১.
কবি ও আলেম চিন্তক মুসা আল হাফিজ এর জার্নিটা বহুমাত্রিক এবং মৌলিক। বৈচিত্র্যকে বহন করে চলায় সক্ষমদের সবচেয়ে বড় গুরুত্বের জায়গাটা হচ্ছে চিন্তার ভারসাম্য , সেটা তাঁর মধ্যে আছে। তাঁকে তাঁর নিজস্ব পরিবেশ ও পরিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাঠ করার মধ্যে গলতি আছে। চিন্তা-গঠনের সঙ্গে পরিবেশের প্রভাব জরুরি। কিন্তু ভয়ংকর সত্য হল, তার পরিবেশ ও প্রতিবেশ তাঁকে ধারণ করতে কতটা প্রস্তুত? তিনি শুধু লেখক বা চিন্তক নন। বরং যাপন ও চিন্তার মধ্যে বৈচিত্রের এমন এক মিথস্ক্রিয়া, যাকে গভীরভাবে না পড়লে কেবল খণ্ডিতভাবে বুঝা যাবে। এই খণ্ডিত বুঝা কিংবা একেবারে না বুঝার ফলে তাঁর গুরুত্বটা অনাবিষ্কৃত এবং অধরা রয়ে গেছে । তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ “হৃদয়াস্ত্র” পাঠ করলাম হৃদয় দিয়ে। চিন্তা ও প্রজ্ঞার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হলো। যেন ভাসাভাসা পাঠের কোনো সুযোগ নেই, প্রতিটি উক্তির ভেতর মন্থন করতে হবে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পূর্বে ‘প্রিরিভিউ’ লেখার তাগিদ ছিলো। বিশেষতঃ অলসতার কারণে পূরণ করতে পারি নি; যা রিভিউ আকারে যাহির করতে হচ্ছে এখন।
মুসা আল হাফিজ জীবন ও জগতের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি পরিসরের গদ্য ও পদ্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন নিজস্ব চিন্তাভাবনা ; ‘হৃদয়াস্ত্র’ এই সিলসিলার তৃতীয় সংযোজন। ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে – ‘নক্ষত্রচূর্ণ’ এবং ‘বিষগোলাপের বন’ নামে আরও দুটি বই।
‘হৃদয়াস্ত্র’ বইয়ের প্রবেশিকায় মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত সন্ধান করেছেন এ ধারার সিলসিলা , তিনি বলেছেন – “মুসলিম ঐতিহ্যে এই প্রকরণের কথা যদি বলি তাহলে বলা যায় মওলানা জালালুদ্দিন রুমির ‘মাসনভী’র কথা ; এখানে সুফি কাব্য দিয়ে যেমন , তেমনি কাব্যধারার মধ্যেই বিভিন্ন বিরতিতে বিভিন্ন আখ্যান স্থাপন করে মওলানা রুমি তার দার্শনিক বিশ্ববীক্ষা উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া ফার্সি ও উর্দু কাব্যের শের রচনার আঙ্গিকে স্বল্প পরিসরে ব্যবহার করে অত্যধিক ব্যঞ্জনা ও দ্যোতনা সৃষ্টির একটি প্রবহমান ঐতিহ্য অনেক বছর ধরেই রয়েছে। এই ঐতিহ্যে বাকচতুর ও ক্ষিপ্রগতির সঞ্চারি পদরচনা করে কাব্যরসজ্ঞদের রসবোধকে গভীর অথচ মোহনীয়-জাদুকরী অনুভূতি ও বোধে নিমজ্জিত করে ফেলা হয়। এসব গদ্য ও পদ্য কলাশৈলীর মননশীল ও সৃজনশীল প্রতিফলন ও অনুরণন আমরা মুসা আল হাফিজের এই গ্রন্থ ট্রিলজিতে চমৎকারভাবে স্বাক্ষর রাখতে দেখি। নিঃসন্দেহে তিনি মুসলিম বিশ্ব ও বাংলা সাহিত্যের এই অনতিপ্রচলিত প্রকরণশৈলির নবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।”
২ .
