এই মহাজগতে আল্লাহ তা’আলা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, শুধু ‘কুন’ (হও) বলে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষের বেলায় তিনি ইরশাদ করেন,
خَلَقْتُ بِیَدَی١ؕ
‘আমি তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা স-দ, আয়াত ৭৫),
وَ نَفَخْتُ فِیْهِ مِنْ رُّوْحِیْ
‘এবং আমি তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দিয়েছি’ (সুরা হাজর, আয়াত ২৯), অর্থাৎ রুহ ফুঁকার মধ্য দিয়ে মানব জীবনের শুরু।
কিন্তু দু’পেয়ে কথা-বলতে-পারা প্রাণী মাত্রই কিন্তু মানুষ নয়। কোরআনে ‘মানুষ’ ও ‘মনুষ্য প্রজাতি’ আলাদা করে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাণীর স্তর ছাপিয়ে এক উন্নত শ্রেণিকে আল্লাহ ‘মানুষ’ সম্বোধন করেছেন, বাকিরা কেবল মনুষ্য প্রজাতি— কোনো ক্ষেত্রে এদেরকে চতুষ্পদ প্রাণীরও অধম সম্বোধন করা হয়েছে। এমনিতে জন্মগতভাবে সবাই মনুষ্য প্রজাতিই থাকে, আপন চেষ্টার মধ্য দিয়ে এবং জীবনকে মঙ্গলময়ী উদ্দেশ্যময় করার পথ ধরে মানুষে উন্নীত হতে হয়। আর এই চেষ্টার একটি অংশই হলো আত্ম-অনুসন্ধান।
আল্লাহ মানুষকে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা আমাদেরকে সমস্ত সৃষ্টির ওপর আধিপত্য বিস্তারের শক্তি জুগিয়েছে। সেই তিনটি বৈশিষ্ট্য হলো :
(১) হেদায়েত
যেমন ইরশাদ আছে—
رَبُّنَا الَّذِیْۤ اَعْطٰى كُلَّ شَیْءٍ خَلْقَهٗ ثُمَّ هَدٰى
‘আমাদের প্রভু প্রত্যেক জিনিসের আকৃতি দিয়েছেন এবং তাদের চলার পথ বাৎলে দিয়েছেন।’ (সুরা ত-হা, আয়াত ৫০)
(২) স্বাধীন ইচ্ছা।
যেমন ইরশাদ আছে—
اِنَّا هَدَیْنٰهُ السَّبِیْلَ اِمَّا شَاكِرًا وَّ اِمَّا كَفُوْرًا
আমি তার সামনে পথ খুলে দিয়েছি, সে চাইলে কৃতজ্ঞ হবে অথবা হবে অকৃতজ্ঞ। (সুরা দাহর, আয়াত ৩)
(৩) সৃজনশক্তি।
যেমন ইরশাদ আছে—عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ یَعْلَمْؕ
মানুষকে আমি এমন কিছু শিখিয়েছি যা সে জানত না। (সুরা আলাক, আয়াত ৫)
فَتَبٰرَكَ اللّٰهُ اَحْسَنُ الْخٰلِقِیْنَؕ
সৃজনশীলদের (খালেক) মধ্যে আল্লাহ সর্বোত্তম সৃজনশীল। (সুরা মুমিনুন, আয়াত ১৪)
কোরআনের এই আয়াত আল্লাহ ছাড়াও ‘খালেক’ বা সৃজনশীল সত্তার অস্তিত্বের কথা জানান দেয়। এবং সেই সৃজনশীল সত্তাদের এক প্রকার হলো মানুষ, এই গুণই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। সুতরাং যেই লোক তার ভেতরকার সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তুলতে পারে না, তার জীবনজনম আর দশটা প্রাণীর মতো খাওয়া-ঘুম আর খাওয়া-ঘুমের আশ্রয় খোঁজাতেই কাটে। তার আর ‘মানুষ’ হওয়ার পথে যাওয়া হয় না।
মানুষের অন্যান্য সব বৈশিষ্ট্য এই তিন বৈশিষ্ট্যের শাখা-প্রশাখা। সৃজনশীলতা ও স্বাধীন ইচ্ছার সাহায্যেই মানুষ এমন জিনিস সৃজন করতে পারে যা আগে অন্য রূপে ছিল। যেমন আল্লাহ গাছ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু মানুষ তার সৃজনশক্তি কাজে লাগিয়ে নৌকো খাট-পালঙ্ক ও বাড়ি বানায়। জমিনে আল্লাহ লোহার খনি রেখেছেন, মানুষ তা উত্তোলন করে গলিয়ে মেশিনের আকৃতি দিয়েছেন, নিজ মেধা খাটিয়ে সেই মেশিনে চলার শক্তি জুগিয়েছেন। এবং এই সৃজনশক্তির ফলেই মানুষ আল্লাহর খলিফা।
যেই জিনিস মানুষ হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক সেই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে আপন সত্তাকে বিকশিত করা। মনুষ্য প্রজাতিকে কোনো কোনো প্রতিবন্ধকতা ‘মানুষ’ হতে দেয় না— কোরআনে বিভিন্ন জায়গায় এই ধরনের প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। হজরত ইবরাহিম (আ) -এর মতো আমাদেরও উচিৎ সেসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। ইবরাহিম (আ) নিজ বোধ ও খুদিকে এমনভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন যে, তার চারদিকে মহাশক্তিধর নমরুদের অভেদ্য কালো বেষ্টনী থাকলেও তিনি সব ভেঙেচুরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং নমরুদের মুখের ওপর বলেছিলেন— গোলামি কেবল এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর।
তার পিতা ছিল মূর্তিপূজকদের নেতা, আর তিনি তার স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের ফলে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার কিছু মানুষের নন বরং সারা পৃথিবীর মুত্তাকিদের ইমাম নির্বাচিত হয়েছেন, এবং তার ঔরসজাত সন্তানদের মধ্যে শত-শত নবী ও রসুল প্রেরিত হয়েছে।
কোরআনে বর্ণিত ইবরাহিম (আ) -এর ঘটনা মনুষ্যজাত থেকে মানুষ হওয়ার একটি নমুনা। মানুষ যেন ইবরাহিম (আ) -এর মতো নিজের ভেতরকার এই তিন বৈশিষ্ট্যকে সমানুপাতে জাগিয়ে তোলে— হেদায়েত, স্বাধীন ইচ্ছা ও সৃজনশক্তি। একজন হেদায়েত পেল কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছা ও সৃজনশক্তির ব্যবহার করল না, অথবা সৃজনশক্তি ব্যবহার করল কিন্তু হেদায়েত ও স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করল না— এমন যেন না হয়। এই তিন বৈশিষ্ট্য সমানুপাতে যেন ব্যবহার হয় আল্লাহ নিজেই তাই দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন— ‘রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানা।’ হে আমার প্রভু! আমাকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন, আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন। (সুরা বাকারা , আয়াত ২০১)
আল্লাহ রব্বুল আলামিন যেন উভয় জাহানের জন্য আমাদের কবুল করে নেন। আমিন।