আল-গাযালীর জীবন ও কর্ম -মোহাম্মদ শওকত হোসেন
মানুষ সসীম জীব। জীবকুলের মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ হলেও মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, শক্তি সামর্থ্য ইত্যাদি সবকিছুতেই রয়েছে সীমাবদ্ধতা। একই মানুষের মধ্যে তাই বিভিন্ন ধরনের গুণাবলীর সমন্বয় বাস্তবিকপক্ষেই বিরল। কিন্তু এ ধরাধামে এমন কিছু অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে যাঁরা এক কথায় বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ইমাম আল গায়ালী ছিলেন এমন একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী মহান মনীষী।
তিনি ছিলেন একাধারে ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, কবি, সূফী সাধক ও সমাজ সংস্কারক। মেধা ও সাধনা, তত্ত্ব ও অনুশীলন, বিশ্বাস ও যুক্তির এক অপূর্ব সুসমন্বয় ঘটেছিল তাঁর জীবনে। জগতে অনেক মেধাবী মানুষের আবির্ভাব হয় যাঁরা তাঁদের মেধার উপযুক্ত ব্যবহার করেন না, অথবা তাঁদের মেধা পুরোপুরি সৎ উদ্দেশ্যে ব্যয়িত হয় না। ইমাম আল-গাযালী ছিলেন অসাধারণ মেধাবী এবং কঠোর অধ্যাবসায়ী । এবং তিনি তাঁর মেধা ও মননের সম্পূর্ণ অংশই ব্যয় করেছিলেন সৎকাজে। এমন অনেক বিখ্যাত মানুষ জগতে আসেন যাঁরা অনেক মূল্যবান কথা বললেও নিজের জীবনে তা পালন করেন না। কিন্তু ইমাম আল-গাযালী ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি কেবল উপদেশ দেন নি; বরং নিজের জীবনে তা তিনি পালনও করেছেন। তিনি নিজেই ছিলেন সত্য-সুন্দর-আদর্শের এক মূর্ত প্রতীক। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ইমানী শক্তিতে শক্তিমান একজন কামেল ব্যক্তি। কিন্তু দার্শনিক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ যুক্তিবাদী এবং সংশয়বাদী। তাঁর মতে, মানবীয় জ্ঞানে সুনিশ্চিত সত্য লাভের কোন নিশ্চয়তা নেই। মানুষের রয়েছে স্বভাবজাত সীমাবদ্ধতা। গাযালীর মতে, একমাত্র প্রত্যাদেশই হচ্ছে যথার্থ বা সুনিশ্চিত জ্ঞান। তাঁর দার্শনিক আলোচনার বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস নিয়েছেন।
এই মহান সাধক-পুরুষ ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসান নামক প্রদেশের অন্তর্গত ভুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম হচ্ছে আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে-ভাউস-আহম্মদ আল-তুসী আল-শাফী আল-নিশাপুরী। ‘গাযালী’ তাঁর মূল নাম নয়—উপাধি। তবে কেন তাঁকে গাযালী বলা হয়, এ বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কোন কোন গবেষকদের মতে, তাঁর জন্মপল্লী ‘গাযালা’-এর নামানুসারেই তিনি এই গাযালী উপাধি ধারণ করেন। আবার কোন কোন গবেষকদের মতে, গাযালী তাঁর বংশগত উপাধি। তাঁর পিতৃকুল পশমের ব্যবসা করতেন। ‘গাযযাল’ শব্দের অর্থ পশম।
এই পশম বুনন ও বিক্রয়ের বংশানুক্রমিক পেশার কারণে তাঁকে গাযালী বলা হয় বলে অনেকের ধারণা। তবে গাযালী নিজে কখনও এই পেশা গ্রহণ করেন নি। তাই অধিকাংশ গবেষক এই পেশাগত কারণে ‘গাযালী’ নামকরণ হওয়ার বিষয়টি সঠিক মনে করেন না।
গাযালীর পিতা ছিলেন দরিদ্র, কিন্তু অত্যন্ত ধর্মভীরু সূফী সাধক এবং জ্ঞান পিপাসু। বাড়ীতে জ্ঞানী-গুণী ও সাধক পুরুষদের জলসা হত প্রায়ই। গাযালী তাই শৈশব থেকেই অত্যন্ত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে মানুষ হন। একজন বিশিষ্ট সূফী সাধকের নিকট গাযালী প্রাথমিকভাবে কোরআন, হাদিস এবং অন্যান্য সহায়ক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর বিদ্যা চর্চার সূচনা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর পিতাকে হারান। এর পরে তিনি জুরজান ও তুস নগরীতে যথাক্রমে আবু নসর এবং শেখ আহম্মদ আল-তুসীর নিকট বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। এই সময়ে তাঁর শিক্ষা জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি হল: একবার বিদ্যা-শিক্ষার কারণে তিনি জুরজান থেকে তুসে প্রত্যাবর্তনের সময় পথিমধ্যে দস্যুদল কর্তৃক আক্রান্ত হন। দস্যুরা তাঁর টাকা-পয়সা, সরঞ্জামাদি, পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুই কেড়ে নেয়। তিনি দস্যুদলকে সবকিছু নিয়ে যেতে বললেন; কিন্তু এই সবকিছুর বিনিময়ে তিনি তাঁর নোট বইগুলি (ক্লাশ নোট) ফেরত চাইলেন। তখন দস্যু সরদার উপহাস করে বলেছিলেন:
“তোমার বিদ্যা যখন আমরা লুট করেছি তখন এ বিদ্যা আর তোমার নয়। এ বিদ্যা এখন আমাদেরই। এগুলো হারিয়ে তুমিতো নিরেট মূর্খ হয়ে গেলে! যার বিদ্যা পুঁথিতেই আবদ্ধ তাকে আবার বিদ্যান বলে নাকি?”
দস্যুর এ ধরনের শেষ বাক্য শেলের মতো গাযালীর হৃদয়ে বিধলো। তিনি চরম শিক্ষা গ্রহণ করলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, যা কিছু তিনি শিখবেন তা পুঁথিতে নয়, মনের মধ্যেই গেঁথে রাখবেন। এর পর তিনি সারা জীবন এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি যখন যা শিখতেন মুখস্ত করে রাখতেন।
ইমাম আল-গাযালী আবু নসর ইসমাইলের নিকট থেকে কোরআন, হাদিস, ফিকাহ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কিন্তু আরও উচ্চতর জ্ঞানের সন্ধানে তিনি ছুটে যান। নিশাপুরে। তৎকালীন সময়ে নিশাপুর ছিল জ্ঞান সাধনার এক বিখ্যাত কেন্দ্র। এখানে ছিল তৎকালীন যুগের সুবিখ্যাত ‘নিযামিয়া মাদ্রাসা’। গাযালী ১০৭৭ সালে (মতান্তরে ১০৭৮ সালে) নিযামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত পণ্ডিত মা’আলী ইমামুল হারামায়েনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি দর্শন, বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যায়ন করেন।
ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর বিজ্ঞতার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর খ্যাতনামা শিক্ষকরাও তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও মেধার উর্বরতা দেখে বিস্মিত হন, এমনকি কেউ কেউ রিতিমত ঈর্শান্বিত হয়ে পড়েন। তিনি লেখালেখি শুরু করেন এ সময় থেকেই। তাঁর অনেক বিখ্যাত শিক্ষকের লেখার চেয়েও তাঁর লেখা অনেক বেশী প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। এ সময় তিনি মূলত একজন জ্ঞানী ও ক্ষুরধার ভার্কিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করতে থাকেন। তৎকালীন সময়ের সেলজুক সুলতানের উজিরে আযম নিজাম-উল-মূলক রাজদরবারে দেশ বিদেশের জ্ঞানী-গুণীদের নিয়ে যুক্তি-তর্কের আসর বসাতেন। গাযালীকে তিনি সেখানে নিয়মিত আমন্ত্রণ জানাতেন। গাযালী সব আসরেই সবাইকে অবাক করে দিতেন। সকলেই তাঁর জান-বুদ্ধি ও যুক্তিপ্রদান ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে যেতেন।
গাযালীর শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ইমামুল হারামায়েনের মৃত্যু হলে নিজাম-উল-মূলক গাযালীকে নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। গাযালী তখন বয়সে নবীন (মাত্র ৩৪ বছর বয়স)। এই অল্প বয়সেই তাঁর অসাধারণ যোগ্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি এই সম্মানিত পদ লাভ করেন। অধ্যাপনা, লেখা-লেখি, রাজসভায় বিশেষ ভূমিকা পালন ইত্যাদি করে তিনি যেমন সুনাম-সম্মান কুড়াতে থাকেন তেমনি তাঁর বৈষয়িক দিকেরও ব্যাপক উন্নতি হতে থাকে। তিনি অত্যন্ত বিলাসপূর্ণ যাকমঞ্চ জীবন যাপন করার সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু বেশীদিন তাঁর এই পার্থিব সুখ-ঐশ্বর্য ভালো লাগলো না। পরম সত্তার গভীর প্রেমে তাঁর হৃদয় আন্দোলিত হয়ে উঠলো।
১০৯৬ সালের কথা, হঠাৎ একদিন সকল পার্থিব সুখ, ঐশ্বর্য, খ্যাতি ও সম্মান ত্যাগ করে ইমাম আল-গাযালী বেড়িয়ে পড়লেন কোন এক অজানা গন্তব্যে। বিভিন্ন দেশ বিদেশে মুসাফিরের বেশে ঘুরে ঘুরে তিনি জগত ও জীবনের বাতেনী জ্ঞান অর্জন করতে লাগলেন; এবং খোদার সাথে মিলনের ধ্যানে নিজেকে মগ্ন করে রাখলেন। প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে তিনি বেড়িয়ে পড়েছিলেন। দশ বছর পরে ১১০৬ সালে তিনি পুনরায় বাগদাদে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন উযীরে আযম ফখরুল-মূলকের বিশেষ অনুরোধে পুনরায় নিযামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনায় যোগ দেন। এ সময় তিনি ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের আলোকে ব্যাপক লেখালেখি করেন। তিনি একজন খাঁটি সূফী সাধকের মত জীবন যাপন করতে থাকেন। এবং লোকজন তাঁকে একজন মহান দরবেশের মত শ্রদ্ধা-ভক্তি ও অনুসরণ করতে শুরু করে। কিন্তু এসময় তিনি ক্রমশ: ইহজগত থেকে আতিজগতের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন- অগ্রসর হতে থাকেন তাঁর পরম প্রিয়জন খোদার পানে।
১১১১ সালের (৫০৫ হিজরী) ১৮ই ডিসেম্বরের কথা, ইমাম গাযালী তাঁর শিষ্য ও প্রিয়জনদের কাছে ডাকলেন। তারপর তাঁর নিজের কাফনের কাপড় জোগাড় করার নির্দেশ দিলেন। অত্যন্ত শান্ত চিত্তে তিনি তাঁর নিজের কাফনের কাপড়ে চুম্বন করে বললেনঃ “হে আল্লাহ্! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমিতো রহমান এবং রাহীম। হে খোদা! একমাত্র তোমাকে পাবার জন্যে এবং তোমার স্বরূপ বোঝার জন্যেই আমি সকল আরাম আয়েশ ত্যাগ করে ঘুরে ফিরেছি, বছরের পর বছর, দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তরে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
এর পর তিনি কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বিছানায় তাঁর পবিত্র দেহ হেলিয়ে দেন এবং সাথে সাথেই এই নশ্বর পৃথিবী থেকে তিনি বিদায় গ্রহণ করেন। মহাকবি ফেরদৌসীর মাজারের পাশে এই ক্ষণজন্মা প্রজ্ঞাবান সাধক পুরুষকে সমাধিস্থ
করা হয়।
ইমাম আল-গাযাণী এ জগত থেকে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তাঁর অমর কীর্তি বেশকিছু মহামূল্যবান গ্রন্থ এবং অনুসরণযোগ্য এক মহান জীবনাদর্শ। তাঁর লিখিত গ্রন্থের প্রকৃত সংখ্যা নিরুপণ করা কষ্টসাধ্য। অনেকের মতে তিনি চার শতাধিক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর সকল গ্রন্থের অস্তিত্ব এখন আর পাওয়া যায় না। তবে ৭০ টিরও বেশী গ্রন্থের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়। ধর্মতত্ত্ব, কোরআনের তাফসীর, ফিকাহ শাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, সূফীতত্ত্ব এবং তাত্ত্বিক দর্শনের উপর তিনি ব্যাপক লেখালেখি করেছিলেন। তাঁর লিখিত অনেক গ্রন্থ এখনও সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে পঠিত হয়। ইহ উয়া উলুমু দ্বীন’, ‘কিমিয়ায়ে সা’য়াদাত’ ইতাদি ধর্মতত্ত্বের উপর লিখিত তাঁর সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থ। তাত্ত্বিত দর্শনের উপর তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী গ্রন্থ হল ‘তহাফুতুল ‘ফালাসিফা’।