স্বাধীনতাতত্ত্ব শিরোনামের আলোচনায় মুসা আল হাফিজ বলেন, “শিক্ষাকে পরিসংখ্যানে তালাশ করা ভূল। শিক্ষাকে তালাশ করতে হয় সংস্কৃতিতে , স্বাধীনতায়।” এখানে লেখক শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির এক ধরনের সম্পর্কের প্রতি ইশারা করলেও তাঁর ভিন্ন এক গ্রন্থ ‘নক্ষত্রচূর্ণ’তে লিখেছিলেন, “শিক্ষা শুধু শিক্ষা। কিন্তু সংস্কৃতি শুধু সংষ্কৃতি নয়।” এখানে শিক্ষাকে স্বতন্ত্র অস্তিত্বে নিয়ে আসার কারণে, সংস্কৃতির সাথে শিক্ষার সম্পর্ককে জটিল করে ফেলা হয়েছে এবং দুটি উক্তির মধ্যে এক ধরনের সংঘাত তৈরি হয়েছে বলে প্রশ্ন তোলা সম্ভব। বাহ্যত সেটাই মনে হচ্ছে।
আপাত সংঘাত মনে হলেও ভিন্নভাবেও দেখার সুযোগ আছে এখানে যে – শিক্ষাকে সীমায়িত করা গেলেও সংস্কৃতির ব্যাপকতাকে অস্বীকার করা যায় না। সংষ্কৃতি সভ্যতা থেকেও গভীর কিছু। যেমন, প্রাচীন রোমের কথাই ধরেন – সেখানের যুদ্ধ, লুণ্ঠন, অমানবিক শাসকশ্রেণী , মিথ্যে গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ছলচাতুরি ইত্যাদি অনুষঙ্গ রোমান সভ্যতার সত্য চিত্র সন্দেহ নেই , কিন্তু সংস্কৃতির কতটা সেখানে ছিল , কিংবা সংস্কৃতির অনুষঙ্গ আদৌ সেখানে ছিল কিনা , এই ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। অর্থাৎ সংস্কৃতির গভীর একটা দ্যোতনা আছে , তাৎপর্য আছে।
নক্ষত্রচূর্ণের আরেকটু পেছনেই তিনি বলছেন যে, “শিক্ষা আছে , সংস্কৃতি নেই , মানে কোনোটাই নেই।” এখানে শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির বোঝাপড়া ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। সংঘাত বাকি থাকে নি আর। কারণ, এখানে শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির সংযোগ মুলত (আমালিয়াত) প্রায়োগিকতায়। ত্বোহা আব্দুর রহমানের চিন্তা দর্শনে ‘আখলাক’কে যেভাবে রূপায়িত করা হয়েছে , এবং সভ্যতা নির্মাণে ‘তাদাউল’ নীতিতে ত্বোহা যেভাবে আমালিয়াতকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি এখানে ‘শিক্ষা আছে সংষ্কৃতি নেই’ মানে হচ্ছে, শিক্ষা আছে কিন্তু প্রায়োগিকতা নেই। সেই শিক্ষা যেমন সংস্কৃতিকে গড়ে তুলতে পারে না তেমনি নিজের অস্তিত্বও বিকশিত করতে ব্যর্থ হয়।
৩ .
‘যে শিক্ষায় যতোটা পরাধীনতা লুকিয়ে থাকে , সে শিক্ষা ততোটাই জাতীয় সংস্কৃতির দুশমন।‘
উপরের সংক্ষিপ্ত অথচ অন্তর্নিষ্ঠ বাক্যটিতে সংস্কৃতির গভীর বোঝাপড়াকে হাজির করা হয়েছে। সংষ্কৃতি হল মানুষ হয়ে গড়ে উঠার শিল্প , যেখানে অনবরত নিজেকে সৃষ্টি করা হয়। সংষ্কৃতি হল এক প্রজ্বলিত আলোক শিখার সাহায্যে প্রগাঢ় তমসা ভেঙে অনতিক্রম্য সফলতার পাহাড়ে আরোহণ করা। আলিয়া আলি ইজেতবেগোভিচ তাঁর ‘Islam between East and West’ কেতাবে বলেন “সংষ্কৃতি হল মানবিক স্বাধীনতারই নির্বাচন ও প্রকাশন।” ‘হৃদয়াস্ত্র’ এর আলাপকে আলিয়া আলির সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করলে , এর যথার্থ তাৎপর্য ও মহিমার ব্যঞ্জনা যাহির হবে। আমরা বুঝতে পারব, শিক্ষায় পরাধীনতা লুকিয়ে থাকলে জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে না।
৪ .
তিনি শিক্ষার সাথে স্বাধীনতা ও মুক্তির গভীর সম্পর্ক তুলে ধরেন এভাবে, “মূর্খদের স্বাধীনতা অন্ধদের দিনের মতো। মূর্খদের পরাধীনতা অন্ধদের রাতের মতো। অন্ধের কাছে দিন ও রাতের ব্যবধান যা মূর্খের কাছে স্বাধীনতা ও পরাধীনতার ব্যবধান তা”। ক্ষমতা ও আধিপত্যের সঙ্গে জ্ঞান ও জানার সম্পর্ক, এবং কিভাবে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা হিসেবে গড়ে উঠেছে ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যচর্চা , তার একটা পষ্ট চিত্র আমরা এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজমে দেখি। বেলফোরদের মতো কলোনিয়াল ফুটসোলজাররা যেভাবে বিবৃতি দিচ্ছে যে, আমরা প্রাচ্য সম্পর্কে জানি বলেই তাকে শাসন করার অধিক হক বা অধিকার রাখি , সুতরাং , আধিপত্যের মোকাবেলা এবং মুক্তি ও স্বাধীনতাও জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত।
৫ .
নিপীড়নের যন্ত্র শিরোনামে মুসা আল হাফিজ লেখেন, “সরকারি বন্দুকের চেয়ে সরকারি গল্প বেশি ভয়ানক”। এক প্রতিবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তির ধর্ষণ মামলায় আটক হবার প্রেক্ষিতে লেখা সংক্ষিপ্ত অথচ স্বচ্ছ এ উক্তিটি সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্ষমতার নির্লজ্জ উপস্থিতি বুঝতে সহায়তা করবে। সে বন্দুক দিয়ে যেমন হত্যা করে, গল্প সাজিয়েও ব্যক্তিত্বকে হত্যা করে। সে তার গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী দিয়ে ভিক্টিমের খেলাফে ‘হেজেমনির বয়ান’ তৈরি করে, খুব সহজেই ঢেকে ফেলে নিজস্ব অশ্লিলতাকে। খুব সম্ভব এজন্যই হিটলার বলেছিলেন, আমরা খুব বেশি শিক্ষিত হয়েছি বলেই আজ আমাদের বিপদ— What we suffer from today is an excess of education। হেজেমনির বয়ান সাধারণত তৈরি করে সমাজের ডমিনেন্ট শ্রেণী ; যারা সামাজিক বিশ্বাস, প্রত্যক্ষণ এবং নীতি নৈতিকতার অনুকূল বয়ান বা গল্প তৈরি করে মজলুম শ্রেণীর অধিকারের দাবিকে অন্যায় ও অনৈতিক সাব্যস্ত করে, চাপিয়ে দেয়। দি প্রিজন নোট বুকসে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হিসেবে কালচারাল হেজেমনির আলাপ আন্তোনীয় গ্রামসি নিয়ে এসেছেন ; হালামলের সমাজ, রাষ্ট্র এবং ক্ষমতার সম্পর্ক নির্মাণে এর ইন্টেলেকচুয়াল তাৎপর্য অনেক। মুসা আল হাফিজে এসে এমন চিন্তা উম্মাহ ও দেশীয় প্রেক্ষিতের উপর নজর রাখে।
কবি ও ফ্যাসিবাদ শিরোনামে, এই সিলসিলায় মুসা আল হাফিজ আরও বলেন, “এটা ভুল যে, ফ্যাসিবাদ স্বাধীনতা দেয় না কবিকে। ফ্যাসিবাদ অগাধ স্বাধীনতা দেয় এবং তা কেবল প্রশংসা করার জন্য।”
দুষ্টচক্র শিরোনামে লিখছেন যে, “প্রশ্ন : অপশাসনের বুকে মাথা রেখে যখন কেউ সুশাসনের কথা বলেন , তারা আসলে কি করছেন? উত্তর : তারা নকল মালের পেকেটে লিখছেন , নকল হইতে সাবধান। এবং এই লেখার জন্য জাতির কাছে দাবি করছেন সন্মান ও স্বীকৃতি।
বিচার শিরোনামে তিনি আরও শক্ত এবং পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “আমার লাশ কাঁধে নিয়ে বিচারের আদালতে যাচ্ছিলাম। পুলিশ আমাকে আটকে বলল , তুমি এ লাশের খুনি।”
উপরের প্রতিটি আলাপ আদতে রাষ্ট্রের হেজেমনির বিভিন্ন বয়ানকে তুলে ধরে। কিভাবে রাষ্ট্র অপরাধ ঘটায়, নিজস্ব অশ্লিলতাকে আবৃত করে পাল্টা-বয়ান দিয়ে এবং দিনশেষে ভিক্টিমকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় হাজির করে। এই অসুস্থ রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি অবহেলা নয়, নিরাপত্তাকর্মীর ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, দার্শনিকদের কাজ শুধু পাহারা দেওয়া নয়, বরং নিরাপত্তাকর্মীরও। নতুবা এই রাষ্ট্র ও সমাজ পচনশীলতার সর্বনিম্ন-স্তরে পতিত হবে। এই নোক্তার প্রতি নির্দেশ করে লেখক বলেছেন, “অসুস্থের প্রতি ভালোবাসা যতো প্রগাঢ় হবে , অসুস্থতার সাথে তোমার আচরণ হবে ততো নির্মম।” [৭১ পৃষ্ঠা]
শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানামুখী তৎপরতাকে আমি পাঠ-প্রতিক্রিয়া আকারে তুলে ধরেছি ঠিক, কিন্তু গ্রন্থটির ব্যপ্তি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। এখানে জীবন ও জগতের পাশাপাশি আছে রুহানিয়াতের প্রতিসরণ। আছে শিল্প-সাহিত্যের প্রেরণা। নানামূখী তত্ত্ব ও ব্যক্তিত্বের মনস্তত্ত্ব অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে লেখক আবিষ্কার করেন জীবনের অবিনাশী দার্শনিক সুর-তরঙ্গ , নির্দেশ করেন মহাজাগতিক সফলতার যাত্রাপথ।
বই : হৃদয়াস্ত্র
লেখক : মুসা আল হাফিজ