ইকবালের খুদী বা আত্মদর্শনের চিন্তা ‘আসরারে খুদী’ বা ‘ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ বক্তৃতার সংকলনেই শুধু দেখতে পাওয়া যায় না । ইকবাল তাঁর সকল কাব্যেই আত্মদর্শনের ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোচনা করেছেন । ইকবালের চিন্তার মধ্যে আমরা একটি গতিশীল বিপ্লবী জীবন দর্শন দেখতে পাই । যে জীবন দর্শন বিশ্বাস, তও‌হীদ ও ভ্রাতৃত্বের উপর গড়ে ওঠে । ইকবালের এই চিন্তা একদিকে যেমন আধুনিক মনস্তত্ব, জীবতত্ব ও শিক্ষার জগতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তেমনি বৈষম্য মূলক সমাজ, স্বৈরাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও অতিব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি যখন দুর্বল মন নিয়ে বেড়ে ওঠে তখন সে সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি জীবনে দমন পীড়নের স্বীকার হন । ইকবালের আত্মদর্শনের বয়ান এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । প্রতিটি জীবন স্বাতন্ত্র্যতা লাভের জন্য লড়াই করে চলে । বাস্তব জীবনে একজন ব্যক্তি এই লড়াই করেই লক্ষ্যে এগিয়ে যায়।কিন্ত ব্যক্তি যখন আত্মদর্শনের শক্তি হারিয়ে ফেলে তখন সে ব্যর্থতা, বৈষম্য, ,জুলুম ও নৈরাজ্যের কবলে পড়ে । কিন্ত ইকবালের এই চিন্তার সূত্র কি ? ইকবাল কোন পদ্ধতিতে আত্মদর্শনের বয়ান হাজির করেছেন ? ইকবালের আত্মদর্শনের তত্ত্ব নিয়ে যখন ভাবা হয় ঠিক তখনই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তওহীদের এই কালেমার দার্শনিক বক্তব্য প্রথমে চলে আসে ।ইকবালের খুদী একাত্মবাদের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে বাস্তব জীবন ও সমাজ জীবনের সকল ধরণের অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কথা বলে ।ইকবাল প্রথমে ব্যক্তিত্বের পুনরুদ্ধারের কথা বলেছেন ,তারপর ব্যক্তি আত্মদর্শনের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সমাজ দর্শনের পুনরুজ্জীবনের ভূমিকায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে ।আর এসবের এক মাত্র উদ্দেশ্য-ই হচ্ছে স্রষ্টার আনুগত্য ও তাঁর বিধান ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা ।

পবিত্র কুরআন তওহীদের বিষয়ে কি বলেছেন; কোন প্রেক্ষাপটে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তওহীদের উপর অবিচল থাকার আদেশ দিয়েছিলেন ?পবিত্র কুরআন তও‌হীদ বা আল্লাহর একত্বের উপর বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়ে কখনো আদেশ ,কখনো উপদেশ আবার কখনো বিভিন্ন জাতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন । আল্লাহ কুরআনের এই আয়াত গুলো তুলে ধরেছেন ,এর প্রধানতম কারণ শেষ নবীর উম্মতদের সতর্ক করে দেওয়া । তাঁরা যেন অন্যান্য জাতির ন্যায় অবিশ্বাস ,জুলুম, নৈরাজ্য ও অবাধ্যতায় জীবন অতিবাহিত করে না ফেলে । আল্লাহ যখন আদেশ দিয়েছেন ‘এক আল্লাহ-ই তোমাদের উপাস্য ‘ ,খুদী এই আদেশ কি গ্রহণ করবে নাকি অবাধ্যতায় নিমজ্জিত হবে । আল্লাহ ব্যক্তিকে গ্রহণ বর্জনের স্বাধীন সত্তা দিয়েছেন । বুদ্ধি ও বিবেনা শক্তিই- পশু ও অন্যান্য প্রাণীর থেকে মানুষ’কে আলাদা করে । আল্লাহ একদিকে মানবজাতির সামনে জীবন বিধান তুলে ধরেছেন অন্য দিকে স্বাধীন মানব মন দিয়েছেন। এই মানব মন যখন আত্মদর্শনে বলিয়ান হয়ে ওঠে তখন সে হয় আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি । আমরা সূরা ইখলাসে দেখি আল্লাহ নিজেই তাঁর পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে তিনি বলেছেন “He is God ,The one and only;” এখানেই সব ধরণের শিরক ও মূর্তিপূজার মতো প্রার্থনা গুলো বাতিল হয়ে যায়।
আল্লাহ তওহীদের ব্যাপারে যে বক্তব্য গুলো দিয়েছেন সে গুলো আমরা দেখব –

“There is no God but God [১]”
-আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই ।

” And your God is one God, There is no god but He.[২]
-এক আল্লাহ ই তোমাদের উপাস্য। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই ।

“God! There is no god But He, the living, The Self-subsisting, eternal.[৩]
-আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই ।তিনি শ্বাশ্বত চিরঞ্জীব।

“The command Rests with none but God, He declares the Truth, And He is the best of judges. [৪]
-ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তো শুধু আল্লাহর ।তিনি শুধু সত্যই বর্ণনা করেন ।তিনিই চূড়ান্ত বিচারক।

” But in truth
He is the one, God.” [৫]

  • আল্লাহই একমাত্র উপাস্য। আর তোমরা যে শিরক করছ ,তা থেকে আমি পুরোপুরি মুক্ত।

“We sent Noah to his people, He said ‘O my people! Worship God ! ye have No other god but Him.”[৬]
-নিশ্চই আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম এবং সে বলেছিল ,হে আমার সম্প্রদায় ! এক আল্লাহর ইবাদত করো ।তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই ।

” To the Ad people we sent Hud, one of their own breathren. He said ” O my people ! Worship God ! Ye have No other god but Him.[৭]

  • আদ সম্প্রদায়ের কাছে ওদের ভাই হুদকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল , হে আমার সম্প্রদায় ! তোমরা এক আল্লাহর উপাসনা করো ।তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই ।

And He is God ,there is No god but He.[৮]

  • এবং তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই । It is He Who is God in heaven and God on earth ; And He is Full of Wisdom and Knowledge. [৯]
    দয়াময় একাই মহাকাশের প্রভু ,জামিনের প্রভু ।তিনিই সত্যিকারের প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।

Therefore exalted be God ,The king ,the Reality , There is no god but He, The Lord of the Throne of Honour![১০]

  • আল্লাহ মহান! সর্বশক্তিমান!তিনিই চূড়ান্ত সত্য!তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি মহিমান্বিত আরশের একাধিপতি।

He is the living(one) , There is no god but He, Call upon Him ,giving Him Sincere devotion. Praise be To God, Lord of the Worlds ! [১১]
তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই ।তাই ধর্মনিষ্ঠ হয়ে একাগ্রচিত্তে শুধু তাকেই ডাকো ,তাঁরই ইবাদত করো । নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা মহাবিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই।

(He is) Lord of the East and the West ,there is No god but He .[১২]

  • তিনি উদয়াচল ও অস্তাচলের মালিক ।তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই ।

ইকবাল তওহীদের এই চিন্তা গুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি তওহীদের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে অন্তরের ঐক্য গড়ে তুলতে বলেছিলেন। আর একজন ব্যক্তি যখন তাঁর স্বীয় আত্মশক্তি অনুভব করে আল্লাহর একত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়,তখন সে হয়ে ওঠে খোদার মনোনীত বান্দা। সে আর কোন উপাস্যের উপাসনা করে না , সে খোদার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তোলে । আর এই চেষ্টা একজন নিষ্ক্রিয় মানবের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না । গতিশীল কর্মপ্রবনতার মাধ্যমেই কেবল পারিপার্শ্বিকতাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জয় করা সম্ভব। ইকবাল
সব কিছুর সমাধানের মন্ত্র খুঁজেছেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ -এর মধ্যে । ইকবাল বলেছেনঃ
” লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর রশ্মী
যতোক্ষণ আছে তোমার হস্তে,
করতে পারবে তুমি ব্যর্থ সকল ভয়ের আক্রমণকে।
আল্লাহ যার দেহের ভিতরে আত্মার মতো,
অহমিকার কাছে শির তার অবনত হয় না ।
ভীতি পায় না প্রবেশ পথ তার বুকে ,
আত্মা তার আর কাউকে করে না ভয় আল্লাহ ছাড়া ।”[১৩]

ইকবাল আত্মদর্শনের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তুলে ধরে জেগে উঠতে বলেছেন । এক আল্লাহর একত্বের দর্শন উপলব্ধি করতে বলেছেন । তিনি যেভাবে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” -এর মন্ত্রে স্বীয় খুদীকে জাগিয়ে তুলেছেন ,তেমনি মানব জাতির আত্মদর্শনের উত্থানেরও স্বপ্ন দেখেছেন ,এই কালেমার মধ্যে । ইকবালের দর্শনের কেন্দ্র বিন্দু হলো ‘খুদী’ ও ‘বেখুদী’। খুদী যখন আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে ওঠে ,তখন সে শুধু নিজের জন্য নয় সমাজের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । আর ইকবালের সকল চিন্তার মুল ছিল খুদীর উন্নতি বিধান । এবং এই খুদী -কে নিয়েই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। ভেজাল একাত্মবাদে যারা বিভোর তাদের বলেছেন, এসব ছাড়ো খাঁটি তওহীদ বুলন্দ করো ,ধারালো তরবারী ছাড়া যুদ্ধে জয়ী হবে কিভাবে । তিনি ইব্রাহীমের পথ অনুসরণ করে মূর্তিসম আত্মীয়তা ত্যাগ করতে বলেছেন । লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-র বাণী উপলব্ধি করে অসত্য,পাপ ,অবিচার,জুলুম ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে বলেছেন।জাতির উত্থান ও পতনে কালেমার বুলন্দ হয়ে উঠতে হবে ভীতি হীন ও আত্মবিশ্বাসের সাথে । ইকবাল উপলব্ধি করেছেন ব্যক্তির মধ্যে কুফর, অনৈসলামিক ভাবধারা, পশ্চিমা চিন্তা অনুপ্রবেশ করেছে । ইকবাল এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে একমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ -এর আঘাতে এসব দুরিভুত করতে পারবেন ।তাই তো তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ -র বাণীর জয়গান গেয়েছেনঃ
” খুদীর গোপন রহস্য নিহিত রয়েছে- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ” তওহীদের এই কালেমায়;
এই দুনিয়া একটি মূর্তিখানা, এখানে বুলন্দ করতে হবে তওহীদের আওয়াজ;
বুলন্দ করতে পারে এ আওয়াজ ইব্রাহীমের পদানুসারীরাই;
খুঁজে বেড়াচ্ছে যামানা এমন ব্যক্তিকেই।
মন লাগিয়েছ তুমি দুনিয়ায়, যা ধোকা বই কিছুই নয় ,
দিতে হবে আওয়াজ লা -ইলাহা-র,
লাভ -লোকসানের ধোকা কাটিয়ে উঠে ।
দুনিয়ার ধন -সম্পদ, আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব- এসব মূর্তিসম,
যা ভিত্তিহীন ধারণারই সৃষ্টি, স্থায়ী সত্য- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
পরে আছে বুদ্ধি ,স্থান -কালের পৈতা;
বস্তুত স্থান কাল বলতে কিছুই নেই ;
সত্য শুধু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
গোলাপ বা লালা ফুলের ঋতু শর্ত নয় লা ইলাহার গানের জন্য;
এর জন্য সমান শীত বসন্ত- সকল ঋতু।
বাসা বেঁধেছে মূর্তি জাতির আস্তীনে,
পেয়েছি আদেশ মূর্তি ভাঙ্গার লা ইলাহা-র আঘাতে। “[১৪]

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ -র বাণী গ্রহণ করলেই কি খুদীর বিকাশ সম্ভব? ইকবাল বলেছেন শুধু তওহীদ বুলন্দ করলেই হবে না , সকল ধরণের দাসত্ব ও গোলামী থেকে খুদীর স্বাধীনতা লাভ করতে হবে । আল্লাহ ছাড়া যত শক্তি আছে ,সে সকল শক্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে ।তওহীদের বুলন্দের পাশাপাশি খুদীর আত্মবিকাশে মনোযোগী হতে হবে ।
ইকবাল বলেনঃ
” পারবেনা বুঝতে যতক্ষণ লা- ইলাহা-র মর্মবাণী,
পারবে না ভাঙ্গতে ততক্ষণ গয়রুল্লাহ-র বন্ধন।”[১৫]

ব্যক্তি যখন তওহীদের পথ অনুসরণ করে তখন সে ব্যার্থতা, জুলুম, নৈরাজ্য ও পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলে । ব্যক্তি যখন সমাজে মিলিত হয় তখন সে আর একা থাকে না ,তখন সে হয়ে ওঠে সঙ্ঘ । একটি সমাজ যখন অন্তরের ঐক্যে, স্রষ্টার সমাজ বিধানে গড়ে ওঠে তখন সেই ঐক্য- ই শ্রেষ্ঠ ঐক্য হয়।আত্মদর্শনের শক্তিতে সে হয়ে ওঠে সৎ, সাহসী ও ন্যায়বান। ইকবাল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কে -ই মুসলিমের জীবনী শক্তি বলেছেন । ঐক্যের পেয়ালা থেকেই মুসলিম-রা সুরা পান করে হয়ে উঠবে বলিয়ান। ইকবাল বলেছেনঃ
” পুণ্য জাতির দেহ ও প্রাণ ‘লা -ইলাহা ‘
যন্ত্রে যে সুর সঠিক রাখে ‘লা- ইলাহা ‘।
লা – ইলাহা গুপ্ত সত্তা-তত্ব মোদের,
সূত্র তাহার বন্ধন করে চিন্তা মোদের।
অক্ষর তারি ওষ্ঠ হইতে পশি অন্তর,
জীবন শক্তি বৃদ্ধি করে নিরন্তর।
উহা অঙ্কিত হলে প্রস্তর পরে অন্তর হয়,
স্মরণে যদি না অন্তর দহে কর্দম হয় ।
হৃদয় যখন দহন করি ব্যথায় তাঁর,
দীর্ঘশ্বাসে ফসল পুড়ি সম্ভাবনার।”
,,,,,,,
একই রঙে রঞ্জিত দিল সমাজ গড়ে ,
একই ভাতি সিনাই গিরি দীপ্ত করে ।
একই চিন্তা জাতির মনে দোলন দিবে ,
একই লক্ষ্য অন্তরে তার সাহস দিবে ।”[১৬]

ইকবাল সূরা ইখলাসের আয়াত ধরে ধরে রুমুয-ই বেখুদীতে তওহীদের বুলন্দ করেছেন।”বল ,সেই আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়” ! আমরা আল্লাহর সাথে কাউকে যেমন যুক্ত করব না তেমনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়েও দ্বিধান্বিত হব না । ইকবাল আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হতে বলেছেন। এখানেও তিনি মুসলিম ঐক্যের কথা বলেছেন । মুসলিম একটি প্রাণ সে যদি আফগান ,তুর্ক, আরবী অথবা চীন দেশে থাকুক তবুও সে মুসলিম ।ইকবাল বলেছেনঃ
“শতেক বক্ষে এক নিঃশ্বাস-বায়ু বহে,
তওহীদেরই গুপ্ত মর্ম অন্য নহে ।
রঞ্জিত হও রঙ্গে তাহার তুল্য হবে ,
বিশ্বে তাহার সুষমা-প্রতিবিম্ব হবে ।
মুসলিম নাম তোমায় যেজন করেছে দান,
দিত্ব হতেই ঐক্যের প্রতি দিয়েছে টান ।
নিজেকে তুর্ক আফগান তুমি বলছ, হায়!
যেমন ছিলে তেমনি আজো রয়েছ ঠায়।
,,,,,,
একক হয়ে তওহীদ তব বাস্তব করো
আড়াল যাহা, কর্ম দ্বারা গোচর করো ।
ঈমানের স্বাদ বর্ধিত হয় কার্য দ্বারা;
মুরদা ঈমান হয় যদি তা কার্য-হারা। “[১৭]

ইকবাল যেমন তওহীদের জয়গান গেয়েছেন তেমনি মুসলিমের নিষ্কর্ম খুদী দেখে মনক্ষুন্ন হয়েছেন। আজ মুসলমানের মর্যাদা মুসলমানের কর্মের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। আজ মুসলমান -ই মুসলমান ‘কে তওহীদের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে । কেউ বস্তবাদী জীবন যাপন করছে ,কেউ ভাববাদী জীবন যাপন করছে । আজ লা ইলাহা-র তরবারী মরিচা পড়া , যদিও বুলন্দ হয় এই কালেমার কিন্ত সেখানে প্রাণশক্তি নেই । ইকবাল মুসলমানের এই দশা দেখে মনোবেদনায় ভুগেছেন। ‘ আল্লাহু আহাদ ‘ যদি মুসলমানের হাতে না থাকে তাহলে সে কিভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তত্ত্ব মুকাবিলা করবে ! ইকবাল বলেছেনঃ
” এ তওহীদ ছিল জীবন্ত শক্তি পৃথিবীতে এক কালে
আজ এটি শুধু বিষয়বস্তু নিরস ইলমে কালামের,
এ আলোক রশ্মিতে কর্মের আঁধার পর্দা না সরালে
মুসলমানের মর্যাদা থাকে মুসলমানের আড়ালে।
সিপাহসালার, তোমার সিপাহি আগেই দেখেছি আমি
কুল-হু- আল্লাহর শমশীর নেই
তোমার সেনার হাতে
আহা , এ তত্ত্ব জানে না মোল্লা এবং জানে না ফকীহ
কর্মের ঐক্য বিনা চিন্তার ঐক্য নিষ্ফল জেনো তাতে ।
জাতির সংজ্ঞা হোক অথবা নেতৃত্ব যা-ই বলো
কে বোঝে তাৎপর্য তার
দু’রাকাত নামাজের ইমামতি যার পেশা ?”[১৮]

ইকবাল ঘুমিয়ে থাকা মুসলিম জাতির উত্থানের গান গেয়েছেন। কখনো আহ্বান, কখনো উপদেশ কখনো বা হুঙ্কার দিয়ে । জেগে ওঠো হে খুদী , তওহীদের পেয়ালায় ঐক্যের শরবত পান করো । তোমার মাথার মধ্যে যদি মূর্তির রসদ থাকে তাহলে সুরার স্বাদ পাবে কি করে ! কি অদ্ভুত! মুমিনরা কি আল্লাহ কে রেখে পাদ্রীর কাছ থেকে ধর্মের শরবত পান করবে ? একজন আল্লাহর মনোনীত বান্দা যিনি আত্মদর্শনে বলিয়ান হবে ,উজ্জীবিত হবে , যুদ্ধ করবে বাতিলের বিরুদ্ধে কিন্ত কি অদ্ভুত দাসত্ব আর গোলামীর মহড়া চলছে আল্লাহ জমিনে । ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আছে কিন্ত আত্মদর্শন নেই । তাই তো ইকবাল দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
” কথায় প্রকাশ করা যায় তওহীদের গভীর তত্ত্ব
কিন্ত তোমার মগজে থাকে যদি মূর্তিমন্দির
তাহলে বলার কিছু নেই ।
যে প্রেমাগ্নির রহস্য সমাহিত লা-ইলাহার বুকে
শায়খ যদি ফকীহদের পথাশ্রয়ী হয়
তাহলে বলার কিছু নেই ।
যে আনন্দ উজ্জীবিত হক ও বাতিলের সংঘাতে
যুদ্ধ ও আঘাতের সাথে থাকে যদি অপরিচিত
তাহলে বলার কিছু নেই ।
পৃথিবীতে আজাদ বান্দার দেখার আছে বহু
কিন্ত গোলামীর দৃষ্টি যদি লাভ করো তুমি
তাহলে বলার কিছু নেই ।”[১৯]

ইকবাল তাঁর কাব্যে খুদীকে সর্বোচ্চ আসনে দেখতে চেয়েছেন। আত্মদর্শনের ক্রমবিকাশ ঘটাতে চিন্তার জগতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন । খুদীর সাথে মিল্লাতের ঐক্য যেনো নিষ্ফল হয়ে না যায় সে জন্য-ই তিনি শক্তিশালী চিন্তা হাজির করেছেন । আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই । শেষ কালাম ছাড়া প্রথম কালামের মর্ম উপলব্ধি কিভাবে সম্ভব! ইকবাল বলেছেনঃ
” বীজের অংকুরোদগম না হতো যদি
মৃত্তিকার শবিস্তান ভেদ করে
বৃক্ষ শাখা – পত্র – পুষ্প দেখতো না পৃথিবীর আলো ।
‘লা’ হতে আরম্ভ জীবন যাত্রার
শেষ তার ‘ইল্লা’-র বুকে,
ইল্লার বৃন্ত হতে বিচ্ছিন্ন ‘লা’
বয়ে আনে জীবনের মৃত্যু পয়গাম।
‘লা’-র প্রান্ত ভেদে অক্ষম
যে মিল্লাতের প্রাণ
বিশ্বাস করো
পূর্ণ হয়ে এসেছে তার জীবন পেয়ালা।[২০]

ঘুমিয়ে থাকা জাতির ঘুম কি ভাঙানো যায় ?ইকবাল সেই চেষ্টাই করে গেছেন । একজন মুসলমানের যখন এই উপলব্ধি হবে তখন সে অনুশোচনা করবে । ভাববে ফেরার কি কোন পথ নেই! ইকবাল সে পথও দেখিয়েছেন । তিনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ -র বাণীর গৌরব প্রচার করেছেন। আল্লাহ -ই মুসলিমের রক্ষা কর্তা । আমরা যে এক আল্লাহর একত্বের শপথ গ্রহণ করেছি ,সে কথা ভুলে গেলে চলবে না । ইকবাল সেই কথাই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। সবাই যেখানে আল্লাহর তওহীদ নিভিয়ে দিতে চাইছে ,সেখানে মুসলমান এক আল্লাহর বুলন্দ করছে । মুসলমানের অন্তরেই আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে । অর্থাৎ আত্মদর্শনের ক্রমবিকাশের মধ্যেই স্রষ্টার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় । ইকবাল বলেছেনঃ
” গৌরব আমাদের ‘ লা -ইলাহা ইল্লাল্লাহ থেকে,
রক্ষক আমরা এই বিশ্বের।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোলাহল থেকে মুক্ত আমরা ,
শপথ গ্রহণ করেছি অদ্বিতীয়ের প্রেমের,
বিবেক আমরা লুকায়িত বিশ্ব প্রভুর অন্তরে,
উত্তরাধিকারী আমরা মুসা ও হারুনের।
জ্যোতিতে আমাদের
উজ্জ্বল চন্দ্র-সূর্য ,
বিদ্যুৎ ঝলক আজো আছে লুকায়িত
আমাদের মেঘের বুকে।
অন্তরে আমাদের প্রতিবিম্বিত হয়
স্বর্গের প্রতিচ্ছবি;
মুসলিমের সত্তাই আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। [২১]

একজন ব্যক্তি যখন স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে স্রষ্টার আনুগত্য গ্রহণ করেন তখন সে হয়ে ওঠে আল্লাহর মনোনীত বান্দা। যে আল্লাহর উপর ঈমান আনে সে ক্ষমতা ও ভীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে না । ইকবালের আত্মদর্শনের বয়ান এখানেই সাহসীকতার গান গেয়েছে। “আল্লাহ এক” এই কালেমার বুলন্দ করে গোটা জীবন অতিবাহিত করেছেন। মুসলমান যখন তওহীদের আমানত রক্ষা করতে পারে না ,তখন সে মাথা নত করে তাগুতের কাছে । আর ইকবাল ঠিক এখানে ই আত্মদর্শনের তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন বিশ্ব ঐক্যের ভিত্তি হলো তওহীদ বা আল্লাহর একাত্মবাদ । ইসলাম বলে কেবল এক আল্লাহর আনুগত্য, কোনো মনুষ্য উপাস্যের আনুগত্য নয় । আল্লাহর সার্বভৌমত্ব চিরস্থায়ী, চিরঞ্জীব, বিশ্বজনীন ও অবিভাজ্য। ইকবালের চিন্তা এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । তিনি তওহীদের ঐক্যে মুসলমানের অন্তরের একতার কথা বলেছেন।তাই তো ইকবালের আত্মদর্শন হয়ে উঠতে পেরেছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। ।

ঋণস্বীকার:

[১] সূরা মুহাম্মদ ৪৭:১৯ ,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[২] সূরা বাকারা ২:১৬৩ ,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[৩] সূরা বাকারা ২:২৫৫ ,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[৪] সূরা আনআম ৬:৫৭ ,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[৫]সূরা আনআম ৬:১৯ ,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[৬] সূরা আরাফ ৭: ৫৯ , সূরা মুমিনুন ২৩: ২৩,
The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[৭] সূরা হুদ ,১১: ৫০ ,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[৮] সূরা কাসাস ২৮: ৭০,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[৯] সূরা জুখরুফ, ৪৩: ৮৪,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[১০] সূরা মুমিনুন, ২৩: ১১৬ ,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[১১] সূরা মুমিন ৪০:৬৫ , The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[১২] সূরা মুজাম্মিল, ৭৩: ৯,The Holy Quran-Abdullah Yusuf Ali
[১৩] আসরারে খুদী -আল্লামা ইকবাল [তরজমা:সৈয়দ আবদুল মান্নান] নবম অধ্যায়
[১৪] যরবে কলীম- আল্লামা ইকবাল ,পৃষ্ঠা -৭
[১৫] পস-চে বায়দ করদ- আল্লামা ইকবাল পৃষ্ঠা -১৯
[১৬] রুমুয-ই বেখুদী- আল্লামা ইকবাল [তরজমা আবুল ফারাহ মুহাম্মদ আবদুল হক; ‘ইসলামী সমাজের ভিত্তিসমূহ-তওহীদ’]
[১৭]রুমুয-ই বেখুদী- আল্লামা ইকবাল [তরজমা আবুল ফারাহ মুহাম্মদ আবদুল হক,’বল সেই আল্লাহ অদ্বিতীয়’]
[১৮] যরবে কলীম- আল্লামা ইকবাল,[ তরজমা আবদুল মান্নান তালিব ‘তওহীদ’]
[১৯]যরবে কলীম- আল্লামা ইকবাল,[ তরজমা আবদুল মান্নান তালিব ‘তওহীদ তত্ত্ব’]
[২০] যরবে কলীম- আল্লামা ইকবাল,[ তরজমা আবদুল মান্নান তালিব ‘ লা ও ইল্লা’]
[২১]আসরারে খুদী -আল্লামা ইকবাল [তরজমা:সৈয়দ আবদুল মান্নান, -সপ্তদশ অধ্যায়]

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *