Allama Iqbal

শায়েরে মাশরিক আল্লামা ইকবাল বিশ্বের মহান কবিদের শ্রেষ্ঠ একজন হিসেবে পরিগণ্য। আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ প্রতিভা ও ফজলে তিনি তাঁর সময়ের কবিদের চেয়ে ছিলেন আলাদা। দর্শননির্ভর শিল্পসফল কাব্যচর্চায় তার স্থান ছিল অন্যান্যদের চেয়ে অতুলনীয় উচ্চতায়।

ইকবালের সমুদয় কালাম পাঠ করার পর, যে সহজ পয়গামটি একজন সাধারণ মানুষেরও বোধগম্য হবে, তা হলো– মানুষকে তার সুপ্ত সামর্থ্য ও শক্তিগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে, সেগুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে এবং সর্বোপরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে ইশক ও ভালোবাসা এবং আনুগত্যের সম্পর্কে তৈরি করতে হবে।

প্রফেসর ইউসুফ সেলিম চিশতী তার “শরহ জারবে কলীম” গ্রন্থে (৪৩০ পৃষ্ঠা) লিখেছেন, আল্লামা ইকবালের কাব্যিকতা বা তাঁর ধর্মীয় চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাসুলপ্রেম এবং তা ছিল তাঁর জীবনপুঁজি। বলা বাহুল্য একজন মুমিন-মুসলিমের এমনটা না হয়ে গত্যন্তরও নেই। হাদিসে এসেছে–“তোমাদের কেউই মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি (রাসুল সা.) তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হবো।”

می ندانی عشق ومستی ازکجا ست؟

ایں شعاع آفتاب مصطفیٰ ؐست

زندہ تا سوزِ اُو در جان تست

ایں نگہ دارندہ ایمان ِ تست

অর্থাৎ ইকবাল বলেন, তুমি কি জানো প্রেম ও আনন্দ কোথা থেকে আসে? (এই প্রেম ও আনন্দ) সরদারে দোজাহাঁ রাসূল সা. এর পবিত্র সূর্যের উত্তাপ। যতক্ষণ এই সূর্যের উত্তাপ তোমার আত্মায় বিরাজমান, ততক্ষণ তুমি জীবন্ত। এবং এই উত্তাপ তোমার ঈমানের রক্ষাকারী!

অন্য কবিতায় –

دردل ِمسلم مقام مصطفیٰؐ است

آبروے ما ز نا مِ مصطفیٰؐ است

طور، موجے ازغبارِِخانہ اش

کعبہ رابیت الحرم کا شانہ اش

کمتراز آنے زاوقاتش ابد

کا سبِ ِافزایش ازذاتش ابد

بوریا ممنون خواب راحتش

تاجِ کسریٰ زیرِ پا ئے اُمتش

درشبستان حرا خلوت گزید

قوم و آئین و حکومت آفرید

ইকবাল বলছেন– “মুস্তাফার স্থান মুসলমানদের হৃদয়ে। আমাদের সম্মান তাঁর বরকতময় নামে। তূর পর্বত তাঁর সমুদ্রের সামনে একটি ঢেউ মাত্র। আর তাঁর বরকতময় কাঁধ পবিত্র কাবাঘরের জন্য বায়তুল হারামের মর্যাদার সমতুল্য। এবং ‘আবাদ’ রাসুল সা.-এর সময়ের একটি মুহূর্তসমানও নয়। সেটি তাঁর সান্নিধ্যে ধন্য হয়। চাটাই তাঁর আরামনিদ্রার কাছে হয়েছে ঋণী। কিসরার মুকুট তাঁর উম্মতের পদতলে পায় শোভা। রাসুল সা. গুহায় নির্জনতা এখতিয়ার করেছেন এবং অতঃপর বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন একটি মহান জাতি, একটি মহান সংবিধান এবং একটি মহান হুকুমত!”

প্রাগুক্ত কবিতাগুলো রাসুল সা.-এর প্রেমনিবেদনে ও গুণকীর্তনে, উপমা-উৎপ্রেক্ষায় যে উচ্চতর ভাব ও ব্যঞ্জনা লাভ করেছে, তা যেকোনো আহলে দিল, আশিকে রাসূলের ভেতর জাগিয়ে তুলবে বিমল প্রশান্তির অনুভূতি এবং আত্মগৌরবের সুমহান উপলব্ধি!

ফকির সৈয়দ ওয়াহিদ উদ্দিন তার “রোজগারে ফকির” গ্রন্থে ইকবালের ইশক রাসুল সম্পর্কে অসামান্য মন্তব্য করেছেন। লিখেছেন: ‘প্রয়াত ডক্টর মুহম্মদ ইকবালের জীবনী ও জীবনের সবচেয়ে বিশিষ্ট, প্রিয় এবং মূল্যবান আবেগ হলো রাসুল সা. এর প্রেম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর যে ভক্তি-অনুরাগ, তা তাঁর চোখের ভেজা কোমলতায় প্রতিফলিত হত। এবং যেখানেই কেউ তাঁর সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উল্লেখ করেছেন, তিনি ভাবাবেগে অভিভূত হয়ে যেতেন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর চোখে অশ্রু বয়ে পড়ত।’

তিনি আরও লিখেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম এবং তাঁর আলোচনা আসা মাত্রই ইকবাল আত্মসংযমের বাইরে চলে যেতেন। তাঁর কাব্যিকতার খোলাসা, সারসত্তা ও নির্যাস হলো, ইশকে রাসূল এবং এতাআতে রাসূল তথা রাসুপ্রেম এবং তাঁর আনুগত্য। ডক্টর সাহেবের সান্নিধ্যে আমি রাসূলের ইশক ও ভালোবাসার যে অভিব্যক্তি দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।’

ইকবাল যেমন নিজে একজন আশিকে রাসূল ও সত্যিকারের রাসূল প্রেমিক ছিলেন। তেমনি তিনি চাইতেন সকল মুসলমান রাসুল সা.-এর প্রকৃত প্রেমিক হয়ে উঠুক এবং তাঁর সুন্নাহের পথ অনুসরণ করুক। কারণ, এতেই মুসলমানের ইহ ও পরকালের প্রকৃত কল্যাণ ও সাফল্য নিহিত আছে। ইকবালের ভাষায়–

ہر کہ عشقِ مصطفیٰؐ سامانِ اوست

بحر وبر درگوشئہ دامانِ اوست

‘প্রত্যেক ব্যক্তি যার অন্তর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা অর্জন করেছে, নিঃসন্দেহে সে এই দুনিয়ার অধিকারী।’

আল্লামা ইকবাল যে অন্তকরণ নিয়ে জন্মেছেন, তার তৃপ্তি ও তুষ্টির জন্য রাসুল সা.-এর এমন ইশক ও উত্তুঙ্গ ভালোবাসার প্রয়োজন ছিল। পবিত্র হারামাইনের যিয়ারত করার ইচ্ছা ইকবালের আজীবন ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি হজ্ব করতে পারেননি। তবে তাঁর চিন্তালোকে তিনি সর্বদাই এই আশীর্বাদ অর্জনে ধন্য হয়েছেন। ‘আরমাগান হিজায’, যেটি ইকবালের শেষ গ্রন্থ এবং নভেম্বর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে। এতে এমন অনেক রুবাইয়াত রয়েছে, যা দেখায় যে, ইকবাল তার কল্পনার জগতে নিরন্তর হিজাজের সফর করে চলছেন। চিন্তার গভীরতা আর ভালোবাসার তীব্রতা এসব রুবাইয়াতের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাসুল সা.-এর শিরোনাম দিয়ে শুরু হওয়া অধ্যায়ের একটি রুবাইয়াতে তিনি বলেছেন, আমি রাসুলের প্রেমে মত্ত হয়ে প্রেমের গান গাইতে শুরু করেছি এবং এই বৃদ্ধ বয়সে মদীনার পথ ধরেছি— সেই পাখির ন্যায়, যে সন্ধ্যায় আপন নীড়ে ফেরার চিন্তায় ডানা মেলে উড়াল দিয়েছে। তাঁর ভাষায় :

با یں پیری رہ یثرب گرفتم نواخواں ازسرورعاشقانہ

چو آں مرغے کہ درصحرا سرشام کشاید پر بفکر ِ آشیانہ

ইকবালের কাব্য-কালাম থেকে এ হাকিকত স্পষ্ট হয় যে, ইকবালের রাসুলপ্রেম ছিল ‘ইশক’ পযার্য়ে উপনীত এবং নিঃসন্দেহে এই ইশকে রাসূল ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে গভীর, শক্তিশালী ও চিরস্থায়ী আবেগ; যার সাথে তার সকল মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক যুক্ত ছিল।

এই কালের অধঃস্থিত ও দিকভ্রান্ত মুসলিম জাতির উদ্ধার ও উত্তরণ নিশ্চিত করতে পারে একমাত্র এই ইশক রাসুল এবং এত্তেবায়ে রাসুল— এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ইকবাল। তিনি লিখেছেন–

بمنزل کوش مانندِ مہِ نو دریں نیلی فضاہر دم فزوں شو

مقام ِ خویش اگر خواہی دریں دیر بحق دل بند وراہِ مصطفی رو

“মুসলমানগণ! তোমরা নতুন চাঁদের মতো তোমার গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করো। এই নীল আকাশে প্রতি মুহূর্তে বাড়তে থাকো। যদি তুমি এই জগতে নিজের হারানো মান ও মাকাম পুনরুদ্ধার করতে চাও, তবে আল্লাহর সাথে অন্তরঙ্গতা গড়ে তুলো এবং মুহাম্মদ মোস্তফার পথ অনুসরণ করো।”

জওয়াবে শিকওয়া’য় আল্লামা ইকবাল বলেন–
کی محمد سے وفا تونے تو ہم تیرے ہیں

یہ جہاں چیز ہے کیا لوح وقلم تیرے ہیں

তোমরা মুহাম্মদ সা. এর আদর্শ আঁকড়ে ধরলে বিজয় তোমাদের হবেই এবং তোমাদের হাতে ধরা দেবে তোমার ভাগ্য। এ পৃথিবী কেন, এর চেয়ে অধিক কিছু হবে তোমাদের জন্য।

বর্তমানে আমরা রাসুল সা.-এর প্রেম ও ভালোবাসাকে তুচ্ছ মনে করছি। এবং সন্দেহ নেই এ কারণেই আজকের পৃথিবীতে আমরা এতটা অপমানিত ও অপদস্থ। আমরা যদি আমাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসাকে লালন করি এবং আমাদের কাজে-কর্মে, আচরণে-আমলে তা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে পৃথিবীতে আগের মতো সম্মানিত ও মহিমান্বিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই বিশ্বজগতে সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের একমাত্র কারণ রাসূল সা. এর ইশক ও ভালোবাসা। ইশক ও প্রেমের এই ভাবাবেগ যদি দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তবে সবকিছুই শূন্য এবং অনর্থক হয়ে যাবে।

লেখক পরিচিতি: কাজী একরাম
লেখক,
গবেষক
অনুবাদক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *