সুরা বাকারার শুরুতে আল্লাহ পাক বলেন— ‘এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েত।’ মুত্তাকি তাদেরকেই বলা হয় যারা তাকওয়া বা খোদাভীতির গুণ রাখেন। সাধারণ চোখে হেদায়েত তাদেরই প্রয়োজন যারা গোনাহগার। কিন্তু আল্লাহ বলছেন যারা তাকওয়া রাখেন তাদের জন্য কোরআন হেদায়েত, তাহলে নিশ্চয় এখানে তাকওয়া অর্থ শাব্দিক অর্থের তাকওয়া নয়, বরং সংজ্ঞায়িত তাকওয়া।

তাকওয়ার সংজ্ঞা দিতে আল্লাহর রসুল (স) কোরআনে কারিমের এই আয়াত তেলাওয়াত করেন—

اِنَّ اللّٰهَ یَاْمُرُ بِالْعَدْلِ وَ الْاِحْسَانِ وَ اِیْتَآئِ ذِی الْقُرْبٰى وَ یَنْهٰى عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِ وَ الْبَغْیِ١ۚ یَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ

আল্লাহ হুকুম দিচ্ছেন প্রত্যেক ক্ষেত্রে (১) ইনসাফ ও (২) ইহসানের সম্পর্ক কায়েম করতে, (৩) নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীদের সাথে সদাচরণ করতে, এবং নিষিদ্ধ করছেন (৪) অশ্লীলতা, (৫) সবধরনের অবৈধ কাজ, (৬) বাড়াবাড়ি। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যেন তোমার তা গ্রহণ করো।
— সুরা নাহল, আয়াত ৯০

মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি বলেন, ‘কোরআনে যেখানে যেখানে তাকওয়া শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এবং সেখানে যে যে অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার একত্রিত ফলাফল হলো তাকওয়ার তফসির। তাকওয়া বিষয়ে কোরআনে ইরশাদ আছে—

اِعْدِلُوْا١۫ هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰى١٘

তোমরা ইনসাফ কায়েম করো, ওটাই তাকওয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থান।
—সুরা মায়িদা, আয়াত ৮’

এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়— ‘তাকওয়া হলো এমন যোগ্যতা, যার ফলে মানুষ ইনসাফকারী ও ন্যায়ানুগ হয়। এই কারণে যিনি কোরআনে বিশ্বাস স্থাপন করেন তাকে প্রথমে ইনসাফের যোগ্যতা হাসিল করতে হবে, অন্যথায় তিনি হেদায়েত হাসিল করতে পারবেন না।’
اِنَّ اللّٰهَ یَاْمُرُ بِالْعَدْلِ وَ الْاِحْسَانِ

‘আল্লাহ হুকুম দিচ্ছেন প্রত্যেক ক্ষেত্রে ইনসাফ ও ইহসানের সম্পর্ক কায়েম করতে।’

(১) ইনসাফ কায়েমের অর্থ যে জিনিস আমি আমার জন্য গ্রহণ করেছি, অন্য লোকেরও তাতে সমান হক থাকাকে তসলিম করা। আল্লাহর রসুল (স) ফরমান, তোমার ভাইয়ের জন্য এমন জিনিসই পছন্দ করো, যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ করো।

(২) ইহসান অর্থ সবার সাথে ভালো আচরণ করা। ইহসানের দুইটা দিক। প্রথমত সবার সাথে ভদ্রতাপূর্ণ ও ইমানদারির সম্পর্ক রাখা, মানুষের হক পুরাপুরি আদায় করা। কিন্তু কেউ যদি নিজের হক ছেড়ে দেয়, সেটা হবে ইহসানের সর্বোচ্চ পর্যায়। যখন কারুর সঙ্গিন অবস্থা সামনে পড়ে, সেই পরিস্থিতিতে ইহসান না করাও না-ইনসাফি। আল্লাহ তাআলাই ইহসানের হুকুম দিয়েছেন। নেককার বান্দারা আল্লাহর হুকুম পালন করে আল্লাহর পথে চলার সৌভাগ্য হাসিল করে। মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি বলেন, এমন লোক যদি কখনো মুসিবতে পড়েন, তখন আল্লাহ তাআলা চারদিক থেকে তার সাহায্যকারী হয়ে সামনে আসেন। আল্লাহ এমনসব মাধ্যমে বান্দাকে সাহায্য করেন, যা কখনো ভাবনাতেও আসেনে, যেসবের সাথে তার কখনো কোনো সংযোগ ছিল না। বান্দার তখন আল্লাহর মেহেরবানির গুণ মনে পড়ে যায়।

وَ اِیْتَآئِ ذِی الْقُرْبٰى

(৩) ‘আল্লাহ হুকুম দিচ্ছেন… নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীদের সাথে সদাচরণ করতে।’

কোনো ধরনের রাখঢাক করা নয়, বরং আগে বেড়ে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সহায়তার হাত বাড়াতে আল্লাহ হুকুম করছেন। এই তিন কাজ— ইনসাফ, ইহসান ও নিকটাত্মীয়ের সাথে সদাচরণ করাকে আল্লাহ তাআলা ওয়াজিব করেছেন, এবং এসব কাজ হচ্ছে তাকওয়ার রুহ। কিন্তু তাকওয়ার পূর্ণতার জন্য আরও তিন কাজ বাকি :

وَ یَنْهٰى عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِ وَ الْبَغْیِ١ۚ

‘এবং নিষিদ্ধ করছেন অশ্লীলতা, সবধরনের অবৈধ কাজ, বাড়াবাড়ি।’

(৪) অশ্লীলতা মানে বেহায়াপনা। যে কাজ জনসম্মুখে মানুষ করে না তা-ই করা। অথবা এমন কাজ, যে কাজ করলে মনের ভেতর পাপবোধ ও গ্লানিবোধ জন্মায়। এমন কাজ বেঁচে থাকা তাকওয়া।

(৫) অবৈধ কাজ মানে ধর্মত ও আইনত যেসব কাজ নিষিদ্ধ। এমন কাজ পরহেজ করা তাকওয়া।

(৬) বাড়াবাড়ি মানে অ্যানার্কিজম। অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রে ইনসাফ কায়েমের জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তার বিরুদ্ধে এমন কোনো অবলম্বন করা যার ফলে ফেতনা-ফাসাদ ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। তবে যদি এমন হয়, খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রই জুলুম করছে, সেক্ষেত্রে ইনকিলাবের পদ্ধতি অবলম্বন করাও তাকওয়ার তাগাদা।

এটাই তাকওয়ার সংজ্ঞা— তিনটি আদেশ তামিল করা ও তিনটি নিষেধ মান্য করা। যারা এই ছয় কাজ করতে পারবে, তারাই কেবল মুত্তাকির স্তরে পৌঁছাতে পারবে, আর তখনই কেবল কোরআন তাদের জন্য হেদায়েত হবে। কোরআনে এমন লোকের অনেক গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে, এবং পরজগতে উত্তম বিনিময়ের সুসংবাদ আছে।

কোরআনের হেদায়েত এমন লোকই পায় যারা হেদায়েতের তালাশি। আল্লাহ তাআলা যেমন আল্লাহর রসুল (স) সম্পর্কে বলেন,

وَ وَجَدَكَ ضَآلًّا فَهَدٰى۪

‘এবং তোমাকে পেয়েছি আমার তালাশে বিভ্রান্ত, তারপর তোমাকে আমার পথ দেখিয়েছি।’
— সুরা দুহা, আয়াত ৭

এইজন্য দিলে হেদায়েত লাভের তড়প থাকতে হবে। আল্লাহ মানুষের দিল দেখেন। যদি কেউ আল্লাহর পথে চলতে চান, তাকওয়া অবলম্বন করেন, আল্লাহ অবশ্যই তার পথের রাহবার হবেন।

وَ الَّذِیْنَ جَاهَدُوْا فِیْنَا لَنَهْدِیَنَّهُمْ سُبُلَنَا١ؕ

আর যারা আমার পথে চেষ্টাসাধনা করে, অবশ্যই অবশ্যই তাদেরকে আমি পথ দেখাই।
— সুরা আনকাবুত, আয়াত ৬৯

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *