Secret of self-Dr. Muhammad Shahidullah

আল্লামা ইকবাল কাব্যের জন্য কাব্য লিখেন নাই। তাঁর কবিতা ছিল তাঁর ভাবের সেবিকা। তাঁর ভাবের উৎস ছিল কুরআন মজীদ। এই জন্য ইকবালকে শুধু কবি না বলে, বলা উচিত মুসলিম দার্শনিক কবি। ইকবালের কাব্যগুরু মৌলানা রূমী । ইকবাল স্বয়ং বলেছেন-

“মুরশিদ রূমী হকীমে পাকযাদ,
সিরে মর্গ ও যিন্দগী বর মা কুশাদ।”

“পূতজন্মা জ্ঞানী গুরু রূমী
আমার নিকট জীবন-মরণের রহস্য প্রকাশ করেছেন ।”

তাঁর বিখ্যাত দার্শনিক কাব্য মসনভী সম্বন্ধে ইসলাম জগতের অভিমত এই যে-

” মৌলানা রূমীর গূঢ়ার্থপূর্ণ মসনভী
ফারসি ভাষায় কুরআন হইছে “

ইকবালের কাব্য সম্বন্ধেও অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করা অনুচিত হইবে না। তিনি তাঁর সমস্ত জ্ঞান বুদ্ধি দ্বারা কুরআন মজীদকে বুঝিতে চেষ্টা করেছেন। তার ফলে তিনি এক অপূর্ব ইসলাম-দর্শন রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন।

রূমী আত্মিক অনুভূতির জ্যোতিতে কুরআন বুঝেছিলেন। ইমাম গাযালী গ্রীক দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষুদ্র প্রদীপকে ছেড়ে এই আত্মিক অনুভূতিরই দিব্য আলোকে কুরআনকে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। ইকবাল কুরআনকে বুঝেছেন আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞানের বিদ্যুৎ-আলােকে। এই আলােক হয়ত সকল সময় রহস্যের গভীর গহ্বরে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। কেননা-

“গর ইন্তিদলাল কারে দীঁ বুদে,
ফখরে রাযী রাযদারে দীঁ বুদে।”

– যদি প্রমাণ প্রয়োগই ধর্মের কার্য হতো,
তবে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী ধৰ্ম্মের রহস্যবিদ হোতেন। “

তবুও আমরা বলতে বাধ্য যে, ইকবাল যে নব্য ইসলাম দর্শনের ভিত্তি পত্তন করেছেন, তা এক দিন না এক দিন এক জগন্মোহন তাজমহলে পরিণত হবে। আমরা এই প্রবন্ধের জন্য প্রধানতঃ তাঁর রচিত পুস্তক “The Reconstruction of Religious Thought in Islam”-এর উপর নির্ভর করেছি।”

জড়বাদী তাদের বুদ্ধিবৃত্তির ( Intellect-এর) উপর নির্ভর করে ধর্ম, খােদা, পরলােক, আত্মা প্রভৃতি তত্ত্ব (Reality)সমূহকে অস্বীকার করেছে। তাদের নিকট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভুতিই (Sense perception) জ্ঞান লাভের প্রধানতম উপায়। সংবাদ বা ইতিহাসের মূলেও এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি। আমরা কারো সংবাদে বিশ্বাস করি কিংবা ঐতিহাসিকের বৃত্তান্ত বিশ্বাস করি, যদি জানি যে, এই সংবাদ ও বৃত্তান্তের মূলে আছে প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি। যদি তা কল্পনা হয়, তবে আমরা তা বিশ্বাস করিব না । ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির পর যা জ্ঞান লাভের উপায়, তা ন্যায়শাস্ত্র (Logic) অনুমােদিত অনুমান (Inference), কিন্তু প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি এবং অনুমানই আমাদের তত্ত্বজ্ঞান লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় নয়। আত্মিক অনুভূতিই (Intuition) তত্ত্ব জ্ঞান লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। ইকবাল তাঁর কাব্যের ভাষায় ইহাকে ‘ইশক বা প্রেম বলেছেন।

–”বর্তমান যুগের পায়ের বেড়ী হচ্ছে বুদ্ধি । আমার যে অশান্ত চিত্ত তা কোথা থেকে ?
প্রেমের চক্ষু দিয়ে দেখ,
তা হলে তুমি তার সন্ধান পাবে।
বুদ্ধির দৃষ্টিতে বিশ্বজগৎ ভেলকি আর জাদু মাত্র।”
–(পয়াম-ই-মশরিক)

বস্তুতঃ ইকবাল প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিকে অস্বীকার করেন না। কিন্তু তিনি তার উপর প্রাধান্য দিয়েছেন মরমী অনুভূতিকে ( Mystic experience )। সূফীগণ ইহাকে বলে ‘‘কশফ’ (দিব্য দর্শন)। নবীগণের ওহী বা প্রত্যাদেশ (Revelation) ইহারই পূর্ণ পরিণতি। ইহার সম্বন্ধে কুরআনে (৫৩:১১) বলা হয়েছে— “সে (মুহম্মদ) যা দেখেছে হৃদয় তা মিথ্যা বলে নাই।”

তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিকে আত্মিক অনুভূতি দ্বারা পরিপূরণ (Supplement) করতে হবে। বাহ্য অনুভূতির ইন্দ্রিয় যেমন চক্ষু, কর্ণ, সেইরূপ অন্তরানুভূতির ইন্দ্রিয় হৃদয়, যাকে কুরআন মজীদে “কলব” বা “ফুআদ” বলা হয়েছে। আমরা আত্মিক অনুভূতিকে দিব্য দর্শন বলতে পারি এবং হৃদয়কে ষষ্ঠ বা অন্তরিন্দ্রিয় বলতে পারি। কুরআনে (৩২: ৯) বলা হয়েছে যে, “অনন্তর তিনি তাকে (মনুষ্যকে) সুগঠিত করলেন এবং তাদের মধ্যে তাদের (সৃষ্ট) আত্মা হতে কোনটি ফুৎকার করে দিলেন এবং তিনি তােমাদের জন্য কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় দিয়েছেন। অল্পই যা তােমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।”

সত্য বটে, অভিজ্ঞতা
দ্বারা দেখা যায় যে, কারো অন্তরানুভূতির মধ্যে অসার ও অসত্য মিশ্রিত থাকে। প্রকৃতপক্ষে এটি আত্মিক অনুভূতি নয়। এটি আত্মিক অনুভূতির নকল (counterfeit) মাত্র। যদি সত্য আত্মিক অনুভূতিকে ঐশ্বরিক বা রহমানী (divine ) বলা হয়, তবে এই নকল অন্তরনুভূতিকে বলতে হবে আসুরিক বা শয়তানী (satanic)। ফ্রয়ডের মনােবিশ্লেষণ (Psycho-analysis) প্রণালী দ্বারা আমরা কিছু পরিমাণে এই আসুরিক অনুভূতিকে চিনে ফেলিতে পারি। কিন্তু তাকে পূর্ণরূপে চিনতে হলে দুইটি নিকষ পরীক্ষার ( Test) প্রয়ােজন – একটি বুদ্ধিদ্বারা (intellectual ) আর একটি ফলাফল দ্বারা (Pragmatic )।

খােদা’তাআলার অস্তিত্ব আমরা কিরূপে প্রমাণিত করতে পারি ? পাণ্ডিত্যপূর্ণ দর্শন (Scholastic philosophy) খােদার অস্তিত্বের তিনটি প্রমাণ উপস্থিত করেঃ
১। সৃষ্টি সম্বন্ধে কার্যকারণ শৃঙ্খলামূলক যুক্তি (cosmological
argument),
২। উদ্দেশ্যবাদমূলক যুক্তি (Teleological argument),
৩। তত্ত্বমূলক যুক্তি (Ontological argument)

আল্লামা ইকবাল এই সকল যুক্তি সম্বন্ধে বলেনঃ
“These arguments embody a real movement of thought in its quest after the absolute, But regarded as logical proofs, I am afraid, they are open to serious criticism and further
betray a rather superficial interpretation of experience.”
-এই যুক্তিগুলোতে পরমতত্ত্বের গবেষণায় চিন্তাশক্তির প্রকৃত পরিচালনার পরিচয় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু আমার আশঙ্কা হয় যে,
তাদেরকে ন্যায়শাস্ত্রসম্মত প্রমাণরূপে গ্রহণ করতে গুরুতর আপত্তি আছে। অধিকন্তু তারা যে অনুভূতির একটা মামুলি ব্যাখ্যা মাত্র, তা অনায়াসে ধরা পড়ে যায়।

অন্তরমুভূতি (Inner exprience) ব্যতীত খোদার অস্তিত্ব জ্ঞানের আর দুইটি উপায় হচ্ছে ইতিহাস এবং প্রকৃতি। পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে ধর্মের জয় ও অধর্মের ক্ষয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অঙ্কিত রয়েছে। কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

“অনন্তর কত না জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি । তারা ছিল অত্যাচারী। অনন্তর সে সমস্ত ছাদ সমেত ভূমিসাৎ হয়েছে। কত না আছে পরিত্যক্ত কূপ আর কত না উচ্চ প্রাসাদ। তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে নাই, তা হলে তাদের এমন হৃদয় হতো যা দ্বারা তারা বুঝত এবং এমন কান হতো যা দ্বারা শুনত ? কারণ নিশ্চয় চক্ষু অন্ধ হয় না, কিন্তু অন্ধ হয় হৃদয়, যা বুকের মধ্যে আছে। তারা তাড়াতাড়ি শাস্তি আনতে তোমাকে তাগিদ করে। কিন্তু আল্লাহ কিছুতেই তাঁর ওয়াদার খেলাপ করবেন না। নিশ্চয় তােমার প্রতিপালক প্রভুর নিকট এক দিন, যা তােমরা গণনা কর তার হাজার বৎসরের ন্যায়। কত না জনপদকে আমি অবসর দিয়েছি, যদিও তারা অত্যাচারী ছিল। তৎপরে তাদেরকে আমি আক্রমণ করেছিলাম। আমার দিকেই তাদের প্রত্যাবর্তন।”
(সূরা হজ্জ, ৪৫-৪৮ আয়াত)

এই সমস্ত উত্থান ও পতনের মধ্যে এক ন্যায়বান শক্তিশালী সহিষ্ণু খােদার অস্তিত্বের জাজ্বল্যমান প্রমাণ রয়েছে।
প্রকৃতির নানা পরিবর্তনে এক জ্ঞানময় শক্তিময় বিশ্বনিয়ন্তার হস্তের পরিচয় আমরা পাই। কুরআন মজীদ বলেছেনঃ

“নিশ্চয় উর্ধ্বলোকসমূহ ও অধোলোকের সৃষ্টিতে, রাত্রি ও দিনের পরিবর্তনে, জলযানে যা মানুষের লাভজনক দ্রব্য নিয়ে সমুদ্র বয়ে যায়, আর পানিতে, যা আল্লাহ উর্ধ্ব থেকে বর্ষণ করেন, তৎপরে যা দ্বারা তিনি পৃথিবীকে মরণান্তে পুনর্জীবিত করেন ও তাতে সকল প্রকার প্রাণী বিস্তৃত করেন, আর বায়ু সকলের পরিবর্তনে, আর মেঘসমূহে, যা উধ্বলোকসমূহে এবং পৃথিবীর মধ্যে বর্ষসেবক-রূপে স্থিত — এই সকল যে জ্ঞানী বোঝে তাহাদের জন্য নিশ্চয়ই নিদর্শনসমূহ আছে।”
(সূরা বাকারা, ১৬৪ আয়াত)।

বাহ্য অনুভূতি ও অন্তরানুভূতি উভয় প্রকারে যে আমরা খোদার অস্তিত্বের জ্ঞানলাভ করি, তা কুরআনের বহু স্থানে উল্লিখিত হয়েছে ; যেমন বলা হয়েছেঃ

“নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে বিভিন্ন দিক্‌প্রান্তে (অর্থাৎ বাহ্য জগতে) এবং তাদের মধ্যে (অর্থাৎ অন্তর্জগতে) আমার নিদর্শনসমূহ দেখাব, এ পর্যন্ত যে তিনি যে সত্য তা তাদের জন্য স্পষ্ট প্রকাশিত হবে। এটা কি তােমার প্রতিপালক প্রভুর জন্য যথেষ্ট নয় যে, তিনি সব পদার্থের উপর সাক্ষী ?”
(সূরাঃ হা-মীম, ৫৩ আয়াত)

খােদা কেবল একটি সৃজনী শক্তি নন। তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সত্তা (Individual) বা পরমাত্মা (the ultimate ego )। কুরআনে (২৪: ৩৫ ) তাঁকে বলা হয়েছেঃ

‘আল্লাহ দ্যুলােকসমূহের ও ভূলােকের জ্যোতি।”

এতে মনে হতে পারে যে, খােদা ব্যক্তিত্ব (Individuality)রহিত সত্তা মাত্র। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গেও বলা হয়েছেঃ

“তাঁর জ্যোতির তুলনা যেমন একটি তাক, যাতে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপ আছে এক কাচের পাত্রে, কাচের পাত্রটি যেন একটি উজ্জ্বল তারা।” (সুরাঃ নূর, ৩৫ আয়াত)

এই আয়াত থেকে আমরা বুঝি তিনি ব্যক্তিত্ববিহীন বিশ্ব-আত্মা নন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক সত্তা। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে জ্যোতির গতির হ্রাস বৃদ্ধি নাই। আল্লাহ কে জ্যোতির সাথে তুলনা দ্বারা তাঁর পরম সত্তাই (absoluteness) সূচিত হয়েছে, অদ্বৈতবাদীর বিশ্বআত্মা নয়। কুরআনের নিম্ন উদ্ধৃত বচনে তাঁর ব্যক্তিত্ব সুস্পষ্ট হয়েছেঃ

‘তুমি কি বােঝ না যে, আল্লাহ জানেন যা কিছু লােকসমূহে এবং যা কিছু ভূলােকে আছে ? এমন কোনো তিন ব্যক্তির গােপন পরামর্শ হয় না, যে তিনি তাদের চতুর্থ হন না; কিংবা এমন পাঁচ জনের যে তিনি তাদের ষষ্ঠ নন, কিংবা তাদের চেয়ে কম বা বেশী, কিন্তু যেখানেই তারা থাকুক না কেন, তিনি তাদের সহিত থাকেন।”
(সূরাঃ মুজাদালাঃ ৭ আয়াত)

সূফী কবির ভাষায় বলতে গেলে —

‘আয় কে হেচ জা না দারী জা,
বু আল ‘আজব মান্দহ, আম কে হর জা তুই।”

– ওহে কোন স্থানেই তােমার স্থান নাই,
কিন্তু আশ্চর্য ! তুমি সর্বস্থানেই বিরাজমান।

সমস্ত জগতের সাথে তাঁর সম্বন্ধ, যেমন দেহের সাথে আত্মার সম্বন্ধ। আত্মা দেহের কোনো স্থানেই অবস্থিত নয়, কিন্তু গোটা দেহে তার ক্রিয়া বিদ্যমান। সূফীরা যখন তাঁকে জানে-‘আলম বলেন, এই অর্থেই বলেনঃ

‘জানে আলম গোয়েমশ গর রবতে জাঁ।
দানম্ ব-তন,
দর-দিলে হর যর্র: হম পিনহা ও হম পয়দাস্তী।”

–আমি তাকে বিশ্বের প্রাণ বলতাম, যদি দেহের সাথে প্রাণের সম্পর্ক জানতাম।
তুমি প্রত্যেক পরমাণুর হৃদয়ে গুপ্ত ও ব্যক্ত আছো।

কুরআনের ভাষায় –
“তিনি আদি ও অনন্ত ; তিনি ব্যক্ত ও গুপ্ত ; তিনি সকল বিষয়ে জ্ঞানী।”
(সূরাঃ হদীদ, ৩ আয়াত)

ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর ইকবাল গ্রন্থ থেকে “ইকবাল দর্শনে খােদা-তত্ত্ব” অধ্যায় টি গ্রহণ করেছি। ভাষা ও শব্দের কিছু পরিবর্তন ও সংযোজন হয়েছে । সত্তর-আশি বছর পূর্বের সংস্করণ বলে ভাষা ও শব্দের পরিবর্তন করা যথাযথ বলে মনে হয়েছে ।
“সম্পাদক”

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *