One of the pioneers of the Muslim Awakening in Bengal: Jamaluddin Afghani

বাংলার মুসলিম জাগরণ ও আফগানী

বিপুল মুসলিম জন-অধ্যুষিত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ১৭৫৭ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদানত হয়। এর পর থেকে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকা ক্রমশ ইংরেজরা গ্রাস করেছিল। তার মুকাবিলায় মীর কাসেম ও টিপু সুলতানসহ কয়েকজন আঞ্চলিক শাসকের নেতৃত্বে প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালিত হয়। এসব আঞ্চলিক প্রতিরোধকে সমর্থনদানের মতো কোন কেন্দ্রীয় শক্তি বা নেতৃত্ব তখন দিল্লীতে বা মুসলিম বিশ্বে ছিল না। ফলে এসব প্রতিরোধ ক্ষণস্থায়ী হয়।

জনবিদ্রোহ ও প্রতিরোধ সংগ্রাম

এ সময় জনতার কাতার থেকে উত্থিত হচ্ছিল একের পর এক বিদ্রোহ। বাংলা-বিহার অঞ্চলে ফকীর মজনু শাহ থেকে শুরু করে অনেক আঞ্চলিক মুসলিম নেতা পরিচালনা করেন জন-বিদ্রোহ। ১৭৬৩ সাল থেকে এ আন্দোলন শুরু হয় । এ গণসংগ্রাম চলাকালেই শাহ ওয়ালিউল্লাহর (১৭০৩-১৭৬১) উত্তরসুরী শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (১৭৪৬-১৮২৩) ইংরেজ কবলিত হিন্দুস্তানকে ১৮০৩ সালে ‘দারুল হারব’ বা ‘যুদ্ধ কবলিত এলাকা’ ঘোষণা করেন।

তাঁর এ ঐতিহাসিক ফতোয়া ভারতবর্ষের মুসলমানদের ছোট-বড় আঞ্চলিক প্রতিরোধ সংগ্রামগুলিকে অভিন্ন আদর্শিক লক্ষ্যে সংহত ও সমন্বিত করতে শক্তি যোগায়। এ পটভূমিতে ১৮১৮ সালে হাজী শরীয়ত উল্লাহর (১৭৮১-১৮৩৯) নেতৃত্বে প্রধানত পূর্ববাঙলাভিত্তিক ফরায়েজী আন্দোলন এবং একই বছর সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর (১৭৮৬-১৮৩১) নেতৃতে দিল্লী থেকে জিহাদ আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৮২০-২১ সাল থেকে বাংলায় জিহাদ আন্দোলনের কাজ শুরু হয়।

এ আন্দোলনগুলি ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিরোধ ও মুক্তি সংগ্রামকে সুনির্দিষ্ট আদর্শিক লক্ষ্যে পরিচালিত করে। জিহাদ আন্দোলনে পূর্ববাঙলাসহ বাঙলার মুসলমানদের তাতপর্যপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল।

১৮৩১ সালের মে মাসে জিহাদ আন্দোলনের প্রধান নায়ক সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী শাহাদাত বরণ করেন। একই বছর এ আন্দোলনের আঞ্চলিক নেতা মওলানা সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) নারকেলবেড়িয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন। ১৮৩৯ সালে (আফগানীর জন্মের বছর) ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহ ইনতিকাল করেন। জিহাদ আন্দোলন ও ফরায়েজী আন্দোলনে এ সময় নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব হয়। এ নেতৃত্বের প্রেরণায় এবং এ আন্দোলনের কর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে ইংরেজবিরোধী সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয়। সিপাহী বিপ্লবের (১৮৫৭) ব্যর্থতার ফলে উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্য অস্তিত্ব হারায়।

বর্ণহিন্দু রেনেসাঁ

সিপাহী বিপ্লবোত্তর পটভূমিতে ইংরেজ ও বর্ণহিন্দুদের মিলিত শোষণ, লুণ্ঠন ও হামলার  শিকার বাঙলার মুসলমানগণ ছিলেন সবদিক থেকেই পর্যুদস্ত। ১৮১৭ সালে রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) কলকাতা আগমনের সময় থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যে কলকাতাকে ঘিরে ইংরেজ প্রসাদপুষ্ট লুটেরা নব্যধনিক গোষ্ঠীর মধ্যে উৎকট সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন নবজাগরণের জোয়ার সৃষ্টি হয়।

এ রেনেসাঁর চেতনায় মুসলমানদের কোন ঠাঁই ছিল না। ১৮১৮ সাল থেকে শুরু করে ওই সময় পর্যন্ত  প্রকাশিত হিন্দু মালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলি হিন্দুর্ধমের গৌরব প্রকাশ করতো। ১৮৬০-৭০ সালে ঢাকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ‘পূর্ববঙ্গের প্রবলশ্রেণী সংলগ্ন’ বুদ্ধিজীবীদের মাঝেও একই ধরনের সাম্প্রদায়িক জাগরণের ঢেউ লক্ষ্য করা যায়।

১৮১৮ থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ৭১ টি বাংলা সাময়িকপত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন রামমোহন রায় থেকে শিবনাথ শাস্ত্রী পর্যন্ত তৎকালীন বাঙলার বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীগণ। ধর্মীয় পরিচয়ে তাদের প্রায় সবাই ছিলেন বর্ণহিন্দু। তাদের হাতে গড়ে ওঠা সংবাদ-সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠাগুলি উনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু-বাঙলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণকে ধারণ করেছে।

উনিশ শতকের সংবাদ সাময়িকীর পরিচয় উল্লেখ প্রসঙ্গে মুনতাসির মামুন লিখেছেন : ‘ঐতিহ্য আবিষ্কার করতে গিয়ে হিন্দুরা প্রাচীনকালের ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে তুলেছিলেন এবং ঔপনিবেশিক শাসনে যে তারাই প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন একথা বলতে তারা ভুলেননি। বিশেষ করে উনিশ শতকের শেষ তিন দশকের হিন্দু পরিচালিত পত্র-পত্রিকাগুলো, যেমন ‘ঢাকা প্রকাশ’, ‘হিন্দু রঞ্জিকা’ প্রভৃতিতে এ মনোভাবই ব্যক্ত হয়েছিল ঘুরেফিরে, আক্রমণাত্মক এবং উদ্ধতভাবে। মধ্যযুগে ভারতে আগত মুসলমানদের তারা চিহ্নিত করেছিলেন আক্রমণকারীরূপে। কিন্তু ইংরেজরাও যে আক্রমণকারী এবং শোষক ও লুটেরা সেসব কথা তারা ভুলে গিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র বা ভূদেব এদের সব রচনাতেই নিজেদের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করা হয়েছে।’ (মুনতাসির মামুনঃ উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িকপত্র, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৫)

মুসলিম জাগরণের পূর্বাভাস

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের অধিকারসহ সকল দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজ প্রতিবেশীদের সাংস্কৃতিক হামলার মুকাবিলা করার যোগ্যতা হারিয়েছিল। হারিয়েছিল হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের সচেতন প্রয়াসে জাগ্রত হবার সামর্থ্। 

এ অবস্থায় মুসলমান সমাজের শহুরে অভিজাত স্তর থেকে এ সময় একটি নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটলো। সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-৯৮), নওয়াব আবদুল লতীফ (১৮২৮-৯৩) ও সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) ছিলেন এ ধারার নায়ক। এ নবধারার আন্দোলনের সাথে পরোক্ষ সমন্বয় ঘটিয়ে ১৮৬৭ সালে মওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী (মৃত্যু ১৮৭৩) জিহাদ আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর (১৭৭৬-১৮৩১) বিপ্লবী ভাবধারা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ‘ভিতর থেকে সংস্কার’-এর নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেন। তার পরিচালিত তাইয়ুনী আন্দোলন ঐতিহাসিকদের কাছে ‘সনাতনী ধারা’ নামেও পরিচিত হয়েছে ।

মুহসিন ফান্ড পুনরুদ্ধার

হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের (১৭৩২-১৮১২) দান করা বিশাল তহবিল ইংরেজরা ১৮১৬ সালে আত্মসাৎ করেছিল। নওয়াব আবদুল লতীফের চেষ্টায় ১৮৭৩ সালের ২৯শে জুলাই থেকে তা পুনরায় মুসলমানদের শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হয়। ঢাকা, হুগলী ও চট্রগ্রামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা  থেকে বেরিয়ে আসা আলেমগণ এ সময় বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় মুসলিম গণ-জাগরণের লক্ষ্যে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে থাকেন। তাদের সাথে যুক্ত হন অবস্থাপন্ন মুসলিম পরিবারের ইংরেজী শিক্ষিত সন্তানগণ।

বিভিন্ন সংগঠন কায়েম

এ সময় বাংলার জাগরণকামী মুসলমানদের মধ্যে নানা ধরনের সংগঠন কায়েম, সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশ ও সাহিত্যক্ষেত্রে এগিয়ে আসার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। ১৮৬৩ সালের ২০ এপ্রিল নওয়াব আবদুল লতীফের (১৮২৮-৯৩) উদ্যোগে কায়েম হয় মোহামেডান লিটারারী সোসাইটি। ১৮৭৫ সালে কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্ররা গড়ে তোলেন ‘মাদ্রাসা লিটারেরী এন্ড ডিবেটিং ক্লাব’। ১৮৭৮ সালের ১২ মে সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) ও সৈয়দ আমীর হোসেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন ‘ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’। ১৮৭৯ সালে ঢাকা মাদ্রাসার সুপারিন্টেন্ডেন্ট ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী কায়েম করেন ‘সমাজ সম্মিলনী সভা’।

সংবাদপত্র প্রকাশ

হিন্দু সমাজের বহু পত্রিকার ভীড়ে ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৭ সালের মধ্যে ‘মোহাম্মদী আখবার’সহ চারটি মুসলিম সম্পাদিত সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশ পায়। বাংলার মুসলমানদের সাময়িকপত্র প্রকাশের সূচনা বলা চলে এ সময় থেকেই।

হান্টারের বই

এ সময়কার আরো কিছু ঘটনা মুসলিম সমাজকে আত্মসচেতন হতে সাহায্য করে। ১৮৬৮ সালে ইংরেজ সিভিলিয়ান ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার-এর ‘এ্যানালস অব দি রুরাল বেঙ্গল’ বা পল্লী বাঙলার ইতিহাস এবং ১৮৭১ সালে তাঁর ’দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস্’ প্রকাশিত হয়। এ বই দু’টিতে বাংলার মুসলমানদের অধপতিত দশার করুণ চিত্র ফুটে ওঠে।

আদমশুমারী ও শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট

১৮৭২ ও ১৮৮১ সালের আদমশুমারী এবং ১৮৮২ সালের ভারতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাঙলার মুসলমানদেরকে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সজাগ হতে উদ্বুদ্ধ করে। ১৮৮১ সালের আদমশুমারীতে প্রথম বারের মতো সকলের সামনে মুসলমানদের সংখ্যাশক্তির বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এ আদমশুমারী থেকে দেখা যায় যে, বর্ধমান প্রেসিডেন্সী, রাজশাহী, ঢাকা ও চট্রগ্রাম বিভাগের জনসংখ্যার ৫০.১৬% মুসলমান এবং ৪৮.৪৫% হিন্দু।

অন্যদিকে ১৮৮২ সালের ভারতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয় যে, বাঙলার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী মুসলমানগণ প্রতিবেশী সমাজের হিন্দুদের তুলনায় শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে পড়েছেন ।

এমনি এক পটভূমি ও পরিস্থিতিতে জামালউদ্দীন আফগানী কলকাতায় আসেন। আফগানীর কলকাতা সফরের আগে থেকেই বাংলাদেশের জাগরণকামী সচেতন মুসলমানদের মাঝে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল।

আফগানীর কলকাতা সফরের ফল

রামমোহন রায়ের কলকাতা আগমনের (১৮১৭) পর প্রায় সাড়ে ছয় দশক পাড়ি দিয়ে কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু উত্থান তখন চূড়াস্পর্শী। সে অবস্থায় জামালউদ্দীন আফগানী ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীতে আসেন। মুসলিম জাগরণের এ নকীবকে নিজেদের মাঝে পেয়ে বাঙলার সমসাময়িক জাগরণকামী মুসলিম চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী, আলেম ও তরুণ সমাজ গভীরভাবে আপ্লুত ও আলোড়িত হন। আফগানীর আহবান ও চিন্তাধারা দ্রুত দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

ইংরেজদের প্রতি আপোসকামী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও তার অনুসারীদের উপদেশ ও বাধা অগ্রাহ্য করে বাঙলার মুক্তিকামী মুসলিম তরুনেরা আফগানীর বিপ্লবী ভাবধারাকে স্বাগত জানান। জামালউদ্দীন আফগানীর উম্মাহ চেতনা তথা প্যান ইসলামী আদর্শ বাংলার সনাতনপন্থীদের সাথে জিহাদপন্থী ও ফরায়েজীদের সমঝোতার ক্ষেত্র রচনায়ও সাহায্য করে।

নওয়াব আব্দুল লতীফের (১৮২৮-১৮৯৩) উদ্যোগে কলকাতার এলবার্ট হলে (বর্তমান কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউজ) আফগানী ‘শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতি’ বিষয়ে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ ভাষণের মাধ্যমে তখনকার বাঙলার মুসলিম বুদ্ধিজীবী, আলেম ও তরুণসমাজ তার কাছ থেকে আগামী দিনের মুক্তির মনযিল সম্পর্কেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা লাভ করেন। ফলে শিক্ষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সাংগঠনিক তৎপরতার ক্ষেত্রে বাঙলার মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দার আল সুলতান’ এবং লাখনৌ থেকে প্রকাশিত ‘মুশির-ই-কায়সার’ পত্রিকায় আফগানীর লেখাগুলির তরজমা প্রকাশ করা হয়। ফলে আফগানীর চিন্তাধারার সাথে এ এলাকার জনগণের যোগসূত্র কায়েম হয়।

জামালউদ্দীন আফগানীর কলকাতা সফর এবং তার চিন্তার প্রভাবে উনিশ শতকের শেষের দিকে বাঙলায় জাগরণকামী মুসলমান সম্পাদিত সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশের সূচনা হয়। এর আগে শেখ আলীমুল্লাহ সম্পাদিত ‘সমাচার সভারাজেন্দ্র’ (১৮৩১), রজব আলী সম্পাদিত ‘জগদুদ্দীপক ভাস্কর’ (১৮৪৬) কিংবা সৈয়দ আব্দুর রহিম সম্পাদিত ‘বালারঞ্জিকা’ (১৮৭৩), মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘আজিজন নেহার’ (১৮৭৪) ও আনিসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘পারিলবার্ত্তাবহ’ (১৮৭৪) ইত্যাদি কয়েকটি সংবাদ সাময়িকপত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এ সব পত্রিকা বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণের ব্যাপারে দায়িত্ব পালনে সচেতন ও সক্রিয় ছিল বলে প্রমাণ মিলে না।

বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতায় আফগানীর প্রভাব

গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া লিখেছেনঃ ‘প্রকৃতপক্ষে ১৮৭৭ সালে ‘মহম্মদী আখবার’ প্রকাশের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান কর্তৃক তাদের আত্মপরিচয় ও অবস্থান জানাবার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এ পত্র-পত্রিকাগুলোর অধিকাংশ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় এবং ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা প্রকাশ এগুলোর প্রধান উপজীব্য ছিল। … তুর্কি খিলাফত এবং জামালউদ্দীন আফগানীর মতবাদ ভারতীয় তথা বাংলার শিক্ষিত মুসলমানদের প্যান ইসলামি চেতনায় উজ্জীবিত করে। বাংলার অনেক শিক্ষিত লোক কর্তৃক সাময়িকপত্র প্রকাশের  মূলে এ চেতনা সক্রিয় ছিল। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত ‘মহম্মদী আখবার’ থেকে শুরু করে ১৮৩০ সাল অবধি সময়ে প্রকাশিত পত্রিকার নামকরণ ও সম্পাদকীয় উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করলে আমাদের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে।  কারণ অধিকাংশ সাময়িকপত্রেরই নাম  মুখ্যত ‘ইসলাম’ আর ‘মুসলিম’ এ দুই বিশেষ শব্দ বাঞ্ছিত।” (গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া: মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিকাশ, পৃ ৯৬-১০১, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫)।

আফগানীর কলকাতা আগমনের পর ১৮৮৪ সাল থেকে মুসলিম সম্পাদিত সংবাদ সাময়িকপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ১৮৮৪ সাল থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত ষোল বছরে এখানে ১৬ টি, ১৯০০ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত নয় বছরে ১৫টি এবং ১৯১১ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত এগারো বছরে ৩০টি মুসলিম সম্পাদিত সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়।

জামালউদ্দীন আফগানীর কলকাতা সফরের আগে বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত সংবাদ-সাময়িকপত্রের সন্ধান বড় একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু আফগানীর কলকাতা সফরের পর ১৯০৩ সালের মধ্যেই জাগরণকামী মুসলিম সম্পাদিত ৩০ টির বেশী পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

প্যারিস থেকে আফগানী কর্তৃক ‘আল উরওয়াতুল উসকা’ প্রকাশের একই বছর ১৮৮৪ সালে মোহাম্মদ নইমুদ্দীনের সম্পাদনায় ‘আখবারে এসলামিয়া’, মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় ‘মুসলমান’ ও ‘মুসলমান বন্ধু’ প্রকাশিত হয়। এরপর একিনউদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় ‘ইসলাম’ (১৮৮৫), মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদের সম্পাদনায় ‘নব সুধাকর’ (১৮৮৬), গোলাম কাদের-এর সম্পাদনায় ‘হিন্দু মুসলমান সম্মিলনী’ (১৮৮৭) প্রকাশিত হয়। করটিয়া থেকে প্রকাশিত ‘আখবারে এসলামিয়া’ ছাড়া বাকী সব ক’টি পত্রিকাই প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। বলা চলে, বাঙলার মুসলিম জাগরণকারী সাংবাদিকতার এটাই ছিল সূচনা-পর্ব। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত ‘সুধাকর’ থেকে এক্ষেত্রে একটি অপেক্ষাকৃত সক্রিয় ও সম্পন্ন ধারা লক্ষ্য করা যায়।

‘মিহির ও সুধাকর’

‘সুধাকর’ প্রকাশ প্রসঙ্গে আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেনঃ “বাঙালী মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের সত্যিকার চেষ্টা হয় সম্ভবত ১৮৮৯ খ্রীস্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়, যাদের সমাজ হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ সমাজ-প্রাণ ও সাহিত্যিক গোষ্ঠী হচ্ছেনঃ মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দীন আহমদ, পন্ডিত রেয়াজ উদ্দীন মাশহাদী, মৌলভী মেরাজ উদ্দীন, মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ, মীর্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, শেখ আবদুর রহীম এবং শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক। বাংলার মুসলমানের দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অভিযোগ এদের প্রাণে একটা তীব্র জ্বালার সৃষ্টি করেছিল। এরা বুঝতে পারেন, বাংলার মুসলমানদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনা ব্যক্ত করার জন্য চাই তার একটা বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক মুখপত্র। এদেরই চেষ্টায় ‘সুধাকর’ প্রকাশিত হয়। মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ এ সাপ্তাহিকপত্রের সম্পাদক পদে বরিত হন।” (দৃষ্টিকোণ, পৃঃ ১৬৯)।

১৮৮৯ সালে সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ প্রকাশিত হবার পর ১৮৯০ সালে মীর মশাররফ হোসেন প্রকাশ করেন পাক্ষিক ‘হিতকরী’। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইসলাম প্রচারক’, ১৮৯২ সালে ‘মিহির’ ও ‘হাফেজ’। ১৮৯৪ সালে শেখ আবদুর রহীমের ‘মিহির’ এবং শেখ মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দীন আহমদ-এর ‘সুধাকর’ একত্রিত হয়ে যৌথ সম্পাদনায় ‘মিহির ও সুধাকর’ নামে ১৯১০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ১৮৯৮ সালে ‘কোহিনুর’, ১৮৯৯ সালে ‘প্রচারক’, ১৯০০ সালে ‘ইসলাম’, ‘নূর অল ইমান’, ১৯০১ সালে ‘মুসলমান পত্রিকা’, ‘সোলতান’ ও ‘নূরুল ইসলাম’ প্রকাশিত হয়। ১৯০৩ সালে ‘নবনূর’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’, ‘হানিফি’, ১৯০৬ সালে ‘ইসলাম সুহৃদ’, ১৯০৭ সালে ‘মোসলেম প্রতিভা’, ১৯০৮ সালে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’, ১৯১১ সালে ‘মোসলেম হিতৈষী’, ১৯১২ সালে ‘প্রভাকর’ ও ‘হাবলুল মতিন’, ১৯১৩ সালে ‘হাকিম’ ও ‘ইসলাম আভা’, ১৯১৫ সালে ‘আহলে হাদিস’, ‘আল এসলাম’, ‘ইসলাম দর্শন’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

‘দি কমরেড’ ও মওলানা মোহাম্মদ আলী

বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র ছাড়া আফগানীর ভাবাদর্শ-প্রভাবিত কয়েকটি ইংরেজী পত্রিকাও এ সময় প্রকাশিত হয়। ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক  ‘দি মুসলিম ক্রনিকল’ ও ‘দি মুসলমান’-এর সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে এ. আলী ও মুজিবর রহমান। আফগানীর চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত মওলানা মোহাম্মদ আলী (১৮৭৮-১৯৩১) কলকাতা থেকে ‘দি কমরেড’ (১৯১১) প্রকাশ করেন। তার পত্রিকায় বিশেষভাবে প্যান ইসলামী চিন্তাধারা ও মুসলিম বিশ্ব পরিস্থিতি গুরুত্ব পায়।

‘আল বালাগ’ ও মওলানা আবুল কালাম আজাদ

মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) ছিলেন প্যান ইসলামী আন্দোলনের শক্তিশালী ব্যাখ্যাতা। আফগানী প্রভাবিত ‘আল-মানার’ গ্রুপের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। তাঁর সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘আল হেলাল’ (১৯১২) ও ‘আল বালাগ’ পত্রিকায় তিনি ধারাবাহিকভাবে প্যান ইসলামী আন্দোলনের ওপর প্রবন্ধ লিখেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি বিভিন্ন স্থানে তার প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষণের মাধ্যমে ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনিও আফগানীর মতোই সৈয়দ আহমদের পাশ্চাত্যপ্রীতি ও আপোসনীতির সমালোচনা করেন।

‘আজাদ’ ও মওলানা আকরম খাঁ

মুসলিম বাঙলার আধুনিক সাংবাদিকতার জনক, ‘আজাদ’ ও ‘মোহাম্মদী’র প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ-ও ছিলেন একজন বিশিষ্ট ‘প্যান ইসলামিস্ট’। তার সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক মরহুম মুজিবুর রহমান খাঁ লিখেছেন: “মওলানা জামালউদ্দীন আফগানী তাঁর আদর্শ। তিনি বিশ্বাস করতেন জিহাদ করে মুসলমান বড় হয়েছিল এবং জিহাদের পথ ধরেই তারা আবার বড় হবে হৃতগৌরব ফিরে পাবে। এ ধরনের নীতি বিশ্বাসের ঘোষণা মওলানা আকরম খাঁর মুখে দিনের পর দিন শুনেছি।” (আবু জাফর সম্পাদিত ‘মওলানা আকরম খাঁ’ গ্রন্থে প্রকাশিত মুজিবুর রহমান খাঁর প্রবন্ধ, পৃ-৯৫)

বাঙলার মুসলমানদের সাহিত্য আন্দোলনে আফগানীর প্রভাব

উনিশ শতকের আশির দশক ও কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে অধিকাংশ মুসলিম লেখক-সাহিত্যিকের ওপর জামালউদ্দীন আফগানীর আদর্শিক প্রেরণার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২)-এর শেষ দিককার রচনা ‘মৌলুদ শরীফ’ (১৯০৫), ‘মদীনার গৌরব’ (১৯০৬), ‘মোশ্লেম বিজয়’ (১৯০৮), ‘ইসলামের জয়’ (১৯০৮) প্রভৃতিতে ইসলামী আন্তর্জাতিকতা ও মুসলিম জাগরণ-প্রয়াসী রূপ স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। এ সময় সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকে জাগরণের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করে বাঙালি মুসলমানদের মধ্য থেকে এগিয়ে আসেন আরো অনেকে। তাদের মধ্যে রেয়াজ অল দীন মাশহাদী (১৮৫৯-১৯১৪), নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন (১৮৬২-১৯৩৩), মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭), মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩), মোহম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩), শেখ আব্দুস সোবহান, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ (১৮৬৯-১৯৫৩), মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৪-১৯৫০), সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৭৬-১৯৫৯), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১), বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২), শেখ আব্দুল জব্বার (১৮৮১-১৯১৮), শেখ ফজলুল করিম (১৮৮২-১৯৩২), মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০) প্রমুখ অগ্রণী ছিলেন।

তারা তাদের সাহিত্যকর্মে মুসলিম সমাজ-চিত্রের প্রতিফলন, ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমাজনীতির ব্যাখ্যা প্রদান, আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধন এবং গৌরবময় অতীতের আলোকে মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যৎ সমাজ রচনার আকাংখা তুলে ধরে মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নিতে  সচেষ্ট ছিলেন। এ সময়কার অধিকাংশ লেখকই কোন-না-কোনভাবে আফগানীর চিন্তার  দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

মাশহাদীর ‘সমাজ ও সংস্কারক’

এ সকল মুসলিম মনীষীর মধ্যে রেয়াজ আল দীন মাশহাদী (১৮৫৯-১৯১৮) কলকাতার এলবার্ট হলে আফগানীর বক্তৃতার প্রায় সাত বছর পর ১৮৮৯ সালে ‘সমাজ ও সংস্কারক’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে আফগানীর চিন্তা-চর্চার গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মাশহাদীর এ গ্রন্থটিতে আফগানীর সংগ্রামী জীবনের আলেখ্য ও চিন্তা চেতনার বিশ্লেষণ ফুটে উঠেছে। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর (১৮২৪-১৮৮৩) আর্যসমাজ (১৮৭৫) বা শুদ্ধি আন্দোলন ভারতবর্ষে উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়ালে তার প্রতিবাদে মাশহাদী ১৮৮৯ সালে ‘অগ্নিকুক্কুট’ প্রকাশ করেন।

ইসমাইল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১) ‘তুরস্ক ভ্রমণ’ (১৯১৩), ‘তুর্কী নারী’ (১৯১৩) ‘স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা’ (১৯১৪), ‘স্ত্রী শিক্ষা’ (১৯১৬), ‘সুচিন্তা’ (১৯১৭) প্রভৃতি রচনায় আফগানীর প্রভাব স্পষ্ট। সিরাজী প্যান ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘আহলে আহমের’ সদস্যরূপে ১৯১২ সালে তুরস্কে গমন করেন। এ সফর তার চিন্তাধারাকে  ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করে।

ত্রিশের দশক পর্যন্ত ইসলামী ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক এয়াকুব আলী চৌধুরীও (১৮৮৭-১৯৩৮) প্যান ইসলামী আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।

সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী

ঊনিশ শতকের শেষ দুই দশক এবং কুড়ি শতকের প্রথম ভাগে প্রকাশিত সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র এবং সমসাময়িক মুসলিম সাহিত্য সাধনা ইংরেজ ও বর্ণহিন্দুদের যৌথ শোষণ-লুণ্ঠনে পিছিয়ে পড়া বাঙলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তশ্রেণীর মুসলমানগণ এ জাগরণ প্রয়াসের কান্ডারী ছিলেন। তবে এ কাজে কয়েকজন সমাজহিতৈষী বিত্তবান মুসলমান বিশেষ যত্নবান ছিলেন।

তাদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন মোমেনশাহীর ধনবাড়ির জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯)। তার কাছে বাঙলার মুসলমানরা নানাভাবেই ঋণী। বিশেষত মুসলিম সমাজের শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে তার অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মিহির ও সুধাকর’ (১৮৯৫) ও ‘প্রচারক’ (১৮৯৯) এর আর্থিক ব্যয় নির্বাহে তিনি সহায়তা করেন। ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকাটি নওয়াব আলী চৌধুরীর স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা ‘আলতাফি প্রেস’ থেকে মুদ্রিত হতো। ‘ইসলাম প্রচারক’ (১৮৯১) তার অবদানের বিশেষ প্রশংসা করেছে।

নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী

কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সুধাকর’ ও ‘ইসলাম  প্রচারক’ পত্রিকা দু’টিকে অর্থ-সাহায্য করেন নবাব ফয়েজুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৪)। এ পত্রিকা দু’টি শিক্ষিত মুসলমান সমাজকে ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবোধে উজ্জীবিত করার প্রয়াস চালায়। কলকাতার একশ্রেণীর অভিজাত লোকের মধ্যে বাংলাভাষার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করতে ‘ইসলাম প্রচারক’ বাংলাভাষার পক্ষে আন্দোলন করে এবং কুরআনের তাফসীর ও  অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের বাংলা তরজমা প্রকাশ করে ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ও কুসংস্কার দূর করতে ভূমিকা পালন করে।

‘আখবারে এসলামিয়া’, ‘হিতকরী’ ও ‘আহমদী’

‘আখবারে এসলামিয়া’ (১৮৮৪) প্রকাশিত হতো করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলীর ‘মাহমুদিয়া প্রেস’ থেকে। ‘সোলতান’ (১৯০১) প্রকাশে আর্থিক সহায়তা করেন রংপুরের জমিদার ও কলকাতার সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসাসিয়েশনের রংপুর শাখার সভাপতি খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ।

টাঙ্গাইল  থেকে আব্দুল হামিদ খান ইউসুফজয়ীর সম্পাদনায় ১৮৮৫ সালে মাসিক ও ১৮৮৬ সালে পাক্ষিক ‘আহমদী’ প্রকাশিত হয় করিমুন্নেছা খানমের অর্থানুকূল্যে।

১৮৯০ সালে মীর মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে পাক্ষিক ‘হিতকরী’ প্রকাশিত হয় টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর আর্থিক সহায়তায়। ‘খৃষ্ট, ব্রাহ্ম ও হিন্দু ধর্মের প্রভাব থেকে ইসলাম ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষাই’ ছিল এ পত্রিকার ঘোষিত লক্ষ্য। এসব পত্র-পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে জামালউদ্দীন আফগানীর প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য।

অধঃপতিত মুসলমানদের অবস্থার উন্নয়ন তথা বাংলার মুসলমানদের নব জাগরণই ছিল এ সময়কার সকল পত্র-পত্রিকার মূল কথা। হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে প্যান ইসলামী আদর্শের প্রবক্তা ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকা।

সাধারণভাবে মুসলমানদের মাঝে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি, মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রচার, ইসলামী আন্তর্জাতিকতা বা উম্মাহ ধারণার প্রচার, তুর্কী খিলাফতের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি ছিল এসব পত্র-পত্রিকার উপজীব্য। ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম অবদানের মহিমা প্রচার, ইংরেজ ও বর্ণহিন্দুদের প্রচার-মাধ্যমে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবমূল্যায়ন করে প্রকাশিত রচনাবলীর জবাব দান, মুসলিম সমাজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তার প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান, শিরক-বিদআত তথা কুসংস্কার দূর করে শরীয়তের অনুশাসনের ভিত্তিতে সকল প্রকার আলস্য ও জড়তা কাটিয়ে নতুন হিম্মতে জেগে ওঠার আহবান প্রচার প্রভৃতি বিষয় ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকার বৈশিষ্ট্য।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং নিজস্ব তাহযীব-তমদ্দুনের বিকাশ সাধন ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকার বিশেষ লক্ষ্য। এমনকি, ‘শিখা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘জয়তী’ প্রভৃতি পত্রিকার অন্তরের বাণীও ছিল মুসলিম সংস্কৃতিভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য-চেতনা। তাদের বক্তব্যও ছিল ইসলামের সাথে সঙ্গতি-সন্ধানে প্রয়াসী।

আফগানীর প্রভাবে বিভিন্ন আন্জুমান ও সংগঠনের জন্ম

মুসলিম জাগরণের লক্ষ্যে এ সময় সাংবাদিকতা ও সাহিত্য আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন ও আন্জুমান প্রতিষ্ঠার বিশেষ উদ্যোগ ছিল। ১৮৮৩ সালে মহম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনী’। ১৮৯৩ সালে গঠিত হয় ‘কলিকাতা মহামেডান ইউনিয়ন’। ১৮৯৪ সালে কায়েম করা হয় ‘মহামেডান এলগিন স্পোর্টিং ক্লাব’। ১৮৯৬ সালে ‘মহামেডান রিফর্ম ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৯ সালে ‘মহামেডান ইউনিয়ন স্পোর্টিং ক্লাব’ স্থাপিত হয় ।

একই বছর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে সভাপতি ও শেখ আব্দুর রহীমকে সম্পাদক করে  গঠিত হয়‘বঙ্গীয় সাহিত্য বিবরণী মুসলমান সমিতি’। পরে এটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ নামে পরিচিত হয়। ১৯০২ সালে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে কলকাতায় ‘মুসলিম ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এ সময় মুসলিম সমাজ কর্মী, বুদ্ধিজীবী ও তরুণ কর্মীদের মাঝে সভা-সমিতি গঠনের আগ্রহ দেখা যায়। ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় ইসলাম মিশন সমিতি’। ১৯১৩ সালে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রতিষ্ঠা করেন ‘আনজুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা’। তিনি ‘শাহজাহান কোম্পানী’ নামে এ সময় একটি পাবলিক লাইব্রেরী কায়েম করেন এবং খিলাফত আন্দোলনের আর্থিক সহায়তার জন্য ‘খেলাফত  স্টোর’ নামে একটি বাণিজ্যকেন্দ্র  প্রতিষ্ঠা করেন ।

প্যান ইসলাম সোসাইটি অব লন্ডন

বাংলার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, কলকাতার সোহরাওয়ার্দী পরিবারের সন্তান আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী আফগানীর প্যান ইসলামী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯০৩ সালে লন্ডনে ‘প্যান ইসলামিক সোসাইটি অব লন্ডন’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘প্যান ইসলাম’ নামে একটি জার্নালও প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রভূমি থেকে প্রকাশিত ‘প্যান ইসলাম’ জার্নালের মাধ্যমে ইউরোপীয় সংস্কৃতির মুকাবিলায় তিনি ইসলামী সংস্কৃতির গৌরব এবং সভ্যতার উত্থানের পক্ষে কাজ করেন।

‘প্যান ইসলাম সোসাইটি’ ১৯০৫ সালে আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর সংকলিত ‘The Sayings of Muhammad ‘ নামে রসূলুল্লাহ্ সা-এর বাণীর একটি সংকলন প্রকাশ করে। বইটি পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের মধ্যে এতখানি প্রভাব ফেলে যে, বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের মৃত্যুর পর তার ওভারকোটের পকেটে এ বইয়ের একখানা কপি পাওয়া যায়।

কুড়ি শতকের রাজনীতির মোড় পরিবর্তনে আফগানীর প্রভাব

১৯০৫ সালে ঢাকাকে কেন্দ্র করে মুসলিম মেজরিটি অধ্যুষিত ‘পূর্ব বাঙলা ও আসাম প্রদেশ’ গঠনের ফলে বাঙলার মুসলিম জাগরণের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। জামালউদ্দীন আফগানীর প্যান ইসলামী স্বাতন্ত্র্য-চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এ ইতিবাচক প্রশাসনিক পরিবর্তনকে বাঙলার জনগণের উন্নতির সোপানরূপে কাজে লাগাতে উদ্যোগী হন। কিন্তু বর্ণহিন্দু জমিদার-উকিল-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্ট আন্দোলন ও তাদের সৃষ্ট ‘যুগান্তর’ ও ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রভৃতি গোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের মুখে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ প্রদেশ রদ করা হয়।

আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর প্রতিক্রিয়াঃ

নবগঠিত প্রদেশ রদের বিরুদ্ধে বাঙলার মুসলমানদের পক্ষ থেকে যে প্রতিবাদ ওঠে, সে ক্ষেত্রে সবচে সোচ্চার ছিলেন জামালউদ্দীন আফগানীর আদর্শিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ প্যান ইসলামী ভাবধারার রাজনৈতিক কর্মীগণ। নতুন প্রদেশ বাতিলের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্যান ইসলামী নেতা আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী বলেনঃ

“If we are silent and less vocal, our silence is the silence of anger and sorrow and not of acquiescence. In proportion to our devotion to the person on Throne of His Majesty the intensity of our resentment at the cowardly device of pulling the announcement in the mouth of the King-Emperor and thus muzzling us effectively ( Matiur Rahman: From Consultation to Confrontation. “

মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্যান ইসলামী ভাবধারার প্রভাব

পূর্ব বাঙলা ও আসাম প্রদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তাৎপর্যকে ধারণ করে ১৯০৬  সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের ১৯১০ সালের নাগপুর অধিবেশনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে ‘‘আত্মনির্ভরশীলতা’’ বা Self Reliance অর্জনের  দলীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ প্রদেশ রদের প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্যান ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে ‘স্বাধিকার আদায়ের’ সংকল্প জোরদার হয়ে ওঠে।

প্যান ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ তরুণ  নেতাদের প্রভাবেই ১৯১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাকিপুরে  অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সদ্য প্রণীত গঠনতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের (Self Government) দাবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  ১৯১৩ সালের ২২ মার্চ মুসলিম লীগের লাখনৌ অধিবেশনে তা অনুমোদিত হয়।

এভাবেই পূর্ব বাঙলা ও আসাম প্রদেশ রদের প্রতিক্রিয়ার পথ ধরে মুসলিম পূর্ব বাঙলা ও আসাম প্রদেশের বাঙলা ও মুসলিম ভারতের রাজনীতি স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আব্দুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলীর আপোসকামী আবেদন-নিবেদনমূলক ধারা অতিক্রম করে জামালউদ্দীন আফগানীর প্যান ইসলামী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত তরুণ মুসলিম নেতৃত্বের অধীনে ‘সক্রিয় রাজনীতি’তে পদার্পণ করে।

শেরে বাঙলা ফজলুল হক

১৯১৩ সালের ৪ এপ্রিল কলকাতায় ব্যবস্থাপক সভার বাজেট বক্তৃতায় নওয়াব সলীমুল্লাহর রাজনৈতিক মানসপুত্র আবুল কাশেম ফজলুল হক পূর্বসুরীদের ‘আবেদন নিবেদন ও করজোড়নীতি’ অতিক্রম করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন: মুসলমানদের দাবি-দাওয়া পূরণে বারবার ব্যর্থ হলে ইংরেজ রাজশক্তিকে এজন্য খেসারত দিতে হবে। (J. H. Broomfield: Elite Conflict,p- 64)

জেহাদী-ফরায়েজী-তাইয়ুনীদের ওপর প্রভাব

বাংলাদেশসহ সর্বভারতীয়  মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চিন্তা ১৮৭০ সাল থেকেই আফগানীর প্যান ইসলামী ভাবধারায় আপ্লুত হয়। ফলে জিহাদপন্থী ও ফরায়েজীপন্থীদের বিপ্লবী ধারা, স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলীর আপোসকামী ধারা এবং কেরামত আলী জৈনপুরীর সনাতনী চিন্তাধারার মাঝে দূরত্ব কমে আসে। আফগানীর প্রভাবে বাঙলার মুসলিম জাগরণের ঊষাকাল থেকেই মুসলিম রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চিন্তাবিদগণ সকলেই যুক্তভাবে কিংবা মুক্তভাবে প্যান ইসলামী আদর্শের প্রবক্তা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।

হিন্দু-মুসলমান রাজনীতির ক্ষেত্রে জিহাদপন্থী ও ফরায়েজীপন্থীদের বিপরীতে স্যার সৈয়দ আহমদের স্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তা ইংরেজদের প্রতি আনুগত্যের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু আফগানীর প্যান ইসলামী চিন্তা ইংরেজদের প্রতি আনুগত্যের এ নীতিকে প্রবলভাবে আঘাত হানে। ভারতীয় মুসলমানদের উম্মাহ চেতনা এবং উসমানীয় খিলাফতের প্রতি সহানুভূতি আফগানীর সংস্পর্শে বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। স্যার সৈয়দের আপোসনীতির বিপরীতে আফগানী দৃঢ়ভাবে মনে করতেন যে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে আপোসের কোন সম্ভাবনা নেই; বরং চূড়ান্ত পর্যায়ে সংঘাত অনিবার্য। আফগানী তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের অনেককেই এটা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ঐক্যচেতনা ও জাগরণের প্রতীক

আফগানী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান প্রচারের সাথে সাথে মুসলিম উম্মাহর কুরআনকেন্দ্রিক ঐক্য ও আদর্শিক সংহতির বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন। মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সামাজিক ব্যবস্থাপনায় ইসলামকে অনুসরণ করার জন্য তিনি আহবান জানান। তিনি তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত করে উত্তরণের পথ দেখান এবং জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বকে কর্মতৎপর হতে তাকীদ দেন। বাঙলাসহ মুসলিম ভারতে ঊনিশ শতকের শেষভাগ থেকে আফগানীর প্রভাব পড়ে এবং কুড়ি শতকে আফগানী তাদের ঐক্যচেতনা ও জাগরণপ্রয়াসের প্রতীকে পরিণত হন।

শিবলী নু’মানীর চিন্তাধারায় পরিবর্তন

উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিন্তানায়ক আল্লামা শিবলী নু’মানী (১৮৭৫-১৯১৪) ১৮৯০-এর দশক পর্যন্তও খিলাফত প্রশ্নে স্যার সৈয়দ আহমদের ধারণার সাথে একমত হয়ে প্রকৃত খিলাফতের ব্যাপারটিকে শুধু খুলাফা-ই-রাশেদার সাথেই সম্পর্কযুক্ত মনে করতেন। তিনি ১৮৯৩ সালে কায়রোতে আফগানীর ঘনিষ্ট সাথি ও ভাবশিষ্য শায়খ মুহাম্মদ আবদুহুর সাথে সাক্ষাত করেন। এরপর শিবলী নু’মানীর চিন্তাধারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

মুসলমানগণ ভাষা ও অঞ্চল নির্বিশেষে বিশ্বাসের ভিত্তিতে এক ও অভিন্ন। আফগানী এ  চিন্তা দেশে দেশে ছড়িয়ে দেন। মুসলমানদের মাঝে এক নতুন স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলেন। উপমহাদেশের খিলাফত আন্দোলন, স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্যের লড়াই,এবং অবশেষে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুসলমানদেরকে ত্যাগ ও কুরবানীর পথে পরিচালিত করতে  আফগানীর প্যান ইসলামী চিন্তা বিশেষ অবদান রাখে।

আফগানী ঊনিশ শতকের মুজাদ্দিদঃ ইকবাল কুড়ি শতকের মুয়াজ্জিন

জামালউদ্দীন আফগানীর চিন্তাধারা ইসলামী দুনিয়ার সামনে স্পষ্ট ও সফলভাবে তুলে ধরেন আল্লামা ইকবাল তার অনুপম সৃষ্টিধারায়। আফগানী ছিলেন ঊনিশ শতকের মুজাদ্দিদ, আর ইকবাল ছিলেন সে বাণীর মুয়াজ্জিন। ইকবালের ‘জাভিদনামা’য় আফগানীর ‘উম্মাহ’ বা ‘মিল্লাত’ চেতনা চমৎকারভাবে ভাষা পেয়েছে। মওলানা রূমীর যবানীতে ইকবাল ‘প্রাচ্যের যুগোত্তরণের পথিকৃত’রূপে অভিহিত করেছেন আফগানীকে। পাশ্চাত্যের গড়া ফাঁদে বন্দী ‘অধর্ম আর ভূগোলের পীড়নে ক্ষত-বিক্ষত’ পৃথিবীর ‘নিরাময় ও মুক্তির জন্য’ আফগানীর আহ্বান ফুটে উঠেছে ইকবালের নিম্নোক্ত কালজয়ী কবিতাংশেঃ

‘‘ উঠ!

ছুঁড়ে ফেল এ বন্দী কারাগারের ঘেরাটোপ

ছড়িয়ে পড় মুক্ত বিশ্বে।

মুসলমানের কাছে সব দেশই তার স্বদেশ।

তার স্থান দেশাতীত।

যদি তোমরা বুদ্ধিমান হও, ভেঙে দাও

ইট আর পাথরের তৈরি পৃথিবীর সীমানা।

এসো, সবাই মিলে আমরা ধুয়ে ফেলি বস্তুতান্ত্রিকতার ক্লেদাক্ত শরীর।”

কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে আফগানীর বাণীকে ইকবাল তাঁর কাব্যে উচ্চারণ করেছেন এভাবেঃ

‘‘ কুরআন হলো ধনিকের মৃত্যু পরোয়ানা

   আর যারা সর্বহারা দাস, কুরআন তাদের আশ্রয়।

  ….এ পৃথিবী মানুষের, আর মানুষ একই পরিবারভুক্ত।”

ইকবালের মিল্লাতে ইসলামিয়া

কুরআনের আশ্রয়ে আফগানী সকল মানুষকে একই পরিবারভুক্ত দেখতে চেয়েছেন। ইকবালের ‘মিল্লাতে ইসলামিয়া’ ধারণা আফগানীর সেই ঐক্য চেতনারই নির্যাস। ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে ঐক্যের একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইকবালের আহবান আফগানীর উনিশ শতকীয় প্যান ইসলাম  আন্দোলনের বিশ শতকীয় বানীরূপে উচ্চারিত। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, কুরআনী জীবনব্যবস্থার রূপায়ণ, মুসলিম সমাজ থেকে অনৈসলামী চিন্তা ও কর্ম তথা জীবনচর্চার মূল উৎপাটন, পাশ্চাত্য বস্তুতান্ত্রিকতার অক্টোপাস থেকে মুক্তি, এসবই আফগানীর ভাবধারার মূল কথা। আর ইকবালের ১৯০৮ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত রচনাবলীতে এ সবই প্রধান বিষয় হিসাবে উচ্চারিত হয়েছে।

ইকবালের ওপর আফগানীর অসামান্য প্রভাব সম্পর্কে ‘বুদ্ধির মুক্তি’  আন্দোলনের নেতা কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) লিখেছেনঃ

‘‘Of the modern Muslim thinkers, he (Iqbal) is indebted Syed Jamal-Ud-Din Afghani who flourished in the second half of the nineteenth century and tried to drive home into the fallen Muslim world with the message of the scientific outlook and political resurgence”( K. A. Wadud: Iqbal in Calcutta Review, Feb. 1949)

আফগানী সম্পর্কে ইকবাল

জামালউদ্দীন আফগানীর চিন্তার দ্বারা ইকবাল কতখানি প্রভাবিত ছিলেন তা তার বিভিন্ন মতামত থেকে জানা যায়। ১৯৩২ সালে আল্লামা ইকবাল তার বন্ধু মোহাম্মদ আহসানের কাছে লেখা চিঠিতে জামালউদ্দীন আফগানী সম্পর্কে লিখেছেনঃ “In Modern terms, from any point of view ,if anybody is entitled to be called a Muzaddid it is Jamaluddin Afghani…. In fact (he) is the chief architect of the present day Renaissance of the Muslim world.”

জওহরলাল নেহরুর কাছে লেখা এক চিঠিতে ইকবাল বলেনঃ

“…. Yet no other man in our time has stirred the soul of Islam more deeply than he. His spirit is still working in the world of Islam and nobody knows where it will end.”  (Thoughts and Reflections of Iqbal)

আল্লামা ইকবাল তার The Reconstruction of Religious Thoughts in Islam নামক বিখ্যাত বইতে জামালউদ্দীন আফগানী সম্পর্কে লিখেছেনঃ

‘‘The man… who fully realized the importance and immensity of this task (i.e. of rethinking the whole system of Islam without completely breaking with the past) and whose deep insight into the meaning of the history of Muslim thought and life, combined with a broad vision engendered by his wide experience of men and manners would have made him a living link between the past and future, was Jamal-Ud-Din Afghani. If his indefatigable but divided energy could have devoted itself entirely to Islam as a system of human belief and conduct, the world of Islam intellectually speaking, would have been on a much more solid ground today.” ( The Reconstruction of Religious Thought in Islam- 1934 ; p- 92)

ইকবালের অনুসারী কবিদের মাধ্যমে আফগানীর চিন্তার প্রকাশ

আল্লামা ইকবালের রচনা ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বাঙলার মুসলমানদেরকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। ইকবালের কবিতার পংক্তিমালা বিভিন্ন মাহফিলে-সমাবেশে কবিতা ও গানের সুরে বা বক্তৃতায় উদ্ধৃত হয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণও তাদের সাহিত্য-সাধনায় ইকবালের রচনার দ্বারা প্রভাবিত হন। এভাবে ইকবালের কাব্যের মধ্য দিয়ে আফগানীর প্যান ইসলামী চেতনার সুর সর্বত্র ঝংকৃত হতে থাকে। ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, শাহাদাত হোসেইন সহ রেনেসাঁ যুগের কবিরা ইকবালকে অধিকতর  আত্মস্থ করে জাতীয় জাগরণের বাণী প্রচার করেন। এভাবে প্রকৃতপক্ষে জামালউদ্দীন আফগানীর চিন্তাধারাই এসব কবিদের প্রেরণার উৎসরূপে ভূমিকা পালন করে।

কুড়ি শতকের স্বাধীনতা সংগ্রামে আফগানীর প্রেরণা

জামালউদ্দীন আফগানীর আন্দোলনের ফল মুসলিম জাহান ভোগ করেছে সমগ্র বিশ শতকব্যাপী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন মহাদেশে মুসলিম দেশগুলোর স্বাধীনতা লাভের পেছনে আফগানীর প্রভাব অনস্বীকার্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালে মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামী উম্মাহ-চেতনার বিস্তার, ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন এবং শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা ও আইন ব্যবস্থাসহ কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত উন্নয়নের ব্যাপারে দাবি ও প্রচেষ্টায় আফগানীর চিন্তার প্রভাব লক্ষ্যণীয়।

মুতামার-রাবেতা-ওআইসিঃ আফগানীর স্বপ্নের ফসল

বিশ শতকে মুসলিম দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা প্রতিষ্ঠা। এর আগে মুতামার-ই-আলম আল-ইসলামী ও রাবেতায়ে আলম-আল-ইসলামীকে সামনে রেখে বিশ্বের ইসলামী চিন্তানায়কগণ স্বপ্ন দেখেছেন। ‘ও আই সি’ তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীন শক্তি সংহত হলে এবং সরকার ব্যবস্থাপনায় ইসলামী প্রতিনিধিত্ব জোরদার হলে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা মুসলিম উম্মাহর আকাংখা বাস্তবায়নে আরো সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

ইসলামী ব্যাংকিং ও আফগানীর ইজতেহাদ চেতনা

আধুনিক যুগের চাহিদা পূরণে জামালউদ্দীন আফগানী উনিশ শতকে ইজতিহাদ সম্পর্কে আহবান জানান। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন দেখা যায় বিশ শতকের সত্তুরের দশকে ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নের চেষ্টার মাধ্যমে। মুজতাহিদদের গবেষণা ও প্রায়োগিক ব্যাংকারদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে গত কয়েক দশকে ইসলামী ব্যাংকিং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সম্প্রসারিত ও সংহত হয়েছে।

শিক্ষার ইসলামীকরণে আফগানীর প্রভাব

শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামীকরণের ক্ষেত্রেও বিগত দশকগুলোতে মুসলিম উম্মাহ কতক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ইরানের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। সৌদি আরবে মদিনা ইসলামী বিশ্বাবদ্যালয়, মক্কায় উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদে আল ইমাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে আলোক বর্তিকার ভূমিকা পালন করছে। মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় একটি মডেল দাড় করেছে। পাকিস্তানে ইসলামাবাদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সফলভাবে কাজ করছে। কয়েকটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সফলভাবে কাজ করছে।

প্রচার মাধ্যম

ইসলামের আহ্বান প্রচারের জন্য আন্তর্জাতিক ইসলামী বার্তা সংস্থা, ইসলামী টিভি চ্যানেল, বেতার কেন্দ্র, সংবাদপত্র প্রভৃতি কার্যকরভাবে পরিচালনার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে।

কুরআনের ছায়ায়

আধুনিক যুগের নানা জিজ্ঞাসা ও চাহিদা মুকাবিলার জন্য মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশগ্রহণ এখন প্রায় সর্বত্রই দৃশ্যমান। মুসলমানদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক জাগরণের একটি আভাস ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর মোকাবিলায় ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ বা সভ্যতার সংঘাত এবং ‘ক্রস’ ও ‘ক্রিসেন্ট’এর পুরনো দ্বন্দ্বকেও সামনে আনার চেষ্টা রয়েছে।

মুসলমানগণ জামালউদ্দীন আফগানী এবং অন্যান্য পথিকৃত মনীষীদের চিন্তা ও আহ্বান অনুসরন করে কুরআনের ছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হলে তারাই সফল হবেন। আল-কুরআনে এ ব্যাপারে ঘোষণা রয়েছে।

তথ্যসূত্র

১. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ (২য় খন্ড) : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

২. রেয়াজ অল দীন অল মাশহাদী অল-ক্বোরেশী অল হিন্দী : মাশহাদী রচনাবলী, প্রথম খন্ড (আবদুল কাদির সম্পাদিত); কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, ডিসেম্বর ১৯৭০।

৩. মোহাম্মদ মতিওর রহমান : ঐতিহাসিক অভিধান ; বাংলা একাডেমী, জুলাই ১৯৬৭।

৪. আবদুল মওদুদ : মুসলিম মনীষা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮১।

৫. ওয়াকিল আহমদ : উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা; বাংলা একাডেমী, ১৯৮৩।

৬. আনিসুজ্জামান : মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র  (১৮৩১-১৯৩০); বাংলা একাডেমী, (১৯৬৯)।

৭. মুনতাসির মামুন : উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িকপত্র; বাংলা একাডেমী, (১৮৮৫)।

৮. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান : আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা, ঢাকা, ১৯৯৩।

৯. গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া : বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিকাশ; বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫।

১০. Aziz Ahmed : Islamic Modernism in India and Pakistan 1967

১১. ফাহমিদ-উর রহমান : ইকবাল মননে অন্বেষণে : আল্লামা ইকবাল সংসদ, ১৯৯৫।

১২. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান : আত্ম-অন্বেষায় বাঙালি মুসলমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ ; বাংলা একাডেমী,  জুন ১৯৯৫।

১৩. শাহজাহান মনির : বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৯১৯-১৯৪০); বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯৩।

১৪. ডক্টর বদিউজ্জামান : ইসমাইল হোসেন সিরাজী  জীবন ও সাহিত্য; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৮।

১৫ খন্দকার সিরাজুল হক : মুসলিম সাহিত্য সমাজ : সমাজ চিন্তা ও সাহিত্য কর্ম বাংলা একাডেমি ১৯৭৪।

লেখক পরিচিতি:
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
লেখক
গবেষক
ইতিহাসবিদ

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *