শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির শ্রদ্ধেয় আব্বাজান শাহ আবদুর রহিম সাহেব দেহলবি সবসময় তাকে প্রায়োগিক দর্শন চর্চায় জোর দিতেন। ওইসময় পরিস্থিতি এমন ছিল যে, সাধারণ তর্কশাস্ত্রবিদগণ অ্যারিস্টটলের দর্শনকে নিজেদের চিন্তার মানদণ্ড বানিয়ে নিয়েছিলেন। তাদের সমস্ত চিন্তা-ফিকির, গবেষণা, তর্কবিতর্ক, মতবাদে বাস্তব জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বহীন ছিল, এবং যাই-বা চর্চা করত সেসবের প্রায়োগিক কোনো ক্ষেত্রও ছিল না। আবশ্যিকভাবে এর ফলাফল যা হবার ছিল তা-ই হলো— তর্কশাস্ত্র কেবল মনোরঞ্জনের উপকরণ হয়ে উঠলো, অন্যদিকে জগৎ ও জীবনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার কোনো প্রয়োজন রইল না। শাহ সাহেব তার আব্বাজান ও তৎকালীন ফাঁপাকথার তার্কিকদের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন :
‘আব্বাজান সাহসিকতা, প্রজ্ঞামতিত্ব, দায়িত্বশীলতা ও আত্মমর্যাদাবোধ ইত্যাদি গুণে পূর্ণতাপ্রাপ্তি হাসিল করেছিলেন। এমনকি ধর্মীয় ও পরকালীন এলেমের পূর্ণ সমঝদারি রাখার পাশাপাশি আর্থসামাজিক জ্ঞানও রাখতেন,— যার সাহায্যে একজন মানুষ খুব সুন্দরভাবে সবার সাথে মিলঝুল রেখে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সচ্ছলতার সাথে চলতে পারে। আব্বাজান বেশিরভাগ সময় মানুষদেরকে প্রায়োগিক দর্শন ও জীবনযাপনে উন্নতি করার বিষয়ে তালিম দিতেন।’
এটাই ছিল শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির চিন্তাদর্শনের ভিত্তি, যা তিনি তার পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন, এবং এর ওপর তিনি এক বিশাল ইমারত দাঁড় করিয়েছিলেন। শাহ সাহেব অন্য এক জায়গায় বলেন :
‘প্রায়োগিক দর্শন— যা জমানার উন্নতি ও প্রগতির ভিত্তি, আল্লাহর কুদরতে আমি এই বৈশিষ্ট্যটি পেয়েছি, তিনি যদি তৌফিক দেন তো কোরআন-সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের আলোকে আমি প্রায়োগিক দর্শনের সব মূলনীতি একাট্টা করব, এবং ক্রমানুসারে সাজাব।’
শাহ সাহেবের রচনা যদি অধ্যয়ন করা হয়, বিশেষ করে যেখানে ‘বন্ধন’ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেখানে প্রায়োগিক দর্শনকে সামনে রেখে সেই বিষয়ে হাদিস একত্র করেছেন এবং আলোচনার প্রেক্ষিতে সেই হাদিসের সাথে টীকাটিপ্পনী যোগ করেছেন।
আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, শাহ সাহেব তার রচনায় সবার আগে চার প্রধান ইবাদতের আলোচনা করেন, এরপর প্রায়োগিক দর্শনের মূলনীতির ওপর তার বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য বিভিন্ন অধ্যায়ে সাজিয়েছেন। ফলে আমরা দীন ও দুনিয়া দুটোই তার দৃষ্টিতে দেখতে পাই। এবং তা ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগের খুবই গুরুত্ব অনুভব করি। শাহ সাহেব ‘ভালোত্ব ও মন্দত্ব’-এর হাকিকত সবরকমের সান্ধ্যভাষা থেকে আলাদা করে একদম সাফ-সাফ বর্ণনা করেছেন। ভালো ও মন্দ বিষয়ে শাহ সাহেব বলেন :
‘কোনো কিছুকে ভালো বলার অর্থ এই যে, তার নির্দিষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্যে পূর্ণতাপ্রাপ্তি হয়েছে। যেমন একটা গাধাকে ভালো বলার অর্থ মাল টানার বৈশিষ্ট্যে ওই গাধাটি পূর্ণতা পেয়েছে, এর মানে এই নয়— গাধাটি মানুষের চেয়েও ভালো। এরকমভাবে মানুষের কোনো দলকে ভালো বলার অর্থ— যেই বৈশিষ্ট্যের ওপর তাদেরকে ভালো বলা হয়েছে, সেই নির্দিষ্ট অর্থেই তারা ভালো। সুতরাং কোনো মানুষকে ভালো বলার অর্থ হবে মহাপুরুষের বৈশিষ্ট্যে সে নির্দিষ্ট পর্যায় অতিক্রম করেছে, এখন তার তুলনায় যে পিছিয়ে আছে, সেই হিসাবে সে কম ভালো গণ্য হবে।’
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এই মহাপুরুষের বৈশিষ্ট্য কী। একজন দার্শনিকের দৃষ্টিতে এর জওয়াব হবে— জগতের সব জাতি ও বংশে দৃষ্টি দাও, সবার চোখে যাকে মহাপুরুষ মনে হয় তার বৈশিষ্ট্যগুলো একত্র করো, এভাবে সব মহাপুরুষের বৈশিষ্ট্য থেকে যে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সবার মধ্যে পাওয়া যায়, তাকেই মহাপুরুষের অবশ্যম্ভাবী বৈশিষ্ট্য ধরে নিয়ে মানদণ্ড নির্ধারণ করো। সেই মানদণ্ডের ভিত্তিতে যেকোনো মানুষ বা সম্প্রদায়ের ওপর পরীক্ষা চালাতে পারো।
সুতরাং ভালো ও মন্দ এভাবেই নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে কল্পনার চেয়ে বাস্তবতাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর এটাই প্রায়োগিক দর্শন অনুসরণের ফল।
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা পড়ার সময় খেয়াল করে দেখবেন শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি সাহেব কোনো কাজ, কোনো চরিত্র বা কোনো আকিদার স্তরকে ঠিক এই পদ্ধতিতেই নির্ধারণ করছেন— ওই বিষয়গুলো সাধারণভাবে পূর্ব-পশ্চিম ও আরব-অনারবের মধ্যে কীভাবে পাওয়া যায়। শাহ সাহেবের এই মতদর্শন প্রজ্ঞামতিত্বের গুপ্তধন থেকে তুলে আনা এক মহামূল্য রত্ন— যা সাধারণত কোনো লেখক-গবেষকের কিতাবে পাওয়া যায় না। কোনো আলেমের কিতাব পড়ে ভালোত্ব বা মন্দত্বের নীতিনির্ধারণ কোনো বাস্তবিক প্রক্রিয়া নয়। হ্যাঁ, এই ক্ষেত্রে অবশ্যই খামখেয়ালি দর্শনের অনুসরণে কামালিয়াত হাসিল হয়!
মোদ্দাকথা, শাহ সাহেবের দর্শন খামখেয়ালিপনা থেকে মুক্ত করে বাস্তবিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। তিনি মানুষের কাজকে মানদণ্ড বানান। এর ফলে শাহ সাহেবের দর্শন সামগ্রিকতা নিজের মধ্যে শামিল করে, এবং একথার জানান দেয় যে, ইসলাম প্রকৃতপক্ষে সার্বজনীন বিপ্লবের দাওয়াত দেয়। কোরআন এই দাওয়াতেরই ব্যাখান, এবং কোরআন এই অর্থে নিজেই নিজের তফসির। শাহ সাহেবের প্রজ্ঞা ও দর্শনে এই মতবাদটিই সবচেয়ে উঁচুমানের। এর সাহায্যে প্রত্যেক কোরআনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুব সহজে বুঝতে পারবে। মোটকথা, শাহ সাহেবের এই মতবাদ কোরআনকে মুসলমানের মন ও মননের খুব কাছে এনে দিয়েছে।
সূত্র : মন ও মননের কথা/ মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি