সত্যিকারের সৃজনশীল গতি নয়; আর আমরা যেগুলোকে ভবিষৎ ঘটনা বলি, তা নতুন সংঘটিত ব্যাপার নয়। এগুলো হচ্ছে এমন কতগুলো জিনিস, যা পূর্ব থেকেই প্রদত্ত এবং এক অজ্ঞাত স্থানে অবস্থিত রয়েছে। অথচ ইউক্লিড আবিষ্কৃত তিনটি মাত্রার অতিরিক্ত একটি নতুন মাত্রার সন্ধানের জন্য আউসপেনস্কির প্রয়োজন একটা সত্যিকারের ক্রমিক সময়ের, অর্থাৎ দূরত্বের,যা ঘটনাসমূহকে রাখছে পর্যায়ক্রমে পৃথক করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে আউসপেনস্কির যুক্তির একটি স্তরের উদ্দেশ্য অনুসারে যে কালকে প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছিল এবং ফলে দেখা হয়েছিল একটা ক্রমিক ধারারূপে, যুক্তির পরবর্তী এক স্তরে সেই কালকেই তার ধারাবাহিকতার বৈশিষ্ট্য থেকে বিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাকে পরিণত করা হয়েছে এমন একটা জিনিসে, যা স্থানের অন্যান্য রেখা ও মাত্রা থেকে কোনো বিষয়েই স্বতন্ত্র নয়। কালের ক্রমান্বিত স্বরূপের দরুনইআউসপেন্স্কি কালকে স্থানে অবস্থিত একটি সত্যিকারের নতুন দিক বলে গণ্য করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য যদি বাস্তবিকই একটি ভ্রান্তি মাত্র হয়, তাহলে এর দ্বারা কী করে আউসপেনস্কির একটি মৌলিক মাত্রার প্রয়োজন মিটতে পারে?

এবার অভিজ্ঞতার অন্যান্য স্তর, অর্থাৎ জীবন ও চেতনা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। চেতনাকে জীবনের একটি বিক্ষেপ হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে । জীবনের অগ্রগতির পথ আলোকিত করার জন্য চেতনা একটি ভাস্বর বিন্দুরূপে কাজ করে থাকে। এটা একটা মানসিক বিক্ষেপের ব্যাপার, একটা আত্মসংহতির অবস্থা । এর দ্বারাই জীবন সেসব স্মৃতি ও সংযোগের দ্বার রুদ্ধ করে বসে উপস্থিত কার্যের সঙ্গে যাদের কোনো সম্বন্ধ নেই। চেতনার সুনির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই; সাময়িক প্রয়োজন অনুসারে চেতনা সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে থাকে। চেতনাকে পদার্থের ক্রিয়া-ক্ৰমের একটি গৌণ লক্ষণ বলে বর্ণনা করার অর্থ হচ্ছে একটা স্বাধীন ক্রিয়াশীলতা হিসেবে একে অস্বীকার করা। আর স্বাধীন ক্রিয়াশীলতা হিসেবে একে অস্বীকার করলে জ্ঞানের বৈধতাকেই করা হয় অস্বীকার। কারণ জ্ঞানমাত্রই চেতনার একটি সুসংবদ্ধ প্রকাশ । আসলে জ্ঞান হচ্ছে জীবনের একপ্রকার নিছক আধ্যাত্মিক নীতি, এক সুনির্দিষ্ট জীবনপদ্ধতি। বাইরে থেকে পরিচালিত মন্ত্রের ক্রিয়া-পদ্ধতির সঙ্গে রয়েছে এর মৌলিক পার্থক্য। খাঁটি আধ্যাত্মিক শক্তি অভিব্যক্ত হয় বোধগম্য উপাদানসমূহের এক সুনির্দিষ্ট সমাহারের মাধ্যমে । কাজেই এই বোধগম্য উপাদানসমূহের একটা নিশ্চিত সংযোজনার পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া আমরা খাঁটি আধ্যাত্মিক শক্তির ধারণা করতে পারি না। ফলে আমরা এই উপাদান সমাহারকে আধ্যাত্মিক শক্তির চরম ভিত্তি বলে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত । পদার্থের ক্ষেত্রে নিউটনের আবিষ্কার আর প্রাকৃতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে ডারউইনের আবিষ্কার- উভয় আবিষ্কারে শুধু একটা যান্ত্রিকতার পরিচয় মেলে। একদিন সব সমস্যাকেই পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা বলে বিশ্বাস করা হতো। বলা হতো, শাক্ত পরমাণুগুলোর আপনা-আপনি বেঁচে থাকার গুণসমূহের সহায়তায় জীবন,চিন্তা,ইচ্ছা, অনুভূতিসহ সকল বস্তুর ব্যাখ্যা হতে পারে । যান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারণা হচ্ছে নিছক একটা বাহ্যপ্রকৃতির ধারণা।

এই ধারণায় প্রকৃতির সর্বাঙ্গীণ ব্যাখ্যা নিহিত আছে বলে দাবি করা হতো। জীববিজ্ঞানের রাজ্যে যান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে এবং বিপক্ষে একটা তুমুল লড়াই এখনো চলছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইন্দ্রিয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতার পথ বেয়ে আমরা পরম সত্তার যে ধারণায় উপনীত হই, তা সত্তার চরম স্বরূপ সম্বন্ধে ধর্ম যে ধারণা পোষণ করে তার কি বিপরীত? জড়বাদই কি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের শেষ পরিণতি? এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বিজ্ঞানের মতবাদসমূহ নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের উৎপাদক, কেননা, তারা প্রতিপাদিক এবং প্রাকৃতিক ঘটনাবলির পূর্বাভাস ও নিয়ন্ত্রণদাত্রী। তবে আমাদের এ কথা ভুললে চলবে না যে যাকে বিজ্ঞান বলা হয়, তা পরম সত্তার একমাত্র সুসংবদ্ধ অভিমত নয়। বিজ্ঞান হচ্ছে পরম সত্তার বিভিন্ন বিভাগ সম্বন্ধে খণ্ড-খও অভিমতের সংগ্রহমাত্র; তারা সমগ্র অভিজ্ঞতার বিভিন্ন টুকরো, তাদের একত্র করলে পরস্পরের সঙ্গে খাপ খায় বলে মনে হয় না। পদার্থকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে এবং মনকে নিয়ে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কারবার ।

কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি প্রশ্ন তুলবেন—জীবন ও মন পরস্পরের সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত, সেই মুহূর্তে আপনি দেখতে পাবেন যে বিভিন্ন রকমের যেসব বিজ্ঞান এই বিষয়গুলোর আলোচনা করে, তাদের স্বরূপ একান্তই বিভাগীয় এবং তারা এককভাবে আপনার প্রশ্নের একটা পূর্ণ জবাব দিতে অক্ষম। বস্তুত নানা ধরনের প্রকৃতি-বিজ্ঞান শকুনের মতো প্রকৃতির মৃতদেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং এর এক-এক টুকরা মাংস নিয়ে এক-একজন দূরে উড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে প্রকৃতি নিতান্তই একটা কৃত্রিম ব্যাপার। সঠিকতার খাতিরে বিজ্ঞানকে যে নির্বাচন পদ্ধতির সাহায্যে প্রকৃতির বিচার করতে হয়, তার ফলে এই কৃত্রিমতার সৃষ্টি। যে মুহূর্তে আপনি বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে গোটা মানবীয় অভিজ্ঞতার আওতায় ফেলবেন, সে মুহূর্তেই এর একটা ভিন্ন স্বরূপ প্রকাশ পেতে শুরু করবে। ধর্ম চায় সত্তার সমগ্রতা উপলব্ধি করতে এবং সে কারণে মানবীয় অভিজ্ঞতার যাবতীয় উপাত্তের (ডেটার) যেকোনোরকমের সমন্বয়ে ধর্ম একটা কেন্দ্রগত স্থান অধিকার করবেই। কাজেই ধর্মের পক্ষে সত্তার কোনো বিভাগীয় সন্দর্শনকেই ভয় করার কারণ নেই। প্রকৃতিবিজ্ঞান স্বভাবতই বিভাগীয়। এই প্রকৃতিবিজ্ঞান যদি তার নিজ প্রকৃতি ও কাজের সীমা মেনে চলে, তাহলে পরম সত্তার কোনো পূর্ণ ধারণা সম্বন্ধে সে বিজ্ঞান কোনো মতবাদের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। কাজেই জ্ঞান গঠনে আমরা যেসব ধারণার সাহায্য নিয়ে থাকি, তা স্বরূপের দিক দিয়ে বিভাগীয় এবং অভিজ্ঞতার যে স্তরে তাদের প্রয়োগ করা হয়, সেই স্তরের সঙ্গে তাদের প্রয়োগটা আপেক্ষিক। যেমন ‘কারণ সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা, তার একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, কারণ কাজের আগে ঘটবে। কারণ-সম্বন্ধীয় এই ধারণাটা প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে আপেক্ষিক।

কারণ, অপরাপর বিজ্ঞান যেসব ক্রিয়াকলাপের বিচার করে থাকে, সেসবের বাইরে কোনো এক বিশেষ রকমের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানের গবেষণা।আমরা যখন জীবন এবং মনের স্তরে উঠে আসি, তখন কারণের ধারণা দিয়ে আমাদের আর কাজ চলে না। আমাদের তখন প্রয়োজন একটা ভিন্নজাতীয় চিন্তার ধারণা। একটা উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে প্রাণবান জীবসমূহ কর্মে প্রবৃত্ত হয় ও তার পরিকল্পনা করে। এই প্রাণবান জীবসমূহের কার্যকারণগত কার্য থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কাজেই আমাদের অনুসন্ধান করে এমন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ধারণা বের করা দরকার, যা ভেতর থেকে ক্রিয়াশীল ‘কারণ’-এর সে ধারণার মতো নয়, যে ধারণামতে কারণ কাজের বাইরের জিনিস এবং বাইরে থেকে ক্রিয়াশীল । এ বিষয়ে অবশ্য সন্দেহ নেই যে একটা প্রাণবান জীবের ক্রিয়াকলাপের এমন কতকগু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা প্রকৃতির অন্যান্য বস্তুর মধ্যেও দৃষ্ট হয় । এসব বৈশিষ্ট্যের পর্যবেক্ষণে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নশাস্ত্রের ধারণাসমূহের দরকার পড়বে। তবে জীবের যে ক্রিয়াকলাপ, তা মূলত একটা উত্তরাধিকারের ব্যাপার; আণবিক পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় সেসবের। পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা সম্ভব নয় । যাহোক, যান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারণা জীবনের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে; কিন্তু কত দূর সে প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে, তা আমাদের দেখতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমি নিজে জীববিজ্ঞানী নই; আলোচনার সুবিধার জন্য আমাকে স্বয়ং জীববিজ্ঞানীদেরই সাহায্য নিতে হবে । জে এস হ্যালডেন আমাদের বলেছেন, একটা প্রাণধারী জীব আর একটা যন্ত্রের মধ্যে পার্থক্যটা হচ্ছে এই যে প্রাণধারী জীব । আত্মপোষণ ও আত্মপ্রজননশীল, কিন্তু যন্ত্র সেরূপ নয়। এরপর তার যে বক্তব্য তা নিম্নে উদ্ধৃত হলো :

অতএব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে যদিও আমরা জীবদেহের ভেতরে এমন বহু লক্ষণ দেখতে পাই, যাদের সূক্ষ্মভাবে নিরীক্ষণ না করা পর্যন্ত প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক কলাকৌশল বলে সন্তোষজনকভাবেই ব্যাখ্যা করা চলে, কিন্তু এদেরই পাশাপাশি আর যেসব লক্ষণ (যথা : আত্মপোষণ ও প্রজনন) রয়েছে, তাদের বেলায় এরূপ ব্যাখ্যা সম্ভব বলে মনে হয় না। জড়বাদী ধারণা—দেহযন্ত্রগুলো এমনভাবে গঠন করা হয়েছে যে, তারা নিজেদের পোষণ, সংস্কার ও প্রজনন নিজেরাই করতে পারে। জড়বাদীরা বলতে চান যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সুদীর্ঘ ধারায়ই এ ধরনের যন্ত্রগুলোর ক্রমবিকাশ ঘটেছে। এই হাইপোথিসিস বা প্রকল্পটি পরীক্ষা করে দেখা যাক। আমরা যখন কোনো একটা ঘটনা জড়বাদীর ভাষায় বর্ণনা করি, তখন তা সেই ঘটনা সৃষ্টির সহায়ক পৃথক পৃথক কলকবজার কতগুলো সহজ গুণের ফল হিসেবেই করি। এই ঘটনার ব্যাখ্যা বা বর্ণনা বলতে এই বোঝায় যে উপযুক্ত সন্ধানের পর আমরা এই অনুমানে পৌঁছেছি যে ঘটনার উৎপাদনে পরস্পর ক্রিয়াশীল স্বতন্ত্র যন্ত্রপাতিগুলোর এমন কতকগুলো সহজ ও ‍সুনির্দিষ্ট গুণ আছে, যা সব সময়ই একই রূপ অবস্থায় একইভাবে কাজ করে। যান্ত্রিক ব্যাখ্যার জন্য প্রথমে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন অংশের অবতারণা করতে হবে। নির্দিষ্ট গুণাবলিসম্পন্ন বিভিন্ন অংশের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ না করলে যান্ত্রিক ব্যাখ্যার কোনো অর্থ হয় না।

আবার আত্মপ্রজনন ও আত্মপোষণশীল একটা যন্ত্রের অস্তিত্ব স্বীকার করার মানে হচ্ছে এমন একটা জিনিসকে স্বীকার করা, যাকে কোনো রকমেই ব্যাখ্যা করা চলে না। শারীর-বিজ্ঞানীরা কোনো কোনো সময় অর্থহীন পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন, কিন্তু সে পরিভাষায় ‘প্রজনন-যন্ত্র’ এই কথাটির মতো একান্ত অর্থহীন কথা আর একটিও নেই । প্রজননকারী মুল জীবের মধ্যে একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি থাকেও, তবু প্ৰজননক্রিয়ার মুলে তার কোনো সাক্ষাৎ আমরা পাইনি। প্রতিটি নতুন জীবনেই সেই যান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নতুন করে গড়ে উঠতে হয়, কেননা মূল জীবটি তার সন্তানের মধ্যে পুনর্জীবন লাভ করে তার দেহেরই এক একান্ত সূক্ষ্ম বিন্দু থেকে। বস্তুত প্রজননের কোনো যন্ত্র বা যান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকতে পারে না । নিয়ত নিজের দেহ সংরক্ষণ ও পুনর্গঠন করছে, এমন যন্ত্রের ধারণা স্ববিরোধী। যে যন্ত্রের বাচ্চাকাচ্চা হয়, সে যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ থাকতে পারে না। আবার এমন অংশ না থাকলে তা আর যন্ত্র থাকে না ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে জীবন একটা অনুপম ব্যাপার; জীবনের বিশ্লেষণের জন্য যন্ত্রের ধারণা যথেষ্ট নয়। ড্রিয়েস নামের অন্য একজন জীববিজ্ঞানী বাস্তব সমগ্রতা বলে যাকে অভিহিত করেছেন, তা হচ্ছে একরকমের ঐক্য। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই ঐক্যই আবার প্রতিভাত হয় বহুত্বের আকারে । নতুন অভ্যাস-সংস্কার গঠন করে হোক কিংবা পুরোনা অভ্যাস-সংস্কারে রদবদল করে হোক, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেড়ে ওঠার সকল উদ্দেশ্যমূলক প্রচেষ্টাতেই জীবনের একটা কর্মধারা রয়েছে; কিন্তু যন্ত্রের বেলায় এই কর্মধারার কথা চিন্তাই করা যায় না। আর কর্মধারা থাকার অর্থ হচ্ছে এই যে এক দূর অতীতের পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া জীবনের ক্রিয়াকলাপের ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।

এই দূর অতীতের মূল খুঁজতে হবে একটা আধ্যাত্মিক সত্তার মধ্যে। যেকোনো স্থানিক অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণে এই আধ্যাত্মিক সত্তা প্রকাশিত হতে পারে, অবশ্য সে বিশ্লেষণ দ্বারা তার উদঘাটন সম্ভব নয়। কাজেই মনে হবে, জীবনটা ভিত্তিমূলক এবং সে ভিত্তি প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক কার্যক্রমের আগে অবস্থিত। কারণ, এই প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক কার্যক্রমের যে নির্দিষ্ট স্বভাব আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার বকাশ লাভ ঘটেছে দীর্ঘকালব্যাপী বিবর্তনের ফলে। জীবন সম্বন্ধে যদি যন্ত্রশিল্পীর ধারণাগুলো প্রয়োগ করা হয়, তাহলে এ ধারণাও অপরিহার্য হয়ে ওঠে যে বুদ্ধিবৃত্তিটাও বিবর্তনের সৃষ্টি। কিন্তু এর দ্বারা বিজ্ঞান এবং তার বাস্তবমুখী অনুসন্ধান-নীতির মধ্যেই বিরোধ বাধিয়ে তোলা হয়। এ বিষয়ে আমি উইলডন কার থেকে একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করব । তিনি এই বিরোধের কথা খুব জোরালোভাষায় বর্ণনা করেছেন :

বুদ্ধিবৃত্তির উদ্ভব যদি বিবর্তনের ফলেই হয়ে থাকে, তাহলে জীবনের প্রকৃতি ও মূল ভিত্তি সম্পর্কে গোটা যান্ত্রিক ধারণাই অযৌক্তিক হয়ে পড়ে এবং বিজ্ঞানের অনুসৃত নীতিও তখন স্পষ্টতই পাল্টে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। জীবনের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা কথাটা খোলাখুলি বর্ণনা করলেই তার মধ্যে তার স্ববিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বুদ্ধিবৃত্তিটা যদি জীবনেরই| ক্রমবিবর্তনের ফলে উদ্ভূত কোনো বস্তু হয়, তবে সে বুদ্ধিবৃত্তি নিরঙ্কুশ নয়, বরং যে বস্তু একে ক্রমবিকশিত করেছে, এ তারই কাজের ওপর নির্ভরশীল। অবস্থাটা যখন এই, তখন এরূপ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান কী করে । জ্ঞাতাকে বাদ দিয়ে কেবল জ্ঞাতকে নিরঙ্কুশ মনে করতে এবং তার ওপর মতবাদ গড়ে তুলতে পারে?

এবার আমি আর-এক পথে জীবন ও চিন্তার আদি মূলে পৌঁছার চেষ্টা করব এবং আমাদের অভিজ্ঞতা বিচারের ধারায় আপনাদের আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাব; এর দ্বারা জীবনের মৌলিক অবস্থার ওপর আরও খানিকটা আলোকপাত হবে এবং একটা আত্মিক ক্রিয়াশীলতা হিসেবে জীবনের স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের একটা উপলব্ধি হবে । আমরা এর আগেই দেখেছি, অধ্যাপক হোয়াইটহেড এ বিশ্বচরাচরকে বর্ণনা করেছেন স্থিতিশীল কোনো কিছু রূপে নয়, বরং নিরবচ্ছিন্ন সৃজন-প্রবাহের লক্ষণ-বিশিষ্ট ঘটনাবলির একটা বিন্যাসরূপে। কালের বুকে প্রকৃতির এই যে নিরন্তর অগ্রগমন—সম্ভবত এই গুণটিই হচ্ছে অভিজ্ঞতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। কোরআনও এই দিকটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। আশা করি, আমার আলোচনার শেষভাগে আমি এটা দেখতে পারব যে এই বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সত্তার চরম স্বরূপ বোঝার উৎকৃষ্ট উপায়। এ সম্পর্কে কোরআনের যেসব আয়াত রয়েছে, তার কয়েকটির (৩ : ১৯০, ২: ১৬৪ : ২৪ : ৪৪) প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আমি এর আগেই আকর্ষণ করেছি। বিষয়টির অত্যধিক গুরুত্ব বিবেচনায় আমি এখানে আরও কয়েকটি আয়াত সংযোজন করব :

নিশ্চয়ই, আল্লাহকে যারা ভয় করেন তাঁদের জন্য পরপর দিন-রাত্রির আগমনে এবং আকাশে ও পৃথিবীতে আল্লাহ যত কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে নিদর্শন রয়েছে । (১০ : ৬)।

আল্লাহ সম্বন্ধে যাঁরা চিন্তা করার বা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার ইচ্ছা করেন তাদের জন্যে তিনিই রাত্রি ও দিনকে পরস্পরের অনুসরণ করার বিধান দিয়েছেন । (২৫৫ : ৬৩)

তুমি কি দেখো না যে আল্লাহ দিনের উপর রাত্রির আগমন এবং রাত্রির উপর দিনের আগমন ঘটান; এবং তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে আইনের অধীন করেছেন, যে আইন অনুসারে তারা একটা নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলে? (৩১ : ২৯)

এটা তারই (কাজ) যে, রাত্রি দিনের উপর ফিরে আসে এবং দিন রাত্রির উপর ফিরে আসে। (৩৯: ৫)

এবং তারই ( কাজ )রাত্রি ও দিনের পরিবর্তন । (২৩ : ৮০)

আরও কতকগুলো আয়াত আছে, যেগুলো সময় সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের আপেক্ষিকতা নির্দেশ করে চেতনার অজ্ঞাত স্তরসমূহের সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করে। তবে আমি এখানে উল্লিখিত আয়াত কয়টিতে অভিজ্ঞতার যে দিকটার। আভাস দেওয়া হয়েছে, শুধু সেই পরিচিত অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিকটার আলোচনা করেই সন্তুষ্ট থাকব। আধুনিক চিন্তার ক্ষেত্রে যাঁরা নেতৃস্থানীয়, তাঁদের মধ্যে বার্গসই হচ্ছেন একমাত্র চিন্তানায়ক, যিনি সময়ের বক্ষে অবস্থিতির লক্ষণটি নিয়ে সূক্ষ্মভাবে আলোচনা করেছেন। প্রথমে আমি আপনাদের কাছে তার অবস্থিতি-সম্পৰ্কীয় ধারণা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করব। তার অস্তিত্বের সাময়িক রূপের একটা পূর্ণতর ধারণার যেসব তাৎপর্য, তা পূর্ণরূপে তুলে ধরার জন্য দেখাব যে তার বিশ্লেষণ পর্যাপ্ত নয়। অস্তিত্বের চরম স্বরূপ সম্বন্ধে কী সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে, এটাই হচ্ছে আমাদের সামনে তত্ত্ববাদী সমস্যা। বিশ্বচরাচর যে কালকে আশ্রয় করে অবস্থিত আছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবু বিশ্বটা যখন আমাদের বাইরে অবস্থিত, তখন এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হওয়ার আশঙ্কা আছে বৈকি। কতকগুলো বিশেষ রকমের অস্তিত্ব আছে যাদের সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাদের থেকে এ-ও আশ্বাস পাওয়া যায় যে অবস্থিতি-কালের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ আমরা পেতে পারি। সময়ের বুকে অবস্থিতির মানে ভালো করে বুঝতে হলে আমাদের ওই বিশেষ অস্তিত্বগুলোর পর্যালোচনা করতে হবে। যেসব বস্তু আমি সামনে দেখতে পাই, তাদের সম্বন্ধে আমার যে ধারণা, তা অগভীর ও বাহ্যিক; কিন্তু আমার নিজের সম্বন্ধে আমার ধারণাটা অভ্যন্তরীণ, ঘনিষ্ঠ ও সুগভীর তাহলে কথাটা দাঁড়াচ্ছে এই যে সচেতন অভিজ্ঞতাটা সেই বিশেষ অস্তিত্ব সত্তার (রিয়েলিটি) সঙ্গে হয় আমাদের নিরঙ্কুশ যোগাযোগ। এই বিশেষ অস্তিত্বটির বিশ্লেষণ করলেই অস্তিত্বের চরম অর্থ অনেকটা বিশদ হয়ে উঠতে পারে। আমার অজ্ঞান অভিজ্ঞতার ওপর যখন আমি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তখন আমি কী দেখতে পাই?

বার্গসের ভাষায় তখন আমি অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে চলি। আমি হয় গরম, না হয় ঠান্ডা বোধ করি। হয় আমি আনন্দিত, না হয় দুঃখিত হই।’ আমি কাজ করি কিংবা কিছুই করি না। আমার চারদিকে যা আছে তা তাকিয়ে দেখি অথবা আমি অন্য কিছু চিন্তা করি । অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা, ভাব-এই যেসব পরিবর্তন, এ মধ্যেই আমার অস্তিত্ব বিভক্ত। পর্যায়ক্রমে এগুলোই আমার অস্তিত্বকে করে নানা রঙে রঞ্জিত। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমার অস্তিত্ব বিলোপ না করেই আমি পরিবর্তিত হচ্ছি। আমার অন্তর-জীবনে স্থিতিশীল কিছু নেই। সব মিলিয়ে একটা নিরন্তর গতি, একটা নিরবচ্ছিন্ন অবস্থা-প্রবাহ, একটা চিরন্তন ধারা। এর কোনো বিরাম নেই; বিশ্রামের ব্যবস্থা নেই। এই যে নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন, কালের সাহায্য ছাড়া তা অচিন্তনীয়। আমাদের ভেতরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপন করে আমরা বলি যে আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার মানে হচ্ছে কাল-আশ্রিত জীবন। আরও সূক্ষ্মভাবে সজ্ঞান অভিজ্ঞতার স্বরূপ অবলোকন করলে এটাই প্রতিভাত হয় যে খুদি তার অন্তর-জীবনে চলেছে কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে। বলতে গেলে, খুদির রয়েছে দুটো দিক। এই দিক দুটোকে অনুভাবক-দিক ও দক্ষ-দিক বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আমরা যাকে বলি স্থানিক জগৎ, দক্ষ-দিক দিয়ে খুদি তারই সঙ্গে গড়ে তোলে নিজের সম্পর্ক। দক্ষ খুদিই সম্বন্ধবাদী মনস্তত্ত্বের বিষয়বস্তু । দৈনন্দিন জীবনের কার্যকর খুদি বাইরের বস্তুবিধানের সঙ্গে কারবার করে । এই বাইরের বস্তুই আবার স্বল্পস্থায়ী চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের ওপর স্থানগত বৈশিষ্ট্যের ছাপ মেরে দেয়। খুদি যেন এখানে তার নিজের বাইরে বাস করে এবং একটা সমগ্রতারূপে নিজের ঐক্য বজায় রেখেই নিজেকে প্রকাশ করে এমন রূপে, যাকে কতকগুলো অবস্থার একটা ধারা ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। কাজেই যেকালে দক্ষ খুদির বাস, তা হচ্ছে সেই কাল যাকে আমরা দীর্ঘ ও স্বল্প বলে নির্ধারণ করে থাকি । স্থান থেকে এর পার্থক্য নির্ণয় সহজ নয়। একটা পথের বিভিন্ন মঞ্জিলের মতো বিভিন্ন স্থানিক বিন্দু দিয়ে তৈরি একটা সরলরেখারূপে আমরা এর কল্পনা করতে পারি । কিন্তু যে কালকে এরূপে গণ্য করা হয়, বার্গসের মতে তা সত্যিকারের সময় নয়। স্থানগত কালে যে অস্তিত্ব, তা ভূয়ো অস্তিত্ব। গভীরভাবে সজ্ঞান অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করলে খুদির সেই দিকটা প্রতিভাত হয়, যাকে আমি বলেছি অনুভাবক- দিক। আমাদের বর্তমান অবস্থার প্রয়োজনে আমরা বাহ্যিক বস্তুনিচয়ের মধ্যে এমনভাবে ডুবে আছি যে এই অনুভাবক খুদির রূপ দেখতে পাওয়া আমাদের খুবই কঠিন। আমরা বাহ্যিক বস্তুর পেছনে নিরবচ্ছিন্নভাবে ছুটে চলেছি। তাতে আমাদের অনুভাবক খুদিকে ঘিরে এমন পর্দার সৃষ্টি হয়েছে, যাতে অনুভাবক খুদিকে মনে হয় আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমরা যখন গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হই, তখন আমাদের দক্ষ খুদির কাজ বন্ধ থাকে; শুধু সেই সময় আমরা আমাদের সত্তার গভীরে প্রবেশ করে অভিজ্ঞতার গ্রহনকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারি।

এই গতীরতর খুদির জীবনধারায় চেতনার বিভিন্ন অবস্থা পরস্পরের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় । অনুভাবক খুদির ঐক্য সেই জীবাণুর মতো, যে জীবাণুর মধ্যে তার পূর্বপুরুষদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্তমান থাকে-বহুত্বের আকারে নয়, বরং একটা ঐক্য রূপে। এই ঐক্যের মধ্যেই প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতা সমগ্রকে পরিব্যাপ্ত করে থাকে। খুদির সমগ্রতায় বিভিন্ন অবস্থার কোনো সংখ্যাগত স্বাতন্ত্র্য নেই। খুদির উপাদানগুলোর বহুত্ব দক্ষ সত্তার উপাদানগুলোর মতো নয়। খুদির উপাদানগুলোর বহুত্ব সম্পূর্ণ গুণাত্মক। অনুভাবক খুদির মধ্যে পরিবর্তন আছে, গতি আছে; কিন্তু এই পরিবর্তন ও গতি অবিভাজ্য। তাদের উপাদানগুলো পরস্পর অনুপ্রবিষ্ট এবং তাদের স্বভাবে পরপর ক্রমের কোনো গুণ নেই। এতে প্রতীয়মান হয় যে অনুভাবক খুদির কালটা এক অখণ্ড এখন’। কিন্তু দক্ষ খুদি স্থানভূত জগতের সঙ্গে কারবার করতে গিয়ে এই একটা ‘এখন’কেই টুকরো টুকরো করে বহু ‘এখন’-এর একটি ক্রমধারায় পরিণত করে। সুতোয় যেমন মুক্তো মালাগুলো পরপর গাঁথা থাকে, এ-ও ঠিক তেমনি । অনুভাবক খুদির যে কাল, সে কালই হচ্ছে খাঁটি কাল, স্থানের সংস্পর্শে তা বিকৃত নয়। কোরআন তার স্বাভাবিক প্রাঞ্জল ভাষায় কালের এই ক্রমিক ও অ-ক্রমিক রূপের প্রতি ইঙ্গিত করেছে :

এবং তাঁরই উপর বিশ্বাস রাখো যিনি জীবিত থাকেন এবং মরেন না…এবং তাঁরই মহিমা কীর্তন করানো যিনি ছয় দিনে আকাশসমূহ ও পৃথিবী এবং তাদের মাঝখানে যা আছে তা সৃষ্টি করলেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন; (তিনি) করুণাময় আল্লাহ । (২৫ : ৫৮-৫৯)।

সকল জিনিসই আমি সৃষ্টি করেছি একটা নির্ধারিত লক্ষ্য দিয়ে; আমার হুকুম মাত্র একটাই ছিল, চোখের পলকের মতো দ্রুত। (৫৪: ৪৯-৫০)।

আমরা যদি সৃষ্টির মধ্যে রূপায়িত গতিটা বাইরে থেকে দেখি, অর্থাৎ আমরা যদি বুদ্ধিগতভাবে এই গতি উপলব্ধি করি, তাহলে এটাকে হাজার হাজার বছরব্যাপী-বর্তমান একটা ধারারূপে মনে হবে। ওল্ড টেস্টামেন্টের মতো কোরআনের পরিভাষায়ও একটা ঐশী দিবস হাজার বছরের সমান। অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হাজার হাজার বর্ষব্যাপী এই সৃষ্টিধারা প্রতিভাত হবে একটা একক, অবিভাজ্য কার্যরূপে, চোখের পলকের মতো দ্রুত। খাঁটি কালের যে ভেতরের অভিজ্ঞতা, তা কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেননা, আমাদের ভাষার যে রূপ তা গড়ে উঠেছে আমাদের প্রত্যহিক দক্ষ খুদির ক্রমিক কালের ওপর ভিত্তি করে। সম্ভবত একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।

প্ৰকৃতাবিজ্ঞানের মতে, আমাদের লাল রঙের যে অনুভূতি, তরঙ্গবেগের গতিই তার কারণ। তরঙ্গবেগের স্পন্দন হয় প্রতি সেকেন্ডে ৪০ লক্ষ কোটি বার । সেকেন্ডকে মনে করা হয় আলোর প্রত্যক্ষ গোচরতার সীমা বলে । এখন বাইরের থেকে যদি আপনি এই বিপুল স্পন্দনসংখ্যা লক্ষ করতে এবং প্রতি সেকেন্ডে দুহাজার স্পন্দন গণনা করতে পারেন, তাহলে এই গণনা শেষ করতে আপনার ৬,০০০ বছরের বেশি সময় লাগবে । বস্তুত তরঙ্গবোগের স্পন্দনসংখ্যা অগণনীয় । অথচ একটা ক্ষণিক মানসিক অনুভূতি ক্রিয়ার সাহায্যে তরঙ্গবোগের একটা স্পন্দনসংখ্যা আপনি অনুধাবন করতে পারেন। এভাবেই আমাদের মানসিক ক্রিয়া তরঙ্গবেগের স্পন্দন পর্যায়কে কালের মেয়াদে রূপায়িত করে । তাহলে অনুভাবক খুদি কমবেশি দক্ষ খুদিরই সংশোধক ।

কেননা, এখানটা-সেখানটা, এখন-তখন-স্থান-কালের এসব ছোট ছোট বৈচিত্র্য দক্ষ খুদির পক্ষে অপরিহার্য। অনুভাবক খুদি এসবের সমন্বয় বিধান করে ব্যক্তিত্বের একটা সুসংবদ্ধ সমগ্রতা গড়ে তোলে। আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার গভীরতর বিশ্লেষণে উদঘাটিত এই অবিকৃত খাটি কাল তাহলে পৃথক পৃথক মুহূর্তের ধারা নয়। এদের আগ-পর ক্রমও পরিবর্তন করা সম্ভব নয় । এ এমন একটা জৈবিক সমগ্র, যেখানে অতীত পেছনে পড়ে থাকে না, বরং বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলে এবং বর্তমানের মধ্যে বসে কাজ করে। আর ভবিষ্যৎটাও এতে এমনভাবে দেওয়া নেই যে তা অতিক্রমের প্রতীক্ষায় সম্মুখে পড়ে রয়েছে। কালের মধ্যে যে ভবিষ্যৎ আছে তার মানে এই যে কালের প্রকৃতির মধ্যে মুক্ত সম্ভাবনারূপে ভবিষ্যৎ নিহিত আছে। কালকে জৈবিক সমগ্র হিসেবে ধরে নিলে যা দাঁড়ায়, কোরআন তাকেই বর্ণনা করেছে তকদির’ বা ভাগ্য বলে । ইসলামি দুনিয়ার ভেতরে এবং বাইরে এই তকদির বা ভাগ্য শব্দের বহু ভুল অর্থ করা হয়েছে। তকদির’ হচ্ছে সেই কাল, যার সম্ভাবনাসমূহ এখনো প্রকাশিত হয়নি। এ কালকে কার্যকারণের ফলাফল থেকে মুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। এককথায়, এটা সত্তারূপী কাল—ভাবনা-চিন্তা করে পাওয়া কাল নয়।

আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন সম্রাট হুমায়ুন এবং পারস্যের শাহ আহমাস্পি সমসাময়িক ছিলেন কেন, তাহলে আমি তার কার্য-কারণগত কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারব না। সম্ভবত এর একটিমাত্র উত্তর এই দেওয়া যেতে পারে যে সত্তার প্রকৃতি অনুসারে তার হওয়ার’ অনন্ত সম্ভাবনার মধ্যেই ব্যবস্থা ছিল যে হুমায়ুনের জীবন ও শাহ আহমাস্পির জীবন নামে পরিচিত দুটি সম্ভাবনার একসঙ্গে রূপায়ণ ও উপলব্ধি ঘটবে। ভাগ্যরূপে বিবেচিত কালই হচ্ছে বস্তুসমূহের প্রাণবস্তু। কোরআন বলে, ‘আল্লাহ সকল বস্তু সৃষ্টি করলেন এবং প্রত্যেকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিলেন। কাজেই একটি বস্তুর ভাগ্য আদেশকারী মনিবের মতো বাইরে থেকে কার্যকর কোনো অনমনীয় নিয়তি নয়। এটা বস্তুর ভেতরকার প্রসারণের সীমা, তার রূপায়ণযোগ্য বিচিত্র সম্ভাবনা : এই সম্ভাবনাগুলো তার স্বভাবের গভীরেই নিহিত থাকে। বাইরের কোনো জবরদস্তির অনুভূতি ছাড়াই এগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হয়ে ওঠে। কালের জৈবিক সমগ্রতার অর্থ তাহলে এই নয় যে পূর্ণাঙ্গ ঘটনাগুলো সত্তার অভ্যন্তরে সজ্জিত রয়েছে এবং সময়ের পাত্র থেকে বালুকণার মতো একটি একটি করে ঝরে পড়ছে।

কালকে যদি আমরা পরস্পর সদৃশ কতকগুলো মুহূর্তের নিছক পুনরাবৃত্তি মনে। করি, তবে আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার বাস্তব কোনো দাম থাকে না; তা হয়ে পড়ে একটা বিভ্রান্তি। কিন্তু কাল যদি এই একই রূপ মুহূর্তরাশির কেবল পুনরাবৃত্তি না হয়ে সত্যিকার হয়, তাহলে পরম সত্তার জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত মৌলিক । এই মুহূর্ত থেকে সম্পূর্ণ অভিনব ও অদৃষ্টপর্ব জিনিস পয়দা হয় । কোরআন বলে, ‘প্রত্যেক দিন কোনো না কোনো নতুন কাজ তাকে (আল্লাহকে) ব্যাপৃত রাখে। প্রকৃত কালে অবস্থিত থাকার অর্থ ক্রমিক কালের নিগড়ে আবদ্ধ হওয়া নয়। প্রকৃত কালে অধিষ্ঠানের মানে মুহূর্তে মুহূর্তে একে সৃষ্টি করা এবং সৃষ্টির দিক দিয়ে একান্তরূপে স্বাধীন ও মৌলিক হওয়া । বস্তুত সকল সৃজনশীল কাজই বন্ধনহীন কাজ । যেটা সৃষ্টি তা পুনরাবৃত্তির বিরোধী : পুনরাবৃত্তিটা যান্ত্রিক কাজের বৈশিষ্ট্য। এ জন্যই যান্ত্রিকতাবাদের পরিভাষায় জীবনের সৃজনমূলক কাজের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞান চায় অভিজ্ঞতার সমরূপতা, অর্থাৎ যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির নিয়ম দাঁড় করাতে । জীবন তার আপনা-আপনি ফুটে ওঠার সুতীব্র অনুভূতির ফলে একটা অনিবার্যতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় । এইরূপে ‘হতে হবে’ এমন প্রয়োজনের সীমার বাইরে জীবন পড়ে যায় ।

কাজেই বিজ্ঞান জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করতে অপারগ। জীববিজ্ঞানী যে জীবনের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিতে যায়, তার কারণ এই যে যেসব জীবনের চালচরিতে যান্ত্রিক কাজের সাদৃশ্য প্রকাশ পায়, শুধু সেসব নিম্নস্তরের জীবনে তাঁর পর্যবেক্ষণ সামাবদ্ধ। জীববিজ্ঞানী যদি তার নিজের মধ্যে বিকশিত জীবনের রূপ প্রত্যক্ষ করেন, অথাৎ তার নিজের মন—যে মন নিরন্তর মুক্তভাবে বাছাই করছে, চিন্তা করছে, অতীত ও বর্তমান প্রদক্ষিণ করছে এবং এত শক্তির সঙ্গে ভবিষ্যতের কল্পনা করছে, সেই মনের মধ্যে পরিস্ফুট জীবনের হদিস যদি তিনি অন্বেষণ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি তার যান্ত্রিক ধারণাগুলোর অপর্যাপ্ততা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারবেন।

আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার যুক্তিগত বিশ্লেষণ থেকে তাহলে প্রতিভাত হচ্ছে যে এই বিশ্বচরাচর একটা স্বাধীন সৃজনশীল গতি। কিন্তু যা চলছে এমন একটা বাস্তব বস্তুর নির্ভর ছাড়া গতির ধারণা আমরা কী করে করতে পারি? এর জবাব হচ্ছে, বস্তুর যে ধারণা তা ব্যুৎপত্তিমূলক। গতি থেকে আমরা বস্তু পেতে পারি, কিন্তু অনড় বস্তু থেকে গতি লাভ করতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি ডেমোক্রিটাসের পরমাণুর মতো পদার্থগত পরমাণুসমূহকে মূল সত্তা বলে ধরে নিই,তাহলে তাদের মধ্যে বাইরে থেকে গতির আমদানি করতে হবে; ধরে নিতে হবে, – এ গতি পরমাণুসমূহের ভেতরের জিনিস নয়, তার স্বভাবের বাইরের জিনিস। আর যদি আমরা গতিকে মোলিক বলে গ্রহণ করি, তাহলে এর থেকে স্থিতিশীল বস্তু পাওয়া যেতে পারে। বস্তুত প্রকৃতিবিজ্ঞান সকল বস্তুকেই গতিতে পর্যবসিত করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, পরমাণুর মূল প্রকৃতি হচ্ছে বিদ্যুৎ—বিদ্যুতায়িত কোনো কিছু নয় । এ ছাড়া আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যে বস্তুকে পাই, তা এমন কোনো বস্তু নয়, আগে থেকেই যার নির্দিষ্ট বাহ্যিক রূপ কাঠামো রয়েছে। কারণ আশু অভিজ্ঞতা হচ্ছে একটা ধারাবাহিক অবস্থা, তাতে কোনো চিহ্নভেদ নেই। আমরা যাকে বস্তু বলি, প্রকৃতির নিরবচ্ছিন্ন ধারায় তা হচ্ছে এক একটি ঘটনা। ঘটনাগুলোকেই আমাদের চিন্তা স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে এবং ব্যবহারিক কাজের সুবিধার জন্য পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে । যে বিশ্বচরাচরকে আমাদের কাছে মনে হয় বস্তুরাশির সমাহার বলে, তা শূন্যে অবস্থিত একটা নিরেট পদার্থ নয়। এটা কোনো বস্তু নয়; বরং একটি ক্রিয়া । বার্গসের মতে চিন্তার প্রকৃতি হচ্ছে ক্রমিক : স্থিতিশীল বিন্দুরাশির একটা ধারারূপে দেখা ছাড়া আর কোনোভাবে গতি নিয়ে কারবার করতে চিন্তা অপারগ। বস্তুত স্থিতিশীল বস্তুর ধারণাকে সম্বল করেই চিন্তার অগ্রগতি। ফলে স্বভাবের দিক দিয়ে যা মূলত গতিমান, তাকে অনড় বস্তু ধারার রূপ দেওয়া এই চিন্তারই কাজ। আমরা যাকে স্থান এবং কাল বলি, এই অনড় বস্তুনিচয়ের সহ-অবস্থিতি এবং ক্রমানুবর্তিতাই তার উৎস।

মুহাম্মদ ইকবাল
ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনে ইসলাম
তরজমা: মোহাম্মদ মোকসেদ আলী এম এ

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *