ইবনে রুদ-এর জীবন ও কর্ম- মোহাম্মদ শওকত হোসেন

মুসলিম মনীষীদের মধ্যে যাঁর প্রভাব পাশ্চাত্যে সর্বাধিক তিনি হলেন ইবনে রুশদ। তাঁর পুরো নাম আবুল ওলিদ মোহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে রুশদ। স্পেনের কর্ডোভা নগরে ১১২৬ খ্রীঃ (হিজরী ৫২০) ইবনে রুশদ জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক দিক দিয়ে স্পেনে তাঁদের ব্যাপক সম্মান ছিল। তাঁর পিতা ও পিতামহ উভয়ই কর্ডোভার বিচারক (কাজি) ছিলেন।

ইবনে রুশদ-এর শিক্ষা জীবন তাঁর জন্মস্থান কর্ডোভায়ই শুরু হয়। শৈশব থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধা ও মননশীলতার পরিচয় দেন। তিনি আরবী ভাষা ছাড়াও গ্রীক এবং হিব্রু ভাষাতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করার পর ইবনে রুশদ একাধারে কোরআন, হাদীস, ফিকাহ, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও চিকিৎসাবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তবে একজন চিকিৎসাবিদ ও দার্শনিক হিসেবেই তিনি সবচেয়ে বেশী সুনাম ও সম্মান লাভ করেন। তিনি জ্ঞানের সাধনায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করতেন। তৎকালীন যুগের কোন বিশিষ্ট লেখকের লেখা তাঁর কাছে অপরিচিত ছিল না। তিনি সবগুলো পড়তেন এবং তাঁর পর্যালোচনা করে পঠিত পুস্তকে নিজ হাতে মন্তব্য লিখতেন। তাঁর পাঠাভ্যাস এত বেশি ছিল যে, সত্তর বছর বয়সেও তিনি নাকি নিয়মিত ষোল ঘন্টা অধ্যায়ন করতেন। কথিত আছে যে, পিতার মৃত্যুর রাত এবং নিজের বিবাহের রাত ব্যতীত অন্য কোন রাতই তিনি একটা বিশেষ সময় পর্যন্ত অধ্যায়ন না করে অতিবাহিত করেন নি।

কর্ম জীবনের শুরুতেই তিনি ১১৭২ সালে কর্ডোভার প্রধান বিচারপতির আসন অলংকৃত করেন। একজন দক্ষ ও বিচক্ষণ আইনজীবী হিসেবে এ সময় তাঁর খ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জ্ঞান সাধনায় ব্যঘাত সৃষ্টি হওয়ার কারণে কিছু দিনের মধ্যে তিনি এই পেশা ত্যাগ করেন।

ইবনে রুশদ-এর প্রথম খ্যাতি আসে একজন চিকিৎসাবিদ হিসেবে। তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় এত বেশী পারদর্শিতা অর্জন করেন যে, দূর-দূরান্ত থেকে বহুলোক, এমনকি প্রখ্যাত চিকিৎসকেরাও, তাঁর চিকিৎসা-পদ্ধতি শিক্ষা করার জন্য তাঁর কাছে ছুটে আসতেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর তিনি বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ‘কুল্লিয়াত ফিল-তিবব’। এই গ্রন্থটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যাপক প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। ইহাতে বহু রোগের লক্ষণ এবং তাঁর প্রতিকারের বিস্তৃত বিবরণ বিদ্যমান রয়েছে। পাশ্চাত্যে প্রায় সর্বত্রই এই গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে পঠিত হয়েছে। ‘বসন্ত রোগ কারো দুইবার হয়না’- এই অভিমতও তিনি এই গ্রন্থেই প্রকাশ করেছিলেন। চিকিৎসা বিদ্যায় তাঁর ব্যপক পারদর্শিতার প্রতি লক্ষ্য করে ১১৮২ সালে তিনি মারাকেশে খলীফা আবু ইয়াকুব ইউসুফ কর্তৃক আমন্ত্রিত হন এবং রাজ-চিকিৎসক দলের অন্তর্ভুক্ত হন। ১১৮৫ খ্রীঃ বিশিষ্ট দার্শনিক ও চিকিৎসাবিদ ইবনে তোফায়েলের মৃত্যুর পর তাঁর স্থলে ইবনে রুশূদকে রাজ-চিকিৎসক দলের প্রধান করা হয়।

ইতোমধ্যে ইবনে রুশদ-এর দার্শনিক চিন্তার বহি:প্রকাশ ঘটতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে একজন দার্শনিক হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই নাম সর্বদা তাঁর জন্য শুভ ছিল না। কেননা নামের চেয়ে দুর্নামের পরিমাণই ছিল বেশী। গ্রীক দর্শন, বিশেষ করে এ্যারিস্টটলের উপর, তাঁর যে সকল লেখা প্রকাশ পায় তাঁর সঠিক মর্ম ও তাৎপর্য বুঝতে অনেকেই অসমর্থ ছিলেন। ইসলামী শরিয়তের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর আলোচনাও তদ্রুপ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। ইবনে রুশূদ ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস নেন। এই প্রয়াস সর্বমহল থেকে কমবেশী সমালোচনার শিকার হয়। মুসলমানরা একে ইসলাম বিরোধী তত্ত্ব হিসেবে পরিগণিত করেন। অনেকেই তাঁকে কাফের এবং মোনাফেক বলেও মন্তব্য করেন। একই সাথে খৃস্টান ধর্মবেত্তারাও পাশ্চাত্যে তাঁর বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করেন। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা তাঁকে ‘পাপের প্রতিশব্দ’ বলে মন্তব্য করেন। এই দুই শ্রেণীর প্রতিবাদ ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, ইবনে রুশদ ১১৯৫ সালে খলিফা কর্তৃক কর্ডোভার নিকটবর্তী ‘ইলিসাস’ নামক স্থানে নির্বাসিত হন। এবং তাঁর অংকশাস্ত্র, পদার্থ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও চিকিৎসা শাস্ত্র ছাড়া অন্য সকল গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়।

ইবনে রুশদ সবচেয়ে বেশী দুর্নাম কুড়িয়েছিলেন তাঁর Tahafur al-Tahafut নামক গ্রন্থের জন্য। এই গ্রন্থে তিনি ইমাম আল-গাযালী ও মুসলিম দার্শনিকদের মতবাদের সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ইসলামের বেশ কিছু বিষয়কে অহেতুক যুক্তির জালে আবদ্ধ না করে তাকে ভিন্ন আংগিকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখানো। এ বিষয়ে তিনি ইমাম আল-গাযালীকেও দোষারোপ করেন। তাছাড়া তিনি অকাট্য যুক্তির যে খেলা এই গ্রন্থে দেখিয়েছেন তাতে ধর্মতত্ত্বও অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীন যুক্তির কাছে আপাত বিতর্কিত অবস্থায় নিপতিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই বিষয়টিকে গোড়া ধার্মীক শ্রেণীর লোকেরা এবং কিছু মন্দ লোকেরা ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করে তাঁকে নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী, মোনাফেক ইত্যাদি বলে অবহিত করেন। কিন্তু এই Tahafut al-Tahafut গ্রন্থেরই শেষ কথাটি ছিলঃ

“God knows every single letter, and perhaps God will accept my excuse and forgive my stumbling in His bounty, generosity, munificence and excellence- there is no God but He!”

যাইহোক, অবশেষে ১১৯৮ সালে খলিফা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ইবনে রুশদকে আবার দরবারে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং পূর্বপদে বহাল করেন। কিন্তু এসময় তাঁর পরমায়ু প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্রচন্ড মানসিক কষ্ট, এমনকি অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পতিত হয়ে নির্বাসনকালে তাঁর শরীর একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। তাই তাঁকে ফিরিয়ে আনলেও আর বেশী দিন এই প্রতিভাকে ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। মাত্র কয়েক মাস পরে ১১৯৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর এই মহামানব ইহকাল ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র :

১. আবদুল মওদুদ, মুসলিম মনীষা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৪, পৃঃ ১৪৯

২. উক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৪৮ ১৪৯।

৩. মাওলানা মোঃ ফজলুর রহমান আশরাফী, বিশ্বের মুসলিম মনীষীদের কথা, আর, আই, এস,পাবলিকেশন, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃঃ ৬৫
৪. উক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৬৫

৫. ডঃ রশীদুল আলম, মুসলিম দর্শনের ভূমিকা, সাহিত্য সোপান, বগুড়া, ১৯৯৫, পৃঃ ৪৬৩ দেখুন।

৬. Averroes, Tahafut al- Tahafut, P. 363.

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *