[আল্লামা ইকবালের জন্ম দিবস উপলক্ষে একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। এটি ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক লিটারেচার অফ ইন্ডিয়া’র সভাপতি ডক্টর শাহ রাশাদ উসমানি লিখিত ‘একিসওয়া সদী মেঁ ইকবাল কে ফিকির কী আহমিয়্যত ও মানাবিয়্যত’ শীর্ষক নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ। স্বল্প অথচ সারগর্ভ আলাপে লেখাটিতে উঠে এসেছে ইকবালের মনন-চিন্তার গঠন ও বিবর্তনে বিশেষত আল কুরআনের ভূমিকা এবং আজকের এই সময়েও তাঁর সমান প্রাসঙ্গিকতার কথা।]
আল্লামা ইকবাল ছিলেন তার সময়ের একজন জিনিয়াস ব্যক্তিত্ব, যিনি একজন ইসলামি চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং উর্দু কবিতার তৃতীয় মাইলফলক, মহান ও সর্বজনীন কবি হিসেবে বিশিষ্ট অবস্থান অধিকার করে আছেন। যিনি তাঁর পরবর্তী পুরো উর্দু কাব্যধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলেন, যাঁর পদরেখা অনুকরণ করে আধুনিক উর্দু কবিতার কাফেলা এগিয়ে চলেছে। ইসলামি সাহিত্যানুরাগীদের জন্য তো ইকবাল চিন্তা ও শিল্পের উৎস এবং আদর্শ রোল মডেল হিসেবে হাজির হয়েছেন। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ইকবালকে কোন্ জিনিস মহত্ত্ব প্রদান করে– এমন প্রশ্নের সর্বোত্তম উত্তরটি দিয়েছিলেন সৈয়দ আবুল আলী মওদূদী। ১৯৯১ সালের মে মাসে, লাহোরের মাসিক ‘সায়্যারাহ পত্রিকা’র ইকবাল সংখ্যায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন–
‘এই সময় এমন একজন মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন ছিল যিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা নিয়ে গর্বিত সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি শিক্ষিত হবেন এবং তাদের চেয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার উপর তার থাকবে অধিক দখল, এবং অতঃপর তিনি ইসলামী আদর্শকে এমন সুদৃঢ়ভাবে সমর্থন করবেন যে, পশ্চিমাগ্রস্ত লোকেরা যার সামনে কথা বলার সাহস পায় না। আল্লামা ইকবালের আসল কৃতিত্ব হলো যে, পাশ্চাত্য জ্ঞান ও শিল্পের আধিপত্য এবং বর্তমান যুগে ইসলাম চলতে পারে না বলে একটি সাধারণ বিশ্বাস ছিল বিধায় ইসলামকে পশ্চিমা সভ্যতার সাথে আপোষ করা এবং ইসলামী আদর্শকে পাশ্চাত্য মতাদর্শের সাথে মিলিয়ে নেওয়া প্রয়োজন’, আল্লামা ইকবাল এই ধারণাকে ভেঙে দেন। এই অর্থে তখন ইসলামি আন্দোলনের জন্য ইকবালের ব্যক্তিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট ছিল। একজন ব্যক্তি তাঁর সকল মতামতের সাথে একমত হবেন–এটা জরুরি নয়, তবে সামগ্রিকভাবে ইকবাল যে পরিষেবা প্রদান করেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যায়নযোগ্য।’
এভাবে আল্লামা ইকবাল বিংশ শতাব্দীতে ইসলামি নবজাগরণের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় এবং সাহিত্য ও কাব্যের ইসলামি দবিস্তান হয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
আল্লামা ইকবাল যখন পৃথিবীতে দৃষ্টি মেলেন, তখন পশ্চিমা সভ্যতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। দাসবৃত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতারা জাতির মধ্যে মানসিক দাসত্বও তৈরি করে দিয়েছিল ইতোমধ্যে। পশ্চিমা ঝড়-ঝঞ্ঝার অভিঘাতে অধিকাংশ মানুষ হীনমন্যতায় ভুগছিল। এমন পরিস্থিতিতে আল্লামা ইকবালের আবির্ভাব জগতসংসারের এক অনন্য ঘটনা বটে। শুরুতে অবশ্য পশ্চিমা শিক্ষার কারণে তিনি পশ্চিমা শিক্ষায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। ইউরোপে ভ্রমণকালে তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতিটি দিক খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। পাশ্চাত্য সভ্যতার সাগরে যতই তিনি ডুব দিয়েছেন, ততই এর অন্দরে লুকিয়ে থাকা সংকটগুলো তার সামনে আবিস্কৃত হয়েছে। এবং, এভাবে তিনি পাশ্চাত্যপ্রভাব থেকে সরে এসে ইসলামের হক্কানিয়্যত ও সত্যতায় বিশ্বাসী ও নিবেদিত হতে থাকেন।
ইকবাল পনেরো বছর ধরে একটানা কুরআন অধ্যয়ন করেন। এবং তা নিয়ে নিরন্তর ‘তাদাব্বুর’ করতে থাকেন, যতক্ষণ না তিনি সমসাময়িক সকল সমস্যার সমাধান এবং পাশ্চাত্য বিদ্বানদের দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র কুরআন থেকেই খুঁজে পান। তাই ইকবাল-সাহিত্য মূলত এই কুরআনিক আবিষ্কারের ব্যাখ্যা ও বয়ানেরই অন্য রূপ। সাজ্জাদ আনসারি ভাবাতিশয্যে কী সুন্দর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন–
‘ইকবাল পড়লে আল্লাহকে মনে পড়ে। আমি বিশ্বাস করি, কুরআন নাযিল যদি না হতো, তবে হয় মাওলানা আজাদের গদ্য নাহয় আল্লামা ইকবালের কাব্য এর জন্য বেছে নেওয়া যেত।’
বাস্তবতা হলো মাওলানা আজাদের গদ্য এবং আল্লামা ইকবালের কাব্য তাদের বিষয়বস্তুর পাশাপাশি শৈলীর সমস্ত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কুরআনিক শৈলীর এক অপূর্ব নমুনা। বিখ্যাত কুরআন-ভাষ্যকার মাওলানা মওদুদি কুরআনের প্রতি ইকবালের প্রেম ও ভাবাবেগকে নিম্নরূপ বয়ান করেছেন–
‘পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সাগরে পা রাখার সময় তিনি (ইকবাল) যতটুকু মুসলিম ছিলেন। তার অভ্যন্তরে উপনীত হয়ে তাকে আরো বেশি মুসলমান পাওয়া গেল, যতক্ষণ না দুনিয়া দেখতে পেল যে, তিনি কুরআনের ভেতর লীন হয়ে গেছেন এবং কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো চৈন্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অস্তিত্ব তাঁর আর ছিল না। তিনি যা কিছু ভাবতেন, যা কিছু দেখতেন, সবই কুরআনের দৃষ্টি দিয়ে দেখতেন এবং ভাবতেন।’
এই কারণেই ইকবাল বলতে চান– হাকিকত এই যে, পৃথিবীতে আল্লাহর কালাম পাঠ করতে গিয়ে যার অন্তরলোকে নুযূলে কিতাবের হালত তৈরি হয়, বুঝতে হবে যে, কাঙ্ক্ষিত রত্নটি তার মিলে গেছে। কারণ এই গ্রন্থ জ্ঞানের সাগরও, জ্ঞানের ভান্ডারও। ড. হাসান রেজার ভাষ্যানুসারে–
‘ইকবাল চিন্তা ও মননের বিকাশের রহস্য হলো– ওহী তথা ঐশী প্রত্যাদেশের দীপ্তিকে জ্ঞানের মাধ্যম হিসেবে আকলের হাওলা করে দেওয়া উচিত নয়, বরং মানুষের উচিৎ বুদ্ধিকে ঐশী প্রত্যাদেশের হাওলা করা, যাতে তা পরিশুদ্ধ হতে থাকে।’
আজ একবিংশ শতাব্দীতে প্রশ্ন উঠানো হচ্ছে যে, এই পরিবর্তিত পরিবেশে, নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইকবালের চিন্তা ও শিল্পের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কী? বলা হচ্ছে, ইকবালের চিন্তা-চেতনা সেকেলে ও অপাঙ্তেয় হয়ে গেছে। আমরা আজ যে নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, তার সামনে ইকবালের তত্ত্বগুলো ব্যর্থ। তিনি আর আমাদের সঙ্গ দিতে সক্ষম নন। কিন্তু সত্য হলো, সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইকবালের চিন্তাধারা আজ আমাদের কাছে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা ছিল তাঁর সময়ে। ডক্টর আনোয়ার আলীর উদ্ধার–
‘ইকবালের নিকট এটা সম্ভব যে, যখন মুসলিম উম্মাহ ইসলামের নীতি অবহেলা করবে, তখন তাকে খিলাফত ও ইমামতের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু যখনই সে সঠিক ধর্মীয় চেতনা নিয়ে ইসলামের জন্য জেগে উঠবে, তখন এই বিশ্বে পুনরায় সে-সব কিছুই প্রকাশ পাবে, যা খোলাফায়ে রাশিদীনের যুগে দুনিয়া প্রত্যক্ষ করেছিল।’
বর্তমান পুঁজিবাদ এবং সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদ বিশ্বমানবতার শান্তি ও শৃঙ্খলা ধ্বংস করে দিয়েছে। স্বার্থপরতা ও প্রবৃত্তিপূজা মানুষকে পশুর চেয়েও বিপজ্জনক করে তুলেছে। এটা সন্ত্রাস ও বর্বরতা, অনাচার ও সহিংসতার যুগ। বস্তুতপক্ষে, আজকের বিপর্যস্ত মানবতা এমন একটি প্রতিকারের সন্ধানে রয়েছে, যা তার সমস্ত ক্ষত সারাতে সক্ষম হবে। ইকবাল এ বিষয়ে গভীরবোধে সচেতন যে, আজকের তাবৎ যন্ত্রণার একমাত্র এবং একমাত্র নিরাময় হলো– ‘ইসলাম’। এবং তাঁর অকম্পিত প্রত্যয়, শান্তি ও সুখের এই যুগ অবশ্যই আসবে। তাই তাঁর স্পষ্ট অভিপ্রকাশ–
‘রাত কেটে যাবে অবশেষ, সূর্যালোকের দীপ্তিতে,
ভরে উঠবে এই পরিবেশ, তাওহীদের লহরীতে!